এখন পর্যন্ত শতাধিক বাল্যবিবাহ রোধ করেছেন তিনি। তার এই অভাবনীয় কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি হিসেবে ২০২২ সালে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির ১০০ উদীয়মান ও প্রভাবশালী নারীর তালিকায় স্থান দিয়েছে তাকে। সানজিদা ইসলাম ছোঁয়া ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার ঝাউগড়া গ্রামের মো. আমিনুল ইসলাম ভূঁইয়া ও খাদিজা আক্তার দম্পতির মেয়ে। এখন কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল সরকারি কলেজে ব্যবস্থাপনা বিভাগের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছোঁয়া।
খুব অল্প বয়সেই বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ নিয়ে কাজ শুরু করেন তিনি। তার মায়ের বাল্যবিবাহ হয়েছিল। তিনি সবসময় দেখে এসেছেন, বাল্যবিবাহ হলে তার পরিণতি কেমন হয়। তার বাবা সামান্য চাকরিজীবী। তার একার সীমিত আয়ে সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকত। একদিকে সংসারের খরচ, অন্যদিকে তাদের দুই ভাইবোনের লেখাপড়ার খরচ। খরচ সামলাতে হিমশিম খেতে হতো। তার মা তখন আক্ষেপ করে বলতেন, অল্প বয়সে বিয়ে না হয়ে যদি লেখাপড়া শিখে স্বাবলম্বী হতাম, তাহলে সংসারে সহযোগিতা করতে পারতাম। মায়ের এসব কথা সানজিদাকে খুব ভাবাত। স্বাবলম্বী হতে না পারা ছাড়াও বাল্যবিবাহর শারীরিক ক্ষতিও অনেক। এদিকে তার স্কুলের অনেক সহপাঠীরও একের পর এক বাল্যবিবাহ হচ্ছিল। একদিন স্কুলে বাল্যবিবাহর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে একটা প্রেজেন্টেশন দেখার সুযোগ হয় তার। তখন তিনি ভাবতে থাকেন, কীভাবে এই সমস্যা রোধ করা যায়।
২০১৪ সালের কথা। তখন ছোঁয়া অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। একটা বাল্যবিবাহর খবর এসে পৌঁছাল তার কাছে। তখনই তিনি ভাবলেন, যেভাবেই হোক বিয়েটা ভাঙতে হবে। তার এই কাজে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন আরও কিছু মানুষ। প্রথম উদ্যোগেই তারা সফল হন। এর পর যারা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, তাদের সঙ্গে আলোচনা করে গড়ে তোলেন ‘ঘাসফড়িং’ নামে একটি সংগঠন। যারা এসব সামাজিক কাজে বেশি আগ্রহী ছিলেন, তাদের নিয়েই সংগঠনের যাত্রা শুরু হয়। শুরুতে তাদের সদস্য সংখ্যা ছিল সাতজন।
সংগঠনের নাম ‘ঘাসফড়িং’ কেন, জানতে চাইলে খবরের কাগজকে ছোঁয়া বলেন, ‘আমাদের এলাকায় মা ও শিশুদের নিয়ে কাজ করা ওয়ার্ল্ড ভিশন সংস্থাটির একটি শাখা রয়েছে। ওখানকার শিশু ফোরামের সঙ্গে আমরা যুক্ত ছিলাম। শিশু ফোরামের নাম ছিল ঘাসফুল। আমরা তিনজন যারা শিশু ফোরামের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, তাদের সঙ্গে আমাদের স্কুলের চারজন যুক্ত হয় বাল্যবিবাহ রোধের কাজে। কিন্তু তারা চারজন শিশু ফোরামের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। তখন আমাদের সাতজনকে আলাদাভাবে চেনার জন্য দৈনিক কালের কণ্ঠের আঞ্চলিক প্রতিনিধি আলম ফরাজী ঘাসফড়িং নাম দেন। এই নামকরণের পেছনে অন্য কারণও রয়েছে। এই যে আমরা নান্দাইল উপজেলার কোথাও বাল্যবিবাহর খবর পেলেই যেকোনো সময় ছুটে যাই তা রোধ করতে, ফড়িংয়ের মতো এভাবে ছুটে যাওয়ার কারণে আমাদের ঘাসফড়িং নাম দেওয়া হয়’।
