বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করেছে সিনেমার গান। অ্যালবামে প্রকাশ পাওয়া গানের চেয়ে হিসাব করলে সংখ্যার দিক দিয়ে সিনেমার গানই বেশি কালজয়ী হয়েছে। সিনেমার গান নিয়ে শ্রোতাদের মধ্যেও উন্মাদনা বেশি থাকে সব সময়। আশি ও নব্বইয়ের দশকে সিনেমায় যেসব গান হতো বলতে গেলে প্রায় সব গানই শ্রোতাদের মুখে মুখে ফিরত। যুগের বিভিন্ন ডালপালা ভেঙে সেসব গানই আজ কালজয়ী গানের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে।
নব্বইয়ের দশকের পর বর্তমান সময় পর্যন্ত নির্মিত অনেক সিনেমার গানও তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে সেটা সংখ্যার তুলনায় কম। আগে সিনেমার গান তৈরি করতেন খ্যাতিমান সুরকার গীতিকবিরা। আলতাফ মাহমুদ, খান আতাউর রহমান, সত্য সাহা, আনোয়ার পারভেজ, আলাউদ্দীন আলী, আলী হোসেন, আলম খান, শেখ সাদী খান, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান, কে জি মোস্তফা, নজরুল ইসলাম বাবু, খন্দকার ফারুক আহমেদ, আমজাদ হোসেন, প্রণব ঘোষ প্রমুখ।
এসব খ্যাতিমান গীতিকার সুরকার সংগীত পরিচালকদের গানেই জগৎ বিখ্যাত হয়েছেন শাহনাজ রহমতুল্লাহ, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীন, মাহমুদুন্নবী, সৈয়দ আব্দুল হাদী, আব্দুল জব্বার, বশির আহমেদ, নিলুফার ইয়াসমীন, আবিদা সুলতানা, রফিকুল আলম, খুরশিদ আলম, সুবীর নন্দী, তপন চৌধুরী, কুমার বিশ্বজিৎ, লাকী আখন্দ, ফেরদৌস ওয়াহিদ, শাম্মী আখতার, এন্ড্রু কিশোর, শাকিলা জাফর, কনকচাঁপা, সামিনা চৌধুরী, বেবী নাজনীন, ডলি সায়ন্তনী, মনির খানসহ আরও অনেক শিল্পী।
দেশীয় শিল্পীদের পাশাপাশি সিনেমার গানে কণ্ঠ দিতেন ভারতের নন্দিত শিল্পীরাও। গান তৈরির ক্ষেত্রে সুরকার ও গীতিকবির সংখ্যাও যেমন বেশি ছিল, তেমনি শিল্পীর সংখ্যাও ছিল অনেক। তবে তখন একটা সিনেমার সব গান একজন সুরকার সংগীত পরিচালকই তৈরি করতেন। শিল্পী বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও ছিল ভিন্নতা। অর্থাৎ যে গানটির জন্য যার কণ্ঠ প্রয়োজন হতো তাকে দিয়েই সেই গানটি গাওয়ানো হতো।
কিন্তু বর্তমানে সিনেমার গানের চিত্র পাল্টে গেছে। এখন একটা সিনেমার গান একজন সুরকার ও সংগীত পরিচালক তৈরি করেন না। সিনেমায় যদি পাঁচটি গান থাকে তবে সেই গানগুলো তৈরি করেন দুই বা তিনজন সংগীত পরিচালক। শিল্পীর ক্ষেত্রেও আর নেই ভিন্নতা। ঘুরেফিরে একই কণ্ঠ ও একই মুখ। বর্তমান সময়ে তৈরি অধিকাংশ সিনেমার গানে কণ্ঠশিল্পী কনা, কোনাল, ইমরানের কণ্ঠই বেশি শোনা যায়। তবে মাঝে মাঝে বালাম, প্রীতম হাসান, ন্যানসি, আতিয়া আনিসা, অবন্তী সিঁথি, হাবীব ওয়াহিদ, হৃদয় খান ও বেলাল খানের কণ্ঠও শোনা যায়। তবে সেটাও হাতেগোনা।
