বিচিত্র সংস্কৃতি আর উন্নত অর্থনীতির দেশ স্পেন অনেক বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর কাছে স্বপ্নের দেশ। আর হবেই না বা কেন, যেখানে খোদ আমেরিকা থেকে শিক্ষার্থীরা যেখানে যায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে আশা করি আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই। বিভিন্ন দেশের স্বপ্নবাজ শিক্ষার্থীদের মতো আপনারও যদি স্বপ্ন থাকে স্প্যানিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার, স্পেনে ঠাঁই পাওয়ার, তবে আজকের এই লেখা আপনার জন্য।
কেন স্পেনে পড়তে যাবেন?
ইউরোপের দেশ স্পেনের রয়েছে এক সমৃদ্ধ ইতিহাস। পশ্চিম ইউরোপের শেনজেনভুক্ত দেশ স্পেনের ভাষা স্প্যানিশ, মুদ্রা ইউরো আর রাজধানী মাদ্রিদ। সারা বিশ্বে পৃথিবীর অন্যতম উন্নত অর্থনীতির দেশ স্পেন। তাই এ দেশ আপনাকে এনে দিতে পারে সাফল্য।
কোর্স খোঁজা ও বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন
প্রতি বছর সারা বিশ্বের হাজার হাজার শিক্ষার্থী স্পেনের মোট ৭৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে আসেন। স্পেনের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ব র্যাংকিংয়ে অনেক এগিয়ে। দেশটিতে শুধু স্প্যানিশ ভাষায় পড়ানো হয় এমন না, ইংরেজি ভাষায়ও পাঠ দান করা হয়ে থাকে। ব্যাচেলর, মাস্টার্স ও পিএইচডি সব প্রোগ্রামই ইংরেজি ভাষায় করার সুযোগ আছে। কিন্তু যদি আপনার স্প্যানিশ ভাষা জানা থাকে তাহলে আপনার জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার উন্মোচন আরও সহজ হবে।
স্পেনে পড়তে যাওয়ার জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা
স্পেনে ব্যাচেলর পড়তে যাওয়ার জন্য এইচএসসি পাস, মাস্টার্স প্রোগ্রামের জন্য ব্যাচেলর ডিগ্রি এবং পিএইচডি করার জন্য থাকতে হবে মাস্টার্স ডিগ্রি। এরপর আপনার দরকার হবে ভাষাগত দক্ষতার। আপনি ইংরেজি ভাষায় কোর্স করতে চাইলে আপনাকে IELTS-এ ন্যূনতম ৫.৫/৬.০ স্কোর পেতে হবে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে এই স্কোর পরিবর্তিত হয়। আর আপনি যদি স্প্যানিশ ভাষায় কোর্স নিতে চান তাহলে আপনাকে স্প্যানিশে আপনার B1/B2 বা DELE (Diploma of Spanish as a Foreign Language) Intermediate বা DELE B1/B2 থাকতে হবে।
উল্লেখ্য যে, স্প্যানিশ ভাষায় সরাসরি ব্যাচেলর প্রোগ্রামে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীকে স্প্যানিশ ভাষায় ভর্তি পরীক্ষায় পাস করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের সময়সীমা ও প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস
স্পেনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রছাত্রীরা তিন ধাপে বিভিন্ন কোর্সে ভর্তির আবেদন করতে পারে।
প্রথম ধাপে স্নাতক কোর্সে ভর্তি নেওয়া হয়, যা সাধারণত বছরের শুরুর (ফেব্রুয়ারি-জুন) দিকে ভর্তির আবেদন গ্রহণ করা হয়।
দ্বিতীয় ধাপে স্নাতকোত্তর কোর্সে ভর্তি নেওয়া হয়, যা সাধারণত বছরের মাঝখানের (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর) দিকে ভর্তির আবেদন গ্রহণ করা হয়।
তৃতীয় ধাপে গবেষণামূলক/PhD কোর্সে ভর্তি নেওয়া হয়, যা সাধারণত এপ্রিল-অক্টোবর পর্যন্ত ভর্তির আবেদন গ্রহণ করা হয়।
স্পেনে দুই ধরনের মাস্টার্স কোর্স আছে: একটি অফিসিয়াল মাস্টার্স, যা স্পেনের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অনুমোদিত আর দ্বিতীয়টি হলো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক অনুমোদিত ও অফার করা মাস্টার্স প্রোগ্রাম, যা তুলনামূলক ব্যয়বহুল। মাস্টার্স প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করতে আপনার ব্যাচেলরের মার্ক্স স্পেনের সমতুল্য স্কেলে রূপান্তর করিয়ে নিতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের জন্য যেসব প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস দরকার পড়বে তার তালিকা নিচে দেওয়া হলো-
১। সব একাডেমিক সার্টিফিকেট এবং মার্কশিট (স্পেনের স্কেলে রূপান্তর করা)
২। মোটিভিশন লেটার ও রিকমেন্ডেশন লেটার
৩। সিভি
৪। পাসপোর্টের কপি ও ১ কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি
৫। আবেদন ফি পরিশোধের প্রমাণ
