
দেশব্যাপী ধর্ষণ-যৌন হয়রানির ঘটনায় প্রতিবাদ ও ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের দাবিতে ক্ষোভে পুড়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষার্থী-শিক্ষক সকলেই প্রতিবাদে নেমেছেন। এছাড়া ধর্ষণ নিপীড়ন, নারী বিদ্বেষী মব এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিরূদ্ধে রুখতে দুই দফা দাবিতে ঢাবির নারী শিক্ষার্থীদের গঠিত হয়েছে ধর্ষণবিরোধী মঞ্চ।
শনিবার (৮ মার্চ) রাত পৌনে ১টার পরপর বিক্ষোভ-মিছিলে উত্তাল হয়ে পড়ে ঢাবি। শুরুতেই ঢাবির কবি সুফিয়া কামাল হল থেকে ছাত্রীরা মিছিল নিয়ে জড়ো হন রোকেয়া হলের সামনে। সেখানে দলে দলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য হল থেকে শিক্ষার্থীরা জড়ো হতে থাকেন। পরে অন্য হলের শিক্ষার্থীরাও যোগ দেন। মুহুর্তের মধ্যে ধর্ষণের প্রতিবাদ ও বিচার দাবিতে মুহুর্মুহু স্লোগানে উত্তাল হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য। এসময় শিক্ষার্থীরা বিচ্ছিন্নভাবে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক জুড়ে বিক্ষোভ মিছিল করেন।
এভাবে রাত ২টার পরপরই একে একে রাজু ভাস্কর্য ছাড়তে শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। এদিকে সকালের আলো ফুটতে ফুটতেই শুরু হয় ঢাবি শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিভাগের ক্লাস বর্জনের হিড়িক। অন্তত ৩০ এর অধিক বিভাগের ক্লাস বর্জন করেছেন শিক্ষার্থীরা। যদিও এ সংখ্যা আরও বাড়বে বলে দাবি অনেক শিক্ষার্থীর। ফের শুরু হয় বিক্ষোভ-মিছিল আর নানা মুহুর্মুহু স্লোগান। অনেকে শিক্ষার্থীরা তাদের বিভাগ ও বিভিন্ন ব্যানারে দাবি তুলেছেন এবং অনেকে ঢাবি উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপিও প্রদান করেছেন।
বিক্ষোভ মিছিল চলাকালীন খবরের কাগজের সঙ্গে কথা বলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নাসরিন। তিনি বলেন, ‘আমরা নারীদের নিরাপত্তা অনিশ্চয়তা বোধ করছি। একই সঙ্গে যারা ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত সেসব ধর্ষকদের যেন সর্বোচ্চ বিচার নিশ্চিত করা হয়। এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়। সর্বোপরি, অবিলম্বে নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়, যেন অনায়াসে নিরাপত্তার সঙ্গে রাস্তাঘাটে চলতে পারে।’
বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে ধর্ষকদের বিচারের দাবি জানিয়ে বাংলা বিভাগের বিক্ষোভে অংশ নেওয়া বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী মোসাদ্দেক আলী বলেন, ‘বিভিন্ন দীর্ঘসূত্রিতার মাধ্যমে ধর্ষকদের যথাযথ বিচার হতে আমরা খুব একটা দেখি না। যে কারণে ধর্ষকরা বারংবার এই ধরনের ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড করার দুঃসাহস দেখিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্ষকদের পার পাইয়ে দেওয়ার মতো বিভিন্ন ঘটনা আমরা অতীতে দেখেছি। আমরা চাই অনতিবিলম্বে বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে ধর্ষকদের বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।’
এদিকে লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলেন একই বিভাগের প্রভাষক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর শেহরিন আমিন ভূঁইয়া। তিনি বলেন, ‘আমরা শুধু আইনের কথা বলি, রুলসের দোহাই দিই। কিন্তু এই রেপিস্টদের শাস্তি দিতে ১০ দিনের বেশি সময় লাগার কথা না। ট্রাইব্যুনাল গঠন করে অতি দ্রুত প্রকাশ্য শাস্তি কার্যকর করতে পারলে ধর্ষণের পরিমাণ কমে আসবে।’
দুপুরে রাজু ভাস্কর্যে বিক্ষোভ করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ সমাবেশে ঢামেকের অধ্যাপক আব্দুল ওয়াহাব বলেন, ‘যারা ধর্ষণ করে এবং যারা এদের মদদ দেয়, তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। এর আগে আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় ধর্ষণের সেঞ্চুরি করা হয়েছে। ধর্ষককে রাজনৈতিক দল এবং নির্বাহী ক্ষমতা যারা ছিলেন, তারা তাকে দেশ থেকে বের করে দিয়েছে। তাই অবিলম্বে সব ধর্ষণের বিচার নিশ্চিত করতে হবে যেন এমন ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি আর না হয়।’
এর আগে সোয়া ১২টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপারাজেয় বাংলার পাদদেশে বিক্ষোভ সমাবেশ করে শিক্ষক নেটওয়ার্ক। ঢাবির সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সামিনা লুৎফা বলেন, ‘ঢাবিতে নারী শিক্ষার্থীকে হেনস্তার ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার জন্য সংশ্লিষ্টদের বিচার দাবি করছি। একইসঙ্গে যারা ঐ শিক্ষার্থীকে বুলিং ও সাইবার আক্রমণের শিকার করিয়েছেন এবং ধর্ষণ ও হত্যার হুমকি দিয়েছেন, তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।’
