সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবিতে চাকরিপ্রত্যাশীরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। গত আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর আন্দোলনটি আরও জোরদার হয়। এরপর তারা বিভিন্ন কর্মসূচিসহ শাহবাগ অবরোধও করে। চলমান ইস্যুতে গত ২৪ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সরকারি চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩২ এবং তিনবারের বেশি বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ ঘটনায় ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন এই ইস্যুতে আন্দোলন করে আসা শিক্ষার্থীরা। পাশাপাশি রাজপথে চলছে আন্দোলন-অবরোধও। গত ৩০ অক্টোবর সচিবালয় অভিমুখে মিছিল নিয়ে এগোতে থাকলে আন্দোলনকারীদের ওপর জলকামান থেকে পানি ছোড়ে পুলিশ। এরপর গত ৩১ অক্টোবর এক বিজ্ঞপ্তিতে চারবার বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার নতুন সিদ্ধান্তের কথা জানায় অন্তর্বর্তী সরকার। তবে চারবার বিসিএস নিয়েও ধোঁয়াশা কাটেনি। যারা ইতোমধ্যে চারবার বিসিএস দিয়ে ফেলেছেন, তাদের ব্যাপারে বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্ট করা হয়নি। এমন সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট নন ৩৫ প্রত্যাশী শিক্ষার্থীরা। তবে অনেক শিক্ষার্থী সরকারের এমন সিদ্ধান্তকে সাধুবাদও জানাচ্ছেন। তারা বলছেন, সরকারের এমন সিদ্ধান্ত যৌক্তিক ও সময়োপযোগী। আজকের প্রতিবেদনে এ ইস্যুতে শিক্ষার্থীদের মতামত তুলে ধরছেন খালিদ ফারহান
এনামুল হক
সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সেশন: ২০১৭-১৮
বাংলাদেশের বিসিএস এর প্রেক্ষাপট বর্ণনায় টুয়েলভথ ফেইল সিনেমার মনোজ (কেন্দ্রীয় চরিত্র) আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আর্থসামাজিক দিক ও বিসিএস সম্পর্কে বাংলাদেশের তরুণদের একটা দিক মনোজ প্রতিনিধিত্ব করে। উন্নয়নশীল দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশের ৭০ ভাগ জনগোষ্ঠী কৃষির উপর নির্ভরশীল। সেই কৃষি পরিবার বা নিম্নবিত্ত অন্যান্য পেশার সাথে জড়িত থাকা পরিবার থেকে যখন কেউ উচ্চশিক্ষা লাভ করে তখন স্বাভাবিকভাবেই সে চেষ্টা করে তার পরিবারের উন্নতির জন্য অথবা নিজেকে শিক্ষিত হিসেবে সম্মানজনক পেশায় দেখার জন্য।
ফলশ্রুতিতে, লেখাপড়া শেষ করেই খুব দ্রুতই একটি চাকরি পাওয়া আমাদের সমাজের প্রেক্ষাপটে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। যার জন্য দেখা যায়, পাবলিক বা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একাডেমিক পড়াশুনার পাশাপাশিই চাকরির প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে। সেই শুরু থেকে যদি চক্রাকারে ঘুরতে-ঘুরতে ২৪ থেকে ৩৫ বছর পর্যন্ত চলে যায়, অথবা এই ১১ বছরে ৭-৮টি বিসিএস দিয়ে ব্যর্থ হয়ে হতাশায় পর্যবসিত হয়, তখন তা রাষ্ট্র বা সমাজের জন্য একজন শিক্ষার্থীকে দারুণভাবে অপচয় করা ছাড়া আর কিছুই নয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সরকারি চাকুরিতে বয়সসীমা ৩৫ বছর একটি অযৌক্তিক ভাবনা বলে আমি মনে করি। ৩৫ বছরে পাশ করে একজন ব্যক্তির চাকরিতে জয়েন করতে বয়স হবে ৩৭ বছর-যা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে খুবই বেশি। কেননা যেখানে ২৫ লাখের উপর বেকার তরুণ চাকরি পাচ্ছেনা অথবা বছরের পর বছর সরকারি চাকরির পিছনে পড়ে থাকছে, তখন এর প্রভাব পুরো সমাজেই পড়ছে। ৩০ বছর