![চট্টগ্রামে অটিজম শিশুর সংখ্যা বাড়ছে](uploads/2024/04/02/1712054232.Autism.jpg)
চট্টগ্রামে অটিজম শিশুর জন্মহার প্রতি বছরই বাড়ছে। এ বৃদ্ধির হারকে আশঙ্কাজনক মনে করছেন গবেষকরা। গত বছর প্রতি ৪৪ জনে একজন, এর আগের বছর ৫৪ জনে একজন, এ বছর প্রতি ৩৩ জনে একজন করে অটিজম শিশুর জন্ম হচ্ছে চট্টগ্রামে।
বর্তমানে সরকারি হিসেবে চট্টগ্রামে ২০ হাজার ও দেশে ৮৬ হাজার অটিজম শিশু রয়েছে। তবে বেসরকারি হিসাবে এর সংখ্যা আরও বেশি।
চট্টগ্রামের নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশনের সভাপতি ও অটিজম গবেষক অধ্যাপক ডা. বাসনা রাণী মুহুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে অটিজম শিশু। এ শিশুদের বাঁচার অধিকার আছে। এ সমাজে বসবাসে অধিকার আছে। তাদের মানবিকভাবে গড়ে তুলতে হবে। মানবতা ও ভালোবাসা দিয়েই অটিজম শিশুদের গড়ে তুলতে হবে। তবে মানুষ এখন একটু সচেতন হয়েছেন। আরও সচেতন হতে হবে।’
তিনি বলেন, স্বল্প ওজনে বাচ্চা, সিজারিয়ান বাচ্চার জন্ম হওয়া, বংশগত সমস্যা, পরিবেশগত সমস্যা যা গর্ভকালীন নিউরনের ওপর প্রভাব, মাতৃগর্ভে থাকার সময়ে ভ্রূণের সমস্যায়ও অটিজম শিশুর জন্ম হয়। দেশে বর্তমানে ৮৬ হাজার অটিজম শিশু আছে। চট্টগ্রামের আছে ২০ হাজার অটিজম শিশু।
তিনি আরও বলেন, ‘অটিজম সারা জীবনের সমস্যা। এটি নিরাময়যোগ্য কোনো রোগ নয়। এটি একটি স্নায়ুবিক বিকাশজনিত সমস্যা। আপনি কখন বুঝবেন শিশুটি অটিজম? যখন দেখবেন সে কথা বলছে অন্যদিকে তাকিয়ে। আপনার দৃষ্টি আকর্ষিত হচ্ছে না। কথা কম বলছে বা দুই বছর বলার পর কথা বন্ধ করে দিচ্ছে। তখন বুঝতে হবে সে অটিজম। তখন তাকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা, ভালোবাসা, মানবতা দিয়ে এগিয়ে নিতে হবে। কখনো অবহেলা করা যাবে না।’
প্রতি বছর ২ এপ্রিল বিশ্ব অটিজম দিবস পালন হয়ে আসছে। এবার ‘সচেতনতা-স্বীকৃতি-মূল্যায়ন: শুধু বেঁচে থাকা থেকে সমৃদ্ধির পথে যাত্রা’ এ প্রতিবাদ্যকে সামনে রেখে পালিত হচ্ছে বিশ্ব অটিজম দিবস।
বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে এ দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে।
এর অংশ হিসেবে মঙ্গলবার (২ মার্চ) সকাল ১০টা থেকে নন্দনকানের চট্টগ্রাম থিয়েটার ইনস্টিটিউটে বিশেষ শিশুদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, অটিজম উত্তরণে আলোকিত মা সম্মাননা প্রদান ও দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ের ওপর আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এদিকে চট্টগ্রামে ২০১০ সালে মাত্র চারজন অটিজম বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন ছাত্রছাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু তৎকালীন অটিস্টিক চিলড্রেন ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার সেন্টার যা বর্তমানে নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশন নামে সুপরিচিত। অটিজম এবং অন্যান্য স্নায়ুবিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্নদের উত্তরণে দীর্ঘ প্রায় একযুগের অধিককাল নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে এ প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে নিষ্পাপ অটিজম স্কুল এবং ২০২১ সালের থেকে ড. আর পি সেন গুপ্ত নিষ্পাপ সমন্বিত বিদ্যালয়। দুই শিফটে পরিচালিত নিষ্পাপ অটিজম স্কুলে বর্তমানে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ১০৬ এবং নিষ্পাপ সমন্বিত স্কুলে শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ১২৪। শুরু থেকে এ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ছাত্রছাত্রী একাডেমিক লেভেলে উত্তরণ হয়ে মূলধারার বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আছে ১৪ শিক্ষার্থী। কিন্তু আবার অনেকেই মূলধারার স্কুলে পড়ালেখার যোগ্যতা অর্জনের পরও স্কুল থেকে বিতারিত হয়েছে তাদের কিছুটা আচরণ এবং মূলধারার শিক্ষকদের অসহযোগিতার জন্য।
