![চট্টগ্রামে খুচরা-পাইকারি বাজার কোনোটাই জমেনি](uploads/2024/04/01/1711950224.ctg.jpg)
চট্টগ্রামে এখনো জমে ওঠেনি ঈদবাজার। গত বছরের তুলনায় এবারে পাইকারি ও খুচরা সব বাজারেই বেচাকেনা কম। ক্রেতারা বলেছেন, রোজায় জীবনযাত্রার ব্যয় মিটাতে হিমশিম খাচ্ছি। বোনাস-বেতন বা ব্যবসায়ে বিল পেলে ঈদের কেনাকাটা করতে পারব।
চট্টগ্রামের টেরিবাজার পাইকারি ও খুচরা কাপড় ব্যবসার কেন্দ্রস্থল। খুচরা ব্যবসায়ীরা কাপড়ের জন্য টেরিবাজারের ওপর নির্ভরশীল। বিগত দিনে রোজার মাসের শুরু থেকেই এসব বাজারে ঈদকেন্দ্রিক বেচাকেনা ভালো হয়। কিন্তু এবারে রোজার মাসের অর্ধেক পার হলেও জমে ওঠেনি এ বাজার। চট্টগ্রামের অন্যান্য বাজারেরও একই অবস্থা। আর এতে হতাশা প্রকাশ করেছেন পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতিবছর রমজানের এক মাস আগে থেকেই জমজমাট থাকে পাইকারি কেনাবেচা। দোকানে থাকা আগের মাল বিক্রি হয়ে যায়। পাশাপাশি নতুন মালের বিক্রি চলতে থাকে। এবারে তা হচ্ছে না। এবার বেশ মন্দাভাব ঈদের পোশাক ব্যবসায়।
তারা আরও জানায়, অন্যান্য বছরের এ সময়ে যে পরিমাণ কাপড় বিক্রি হতো এবার তার অর্ধেক বিক্রি হচ্ছে। টেরিবাজারে ছোট বড় সব দোকানেই এমন মন্দাভাব। এ মন্দাভাবের কারণ সাধারণ ক্রেতাদের কাছে অর্থসংকট রয়েছে। মানুষের হাতে টাকা থাকলে ঈদ উপলক্ষ আগে থেকে নতুন পোশাক কিনে ফেলে। কিন্তু এবার টাকা না থাকায় বেচাবিক্রি কম।
সাধারণ ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলেও ব্যবসায়ীদের এমন ভাবনার সত্যতা পাওয়া গেছে। পেশাজীবী ও শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে এখনো ঈদের আমেজ আসেনি। সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বেতন বোনাস হয়নি। চাকরিজীবীদের বেতন-বোনাস হাতে পেলে তার একটি প্রভাব গিয়ে পড়ে পোশাক মার্কেটের ওপর।
চট্টগ্রাম নগরের আন্দরকিল্লা পার হয়ে লালদীঘি যাওয়ার মাঝামাঝি সড়কের বামে প্রবেশ করলেই টেরিবাজার। একশত গজ গেলেই নামিদামি সব কাপড়ের দোকান। মনে রেখ, বৈঠক বাজার, বিনয় ফ্যাশন, পরশমণি, মাসুম ক্লথ স্টোরসহ প্রায় আড়াই হাজার দোকান রয়েছে।
শনিবার (৩১ মার্চ) বেলা ১২টায় টেরিবাজার ঘুরে দেখা গেছে, একেকটি বড় দোকানে যে পরিমাণ ক্রেতা থাকার কথা সেই পরিমাণে নেই। চট্টগ্রামের টেরিবাজার বিনয় ফ্যাশনের মালিক মোহাম্মদ রফিকুল করিম বলেন, ‘বিগত সময় থেকে এবার বেচা-বিক্রি খারাপ। কেনাবেচার সময় পার হয়ে যাচ্ছে কিন্তু ক্রেতা নেই। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার বিক্রি ৫০ শতাংশ কম, এতে পুঁজি হারানোর অবস্থা। দোকানে ১৫ জন কর্মচারী রয়েছেন। তাদের বেতন ভাতা বোনাস দিতে পারব কি না, বুঝতে পারছি না।’
মনে রেখ শপিংমল এ গিয়ে দেখা গেছে, শপিংমলের তৃতীয় তলায় ১০ থেকে ১২ জন কর্মচারী দাঁড়িয়ে আছেন। সবাই এক জায়গাতে দাঁড়িয়ে থাকার বিষয়টি জানতে চাইলে মনে রেখর পরিচালক আবদুল গফুর খবরের কাগজকে বলেন, ‘দোকানের ভেতরে কাস্টমার নেই। ক্রেতারা প্রবেশ করলেই একজন ক্রেতার সঙ্গে একজন কর্মচারী যাবেন কাপড় দেখানোর জন্য। সে জন্য সবাই এক জায়গাতে দাঁড়িয়ে আছেন।’