কোনো বাল্যবিবাহর ঘটনা শুনলেই তিনি তার সহযোগী ও শিক্ষকদের নিয়ে ছুটে যান সেখানে। প্রথমে অভিভাবকদের বাল্যবিবাহর নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেন। অনেক অভিভাবক তা বুঝতে পেরে বিয়ে ভেঙে দেন। কিন্তু অনেকে তাদের কথা শুনতে চান না, কিছুতেই বুঝতে চান না। সে ক্ষেত্রে তারা প্রশাসনের সহযোগিতা নিতে বাধ্য হন। এভাবে ছোঁয়া ও তার সংগঠন ‘ঘাসফড়িং’-এর পরিচিতি বাড়তে থাকলে কোথাও কেউ বাল্যবিবাহর খবর জানতে পারলেই ফোন করে তাদের জানিয়ে দেন। বেশির ভাগ সময়ই ছোঁয়া নিজে উপস্থিত থেকে এর সমাধান করেন। কখনো যদি তিনি সশরীরে উপস্থিত থাকতে না পারেন, সে ক্ষেত্রে দূর থেকেই শিক্ষক, প্রশাসন, সহযোগী সবার সঙ্গে কথা বলে এর প্রতিরোধের ব্যবস্থা করেন।
শুধু কি নিজ জেলার ভেতরই এ কার্যক্রম সীমাবদ্ধ নাকি আরও বিস্তৃত পরিসরে কাজ করছেন? এ প্রশ্নের উত্তরে ছোঁয়া খবরের কাগজকে বলেন, ‘এখন আমরা ময়মনসিংহ জেলার ভেতরই কার্যক্রম চালাচ্ছি। এ ছাড়া অনলাইন প্ল্যাটফর্মে অ্যাডভোকেসির কাজ করছি। এককভাবে আমি আমাদের জেলার ভেতরেই কাজ করছি। কিন্তু আমি বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছি। যেমন, ওয়ার্ল্ড ভিশনের ইয়ুথ ফোরামের সঙ্গে কাজ করছি। প্রতিটি জেলা, উপজেলায় এ সংস্থার একটি ফোরাম সংগঠন রয়েছে। বাংলাদেশের সব প্রান্তেই আমাদের ইয়ুথরা কাজ করছেন’।
বাল্যবিবাহ রোধ ছাড়া আর কী কী সামাজিক কাজ করছেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাল্যবিবাহ ছাড়া আমরা বৃক্ষরোপণ, ত্রাণ বিতরণ, ঝরে পড়া শিশুদের পুনরায় স্কুলে ভর্তি করা এবং তাদের উপবৃত্তির ব্যবস্থা করে দেওয়ার কাজ করি। যেসব শিশু কখনো স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়নি, তাদের স্কুলে ভর্তি করিয়ে বই, স্কুল ড্রেস কিনে দেওয়া থেকে শুরু করে সবকিছুর ব্যবস্থা করে দিই। এ ছাড়া যখন দেশে যে দুর্যোগ সংঘটিত হয়, আমরা সেখানে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিই। গত শীতে আমরা ৫০০ কম্বল বিতরণ করেছি দরিদ্র মানুষদের মাঝে’।
প্রতিবন্ধকতার প্রশ্ন আসতেই তিনি বলেন, ‘কাজ করতে গেলে প্রতিবন্ধকতা আসবেই। যখন প্রথম প্রথম বাল্যবিবাহ রোধ করার কাজ শুরু করি, মানুষ দা, বাঁশ এসব নিয়ে ধাওয়া করত। মা-বাবাকে ফোন করে আমার প্রাণনাশের হুমকি দিত। আমাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাওয়ার কথা বলত। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকত দল বেঁধে। এও বলত, আমাকে কিছু টাকা দেওয়া হবে। আমি যেন এসব কার্যক্রম বন্ধ করে দিই। আরেকটা ইস্যু যেটা হয়, বিয়ে দেওয়ার জন্য ভুয়া জন্মসনদ বানিয়ে বয়স বাড়ানো হয়। কাজি, চেয়ারম্যান এদের সহযোগিতা নিয়ে এসব বন্ধ করার চেষ্টা করি। এই যাত্রাপথ অতটা সহজ ছিল না আসলে। তবে এখন নান্দাইল উপজেলায় আর কোনো বাল্যবিবাহ হয় না’।