এ থেকে দেখা যায়, অকুপেশনাল থেরাপিস্ট, স্পিচ ল্যাঙ্গুয়েজ থেরাপিস্ট অটিজম উত্তরণে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে।
ইউএস সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী প্রতি ৩৬ জন আমেরিকান শিশুর মধ্যে ১ জনের অটিজম আছে এবং আমাদের দেশে প্রতি ১,০০০ জনে ১ থেকে ৩ জন শিশু অটিজম বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন।
গবেষণা বলছে, মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের অটিজম হয়ে থাকে ৪ থেকে ৫ গুণ বেশি। সম্মিলিতভাবে যত শিশুর ডায়াবেটিস, এইডস, ক্যান্সার, সেরিব্রাল পালসি, সিস্টিক ফাইব্রোসিস, মাসকুলার ডিসট্রফি এবং ডাউন সিন্ড্রোম হয়ে থাকে তার চেয়ে অটিজমের সংখ্যাই বেশি। প্রতি বছর আমেরিকায় ২ মিলিয়ন লোকের মাঝে এএসডি (অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার) দেখা যায় এবং সারা বিশ্বে ১০ মিলিয়নের মতো লোকের অটিজম হয়ে থাকে।
এ ছাড়া আমেরিকায় সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এ অটিজমের বিস্তার বার্ষিক ১০ থেকে ১৭ শতাংশ বেড়েছে। এই বৃদ্ধির নির্ভরযোগ্য কোনো কারণ ও ব্যাখ্যা জানা যায়নি। তবে উন্নত যথাযথ রোগ নির্ণয় প্রক্রিয়ার প্রভাব এবং পরিবেশগত প্রভাব এর জন্য দায়ী বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
নিষ্পাপ অটিজম স্কুলের অধ্যক্ষ সোমা চত্রবর্ত্তী বলেন, চট্টগ্রামে থেরাপিস্ট এবং বিশেষায়িত স্কুলের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। প্রয়োজনীয় উদ্যোগ এবং পেশাগত সুযোগ-সুবিধা না থাকায় শিক্ষিত ছাত্রছাত্রীরা এই বিশেষ শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত না হওয়ায় এ বিষয়ে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতিও হচ্ছে না। প্রতিটি অটিজম শিশুর আচরণ স্বতন্ত্র হওয়ার কারণে তাদের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা ভিন্ন। তাই ১:১ বা ক্ষেত্র বিশেষে ১:২ ব্যবস্থায় বিশেষ শিশুদের শিক্ষা দেওয়া হয়। বিশেষায়িত শিক্ষাব্যবস্থা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যা অভিভাবকরা পরিবারের অন্যান্য স্বাভাবিক সন্তানের লেখাপড়ার পাশাপাশি অটিজম সম্পন্ন শিশুর জন্য অতিরিক্ত ব্যয় ভার বহনে অক্ষমতার কারণে এবং পরিচালন ব্যয় বেশি হওয়ায় যাথাযথভাবে স্কুলগুলো পরিচালনা করা অত্যন্ত কঠিন। আমরা বিশেষ স্কুলগুলোকে দ্রুত এমপিও ভুক্তি করার জন্য সরকারের নিকট আবেদন জানাই।
নিষ্পাপ অটিজম ফাউন্ডেশনের সহসভাপতি রোশাঙ্গীর বাচ্চু বলেন, ২০১৩ সালের এনডিডি সুরক্ষা আইনের মাধ্যমে এনডিডি প্রটেকশন ট্রাস্টের সহায়তায় প্রফেশনালদের প্রশিক্ষণ, বিভিন্ন পলিসি নির্ধারণ, কার্যরত প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বিশেষ শিশুদের চলমান স্বাস্থ্যভাতা, শিক্ষা উপবৃত্তি, বয়স্কভাতার পরিমাণ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
আবদুস সাত্তার/পপি/অমিয়/