
গত বছরের ৫ আগস্টের আগে নিয়োগ করা শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং শিক্ষার্থী সবাইকে ফ্যাসিস্ট বলা এবং শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করা নিয়ে বরিশালে প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে গত রবিবার বিকেলে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে উপাচার্য অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিন বলেন, ৫ আগস্টের আগে নিয়োগ করা সব শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা ফ্যাসিস্টের রিক্রুটমেন্ট। তার দেওয়া ওই বক্তব্যের একটি ভিডিও ক্লিপ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ওই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া হিসেবে রাতেই বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ জন শিক্ষক প্রতিবাদ জানিয়েছেন। পাশাপাশি সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) সংবাদ সম্মেলন করে ভিসির বক্তব্য প্রত্যাহার এবং শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে বলেছেন। অন্যথায় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে নামার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
এদিকে ভিসির বক্তব্যের প্রতিবাদ ও শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। গত রবিবার রাতে ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীরা মশাল মিছিল করেছেন। গতকাল সকালে প্রশাসনিক ভবনের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। অন্যদিকে ভিসির বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে নগরীতে বিএনপির পক্ষ থেকে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। ফলে এসব কর্মসূচিতে ভিসিবিরোধী আন্দোলন জোরালো হয়ে উঠছে।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তর থেকে ভিসির দেওয়া বক্তব্যের একটি ব্যাখ্যা গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে পাঠানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, উপাচার্যের বক্তব্যের কারণে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে যে ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে, তা কোনোভাবে কাম্য নয়। একই সঙ্গে উপাচার্যের শব্দচয়নের কারণে কেউ ব্যথিত হয়ে থাকলে তাদের কাছে তিনি আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে উপাচার্য শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।
ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে উপাচার্য বলেন, ‘আমি এখানে এসেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণের জন্য। জুলাই আন্দোলনের পর আমরা যারা বিভিন্ন জায়গাতে এসেছি, তাদের বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সমস্যায় ফেলা হচ্ছে। এই কাজগুলো অত্যন্ত অনুচিত হচ্ছে, শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘এই বিশ্ববিদ্যালয় ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত। শুরু থেকে যারা নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ভর্তি শিক্ষার্থী, তারা সবাই ফ্যাসিস্ট আমলের। কেউ যদি বলে আমি ফ্যাসিস্টের কেউ নই, সেটা দাবি করতে পারবেন না। সেই আমলে সবাই রিক্রুটেড। আমরা জানি কীভাবে রিক্রুটমেন্ট হয়েছে। এখন প্রশ্ন, শিক্ষার্থীদের কেন উসকে দেওয়া হচ্ছে?’
শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মালার বিষয়ে ওই ভিডিওতে ভিসি ড. শুচিতা শরমিন বলেন, যে ঘটনা জুলাই আন্দোলনেও হয়নি, এবার তার চেয়ে বড় ঘটনা ঘটে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভাইস চ্যান্সেলরের বাংলোর শুধু গেট ভাঙা হয়েছে এমন নয়, কেচি গেটের ভেতরেও ভাঙার চেষ্টা হয়েছে। আমাদের সব শিক্ষার্থীর মধ্যে দুই-তিনজন যদি বিচ্যুত হয়ে যান, তাদের দিকেও আমাদের তাকাতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ নষ্ট থেকে শুরু করে সম্মান নষ্ট করা, ইমেজ নষ্ট করলে মামলা হতেই পারে।’
তিনি বলেন, ‘মামলা প্রত্যাহার করতে হলে শিক্ষার্থীদের আমার কাছে আসতে হবে, কথা বলতে হবে। তারা যে ভুল করেছে সেই অনুশোচনা হলে নিশ্চয়ই আমরা বিবেচনা করব। আমরা শিক্ষার্থীদের ক্ষতি করার জন্য বসিনি। আমরা শিক্ষার্থীদের মানবিকতা, উন্নয়ন কল্যাণ দেখতে চাই, ধ্বংস দেখতে চাই না।’
গতকাল দুপুরে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাউন্ড ফ্লোরে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষকরা বলেন, আমরা প্রমাণ সহকারে জানি উপাচার্য ড. শুচিতা শরমিন নিজে ছিলেন ফ্যাসিস্ট শক্তির একজন চিহ্নিত দোসর। ২০২৪ সালের আমি-ডামির নির্বাচনের পক্ষে দাঁড়িয়ে বিশিষ্ট নাগরিক, শিক্ষক ও পেশাজীবীরা যে বিবৃতি দিয়েছিলেন তাদের সেই বিবৃতিপত্রে ১০৮ নম্বর স্বাক্ষরকারী ছিলেন উপাচার্য ড. শুচিতা শরমিন। এমন চিহ্নিত ফ্যাসিস্ট বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সবাইকে ফ্যাসিস্ট বলেছেন, এর চেয়ে লজ্জার ও ঘৃণার কিছু হতে পারে না। আমরা তার এই বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানাই এবং আমরা দাবি জানাচ্ছি এই বক্তব্যের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষার্থীর কাছে তাকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন শিক্ষক সঞ্জয় কুমার সরকার। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘ভিসি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এযাবৎকালের সব নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, যা অত্যন্ত দুঃখজনক ও অনভিপ্রেত। এই কথা দ্বারা তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে অন্যায়ভাবে আহত করেছেন। আমরা তার এই বক্তব্যেরও তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।’
এদিকে ভিসির অপসারণের দাবিতে বিএনপির পক্ষ থেকে গতকাল নগরীর অশ্বিনী কুমার হলের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। কর্মসূচিতে বিএনপি, ছাত্রদলসহ সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মী অংশ নেন। এতে একাত্মতা প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন মহাননগর বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আফরোজা খানম নাসরিন। তিনি বলেন, ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনের পক্ষে স্বাক্ষরকারী ড. শুচিতা শরমিনের চেয়ে বড় চিহ্নিত ফ্যাসিস্ট অন্য কেই নেই। কিন্তু নিজেকে রক্ষা করতে আওয়ামী লীগ ও পতিত শেখ হাসিনার দোসর জুলাই-আগস্টে যারা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তাদের ফ্যাসিস্ট বলছেন, যা বড়ই হাস্যকর।
তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদের দোসর উপাচার্য অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিনকে অপসারণ করে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়কে ফ্যাসিস্ট মুক্ত করতে হবে। না হলে বৃহত্তর আন্দোলনে নামতে বাধ্য হবেন ছাত্রদলের ভাইবোনেরা।