কিন্তু বর্তমানে সিনেমার গানগুলো কনা, কোনাল ও ইমরানের দখলেই বেশি। এটা কী বিশেষ কোনো সিন্ডিকেট নাকি যোগ্যতা? এই প্রশ্নও মাঝে মাঝেই ওঠে সংগীতাঙ্গনে। আগের দিনে সিনেমার গানগুলোয় অনেক শিল্পীর কণ্ঠ শোনা গেলেও বর্তমানে প্রায় প্রতিটি সিনেমায় এই তিনজন শিল্পীর কণ্ঠই বেশি শোনা যায়।
অথচ একসময়ের প্লেব্যাকে নিয়মিত কনকচাঁপা, সামিনা চৌধুরী, ন্যানসি, মনির খান, আসিফ আকবর গানে সরব থাকলেও সিনেমার গানে তাদের উপস্থিতি একেবারেই হাতের কড়গুনে বের করা যাবে। এ ছাড়া ক্লোজআপ ওয়ান তারকা লিজা, সেরাকণ্ঠ বিজয়ী ঝিলিক, জিনিয়া জাফরিন লুইপা, কিশোর দাস, সাব্বির জামান, মুহিন, মৌমিতা নদী, পড়শী, খেয়ার শিল্পীদের সিনেমার গানে পাওয়া যায় না।
যখন এসব ভালো এবং জনপ্রিয় শিল্পীদের দিয়ে সিনেমার গান গাওয়ানো হয় না, তখন সিন্ডিকেটের প্রশ্ন আরও বেশি প্রবল হয় মিডিয়া পাড়ায়এ সম্পর্কে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত খ্যাতিমান সুরকার ও সংগীত পরিচালক শওকত আলী ইমন খবরের কাগজকে বলেন, ‘এটা অবশ্যই সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেট ছাড়াতো এটা সম্ভব নয়। ঘুরেফিরে সব কাজ তিন-চারজনই করছে, বাকিরা কি যোগ্য না? তাদেরই সব যোগ্যতা আছে!’
তিনি আরও বলেন, ‘আমিও এক সময় অনেক বেশি কাজ করেছি, তখন যারা যোগ্য তাদের দিয়েই কাজ করাতাম। তখন সিন্ডিকেট ছিল না। এখন কাজ কমিয়ে দিয়েছি। তবে এই সিন্ডিকেট বেশিদিন টিকবে না। হয়তো এটা ভেঙে আবার নতুন কোনো সিন্ডিকেট আসবে। তবে আমরা কোনো সিন্ডিকেট চাই না। যোগ্যরা সঠিক জায়গায় পৌঁছাক। সিনেমার গান সিন্ডিকেট মুক্ত হোক।’
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত সুরকার ও সংগীত পরিচালক ইমন সাহা বর্তমানে আমেরিকার ফ্লোরিডা রয়েছেন। সেখান থেকে খবরের কাগজকে বলেন, ‘সিন্ডিকেট আগেও ছিল, এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। কাজের জন্য কেউ কেউ হয়তো পিআর মেইনটেইন করেন, এটা আসলে দোষের কিছু নয়। আর আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি সব সময় সূর্যের আলো যেদিকে থাকে সেদিকেই চলে। যারা কাজ করছেন তাদের যোগ্যতা আছে। এখন হয়তো তারা নিয়মিত কাজ করেন, এক সময় তাদের জায়গা অন্য কেউ নেবে এটাই স্বাভাবিক।’
সিনেমার গান নিয়ে সংগীত পরিচালক রিপন খান সম্প্রতি তার ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘সিনেমার গানগুলো বেশির ভাগ একইরকম! নতুনত্ব নেই বললেই চলে। একই রকম কণ্ঠ, একই টিউন এবং মিউজিক। একই নাচ, দৃশ্য!’
