দেশের অন্যতম ফ্যাশন হাউস সারা লাইফস্টাইলের পরিচালক শরীফুন রেবা। দীর্ঘ সময়ের পথচলায় ক্রেতাদের মন জয় করে বর্তমানে সারা হয়ে উঠেছে দেশের প্রথম সারির ফ্যাশন হাউস। সম্প্রতি এক আড্ডায় সারা লাইফস্টাইলের পরিচালক আমাদের সঙ্গে শেয়ার করেছেন নিজের ফ্যাশন ভাবনা ও ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা। সেই আড্ডার চুম্বকীয় অংশ তুলে ধরেছেন ফিচার সম্পাদক খালেদ আহমেদ
দেশীয় পোশাক বিভিন্ন বিদেশি ফ্যাশনের মিশ্রণ নতুন কিছু নয়। আপনি এই মিশ্রণকে কীভাবে দেখেন?
আমি ব্যাপারটা ইতিবাচকভাবে দেখি, আসলে কাস্টমাইজ করেই তো ফ্যাশন স্টাইল। আমাদের দেশের মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন, সব ধরনের কাপড় পরে, আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন দেখতাম একই ধরনের স্টাইল। এখন দেখি প্রতি ধাপে ধাপে ট্রেন্ড পরিবর্তন হচ্ছে, এগুলো আমরা বিশ্ব ফ্যাশন থেকেই নিচ্ছি, দেশ আলাদা হলে, বিশ্ব কিন্তু একই, সবাই সবাইকে অনুকরণ করছে, সবাই সবারটা দেখছে, সেটা আবার ভাগ করে নিচ্ছে। ফ্যাশন অনেক আগে থেকেই মিশ্রণ হচ্ছে, এটা নতুন কিছু না। তবে এখন ফ্যাশন সম্পর্কে মানুষ জানে এবং খবর রাখে। এখান থেকে আমরা নতুন নতুন আইডিয়া পাচ্ছি, যা আমাদের জন্য ভালো হচ্ছে। তাই দেশীয় পোশাক বিভিন্ন বিদেশি ফ্যাশনের মিশ্রণটি আমি ইতিবাচকভাবেই দেখি।
বাংলাদেশের পোশাক সেক্টরে ভারতীয় ও পাকিস্তানি কাপড়ের বড় একটা বাজার আছে। এ বিষয় আপনার মতামত কি?
মুক্তবাজার অর্থনীতিতে পৃথিবীর সব দেশেই এখন আমাদের পোশাক যাচ্ছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তান থেকে আমাদের দেশে বিভিন্ন রকমের তৈরি পোশাক কিংবা কাপড় আসছে।
আমি এটা কোনোভাবেই খারাপ ভাবে দেখি না, একটা পরিবারের পাঁচজন সদস্য থাকলে, একেক জনের পছন্দ একেক রকমের, তারা যে কোনো জিনিস পছন্দ করতে পারে সেটা তার ব্যাপার। কিছু মানুষ আছে সে দেশীয় পরতে চায়, আবার কেউ যদি ভারতীয় পোশাক পরতে চায় এটা একান্ত তাদের ইচ্ছা। আমি অনেক ক্রেতাকে জানি যারা কখনো ভারতীয়, পাকিস্তানি পোশাক কিনে না। তারা দেশি পোশাকই পরতে পছন্দ করে। তাই আমি মনে করি এটি সম্পূর্ণ ক্রেতার ওপর নির্ভর করে তারা কি পরবে। আমি মনে করি না যে, ভারতীয়, পাকিস্তানি পোশাক আমাদের দেশীয় পোশাকের ওপর নেতিবাচক কোনো প্রভাব ফেলছে। আমরা একটা ফ্যাশন ব্র্যান্ড চালাচ্ছি, আমি মনে করি না তাদের দ্বারা আমরা কোনো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।
এবারের ঈদে সারা লাইফস্টাইল কোন ধরনের পোশাক এনেছে?
সারা সব সময় ট্রেন্ড অনুযায়ী পোশাকে নতুনত্ব নিয়ে আসে, এবারের ঈদে আমরা স্ক্রিন প্রিন্টের ওপর পোশাক এনেছি, গত ঈদের স্ক্রিন প্রিন্টের পোশাকে বেশ ভালো সারা পেয়েছি, ক্রেতাদের ব্যাপক চাহিদা ছিল যে স্ক্রিন প্রিন্টের ওপর নতুন ডিজাইনের পোশাক আনার। কাটে ছাটে নতুন প্যাটার্নের ট্রেন্ড অনুযায়ী কিছু টু-পিস এনেছি। এ ছাড়া নতুন সংযোজনের সাবলিমেশন প্রিন্ট, কারচুপি, এমব্রয়ডারি, অল ওভার প্রিন্টের পোশাক এসেছে। পোশাকের মোটিফ ও নকশায় রাখা হয়েছে উৎসবের আমেজ। মেয়েদের জন্য শাড়ি, থ্রি-পিস, টপস, আনারকলি থ্রি-পিস, কুর্তি, কো-অর্ডস, ডেনিম প্যান্ট, শ্রাগ, ওয়ান-পিস, টু-পিস, স্কার্ফ, শারারা, কাফতান, টি শার্ট এনেছি। প্রিন্সেস লাইন, ডাবল লেয়ার, এ লাইন, সিমেট্রিক, এসিমেট্রিক বিভিন্ন কাজ রয়েছে পোশাকগুলোর প্যাটার্নে। ছেলেদের জন্য এক্সক্লুসিভ পাঞ্জাবি এসেছে, যেগুলো যেকোনো অনুষ্ঠানে পরতে পারবেন। এ ছাড়া ক্যাজুয়াল শার্ট, ফরমাল শার্ট, টি শার্ট, পোলো শার্ট, ডেনিম প্যান্ট, চিনো প্যান্ট, কার্গো প্যান্ট, কোটি, পায়জামা রয়েছে। শিশুদের ক্ষেত্রে নতুন পোশাক, এনেছি, পরিবারের সবার জন্য একই ডিজাইনের পোশাক আছে।
পোশাক তৈরিতে প্রধানত কী ধরনের সুতা, রং এবং কাপড় ব্যবহার করছেন?
