অর্থনৈতিকভাবে অনুন্নত উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের অবশেষে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের দ্বার খুলতে যাচ্ছে।
রবিবার (১০ মার্চ) দুদিনের সফরে কুড়িগ্রাম এসে অঞ্চলটি ঘুরে গেছেন ভুটানের রাষ্ট্রদূত রিনচেন কুয়েনসিল। তার সঙ্গে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক কর্তৃপক্ষের (বেজা) শীর্ষ কর্মকর্তারাও ছিলেন।
রবিবার দুপুরে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ধরলার সেতুর পূর্বপাড়ে ভোগডাঙা ইউনিয়নের মাধবরাম এলাকায় ‘ভুটানিজ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ পরিদর্শন করেন তিনি। সেখান থেকে ভূরুঙ্গামারী উপজেলার সোনাহাট স্থলবন্দর পরিদর্শনে যান তিনি।
ভুটান থেকে ভারত হয়ে সোনাহাট স্থলবন্দরের দূরত্ব ১৫০ কিলোমিটার। ওই পথে ভুটানের সঙ্গে এ অর্থনৈতিক অঞ্চলের যোগাযোগ খুবই সহজ হবে।
পরিদর্শনের সময় ভুটানের রাষ্ট্রদূত ছাড়াও ভুটান ও বাংলাদেশের বেজার শীর্ষ কর্মকর্তাসহ কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ, পুলিশ সুপার আল আসাদ মো. মাহফুজুল ইসলাম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) উত্তম কুমার রায়, কুড়িগ্রাম পৌরসভার মেয়র কাজিউল ইসলাম, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুসফিকুল আলম হালিম, সহকারী কমিশনার (ভূমি) মিজানুর রহমানসহ স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
কুড়িগ্রামে প্রস্তাবিত ‘ভুটানিজ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ বাস্তবায়ন হলে তাতে ভুটান ও বাংলাদেশের জনগণ বিশেষত কুড়িগ্রামের মানুষ বেশি উপকৃত হবে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূত রিনচেন কুয়েনসিল।
প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) এবং কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানিয়ে রাষ্ট্রদূত রিনচেন কুয়েনসিল বলেন, ‘চুক্তিপত্রসহ আনুষঙ্গিক কাজ সম্পন্ন করে আমরা কলকারখানা স্থাপন করতে পারলে শুধু ভুটান নয়, বাংলাদেশ বিশেষ করে কুড়িগ্রামের মানুষ উপকৃত হবে। এখানে কর্মসংস্থান, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি হবে। ফলে কুড়িগ্রাম এলাকার মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি ঘটবে। এটি বাংলাদেশ-ভুটানের চলমান সুসম্পর্ককে আরও অর্থবহ, দৃঢ় ও মজবুত করবে। আমরা আশাবাদী এই উদ্যোগ উভয় রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত ভালো হবে।’
জিটুজি ভিত্তিক যৌথ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের কার্যক্রম শুরু প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আমি সুনির্দিষ্ট সময় বলতে পারব না। প্রথমত আমরা উভয়পক্ষ আলোচনা করব। উভয়পক্ষের স্বার্থ, কীভাবে কার্যক্রম হবে এসব বিষয় নিয়ে বিশদ আলোচনা করতে হবে। ফলে কিছুটা সময় লাগতে পারে।’
অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য নির্ধারিত স্থান পরিদর্শন শেষে প্রতিনিধি দল জেলার ভূরুঙ্গামারী উপজেলার সোনাহাট স্থলবন্দর পরিদর্শনে যান। দুদিনের সফরে আসা দলটি সোমবার চিলমারী নৌবন্দর পরিদর্শন শেষে কুড়িগ্রাম ত্যাগ করবেন।
ভুটানের চার সদস্যের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে রয়েছেন বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন।
২০২৩ সালের মে মাসে লন্ডনে ভুটানের রাজা ও রানির সঙ্গে এক দ্বিপক্ষীয় সভায় কুড়িগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ ও ভুটান সরকারের যৌথ উদ্যোগে কুড়িগ্রামে জিটুজি ভিত্তিক প্রস্তাবিত ‘ভুটানিজ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ স্থাপনের জন্য জেলা শহরের পূর্ব প্রান্তে ধরলা ব্রিজের পূর্বে কুড়িগ্রাম-ভূরুঙ্গামারী সড়কের পূর্ব পাশে অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য জায়গা নির্ধারণ জেলা প্রশাসন ও বেজা।
কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, সদরের ভোগডাঙা ইউনিয়নের মাধবরাম মৌজার অন্তর্ভুক্ত ১৩৩ দশমিক ৯২ একর খাস জমি অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে (বেজা) হস্তান্তর করা হয়েছে। আরও ৮৬ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব পেয়ে তার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে কুড়িগ্রাম অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের যে স্থবিরতা ছিল তা কাটতে শুরু করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৫ সালে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ মাঠে এক জনসভায় কুড়িগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতেই জেলা শহরের পূর্ব প্রান্তে ধরলা ব্রিজের পূর্বে কুড়িগ্রাম-ভূরুঙ্গামারী সড়কের পূর্বপাশে অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য জায়গা নির্ধারণ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কুড়িগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এখন সময়ের অপেক্ষায়।
বাংলাদেশ ও ভুটান সরকারের যৌথ উদ্যোগে কুড়িগ্রামে জিটুজি ভিত্তিক প্রস্তাবিত ‘ভুটানিজ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ স্থাপনের সম্ভাবনা যাচাইয়ে এ ভুটান ইতিবাচক হলে কার্যক্রম শুরু করতে বেশি দেরি হবে না।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, কুড়িগ্রামের সোনাহাট স্থলবন্দর হয়ে ভুটানের ফুন্টসলিং এলাকার দূরত্ব কম। মাত্র ১৫০ কিলোমিটার। যাতায়াত সহজ হওয়ায় ভুটানের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি হলে জেলার আর্থসামাজিক অবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে। নতুন নতুন ব্যবসা-বাণিজ্যের দ্বার উন্মুক্ত হবে। পাশাপাশি শিক্ষা, সংস্কৃতির প্রসার ঘটবে। সর্বোপরি জেলার স্থলপথে বহুল প্রতিক্ষিত ইমিগ্রেশন ব্যবস্থা চালু ত্বরান্বিত হবে। সোনাহাট থেকে ঢাকাসহ বাংলাদেশের সব অঞ্চলে যোগাযোগের অন্যতম মহাসড়টিও ইতোমধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে।
চিলমারী নৌবন্দর আমদানি ও রপ্তানিকারক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জামান আহমেদ বলেন, ‘কুড়িগ্রামে নৌ ও স্থলবন্দর-কেন্দ্রিক বাণিজ্য ইতোমধ্যে জেলার অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখছে। অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা হলে তা জেলার ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি এ অঞ্চলের মানুষের আর্থসামজিক অবস্থার উন্নয়নে সহায়ক হবে। আর এতে করে কুড়িগ্রাম সীমান্তে ইমিগ্রেশন ব্যবস্থাও দ্রুত চালু হবে।’
সোনাহাট স্থলবন্দরের সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সরকার রকীব আহমেদ জুয়েল বলেন, ‘সোনাহাট বন্দর ইমিগ্রেশন না থাকায় ব্যবসায় যে প্রাণ থাকার কথা সেটি নেই। কিন্তু বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যবসাবান্ধব বন্দর এটি। ভুটান খুবই কাছে। তিন ঘণ্টার পথ। অর্থনৈতিক অঞ্চল হলে শুধু কুড়িগ্রাম নয়, বাংলাদেশ এর সুবিধা পাবে। সারা দেশের ব্যবসায়ীরা এই পথে ব্যবসা করবেন।’
কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ খবরের কাগজকে বলেন, ‘কুড়িগ্রামের সঙ্গে ভারত ও ভুটানের কানেক্টিভিটি আগে থেকেই ভালো। যেটি আজকে রাষ্ট্রদূত বললেন। জেলার দুটি স্থলবন্দর ও চিলমারী নৌবন্দরের সঙ্গে ভুটানে যোগাযোগ সুবিধা রয়েছে। বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল, কাঁচামাল তৈরির সম্ভাবনা এবং মানবসম্পদ মিলিয়ে কুড়িগ্রামে যৌথ অর্থনৈতিক অঞ্চল হলে এ অঞ্চলের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার ব্যাপক উন্নতি হবে বলে সরকার মনে করছে। আজকে প্রতিনিধি দল এসে দেখার পরে ইতিবাচক কথাই বলেছেন। আশা করা হচ্ছে দ্রুত কার্যক্রম শুরু হবে। এটি বাস্তবায়ন হলে জেলার অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে।’
গোলাম সিরাজ/সাদিয়া নাহার/অমিয়/