আপনার ডকুমেন্টস সবকিছু ঠিক থাকলে, দু-এক মাসের মধ্যে আপনাকে মেইল করে জানিয়ে দেওয়া হবে। অ্যাকসেপ্টেন্স লেটার আপনার ঠিকানায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এরপর আবেদন কনফার্ম করার জন্য টিউশন ফির পুরোটা বা আংশিক অংশ বিশ্ববিদ্যালয়রে প্রদত্ত ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিতে হবে। টিউশনের ফির কতটুকু অংশ জমা দিতে হবে, সেটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ভিন্ন হতে পারে। এই টিউশন ফি (আংশিক/ পূর্ণ) জমা দেওয়ার পরে, বিশ্ববিদ্যালয় আপনাকে অ্যাকপ্টেন্স লেটারের হার্ডকপি ও ভিসার জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য কাগজপত্র পাঠাবে।
পড়াশোনার খরচ ও বৃত্তি
স্পেনের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাইলে আপনার বার্ষিক ফি দিতে হবে ৬,০০-১,২৮০ ইউরো। আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় হলে বার্ষিক ফির পরিমাণ হবে ৫,৫০০-১৮,০০০ ইউরো পর্যন্ত।
বিশ্ববিদ্যালয় ও কোর্স ভেদে এই টিউশন ফির তারতম্য হয়ে থাকে। ইউরোপের বাইরের দেশগুলোর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রতি ক্রেডিট ৫৫-৮০ ইউরো হয়ে থাকে আর মাস্টার্স বা পিএইচডি প্রোগ্রামে প্রতি ক্রেডিটের ফি হয়ে থাকে ২২-৩৬ ইউরো।
স্পেনের পাবলিক ও প্রাইভেট সব বিশ্ববিদ্যালয়েই আছে বৃত্তির সুবিধা। মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট ঘেটে বৃত্তির খবরা-খবর জেনে নেওয়া ভালো।
স্পেনের আবাসন ব্যবস্থা
স্পেনে আপনি কোথায় আছেন সেটার ওপর নির্ভর করবে আপনাকে আবাসন বাবদ কত খরচ করতে হবে। মাদ্রিদ বা বার্সেলোনার মতো শহরে থাকতে আপনাকে ৩৫০-৯০০ ইউরো দিতে হতে পারে শেয়ারড ফ্ল্যাটের জন্য। কিন্তু আপনি যদি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দূরে সালামাঙ্কা, স্যান্টিয়াগো ডি কম্পোসটেলা ও গ্রানাডা শহরে থাকেন আপনি ৩০০ ইউরোতে আপনার ফ্ল্যাট পেয়ে যাবেন। শুধু তাই নয়, অন্যান্য খরচও এখানে কম। আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলেও আবেদন করতে পারেন। দ্রুত আবেদন করলে আপনার হোস্টেলে থাকার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। আপনি যেখানেই থাকেন না কেন, ভিসার জন্য আপনাকে সংগ্রহ করতে হবে হাউজিং কন্ট্রাক্ট ডকুমেন্টস।
ভিসা আবেদন প্রক্রিয়া ও প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস
স্পেনের ভিসা পেতে আপনার সময় লাগবে তিন মাসের বেশি, তাই আগে থেকেই আপনাকে আবেদনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ভিসা পাওয়ার প্রথম ধাপে আপনাকে ঢাকা স্পেনের দূতাবাস থেকে ভিসা প্রাপ্তির জন্য আবেদন করতে হবে। এজন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে নিচের ওয়েবসাইটে ভিজিট করে-
http://www.exteriores.gob.es/embajadas/dhaka/es/Paginas/inicio.aspx
আপনি সব কাগজ নিয়ে সময়মতো এম্বেসিতে উপস্থিত হয়ে ডকুমেন্টস দাখিল করবেন। যদি সব ডকুমেন্টস ঠিক থাকে, তাহলে ভিসা ফি ব্যাংকে জমা দিয়ে রসিদসহ সব ডকুমেন্টস জমা দিতে হবে।
প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের লিস্ট নিচে দেওয়া হলো-
১। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঠানো অফার লেটার
২। সব সত্যায়িত ডকুমেন্টস, মার্কশিট ও সনদ
৩। পাসপোর্ট ও ফটোগ্রাফ
৪। সিভি, মোটিভেশন লেটার ও রিকমেন্ডেশন বা রেফারেন্স লেটার
৫। ব্যাংক স্টেটমেন্ট ও আর্থিক সচ্ছলতার ডকুমেন্টস
৬। IELTS / DELE B1-B2-এর সনদ
৭। হাউজিং সার্টিফিকেট/ ডকুমেন্টস
১১। ফ্লাইট বুকিং টিকিট
১২। স্কলারশিপের পেপার (যদি থাকে)
খণ্ডকালীন কাজের সুযোগ
স্পেনে একজন বিদেশি শিক্ষার্থী সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা কাজ করার সুযোগ পান। তবে একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, খণ্ডকালীন কাজের টাকায় নিজের খরচ চালানো সম্ভব হলেও টিউশন ফি দেওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়বে।
স্পেনে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ
স্পেনে উচ্চশিক্ষারত বিদেশি শিক্ষার্থীরা তাদের উচ্চশিক্ষা সমাপ্তির পর স্পেনে একটি চাকরি খোঁজার জন্য অথবা নিজস্ব ব্যবসায়িক প্রকল্প তৈরি/ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে সর্বোচ্চ ১২ মাস স্পেনে থাকার অনুমতি পান। এখানে পাঁচ বছর থাকার পর অস্থায়ী বসবাসের অনুমতির জন্য আবেদন করার সুযোগ থাকে। তবে এজন্য কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে যেমন- সফলভাবে স্পেনে কোর্স শেষ করতে হবে, স্বাস্থ্যবিমা থাকতে হবে এবং চাকরি পাওয়ার আগ পর্যন্ত চলার মতো আর্থিক সামর্থ্যের প্রমাণপত্র থাকা লাগবে। আর টানা ১০ বছর থাকার পর, আপনি স্থায়ী বসবাসের জন্য আবেদন করতে পারবেন। সূত্র: studyspice.com
লেখক: শিক্ষার্থী, স্পেন
/রিয়াজ