এমভি আবদুল্লাহর ২৩ নাবিক লাইটার জাহাজ ‘এমভি জাহান মণি’ থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি জেটিতে অন্য নাবিকের সঙ্গে নামলেন জাহাজের অয়েলার আইনুল হক অভি। ছেলেকে কাছে পেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বুকে জড়িয়ে নেন মা লুৎফে আরা বেগম। দুজনের চোখে আনন্দ অশ্রু। মঙ্গলবার (১৪ মে) বিকেল ৪টায় এমন দৃশ্য চোখে পড়ে সবার।
এর আগে জাহাজ নিয়ে সাড়ে ৫ মাস আগে চট্টগ্রাম ছেড়ে গিয়েছিল এস আর শিপিংয়ের মালিকানাধীন জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’। এর মধ্যে ঘটে গেল সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়ার ঘটনা। দুশ্চিন্তা আর উৎকণ্ঠায় কেটেছে প্রতিটা মুহূর্ত। নাবিকদের স্বজনদের ঈদটাও কেটেছে উৎসবহীন। সাড়ে ৫ মাস পর সন্তানকে ফিরে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন মা লুৎফে আরা বেগম। সন্তানকে ফিরে পেয় খুশিতে আত্মহারা তিনি।
এ সময় তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমাদের গ্রামের বাড়ি মীরসরাই পশ্চিম ইছাখালী এলাকায়। শহরে কাজীর ডেউড়ি এলাকায় বাস করি। আমার দুই ছেলে। আইনুল হক অভি আমার বড় ছেলে। ছেলের বাবা করোনাতে মারা গেছেন। জলদস্যুর কবলে পড়ার খবর পেয়ে প্রতিটা সময় দুশ্চিন্তায় সময় পার করেছি। তারা যেন নিরাপদে আর সুস্থ থাকে, আল্লাহর কাছে সব সময় এটাই প্রার্থনা করেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘যে দিন জানতে পেরেছি জলদস্যুরা মুক্তিপণ পাওয়ার পর জাহাজ থেকে নেমে গেছে, সে দিন কিছুটা স্বস্তি পেয়েছি। সব মিলিয়ে সাড়ে ৫ মাস পর আমি আমার ছেলেকে কাছে পেয়েছি। আমার খুব ভালো লাগছে। আসলে মায়ের ছেলে মায়ের বুকে ফিরে এসেছে, এ অনুভূতি কীভাবে প্রকাশ করব, তা আমার জানা নেই। আমি খুব খুশি আজ। আমার ছেলেকে ফিরে পেয়েছি, এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কিছু হতে পারে না।’
জাহাজে থাকা নাবিক অয়েলার আইনুল হক অভি খবরের কাগজকে বলেন, ‘সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়ার পর এক ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। আমরা ফ্লোরে ঘুমাতাম। মশা-মাছি থাকার কারণে রাতে ঠিকমতো ঘুম হতো না। কয়েক মাসের খাবার জাহাজে মজুত থাকে। কাজেই খাবার ছিল জাহাজে। জলদস্যুরাও আমাদের খাবার খেয়েছে। তারা দুম্বা নিয়ে এসেছিল। তবে তারা আমাদের দিয়ে কাজ করিয়েছে। দুম্বা জবাই করিয়েছে। তারা খেয়েছে, আমাদেরও খেতে দিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঈদের দিন অনুরোধ করার পর তারা আমাদের নামাজ পড়তে দিয়েছিল। তারপর অনুরোধ করার পর আমরা একটি ছবি তুলেছিলাম। সব মিলিয়ে ঈদের দিন আমাদের কাছে ঈদ মনে হয়নি। আজ আমরা পরিবারের সদস্যদের দেখতে পাচ্ছি। নিরাপদে দেশে ফিরে আসতে পেরেছি। কাজেই আমরা বলতে চাই, আজই আমাদের ঈদ। আমরা খুব খুশি।’
এর আগে গতকাল সোমবার (১৩ মে) সন্ধ্যা ৬টায় জাহাজটি নোঙর করেছিল কুতুবদিয়ায়। সেখান থেকে মঙ্গলবার বিকাল ৪টার দিকে ‘এমভি জাহাজ মণি’ নামে লাইটার জাহাজে করে চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি জেটিতে আনা হয় ২৩ নাবিককে। নাবিকদের বরণ করে নিতে তাদের স্বজনরা ফুল নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন জেটিতে। নোঙর করার পর জাহাজ থেকেই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন নাবিকরা। পরে চট্টগ্রাম বন্দরের আয়োজনে নাবিকদের ফুল দিয়ে বরণ করে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
জাহাজের ২৩ নাবিক হলেন জাহাজের মাস্টার মোহাম্মদ আবদুর রশিদ, চিফ অফিসার মো. আতিক উল্লাহ খান, সেকেন্ড অফিসার মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, থার্ড অফিসার এন মোহাম্মদ তারেকুল ইসলাম, ডেক ক্যাডেট মো. সাব্বির হোসাইন, চিফ ইঞ্জিনিয়ার এএসএম সাইদুজ্জামান, সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. তৌফিকুল ইসলাম, থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. রোকন উদ্দিন, ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদ, ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান, ইলেকট্রিশিয়ান ইব্রাহীম খলিল উল্লাহ, এবি পদের মোহাম্মদ আনোয়ারুল হক, মো. আসিফুর রহমান, মো. সাজ্জাদ হোসাইন, জয় মাহমুদ, ওএস পদের মো. নাজমুল হক, অয়েলার পদের আইনুল হক, মোহাম্মদ শামসুদ্দিন, মো. আলী হোসেন, ফায়ারম্যান মোশাররফ হোসেন শাকিল, চিফ কুক মো. শফিকুল ইসলাম, জিএস পদের মোহাম্মদ নুর উদ্দিন ও ফিটার মোহাম্মদ সালেহ আহমদ।
এর আগে মোজাম্বিক থেকে ৫৬ হাজার টন কয়লা নিয়ে দুবাই যাওয়ার পথে গত ১২ মার্চ সোমালিয়ার জলদস্যুরা ২৩ বাংলাদেশি নাবিকসহ এমভি আবদুল্লাহ জাহাজটি জিম্মি করেছিল। গত ১৪ এপ্রিল ভোরে জাহাজটি জলদস্যুমুক্ত হয়। এ সময় ৬৫ জন জলদস্যু জাহাজটি থেকে বোটে নেমে যায়।
এরপর গত ২২ এপ্রিল বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে জাহাজটি দুবাইয়ের আল হামরিয়া বন্দরে ভিড়েছিল। কয়লা খালাস শেষে ২৭ এপ্রিল স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে নতুন ট্রিপের পণ্য লোড করতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের মিনা সাকার বন্দরে যায় জাহাজটি। সেখান থেকে চুনাপাথর নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দেয় এমভি আবদুল্লাহ। সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্তির ঠিক এক মাস পর বাংলাদেশে পৌঁছাল এস আর শিপিংয়ের মালিকানাধীন জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’।