জনপ্রিয় গায়িকা লুইপা বলেন, ‘একটা সিনেমায় বিভিন্ন ধরনের গান থাকে। আগেকার দিনে যখন গুণী সংগীত পরিচালকরা গান তৈরি করতেন, তখন তারা যে গানের জন্য যার কণ্ঠ ভালো মানাবে তাকে দিয়েই গান গাওয়াতেন। এখন সেটা হয় না। এখন সিনেমায় গানের জন্য শিল্পী নির্ধারণ করেন পরিচালক ও প্রযোজক। ঘুরেফিরে দুই-তিনজন শিল্পীকেই সিনেমার গানে দেখা যায়। সিনেমার গানের জন্য পরিচালক ও প্রযোজকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করতে হয়, মাঝে মাঝে বসতে হয় চা কফি খেতে। এই যোগ্যতা আমার নেই তাই হয়তো সিনেমার গানে আমাকে ডাকা হয় না। তবে গানের মাধ্যমে শ্রোতাদের কাছে যে ভালোবাসা পাচ্ছি সেটা অনেক।’
সেরাকণ্ঠ চ্যাম্পিয়ন গায়িকা ঝিলিক বলেন, ‘সিনেমার গানে যদি আমাকে কেউ না ডাকে, তাহলে আমি নিজে নিজে তো আর গান গাইতে পারব না। ঘুরেফিরে তিনজন শিল্পীই প্রায় সব সিনেমার গানেই থাকছেন। এই তিন- চারজন ছাড়া শিল্পীর নাম বলতে গেলে হিসাব করে বের করতে হয়। আমি দেশ ও দেশের বাইরে নিয়মিত স্টেজ শো করছি। দেশের বাইরে দেশকে রিপ্রেজেন্ট করছি। তারপরও কেউ যদি আমাকে না ডাকে আমার তো কিছু করার নেই। হয়তো আমার নিজেরই যোগ্যতা নেই সিনেমায় গান করার। আমি তো কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারি না। তবে যেহেতু নির্দিষ্ট কয়েক শিল্পী সিনেমার সব গানে কণ্ঠ দিচ্ছেন, এটা অবশ্যই সিন্ডিকেট।’
কণ্ঠশিল্পী ও সংগীত পরিচালক কিশোর দাস বলেন, ‘সিন্ডিকেট আছে এটাই আমি জানি না। আর যদি সিন্ডিকেট থেকে থাকে, তাহলে এটা ওপেন করে দেওয়া হোক, আমরাও জানতে চাই এই সিন্ডিকেটের অংশ হতে হলে কী কী যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন। তখন আমরাও পরীক্ষা দেব। এ ছাড়া সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে, গান তো সব ভারতে চলে যাচ্ছে। তারা তো আর জানে না বাংলাদেশের কোন শিল্পী কোন গান ভালো গাইতে পারবেন। নিশ্চয়ই তাদের কাছে বাংলাদেশ থেকে শিল্পীদের নাম ও রেফারেন্স যায়। আর গান তো সব একই রকম হচ্ছে। আমাদের দেশের সংগীত পরিচালকরা গান তৈরি করলে তারা অবশ্যই অন্য শিল্পীদের কণ্ঠ গানে ব্যবহার করতেন।’
জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাতা রায়হান রাফি বলেন, ‘আমার ক্ষেত্রে কোনো সিন্ডিকেট কাজ করে না। কারণ আমার সিনেমার জন্য যাকে প্রয়োজন তাকেই ডাকি। আমি অনেক নতুন শিল্পীকে দিয়েও আমার সিনেমার গান করিয়েছি এবং জনপ্রিয় হয়েছে। আমার মনে হয় যার যোগ্যতা আছে, শেষ পর্যন্ত সেই টিকে থাকবে।’
চলচ্চিত্র নির্মাতা অনন্য মামুন বলেন, ‘আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে কিছু রিকুয়েস্ট আগেও ছিল, এখনো আছে। তবে আমাদের মিউজিক ডিরেক্টররা নতুন কোনো শিল্পীকে দিয়ে এখন এক্সপেরিমেন্ট করতে চান না। এ ছাড়া পরিচালক এবং প্রযোজকও একটু সেইফ গেইম খেলতে চান এখন। সবকিছু মিলিয়ে এটা আসলে সময়ের চাহিদা। সিনেমায় ইমরান, প্রীতমের একটা গান লাগবেই, আবার আইটেম গান হলে সেটা কনাকে বাছাই করা হয়। আমি বলব, এটা আসলে সময়ের চাহিদা।’
জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী কনা বলেন, ‘সিন্ডিকেট শব্দটার সঙ্গে আমি পরিচিত না। আমি এটা বুঝিও না। আমাকে যারা ডাকে, গান গাইতে বলেন আমি শিল্পী হিসেবে কাজ করি। এ শব্দটা আমি আপনাদের কাছেই শুনতেছি। সারা পৃথিবীতে যারা যোগ্য তারাই কাজ করেন। আমি কোনো সিন্ডিকেটে নেই।’
এ সম্পর্কে জানতে কণ্ঠশিল্পী কোনালের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তার সাড়া মেলেনি।
তবে গান-সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, সিনেমার গানের ভিন্নতা আনতে অবশ্যই আরও শিল্পীর কণ্ঠ ব্যবহার করা প্রয়োজন। তাতে করে সিনেমার গান আরও বেশি মানসম্পন্ন হবে।
/শাকিল