বয়সেই চাকরি না পেয়ে প্রচন্ড হতাশায় আত্মহত্যার খবরও আমরা দেখেছি, তাই ৩৫ বছর পর্যন্ত সরকারি চাকরির জন্য পড়ে থাকা মেধার অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। যার জন্য করোনা বা অন্যান্য অসুবিধা সাপেক্ষে ৩২ বছর-ই সরকারি চাকরিতে প্রবেশের জন্য যথাযথ মনে করি। আর এই সময়ের মধ্যে একজন ব্যক্তি ৩-৫ বার বিসিএস পরীক্ষায় বসতে পারাটাই যৌক্তিক মনে করি। দিনের পর দিন অসংখ্যবার বিসিএস পরীক্ষার জন্য বসে থেকে হতাশ হওয়ার চেয়ে একটা টাইম ফ্রেম বেঁধে দেয়াটাই যৌক্তিক মনে করি।
এরপরও কতবার বিসিএস দেয়া যাবে এই বিষয়টি আরো বিস্তারিত আলোচনা বা পর্যালোচনার দাবি রাখে। কিন্তু বয়সের ব্যাপারটি ৩৫ আমি অযৌক্তিক ই বলবো।
এন এম রাসেল
সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
সেশন: ২০১৭-১৮
সরকারি চাকরির মধ্যে ছাত্রছাত্রীদের প্রথম পছন্দের তালিকার শীর্ষে থাকে বিসিএস ক্যাডার। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের চারবার বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত আমার মতো সদ্য স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করা প্রার্থীদের অনেকে হতাশ করেছে।
একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি মূলত অনেকেই বিসিএসের প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন, যার দরুন এত ভালো প্রস্তুতি নেওয়াটা অনেকের পক্ষেই প্রায় সম্ভব হয়ে ওঠে না। তার জন্য অনেকেই প্রথমবার বিসিএস দিলে এতটা প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দিতে পারে না। অনেক বড় ভাই-আপুর থেকে জানতে পাই যে, তাদের কেউ কেউ ৫/৬/৭ বার পরীক্ষা দিয়ে ক্যাডার হতে পেরেছিলেন। এ দেশের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী অর্থনৈতিক সংকটের জন্য নিজের পড়াশোনার খরচ নিজেই বহন করেন। সেক্ষেত্রে বিসিএস পরীক্ষাকে সীমাবদ্ধতায় রাখা ঠিক হবে কি?- আপনাদের কাছে প্রশ্ন রাখলাম। স্বপ্নে যদি সীমাবদ্ধতা থাকে তাহলে স্বপ্ন শিকড়েই নষ্ট হয়ে যাবে। আমাদের মতো যারা টিউশন অথবা ক্লাস শেষে আলাদা কাজ করে অর্থ জোগান দিয়ে পড়াশোনা চালান, তাদের জন্য এই সিদ্ধান্ত হতাশা সৃষ্টি করবে। আশা রাখি, বর্তমান সরকার আরও সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্তে উপনীত হবে।
শাহরিন জান্নাত নীরা
তৃতীয় বর্ষ, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ কতবার বিসিএস দিতে পারবেন- এমন সময় বেঁধে দেওয়ার দিকে মনোযোগ না দিয়ে বরং এক একটা বিসিএসের সম্পূর্ণ নিয়োগ প্রক্রিয়াকাল (প্রিলি-রিটেন-ভাইভা, ভেরিফিকেশন ও গ্যাজেট প্রকাশের সময়কাল) কী করে সর্বোচ্চ এক বছরের মধ্য সম্পন্ন করা যায়, তার দিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর দেওয়াটা জরুরি বলে আমি মনে করি।
তাছাড়া প্রথমে পিএসসির পূর্ণ সদস্য গঠন করে আগের ঝুলে থাকা নিয়োগগুলো সম্পন্ন করা উচিত, যাতে পরবর্তী বিসিএসগুলোয় এই সুদীর্ঘ কালক্ষেপণ কমিয়ে আনা যায়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিসিএস ক্যাডার হওয়া বেশির ভাগেরই স্বপ্নের পেশা। সেক্ষেত্রে শুরুতেই এভাবে এত কম সময় (চারবার) বেঁধে দেওয়ার কারণে যারা পূর্বেই কয়েকবার পরীক্ষা দিয়ে ফেলেছেন- এমন প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় যারা একদমই নতুন, তারা টিকে থাকতে না পেরে বৈষম্যের শিকার হবে বলে আমি মনে করি। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ছয়বার আইসিএস দেওয়ার নিয়ম চালু রয়েছে।