এই যাত্রাপথে শুরু থেকেই সাহস জুগিয়ে পাশে থেকেছেন তার মা। বাবা প্রথমে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। পরবর্তীতে তিনি ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছেন, ছোঁয়া ঠিক কাজই করছে। এর পর তিনিও আর বাধা দেননি। সমাজের মানুষও একসময় বিষয়টিকে ভালোভাবে গ্রহণ করে। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। ক্রমশই তার শুভাকাঙ্ক্ষী বাড়তে থাকে। সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। ছোঁয়া ও তার সংগঠনের কল্যাণে ঝাউগড়াকে বাল্যবিবাহমুক্ত গ্রাম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ছোঁয়া চান, পুরো দেশটাকেই একদিন বাল্যবিবাহমুক্ত দেশ হিসেবে ঘোষণা করা হোক।
আপনার এই যাত্রাপথে মা ছাড়াও সবসময় আপনাকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে, এমন কারও কথা কি বলতে চান? এই প্রশ্নের জবাবে ছোঁয়া খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা যখন এই প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতাম, তখন আমাদের প্রশাসন এবং সাংবাদিকরা অনেক সহযোগিতা করতেন। বিশেষ করে কালের কণ্ঠের প্রতিনিধি আলম ফরাজী সহযোদ্ধার মতো সঙ্গে থেকেছেন। এ ছাড়া প্রথম আলো, আজকের পত্রিকার প্রতিনিধি, নান্দাইলের ওসি, যখন যিনি থাকতেন তারা অনেক সাপোর্ট করতেন। প্রথমদিকে যখন আমরা কাজটা শুরু করি, আমাদের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন হাফিজুর রহমান স্যার এবং মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা ছিলেন রোমানা আক্তার, তারা খুব সহযোগিতা করেছেন। এ ছাড়া বড় কোনো সমস্যা হলে আমাদের সাবেক এমপি আনোয়ারুল আবেদীন খান তুহিন নিজে তা সমাধান করেন। আর আমাদের সব আর্থিক সহায়তা দেন কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন স্যার’।
সানজিদা তার সংগঠনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে খবরের কাগজকে বলেন, ‘পড়াশোনার পাশাপাশি সামাজিক কাজটা চালিয়ে যেতে চাই। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে আমাদের কাজগুলো ছড়িয়ে দিতে চাই। আমাদের দেখে যদি কেউ ভালো কাজে অনুপ্রাণিত হয়, সেটাই আমাদের সার্থকতা। আমরা ‘ড্রিমার ইয়ুথ অর্গানাইজেশন’ নামে নতুন একটি নাম ক্রিয়েট করেছি। এই সংগঠনটি নিয়েই আমরা সামনে এগিয়ে যেতে চাই। এর পাশাপাশি আমার একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র রয়েছে। এখানে দরিদ্র নারীদের বিনামূল্যে সেলাই প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। প্রশিক্ষণ শেষে কীভাবে তারা স্বাবলম্বী হতে পারে, সে ব্যাপারে সহযোগিতা করি। এভাবে আমাদের এলাকায় উদ্যোক্তা তৈরি করছি। গত বছর বসুন্ধরার পক্ষ থেকে এই প্রশিক্ষণকেন্দ্রের ২০ জন নারীকে সেলাই মেশিন উপহার দেওয়া হয়েছে। এসব কাজই আরও ভালোভাবে করে যেতে চাই’।
জাহ্নবী