৩ ডিসেম্বর ১৯৭১, মহান মুক্তিযুদ্ধের রক্ত ঝরা বরগুনার ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। নানান কৌশলের মধ্য দিয়ে পাক বাহিনীকে পরাজিত করে এদিন হানাদারমুক্ত হয় বরগুনাবাসী।
ওই সময়ে পাক বাহিনীর হাতে নিহত হওয়া জেলার ১৩৮ জন শহীদ স্মরণে বরগুনা পৌর গণকবরে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ এবং সার্কিট হাউস ময়দানে নির্মাণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ। যেখানে বরগুনার বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় দিনটি স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, বিজয় শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করাসহ নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে যথাযোগ্য মর্যাদায় বরগুনা হানাদার মুক্ত দিবস পালিত হয়ে আসছে।
মুক্তিযুদ্ধে নবম সেক্টরের বুকাবুনিয়া সাবসেক্টরের অধীনে ছিল বরগুনা। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাষ্যমতে, মাত্র ২২ জন মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বের মধ্য দিয়ে হানাদার মুক্ত হয় বরগুনা। তবুও মুক্তিযুদ্ধের সেই সময়কার স্মৃতি স্মরণ করতে গিয়ে এখনো অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন বরগুনার বীর মুক্তিযোদ্ধা মানোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরই বরগুনার মুক্তিকামীরা যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করেন। এরমধ্যেই পাক বাহিনী পটুয়াখালী জেলা দখল করলে হানাদারদের মোকাবেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের তেমন কোন অস্ত্র না থাকায় ধ্বংসযজ্ঞ ও ক্ষয়ক্ষতির ভয়ে তারা অন্য এলাকায় চলে যান। ফলে বিনা বাধায় বরগুনা দখল করে পাক বাহিনী। এরপর বিভিন্ন থানা ও তৎকালীন মহকুমা সদরে অবস্থান করে পৈশাচিকভাবে নারীদেরকে নির্যাতন করাসহ নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। বিশেষ করে ২৯ ও ৩০ মে জেলখানায় ৭৬ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। কয়েক মাসের মধ্যে বরগুনার মুক্তিযোদ্ধারা মনোবল ও শক্তি অর্জন করে এলাকায় ফিরলে বামনা, বদনীখালী ও আমতলীতে ব্যাপক যুদ্ধ হয় এবং পাক বাহিনীরা জেলার ট্রেজারি, গণপূর্ত বিভাগের ডাকবাংলোয় অবস্থান নেয়।
বরগুনা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. জাহাঙ্গীর কবির স্মৃতি চারণে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা হেড কোয়ার্টারের নির্দেশ পেয়ে আমাদের বুকাবুনিয়ার মুক্তিযোদ্ধারা ২ ডিসেম্বর বেতাগী থানার বদনীখালী বাজারে আসেন। রাত ৩ টার দিকে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সাত্তার খানের নেতৃত্বে তারা নৌকায় করে বরগুনার খাকদোন নদীর পোটকাখালীতে অবস্থান নিয়ে নিজস্ব সংকেত পেয়ে ভোর রাতে তীরে উঠে আসেন। মাত্র ২১ জন সহযোদ্ধা নিয়ে তিনি বরগুনা মুক্ত করার লক্ষে আক্রমণ করেন। তাদের মধ্যে ১০ জন ছিলেন বরগুনার, বাকি ১১ জন ছিলেন ঝালকাঠির।
বরগুনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার আবদুল মোতালেব মৃধা ওই রাতের স্মৃতি চারণে বলেন, কারাগার, ওয়াবদা কলোনী, জিলা স্কুল, সদর থানা, ওয়্যারলেস স্টেশন, এসডিওর বাসাসহ বরগুনা শহরকে কয়েকটি উপবিভাগে ভাগ করা হয়। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী যে যার অস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেন এবং ফজরের আজানকে যুদ্ধ শুরুর সংকেত হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আজান শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ছয়টি স্থান থেকে একযোগে ফায়ার করা শুরু হলে পাক বাহিনীরা সম্মুখ যুদ্ধে না গিয়ে পালিয়ে যেতে থাকে। এরপর দ্বিতীয় দফা ফায়ার করে জেলখানার দিকে এগোতে থাকেন মুক্তিযোদ্ধারা। চারজন সহযোগীসহ আবদুস সাত্তার খান ছিলেন কারাগার এলাকায়। তারা এসময় জেলখানায় অবস্থানরত পুলিশ ও রাজাকারদের আত্মসমর্পণ করিয়ে এসডিও অফিসের সামনে আনেন এবং কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা গিয়ে স্বাধীনতাকামী তৎকালীন এসডিও আনোয়ার হোসেনকে মুক্ত করেন। দুপুর ১২ টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা তাকে সাময়িকভাবে প্রশাসনিক দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে বুকাবুনিয়া সাব সেন্টারে চলে যান। এরপরই বরগুনার বুকে লাল সবুজের পতাকা উড়তে থাকে। সেদিন থেকেই বরগুনা হানাদার মুক্ত হয়।
মহিউদ্দিন অপু/এআর