![ইসরায়েলে ইরানের হামলার প্রভাব: কমেছে জ্বালানি তেলের দাম](uploads/2024/04/17/1713344626.oil-rig-gulf.jpg)
সপ্তাহান্তে ইসরায়েলে ইরানের প্রতিশোধমূলক হামলার পর এশিয়ার প্রাথমিক বাণিজ্যে জ্বালানি তেলের দাম কমেছে। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজার আদর্শ ব্রেন্ট ক্রুডের দাম কমেছে, কিন্তু এখনো ব্যারেলপ্রতি ৯০ ডলারের কাছাকাছি বিক্রি হচ্ছে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানের পদক্ষেপের প্রত্যাশায় জ্বালানি তেলের দাম ইতোমধ্যে বেড়েছে। গত সপ্তাহে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম বেড়ে গত ছয় মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। তবে ইরানের হামলার পরে আবার দাম কিছুটা কমেছে।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে চলমান এই সংঘাত কীভাবে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ চেইনকে প্রভাবিত করতে পারে- জ্বালানি তেলের বাজারগুলো তা দেখতে চাইবে।
ব্রিটিশ সম্প্রচার মাধ্যম বিবিসির খবরে বলা হয়, জ্বালানি তেলের দামের ওঠানামা সারা বিশ্বে প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ বিশ্বের দেশগুলো জ্বালানি পণ্যটির ওপর অত্যধিক নির্ভরশীল, যেটি পেট্রল ও ডিজেলের মতো জ্বালানি উৎপাদন করতে ব্যবহৃত হয়। গত কয়েক বছরে বিশ্বব্যাপী জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয়ের পেছনে জ্বালানির দাম একটি প্রধান চালকের ভূমিকা পালন করেছে।
যখন রাশিয়া ২০২২ সালে ইউক্রেন আক্রমণ করেছিল, তখন সরবরাহের আশঙ্কায় তেলের দাম বেড়ে ব্যারেলপ্রতি ১২০ ডলারে পৌঁছে ছিল। কারণ, পশ্চিমা দেশগুলো বিশ্বের অন্যতম প্রধান তেল রপ্তানিকারক রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এই লাফের ফলে শুধু পাম্পগুলোতে জ্বালানি তেলের উচ্চ মূল্যই নয়, বরং অন্যান্য অগণিত পণ্যের দামও বেড়েছে। কারণ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো উচ্চ খরচ কভার করার জন্য তাদের দাম সমন্বয় করে।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, আক্রমণের বিষয়ে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া আগামী দিন এবং সপ্তাহগুলোতে বিশ্ববাজারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট বলেছেন, ইরানের সঙ্গে দ্বন্দ্ব এখনো শেষ হয়নি।
১ এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে হামলার প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার করার পর চলতি সপ্তাহান্তেই ইরান ইসরায়েলের দিকে ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করার পরে দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী এই মন্তব্য করেছেন। বিবিসি জানায়, ইসরায়েল বলেনি যে, তারা কনস্যুলেটে হামলা চালিয়েছে, তবে এটির পেছনে তারা রয়েছে বলে ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হচ্ছে।
খবরে বলা হয়, গত সপ্তাহের শেষে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি ৯২ ডলার ১৮ সেন্ট ছুঁয়েছে, যা অক্টোবরের পর থেকে সর্বোচ্চ। কিন্তু গত সোমবার সেটি প্রায় ৮৯ ডলার ৫০ সেন্টে নেমে এসেছে। এদিকে সোনার দামকে প্রায়শই অনিশ্চয়তার সময়ে নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু এই সময়ে এসে সোনার দামও কমেছে।
শুক্রবার আউন্সপ্রতি ২ হাজার ৪৩১ ডলার ২৯ সেন্টে রেকর্ড সর্বোচ্চ দামে পৌঁছানোর পরে, সোমবার সোনার দাম আবার ২ হাজার ৩৩২ ডলার ৯৭ সেন্টে ফিরে আসে।
জ্বালানি বিশ্লেষক বন্দনা হরি বলেন, জ্বালানি তেলের দাম কমার অর্থই হলো, এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, বাজারে এই সময়ে অতিরিক্ত সরবরাহের ঝুঁকি বিবেচনা করার প্রয়োজন নেই।
কিন্তু ট্রেডিং প্ল্যাটফর্ম এক্সএম ডটকমের পিটার ম্যাকগুয়ার বলেছেন, তিনি ধারণা করেছিলেন যে জ্বালানির বাজার অস্থির হবে এবং ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে ইসরায়েল ইরানের পদক্ষেপের কঠোর প্রতিক্রিয়া জানালে তেলের দাম বাড়বে।
এদিকে ইনসাইট ইনভেস্টমেন্টের বিনিয়োগের প্রধান এপ্রিল লারুস বলেছেন, আমাদের কাছে আরও তথ্য না পাওয়া পর্যন্ত বাজারগুলো সম্ভবত পরোক্ষভাবে বাণিজ্য চালিয়ে যাবে।