এদিকে, দ্বিতীয় তলা ও তৃতীয় তলাবিশিষ্ট প্রায় চার থেকে পাঁচ হাজার বর্গফুটের এ শপিংমলে চোখে পড়ার মতো ক্রেতা সমাগম দেখা যায়নি। ক্রেতা না থাকার বিষয়ে আবদুল গফুর বলেন, ‘সাধারণ মানুষের হাতে টাকা নেই। তাই কাপড় কিনছেন না। বর্তমান সময়ে সব কিছুর দাম বেশি। সাধারণ মানুষ জীবনযাত্রার ব্যয় মিটাবেন কীভাবে সেই চিন্তা করছেন। আগে রমজানের এ সময়ে আমরা নিশ্বাস ফেলার সুয়োগ পেতাম না। এখন ক্রেতা না থাকায় কর্মচারীদের অলস সময় পার করতে হচ্ছে।’
সাফা ফেব্রিক্সের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আমিনুর ইসলাম বলেন, ‘আমার দোকানে মহিলাদের থ্রি পিসের থান কাপড় বিক্রি করি। ক্রেতারা কাপড় উল্টেপাল্টে দেখে চলে যায়। বিক্রি করতে পারি না। অনেকে দাম জানতে চেয়ে দাম শোনার পর রেখে দেয়। সব কিছুর দাম বৃদ্ধির এ সময়ে আমাদের টিকে থাকা দায়।’
এক্স-ম্যান নামের দোকানে পুরুষের প্যান্ট, শার্ট, শেরওয়ানি, পাঞ্জাবি, পায়জামা বিক্রি করে। ক্রেতা না থাকায় দোকানের ৫ জন কর্মচারীকে অলস সময় পার করতে দেখা গেছে। দোকানের পরিচালক মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন টিপু বলেন, ‘মানুষের মধ্যে দুর্ভিক্ষ চলছে। না হয় এমন অবস্থা হবে কেন? ২০২৩ সালে ভালো ব্যবসা ছিল। কিন্তু এবার বিক্রি নেই। আমি ২০০৭ সাল থেকে টেরিবাজারে ব্যবসা করছি। এমন অবস্থা আগে কখনো দেখিনি।’
নগরের টেরিবাজারের ‘মাসুম ক্লথ স্টোর’ পাইকারি ও খুচরা কাপড় বিক্রি করে। পাইকারি ব্যবসায় পুরোনো পাইকারদের বাকিতে মাল দিতে হয়। বাকি টাকা জমা দিয়ে বারবার কাপড় নিয়ে যান জেলা উপজেলার খুচরা ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এবার খুচরায়ও ব্যবসা হচ্ছে না উল্লেখ করে ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক জয়নাল আবেদিন মাসুম বলেন, ‘ব্যবসা হলে খুচরা ব্যবসায়ীরা আমাদের কাছে বারবার আসতেন। তারা আগে যে মাল নিয়েছেন সেগুলো এখনো বিক্রি করতে পারেননি। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, উপজেলার হাট-বাজারগুলোতেও কেনাবেচা নেই। আর এর প্রভাব পড়ছে আমাদের ব্যবসার ওপরও। ধার-দেনা করে দেশি-বিদেশি মাল তুলেছি। কিন্তু আশানুরূপ কেনাবেচা নেই। বৈশ্বিক-সংকটের প্রভাব পড়েছে আমাদের ব্যবসার ওপর।’
এদিকে টেরিবাজারে কথা হয় হামজারবাগ থেকে আসা মোতাহেরা বেগম মুক্তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘তিন সন্তানের জন্য ঈদের পোশাক কিনতে এসেছি। কিন্তু এখানে এসে দেখছি প্রত্যেক পোশাকের দাম বেশি। বর্ধিত দামে কাপড় কেনা সম্ভব হচ্ছে না। সব টাকা দিয়ে কাপড় কিনলে সংসার খরচে টান পড়বে। সে জন্য দুই সন্তানের জন্য আজকে কাপড় কিনেছি। আরেকজনের জন্য পরে কিনব।’
টেরিবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আলহাজ আমিনুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘রমজানের এ সময়ে যে পরিমাণ ব্যবসা হওয়ার কথা সে পরিমাণ ব্যবসা হচ্ছে না। তাই টেরিবাজারের ব্যবসায়ীরা হতাশ। আসলে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি, সংসারের খরচ বাড়ায় মানুষের হাতে নগদ টাকা নেই। মানুষ যে অর্থনৈতিক-সংকটে রয়েছে সেটি এবারের ঈদে বোঝা যাচ্ছে। মানুষ আগে ভাত খাওয়ার চিন্তা করে এরপর পোশাকের চিন্তা। চলমান বৈশ্বিক মন্দা ও দেশীয় বাজারে অস্থিতিশীলতার প্রভাবে এবার অনেকেই গত বছরের কাগড় দিয়ে ঈদ করবে, এমনটি আমার মনে হচ্ছে।’