যেহেতু চাকরির বয়স ৩২ করা হবে, বাংলাদেশে একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ কতবার দিতে পারবেন তা একান্তই বেঁধে দিতে হলে ন্যূনতম পাঁচ থেকে সাতবার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে বলে আমি মনে করি।
মো. আমান উল্লাহ খান
পপুলেশন সায়েন্স অ্যান্ড হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
সেশন: ২০১৬-১৭
বাংলাদেশের বৃহৎ যুবসমাজকে কাজে লাগাতে পারলে দেশের উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হবে। তবে দেশে সরকারি এবং বেসরকারি চাকরির বাজার বৃদ্ধি করে বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিই নতুন বাংলাদেশের প্রধান চ্যালেঞ্জ।
সরকারি চাকরিতে বয়সের প্রবেশসীমা বৃদ্ধিতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। কারও মতে, এতে যুবসমাজ উপকৃত হবে। আবার কেউ দাবি করছেন বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে বেকারত্ব হারের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।
বয়স নির্ধারণে পৃথিবীব্যাপী যে প্যারামিটারকে প্রাধান্য দেওয়া হয় তা হলো, সে দেশের নাগরিকদের গড় আয়ু এবং তাদের শারীরিক সম্ভাবনার গড় অবস্থা। সেই হিসাবে বাংলাদেশে সরকারি চাকরির বয়স বৃদ্ধি করে ৩২ বা ৩৫ করা অযৌক্তিক নয়। তবে চারবার বিসিএস পরীক্ষাদানের সীমাবদ্ধতা নাগরিক অধিকারের ওপর চরম হস্তক্ষেপ। ফলে রাষ্ট্রকে বয়স থাকাকালীন সরকারি চাকরিতে নাগরিকদের সুযোগ প্রদানের সীমাবদ্ধতা নির্ধারণের মধ্য দিয়ে নাগরিক জীবনের ওপর হস্তক্ষেপের সুযোগ দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
যুবসমাজের কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে রাষ্ট্র তার সক্ষমতার প্রমাণ দিক, নাগরিকের ওপর অপ্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ করে নয়।
জান্নাতুন নাঈম
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
১৭ ব্যাচ (দ্বিতীয় বর্ষ)
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদের নতুন সিদ্ধান্তে ৩৫ প্রত্যাশী আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সন্তুষ্ট নয়। তাদের দাবি, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ (পুরুষ) এবং ৩৭ (নারী) করার পাশাপাশি অন্তত আটবার বিসিএসে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হোক। তবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের এ দাবি সরকার মেনে নিলে সেটি দীর্ঘ মেয়াদে সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
প্রথমত, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ালে অবসরের বয়সসীমাও বাড়াতে হবে। এর ফলে দীর্ঘ মেয়াদে বেকারত্ব কমার পরিবর্তে বাড়বে। স্বাভাবিকভাবে একজন ৩২ বয়স্ক এবং ষাটোর্ধ্ব চাকরিজীবীর কর্মক্ষমতা ও সৃজনশীলতা অসমান হবে।
দ্বিতীয়ত, একাধিকবার বিবিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ থাকলে চাকরিপ্রার্থীদের নতুন কোনো সুযোগ না খুঁজে সরকারি চাকরি না হওয়া পর্যন্ত বিসিএস এবং সরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার প্রবণতা থেকে যাবে। ফলে চাকরিপ্রার্থীদের একটা দীর্ঘসময় বেকার থাকার সম্ভাবনাও রয়েছে।
সেক্ষেত্রে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২ এবং বিসিএস পরীক্ষায় সর্বোচ্চ চারবার অংশগ্রহণ নির্ধারণ করে দেওয়া যৌক্তিক সিদ্ধান্ত মনে হয়েছে।
হাসান