‘বিবিসিস টুডে’ অনুষ্ঠানের এক বক্তব্যে এপ্রিল লারুস বলেছেন, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে মধ্যপ্রাচ্যে এই পরিস্থিতি অনেক দিন ধরে চলছে। এ ধরনের ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা যতদিন বেশি স্থায়ী হয়, জ্বালানি তেলের বাজারগুলো তত বেশি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এবং তারা প্রথম দিকেই কোনো আতঙ্কিত প্রতিক্রিয়া দেখায় না।’
এদিকে ইসরায়েলে ইরানের হামলার পরে জ্বালানি তেল ও সোনার পাশাপাশি অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্যেও সংঘাতের প্রভাব ফুটে উঠেছে।
বিবিসি জানায়, সোমবার এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের শেয়ার বাজারগুলোর শেয়ারের দাম হ্রাস পেয়েছে কারণ বিনিয়োগকারীরা আক্রমণের প্রভাবকে পরিমাপ করেছে। যুক্তরাজ্যের ‘এফটিএসই ১০০’ শেয়ার সূচকও শুরুর লেনদেনে সামান্য কমেছে।
বিনিয়োগ সংস্থা এজে বেলের বিনিয়োগ পরিচালক রাস মোল্ড বলেছেন, বাজারগুলো ‘আপেক্ষিক শান্তভাবে সপ্তাহ শুরু করেছে’।
তবে তিনি বলেন, সোনার দাম রেকর্ড উচ্চতার কাছাকাছি থাকা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ক্রমাগত বিচলিত হওয়ার ইঙ্গিত দেয়।
রাস মোল্ড আরও বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে আরও বিস্তৃত সংঘাত, ভূ-রাজনৈতিক ও মানবিক প্রভাবের বাইরেও, জ্বালানির দাম বৃদ্ধি পেতে পারে এবং মুদ্রাস্ফীতি কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সতর্ক প্রচেষ্টাকে অকার্যকর করতে পারে।
ইউএস এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের তথ্য অনুসারে, ইরান বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী এবং ওপেক তেল উৎপাদনকারী কার্টেলের তৃতীয় বৃহত্তম সদস্য।
বিশ্লেষকরা বলছেন, তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি নির্ভর করবে, হরমুজ প্রণালি দিয়ে চলাচলকারী জাহাজগুলোর ওপর প্রভাব পড়বে কি না সেটার ওপর।
এই প্রণালিটি ওমান ও ইরানের মধ্যে অবস্থিত। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শিপিং রুট। কারণ বিশ্বের মোট তেল সরবরাহের প্রায় ২০ শতাংশ এই প্রণালির মধ্য দিয়ে যায়।
ওপেকের সদস্য সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত ও ইরাক প্রণালি দিয়ে বেশির ভাগ তেল রপ্তানি করে।
বিবিসির খবরে বলা হয়, শনিবার হরমুজ প্রণালি দিয়ে যাওয়ার সময় ইসরায়েলের সঙ্গে সংযোগ রক্ষাকারী একটি বাণিজ্যিক জাহাজ জব্দ করেছে ইরান।
ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের এক খবরে বলা হয়, তেহরানের আক্রমণ শুরু করার পরে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের রিপাবলিকান নেতারা প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে বিদ্যমান ব্যবস্থাগুলো কার্যকর করতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য অভিযুক্ত করেছেন এবং তারা বলেছেন যে এই সপ্তাহে ইরানের ওপর থাকা নিষেধাজ্ঞাগুলোকে আরও কঠোর করার জন্য একটি সিরিজ বিল গ্রহণ করবেন তারা।
রবিবার ফক্স নিউজের সঙ্গে কথা বলার সময় প্রতিনিধি পরিষদের রিপাবলিকান প্রতিনিধি স্টিভ স্ক্যালাইজ বলেছেন, প্রশাসন ইরানের জন্য তাদের তেল বিক্রি করা সহজ করে দিয়েছে, যার মাধ্যমে তারা ‘সন্ত্রাসী কার্যকলাপের অর্থায়নে’ ব্যবহার করা হচ্ছে এমন রাজস্ব তৈরি করেছে।
ইরানকে শাস্তি দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক চাপ বাইডেন প্রশাসনের জন্য একটি কণ্টকাকীর্ণ সমস্যা তৈরি করেছে। এই সমস্যাটি এমন যে- আঞ্চলিক উত্তেজনা না বাড়িয়ে, তেলের দাম বাড়ানো বা ইরানের তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা চীনের প্রতি বিরোধিতা না করে কীভাবে ভবিষ্যতে এই ধরনের হামলা ঠেকানো যায় সেই পরিকল্পনা করা।
বেশ কিছু আঞ্চলিক বিশ্লেষক বলেছেন, তারা সন্দেহ করেছেন যে জো বাইডেন ইরানের অপরিশোধিত জ্বালানি তেল রপ্তানি বন্ধ করতে বিদ্যমান মার্কিন নিষেধাজ্ঞাগুলো কার্যকর করার জন্য উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেবেন। কারণ, এই জ্বালানি তেল ইরানের অর্থনীতির প্রাণশক্তি।