দেশের পোশাক খাতের উন্নয়নে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে (ইইউ) সহযোগিতা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)। বিশেষ করে চলমান ‘এভরিথিং বাট আর্মস (ইবিএ)’ স্কিম থেকে জিএসপি প্লাসে উত্তরণের সময়কাল বৃদ্ধি করে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করার অনুরোধ জানানো হয়।
রবিবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ডেনমার্ক, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, স্পেন, ইতালির রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে এক বৈঠকে বিজিএমইএর সভাপতি এস এম মান্নান (কচি) এই আহ্বান জানান।
বৈঠকে বিজিএমইএর সভাপতি বলেন, স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের পরও বাংলাদেশ যাতে করে তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারে, তা নিশ্চিত করার জন্য এই সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিজিএমইএ কমপ্লেক্সে এই বৈঠক হয়। বৈঠকে প্রতিনিধিদলে ছিলেন বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদলের প্রধান ও রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি, ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত ক্রিশ্চিয়ান ব্রিকস-মোলার, জার্মানির রাষ্ট্রদূত আচিম ট্রস্টার, ইতালির রাষ্ট্রদূত আন্তোনিও আলেসান্দো, সুইডেনের রাষ্ট্রদূত আলেকজান্দ্রা বার্গ ভন লিন্ডে, নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের চার্জ ডি-অ্যাফেয়ার্স থিজস ওয়াউডস্ট্রা, ইউ ডেলিগেশনের উপপ্রধান (ডেপুটি হেড অব মিশন) ড. বার্ন্ড স্প্যানিয়ার, স্প্যানিশ দূতাবাসের কমার্শিয়াল অ্যাটাশে এসথার পেরেজ তাহোসেস এবং বাংলাদেশে ইইউ প্রতিনিধিদলের বাণিজ্য উপদেষ্টা আবু সৈয়দ বেলাল।
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন বিজিএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম, সহসভাপতি আরশাদ জামাল (দীপু), মো. নাসির উদ্দিন, মিরান আলী, আবদুল্লাহ হিল রাকিব, পরিচালক আসিফ আশরাফ, মো. ইমরানুর রহমান, শোভন ইসলাম, হারুন অর রশিদ, মোহাম্মদ সোহেল সাদাত, মো. আশিকুর রহমান (তুহিন), শামস মাহমুদ, আবরার হোসেন সায়েম, মো. মহিউদ্দিন রুবেল, শেহরিন সালাম ঐশী, মো. নুরুল ইসলাম, সাইফুদ্দিন সিদ্দিকী সাগর, মো. রেজাউল আলম (মিরু) এবং বিজিএমইএ স্ট্যান্ডিং কমিটি অন আইএলও অ্যান্ড লেবার অ্যফেয়ার্সের চেয়ারম্যান আ ন ম সাইফুদ্দিন।
বৈঠকে বিজিএমইএর পক্ষ থেকে দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের বিভিন্ন দিক, বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা এবং শ্রমিকদের কল্যাণের মতো ক্ষেত্রগুলোতে শিল্পের অর্জন তুলে ধরা হয়। এ সময় ডিউ ডিলিজেন্স ডিরেকটিভ ও অন্য আসন্ন প্রটোকলগুলো অনুসরণ করার ক্ষেত্রে শিল্পের সক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্য ইইউর সহযোগিতা কামনা করেন বিজিএমইএর সভাপতি এস এম মান্নান।
সবচেয়ে বড় বাণিজ্য ও উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে ইইউর সহযোগিতা বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে বিজিএমইএ সভাপতি বাংলাদেশের পাশে থাকার জন্য ইইউর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। সেই সঙ্গে তিনি পণ্যের ন্যায্যমূল্য ও এথিক্যাল সোর্সিং নিশ্চিত করতে ইউরোপীয় ক্রেতাদের আহ্বান জানানোর জন্য রাষ্ট্রদূতদের অনুরোধ করেন। এ সময় বিজিএমইএ নেতারা অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে ইইউর সঙ্গে অংশীদারত্ব আরও জোরদার করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।
বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশ অবদান পোশাক খাতের। আবার এই পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপ। চীনের পর ইউরোপে দ্বিতীয় পোশাক সরবরাহকারী বাংলাদেশ। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) তথ্যমতে, দেশের মোট পোশাকের ৫০ শতাংশ রপ্তানি হয় ইইউভুক্ত ২৭টি দেশে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪ হাজার ৬৯৯ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়। তার মধ্যে ইইউতে রপ্তানি হয় ২ হাজার ৩৫৩ কোটি ডলার। এই অঞ্চলে দেশের পোশাক খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ৪ শতাংশ।
এই কারণে বাংলাদেশের পোশাক খাতকে এগিয়ে নিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূমিকা একটি বড় ব্যাপার। কিন্তু সম্প্রতি ইউরোপীয় পার্লামেন্টে পাস হওয়া করপোরেট সাসটেইনেবিলিটি ডিউ ডিলিজেন্স ডিরেক্টিভ বা সিএসডিডিডি আইন পোশাক খাতকে প্রভাবিত করতে পারে। এ ছাড়া ২০২৯ সালের পর জিএসপি সুবিধা চলে গেলেও পোশাক খাত বড় ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। এ কারণে উভয়পক্ষের মধ্যে সমঝোতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ডিউ ডিলিজেন্স ডিরেক্টিভ আইনটি কার্যকর হলে বাংলাদেশের পোশাককারখানাগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে পরিবেশ ও শ্রমবান্ধব করতে হবে। নতুন করে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি বাড়াতে হবে শ্রমের মজুরি। এই আইন বাস্তবায়িত হলে বড় পোশাককারখানাগুলো সক্ষমতা অর্জন করে টিকে থাকতে পারলেও চাপে পড়বে ক্ষুদ্র ও মাঝারিশিল্প। এই কারণে একটি বড় অংশীদার হিসেবে ইইউর সঙ্গে এই আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে মনে করছেন এই খাতের ব্যবসায়ীরা।
যদিও নতুন কমিটি দায়িত্ব নেওয়ার বিজিএমইএর নেতাদের সঙ্গে এটি ছিল প্রতিনিধিদলের দলের সৌজন্য সাক্ষাৎ। তবে ভবিষ্যতে ইইউর সঙ্গে সম্পর্ককে আরও অনন্য উচ্চতায় নিতে এর ভূমিকা অনেক বলে মনে করেন পোশাক খাতসংশ্লিষ্টরা।
বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিএমইএর পরিচালক শোভন ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘এটা আমাদের একটি দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ছিল। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ডিউ ডিলিজেন্স ল এবং আরও অনেক নীতিমালা সামনে আসছে। আমরা তাদের বলেছি, দেখ আমরা এসব খাতে অনেক বিনিয়োগ করেছি। তারা আমাদের এসব ব্যাপার নিয়ে খুশি।’
শোভন ইসলাম বলেন, ‘ইউরোপ আমাদের বড় বাজার। আমরা মূলত সেখানে আমাদের মার্কেট শেয়ার বাড়ানোর বিষয়ে কাজ করছি। তবে আমরা যদি ব্যবসায়িক নীতিগুলো বাস্তবায়ন করি তাহলে সেখানে আমাদের বাজার এমনিতেই আরও বড় হবে।’
স্প্যারো অ্যাপারেলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, ‘আমরা তাদের জানিয়েছি যে, ইউরোপ আমাদের খুব ভালো একটি উন্নয়ন সহযোগী। আমরা প্রতিনিয়ত সেখানে মার্কেট শেয়ার বাড়িয়ে যাচ্ছি। চায়নার কাছ থেকে আমরা মার্কেট শেয়ার তাদের দিতে চাই। এ কারণে তাদের সহযোগিতা আমাদের একান্ত প্রয়োজন।’
শোভন ইসলাম বলেন, ‘আমরা তাদের জানিয়েছি যে, গত কমিটিতে আমরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ভালো কাজ করেছি। এই কমিটিও তাদের সঙ্গে আরও ভালোভাবে কাজ করতে চাই। এ ক্ষেত্রে তাদের পক্ষ থেকে যেমন সহযোগিতা থাকবে তেমনি আমাদের পক্ষ থেকেও থাকবে। এ জন্য আমরা তাদের নীতিমালাগুলোকে বাস্তবায়ন করব বলেও জানিয়েছি।’
ইসমাঈল/