অনেক দিন আগে চট্টগ্রামের আনোয়ারার ফুলতলা গ্রামে বাস করত এক গোঁফওয়ালা পালোয়ান। নাম তার মিজান শেখ। তার ছিল ইয়া বড় এক গোঁফ। দীর্ঘদিনের চর্চার ফলে সে তার গোঁফটাকে সামনে, পেছনে, ডানে, বাঁয়ে, ওপরে, নিচে যেদিকে ইচ্ছে সেদিকে নাড়াতে পারত। ফুলতলা গ্রামের শিশু-কিশোররা কিন্তু তাকে খুব পছন্দ করত। কারণ গোঁফওয়ালা পালোয়ান বাচ্চা-কাচ্চাদের সঙ্গে খেলতে খুব পছন্দ করত এবং বাচ্চাদের সে গাছ থেকে আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, গোলাপজাম ইত্যাদি পেড়ে খাওয়াত।
কীভাবে? তার ইয়া বড় সেই গোঁফটি ব্যবহার করে। যেমন- দুষ্টু ছেলের দল কোনো উঁচু আমগাছে আমের নাগাল না পেলে গোঁফওয়ালা পালোয়ানকে এসে বলত, চাচা, আমাদের ওই উঁচু আমগাছের আমগুলো পেড়ে দাও। আর তখনই গোঁফওয়ালা পালোয়ান মিজান শেখ তার মস্ত বড় গোঁফ ওপরে তুলে আমগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে দিত হেঁচকা টান। আম মাটিতে পড়ত টুপটাপ করে। আর শিশু-কিশোররা সেই আম কুড়িয়ে নিয়ে হইচই করতে করতে বাসায় ফিরে যেত।
একবার কর্ণফুলী নদীতে গোঁফওয়ালা পালোয়ান শিশু-কিশোরদের সঙ্গে নৌ ভ্রমণে গেল। তীব্র খরস্রোতা নদীর জলে নৌকা চলছে ঢেউয়ের তালে তালে। গোঁফওয়ালা পালোয়ান বাচ্চাদের সঙ্গে গল্প করতে করতে চলেছে। বেখেয়ালের কখন যে তার বিশাল গোঁফ নদীর জলে ডুবে গেছে, তা সে খেয়াল করেনি। হঠাৎ মস্ত বড় একটা বোয়াল মাছ জড়িয়ে গেল গোঁফের সঙ্গে। গোঁফওয়ালা পালোয়ান গোঁফে টান ও ওজন অনুভব করে গোঁফ ধরে টানতে টানতে বোয়াল মাছটাকে নৌকায় তুলে ধপাস করে ফেলল। বাচ্চারা খুশিতে যথারীতি হইচই করে উঠল। গোঁফওয়ালা পালোয়ান সেই বিশাল আকৃতির বোয়াল মাছটাকে বাসায় এনে রান্না করিয়ে সারা গ্রামের শিশু-কিশোরদের খাওয়াল। শিশু-কিশোরের দল তো বেজায় খুশি। তারা খাওয়া-দাওয়া সেরে গোঁফওয়ালা পালোয়ানকে নিয়ে আনন্দ মিছিল বের করল।
এভাবেই দিন যাচ্ছিল। দেখতে দেখতে বাংলা নববর্ষ চলে এল। বৈশাখ মাস। এ মাসে চট্টগ্রামের লালদীঘির ময়দানে ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলীখেলার আয়োজন হয়। সেই ১৯০৯ সাল থেকে এই বলীখেলা হয়ে আসছে। এটা আসলে এক ধরনের কুস্তি। আর কুস্তি খেলায় গোঁফওয়ালা পালোয়ান মিজান শেখের অনেক নামডাক। কাজেই জব্বারের বলীখেলার আয়োজনে যথাসময়ে তার ডাক পড়ল।
সে একের পর এক বলী কুস্তিগিরদের হারিয়ে অবশেষে ফাইনালে উঠে গেল। ফাইনালে প্রতিদ্বন্দ্বী বিখ্যাত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বলী কুস্তিগির মর্মর সিং। মর্মর সিং তরুণ, অন্যদিকে মিজান শেখের বেশ বয়স হয়েছে তখন। সে ফাইনাল খেলায় অনেকক্ষণ ধরে সমানে সমানে ফাইট দিলেও, শেষ পর্যন্ত আর পেরে উঠছিল না। উপস্থিত শিশু-কিশোররা তাকে চেঁচামেচি করে উৎসাহ দিচ্ছিল। হঠাৎ গোঁফওয়ালা পালোয়ান মিজান শেখ এক কাণ্ড করে বসল। সে মর্মর সিংকে তার গোঁফে পেঁচিয়ে দিল এক আছাড়। আছাড় খেয়ে মর্মর সিং বলীখেলার মাঠে গড়াগড়ি দিতে লাগল, আর উঠতে পারল না। অবশেষে গোঁফওয়ালা পালোয়ানকে বিজয়ী ঘোষণা করা হলো। ফুলতলা গ্রামের শিশু-কিশোররা সবাই গোঁফওয়ালা পালোয়ান মিজান শেখকে কাঁধে চড়িয়ে, তার গোঁফটাকে নানা রং মেখে সাজিয়ে বিজয় মিছিল বের করল। সে কী আনন্দ! সে কী উচ্ছ্বাস!! তা আর কী বলব।
মেহেদী আল মাহমুদ