![ভাড়ায় খাটছে বিসিআইসি সার ডিলারদের লাইসেন্স](uploads/2024/04/19/1713514715.BCIC.jpg)
খাগড়াছড়ির সাবেক সংসদ সদস্য যতীন্দ্রলাল ত্রিপুরার সহধর্মিণী ক্রয়সাঞো মারমা কাগজে-কলমে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) একজন সার ডিলার। তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম ‘ত্রিরত্ন কনস্ট্রাকশন’। খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার ৩ নম্বর গোলাবাড়ী ইউনিয়নের ডিলার হলেও তার প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সের নামে বরাদ্দকৃত সার বিক্রি করা হয় খাগড়াছড়ি বাজারের জামে মসজিদসংলগ্ন মেসার্স আলিফ ট্রেডার্সে।
লাইসেন্সের স্বত্বাধিকারী ক্রয়সাঞো মারমা জানান, বার্ষিক ৫০ হাজার টাকা চুক্তিতে লাইসেন্সটি আবুল কালাম নামে একজন ব্যবসায়ীর কাছে ভাড়ায় দিয়ে রেখেছেন তিনি।
একই অভিযোগ রয়েছে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মনীন্দ্রলাল ত্রিপুরার সহধর্মিণী স্বর্ণাদেবী ত্রিপুরার মালিকানাধীন ‘মেসার্স ত্রিপুরা ট্রেডার্স’-এর বিরুদ্ধে। এই লাইসেন্সটি খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার পেরাছড়া ইউনিয়নে সার বিক্রয়ের জন্য অনুমোদন দিয়েছে বিসিআইসি। এটি ভাড়ায় দিয়ে রেখেছেন খাগড়াছড়ি পৌর শহরের পানখাইয়াপাড়া সড়কের ব্যবসায়ী রিটন চাকমার কাছে। খাগড়াছড়ি বাজারে রিটন চাকমার মালিকানাধীন ‘ভাই ভাই স্টোর’-এর সামনে ঝোলানো হয়েছে পেরাছড়া ইউনিয়নের ‘মেসার্স ত্রিপুরা ট্রেডার্স’-এর নামে সার বিক্রয় কেন্দ্রের ব্যানার। সার উত্তোলন করে এখানেই গুদামজাত করে অনেক বছর ধরে বিক্রি করে আসছেন রিটন চাকমা নামের ওই ব্যবসায়ী।
কেউ কেউ আবার নিজের নামে লাইসেন্স থাকা সত্ত্বেও ভাড়ায় নিয়ে ব্যবহার করছেন একাধিক লাইসেন্স। খাগড়াছড়ি পৌর শহরে সার বিতরণের জন্য সরকারিভাবে অনুমোদন দেওয়া হয় ‘মেসার্স বড়ুয়া ট্রেডার্স’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে। এই প্রতিষ্ঠানটির মালিক প্রিয়দর্শী বড়ুয়া। তার ছেলে বিপ্লব বড়ুয়ার নামেও ‘মেসার্স বালি এন্টারপ্রাইজ’ নামে জেলার মহালছড়ি উপজেলার মাইসছড়ি ইউনিয়নে একটি বিসিআইসি সার ডিলারের লাইসেন্স রয়েছে। এর পরও তিনি খাগড়াছড়ি সদর ইউনিয়নের জন্য অনুমোদনকৃত ‘মেসার্স কে. এন্টারপ্রাইজ’ নামে অপর একটি লাইসেন্স বার্ষিক চুক্তিতে ভাড়ায় নিয়ে ব্যবহার করছেন বছরের পর বছর ধরে। অর্থাৎ তিনটি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সের অনুকূলে বরাদ্দকৃত সার উত্তোলন করে তিনি সেসব বিক্রি করে আসছেন খাগড়াছড়ি শহরের পানখাইয়াপাড়া সড়কের মেসার্স বড়ুয়া ট্রেডার্সে। মেসার্স কে. এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী উলাপ্রু মারমার কাছে জানতে চাইলে তার লাইসেন্সটি ভাড়ায় দিয়ে রেখেছেন বলে স্বীকার করেন। খবরের কাগজকে তিনি বলেছেন, ‘লাইসেন্স বাবদ বড়ুয়াবাবু আমাকে বছরে ৫০ হাজার টাকা করে ভাড়া দেন।’
কাজল বড়ুয়া নামে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার ভাইবোনছড়া ইউনিয়নের বিসিআইসির আরেক সার ডিলার নিজের নামে লাইসেন্স থাকা সত্ত্বেও ভাড়ায় নিয়ে ব্যবহার করেন অন্য আরও দুটি লাইসেন্স। মহালছড়ি উপজেলার ক্যায়াংঘাট ইউনিয়নের ‘মেসার্স বিপুল বড়ুয়া’ এবং পানছড়ি উপজেলার উল্টাছড়ি ইউনিয়নের ‘মেসার্স তাহের অ্যান্ড ব্রাদার্স’ এই দুটি লাইসেন্সের অনুকূলে বরাদ্দকৃত সার উত্তোলন করে বিক্রি করেন ভাইবোনছড়া বাজারের মেসার্স কাজল ট্রেডার্সে।
বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন খাগড়াছড়ি জেলা ইউনিটের সভাপতি কে এম ইসমাইল হোসেনের মালিকানাধীন ‘মেসার্স আকাশ এন্টারপ্রাইজ’-এর নামে লাইসেন্সের অনুমোদন দেওয়া হয় দীঘিনালা উপজেলার মেরুং ইউনিয়নে সার বিক্রয়ের জন্য। তবে এই লাইসেন্সটিও মো. রফিক নামে বোয়ালখালী ইউনিয়নের এক ব্যবসায়ীর কাছে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। লাইসেন্স ভাড়ায় নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বোয়ালখালী বাজারের রফিক বীজ ভাণ্ডারের মালিক মো. রফিক বলেন, ‘লাইসেন্সটি আমি ভাড়ায় নিয়ে চালাই। তবে তার জন্য বছরে কত টাকা ভাড়া দিই তা আপনাকে বলা যাবে না।’
এ ছাড়া দীঘিনালা উপজেলার বোয়ালখালী ইউনিয়নের ‘মেসার্স এসএস ট্রেডার্স’ নামে অনুমোদিত লাইসেন্সের মালিক থাকেন চট্টগ্রাম শহরে। নিজে ব্যবসা না করে অন্য ব্যবসায়ীর কাছে ভাড়ায় দিয়ে রেখেছেন লাইসেন্স। দীঘিনালার বাবুছড়া ইউনিয়নের ‘মেসার্স রাজ্জাক স্টোর’-এর আব্দুর রাজ্জাকও নিজে ব্যবসা করেন না। মাটিরাঙ্গা উপজেলার গোমতী ইউনিয়নের ‘মেসার্স জুয়েল এন্টারপ্রাইজ’-এর মালিক মো. মহিউদ্দিন থাকেন প্রবাসে। তবে লাইসেন্স ভাড়া দিয়ে রেখেছেন অন্যজনের কাছে। মাটিরাঙ্গা উপজেলার সদর ইউনিয়নের ‘মেসার্স হাকিম স্টোর’-এর মালিক মো. আব্দুল হাকিম এবং রামগড় উপজেলার সদর ইউনিয়নের ‘মেসার্স মোস্তফা ট্রেডার্স’-এর মালিক মো. মোস্তফা ইউনিয়নে সার বিক্রি না করে বিক্রি করেন পৌর সদরেই।
নীতিমালায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ইউনিয়নই হবে সার বিতরণের কেন্দ্রবিন্দু। এ ছাড়া প্রতিটি পৌরসভায় একজন করে বিসিআইসির ডিলার সার বিতরণ করবেন। তবে খাগড়াছড়ি জেলার ৩৮টি ইউনিয়ন এবং ৩টি পৌরসভায় সার বিতরণে চলছে এসব অনিয়ম। কৃষকদের পরিবহন খরচ কমাতে সরকার বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়। তবে ইউনিয়নে সার পাচ্ছেন না প্রান্তিক কৃষকরা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় সারা বছর ধরে কৃষকদের গুনতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের পরিবহন ব্যয়।
খাগড়াছড়ি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক মোহাম্মদ বাছিরুল আলম বলেন, ‘আমি মূলত জেলা প্রশিক্ষণ অফিসার। উপপরিচালকের বদলিজনিত কারণে সম্প্রতি আমাকে ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমি দু-একজন ডিলারের লাইসেন্স ভাড়া দেওয়ার বিষয়টি জানতাম। এত বেশি অনিয়মের কথা আমার জানা ছিল না। এ বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জেলা সার ও বীজ মনিটরিং কমিটির সভাপতি, খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান বলেন, ‘ডিলারদের লাইসেন্স ভাড়া দেওয়ার বিষয়টি সম্পর্কে অবগত ছিলাম না। এ ব্যাপারে খতিয়ে দেখা হবে এবং সত্যতা পাওয়া গেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেব।’
উল্লেখ্য, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে খাগড়াছড়ি জেলার ৩৯ জন সার ডিলারের জন্য সরকারিভাবে সারের চাহিদা রয়েছে ৩৪ হাজার ৭১৩ মেট্রিক টন। এর মধ্যে ইউরিয়া ১৫ হাজার ৯২০ টন, টিএসপি ১০ হাজার ৭৮৯ টন, ডিএপি ৪ হাজার ৮৯৫ টন এবং এমওপি ৩ হাজার ১০৯ টন। চাহিদা অনুযায়ী ডিলাররা মাসের শুরুতেই লাইসেন্সের অনুকূলে বরাদ্দকৃত সার উত্তোলন করে নেন। সরকারিভাবে কৃষক পর্যায়ে খুচরা বিক্রয় মূল্যও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। তবে দাম নির্ধারণ করে দিলেও সার ও বীজ মনিটরিং কমিটির যথাযথ তদারকি নেই খাগড়াছড়ি জেলায়। জেলা সদরে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কেজিপ্রতি ১ টাকা এবং উপজেলা পর্যায়ে কেজিপ্রতি ৩ থেকে ৫ টাকা বেশি মূল্যে সার বিক্রয়ের অভিযোগ রয়েছে ডিলারদের বিরুদ্ধে।
এ ছাড়া কৃত্রিম সংকট তৈরি করে অতিরিক্ত দাম হাতিয়ে নেওয়া হয় কৃষকদের কাছ থেকে। কখনো কখনো আবার চট্টগ্রাম শহরের এজেন্টদের কাছে অতিরিক্ত দামে সার বিক্রি করে দেন অনুমোদিত ডিলাররা।