সমাবেশে শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে ৯ দফা দাবি জানানো হয়। ওই ৯ দফা দাবি পাঠ করেন শিক্ষার্থী নওরীন সুলতানা তমা। দাবিগুলো হলো- জননিরাপত্তা দানে ব্যর্থ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে দায় স্বীকারপূর্বক পদত্যাগ করতে হব, সারাদেশে অব্যাহত ধর্ষণ, নারী নিপীড়ন, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, সারাদেশে ঘটে যাওয়া ধর্ষণ ও নিপীড়নের সব ঘটনার বিচার নিশ্চিত করতে হবে, প্রয়োজনে ধর্ষণের ঘটনার বিচারের জন্য আলাদা ট্রাইবুনাল গঠন করতে হবে, সংশ্লিষ্ট অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে ধর্ষণ ও নারী-নিপীড়ন প্রতিরোধের আইনসমূহে প্রয়োজনীয় যৌক্তিক সংযোজন, বিয়োজন ও সংশোধন করতে হবে।
সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রের জন্য যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল গঠন আইন করে বাধ্যতামূলক করতে হবে, প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে জেন্ডার সংবেদনশীলতার পাঠ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
ধর্ষণ মামলা গ্রহণে যে জটিলতা তা দূর করতে হবে। বিশেষ আইন অথবা বিশেষ সেলে’র অধিকারবলে ধর্ষণের অভিযোগ যেকোনো থানা গ্রহণ করবে এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, ভুক্তভোগী ও সাক্ষীকে সব ধরনের সুরক্ষা প্রদানের জন্য ২০১১ সালে পর্যালোচিত সাক্ষী সুরক্ষা আইন পুনরায় পর্যালোচনা ও প্রয়োগ করা, চবির নারী শিক্ষার্থীদের হেনস্তা, স্লাটশেমিং এবং বরখাস্তের ঘটনা পূর্ণ তদন্ত করে অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সমন্বয়ে স্বাধীন যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল কার্যকর করতে হবে। সেলে আবশ্যিক নারী সদস্য থাকবে। অপরাধ প্রমাণ সাপেক্ষে, দোষীকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা উক্ত সেলকে দিতে হবে।
এদিকে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) শিক্ষার্থীরাও প্রতিবাদ জানাতে পিছিয়ে নেই। রবিবার বুয়েটের কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডসহ ছয়টি দাবি উত্থাপন করন তারা।
রাতে ফের রাজু ভাস্কর্যের বিক্ষোভ ও মশাল মিছিল: পূর্বঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে ধর্ষণবিরোধী মঞ্চ গঠন, সকল ধর্ষণের বিচার ও আছিয়ার ধর্ষণকারীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম শেষে ফের রবিবার রাত ৮টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাস বিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মশাল মিছিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
এসময় তারা ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস উই ওয়ান্ট জাস্টিস’. ‘আমার সোনার বাংলায়, ধর্ষকদের ঠাই নাই’, ‘তুমি কে আমি কে, আসিয়া আসিয়া’, একটা একটা ধর্ষক ধর, ধরে ধরে কবর দে’, ‘ধর্ষকদের কালো হাত, ভেঙে দাও গুড়িয়ে দাও’ সহ স্লোগান নানা স্লোগানের মাধ্যমে ধর্ষণের প্রতিবাদ এবং ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানান।
দুই দফা দাবিতে ধর্ষণবিরোধী মঞ্চ গঠন: নারীর প্রতি সংঘটিত ধর্ষণ নিপীড়ন, নারীবিদ্বেষী মব এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিরূদ্ধে রুখতে ঢাবির নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে গঠিত হয়েছে ধর্ষণবিরোধী মঞ্চ। গঠনের পরপরই ধর্ষণবিরোধী মঞ্চ গঠন, সকল ধর্ষণের বিচার ও আছিয়ার ধর্ষণকারীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দাবি জানিয়েছে মঞ্চটি।
শনিবার মাঝরাতে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের ঢাবি শাখার মুখপাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রাফিয়া রেহনুমা হৃদির পাঠানো এক বার্তায় এ দাবি জানানো হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, ‘যতদিন পর্যন্ত আমাদের দাবি বাস্তবায়ন না হচ্ছে ধর্ষণবিরোধী মঞ্চ তাদের কর্মসূচি বহাল রাখবে।’
ধর্ষণকারীদের বিচার চায় ঢাবি সাদা দল: নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে নারী ও শিশু ধর্ষণকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দল। রবিবার সংগঠনের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান, যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. আব্দুস সালাম এবং অধ্যাপক ড. মো. আবুল কালাম সরকার স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এ দাবি জানানো হয়।
সোমবার সারাদেশে মানববন্ধন করবে ছাত্রদল: দেশব্যাপী নারীদের ওপর সহিংসতা, নিপীড়ন, ধর্ষণ, অনলাইনে হেনস্তা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সার্বিক অবনতি ও বিচারহীনতার প্রতিবাদে সোমবার (১০ মার্চ) সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করবে ছাত্রদল। রবিবার ছাত্রদলের দপ্তর সম্পাদক (সহ-সভাপতি পদমর্যাদা) মো. জাহাঙ্গীর আলমের পাঠানো এক বার্তায় এ তথ্য জানানো হয়েছে।
উল্লেখ্য, মাগুরা শহরে বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসে আট বছরের এক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। অচেতন অবস্থায় শিশুটিকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই ঘটনায় শিশুটির দুলাভাই ও বোনের শ্বশুরকে আটক করেছে পুলিশ। এছাড়াও দিন দিন নারীর নিরাপত্তা ও শ্লীলতাহানি ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়াতে বেশ উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য।
আরিফ জাওয়াদ/মাহফুজ