আমরা কেমিক্যাল রিলেটেড যেকোনো ব্যাপারে খুবই সচেতন থাকি। আমাদের টেস্টিং ল্যাব আছে, যেখানে প্রতিটি প্রোডাক্টের সুতা, রং এবং কাপড় পরীক্ষা করা হয়, কোনো ক্ষতিকর উপাদান আছে কিনা, যা শরীর ও ত্বকের ক্ষতি করবে কিনা, ল্যাব পরীক্ষার ১০০% পজিটিভ রেজাল্ট আসলেই তারপর সেটা দিয়ে পোশাক তৈরি করা হয়। আপনাদের যাত্রা শুরু থেকে এ পযর্ন্ত কোন কোন ডিজাইন বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে বলে আপনি মনে করেন?
আপনাদের তৈরি কোন ডিজাইন ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল?
সব ফ্যাশন হাউসের নিজস্ব কিছু স্টাইল থাকে, সারা কিছু কিছু ক্ষেত্রে নতুনত্ব নিয়ে এসেছে যেমন- ডেনিম নিয়ে আমরা বেশ আলাদা কাজ করেছি। ডেনিমের শাল, কুর্তি এগুলো নতুন মাত্রা যোগ করেছে আমাদের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে। এ ছাড়া উইন্টার জ্যাকেটেও আমাদের অনেক নতুনত্ব নিয়ে এসেছি।
সারা লাইফস্টাইলের শুরুর দিকে আপনার যে স্বপ্ন ছিল তারই প্রতিফলন আজকের অবস্থান। আগামী পরিকল্পনা জানতে চাই?
সারা লাইফস্টাইলে বর্তমানে মোট ১৪টি আউটলেট আছে। আমরা চাই সারা দেশে আউটলেট করার। পুরো দেশের মানুষ সারা থেকে পোশাক কিনতে পারবে এমন একটা জায়গায় সারা লাইফস্টাইলকে নিয়ে যেতে। তাই দেশের মধ্যেই আগে ব্যাপক পরিসরে আগাতে চাই, এই বছর ৪টি আউটলেট ওপেন করার ইচ্ছা আছে। আন্তর্জাতিকভাবে যেতে সারা লাইফস্টাইলের আরেকটু সময় লাগবে। আমরা সব সময় আমাদের গ্রাহকদের রুচির কথা মাথায় রেখে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভিন্ন কিছু করার জন্য ডিজাইন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করি। যদিও আমরা দীর্ঘদিন ধরে রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তবুও আমরা খুচরা ব্যবসায় নতুন। আমরা প্রতিনিয়ত শিখছি। দেশে ভালোভাবে কাজ করে তারপর আন্তর্জাতিকভাবে যাওয়ার ইচ্ছা আমাদের। এ ছাড়া আমরা আগামীতে সব জেলা শহরে যেতে চাই।
সারা লাইফস্টাইলের কো-ব্র্যান্ড ঢেউয়ের পোশাকের বৈশিষ্ট্য নিয়ে বলুন।
কো-ব্র্যান্ড ঢেউ আসলে আমরা টিনএজ আর ভার্সিটি পড়ুয়াদের জন্য এনেছি, এখনকার প্রজন্ম অনেক এগিয়ে গিয়েছে। তারা বিশ্বের সব ফ্যাশন সম্পর্কে জানে এবং জেনে সেই রকম পোশাক পরতে পছন্দ করে। সারা লাইফস্টাইলে ওয়েস্টার্ন পোশাক ডিজাইন করত না, তাই অনেক তরুণী তাদের পছন্দের পোশাক খুঁজে পেত না। তাই ওয়েস্টার্ন পোশাক থেকেই ঢেউ করা, আর ভালো সাড়াও পেয়েছি। সারা যেমন জনপ্রিয় হয়েছে, ঢেউও কোনো অংশে কম নয়। একেবার নতুন হিসেবে বেশ ভালো করছে।
বাংলাদেশের মানুষ গত প্রায় ১০ বছরে অনেক বেশি ফ্যাশন সচেতন হয়েছেন। এ বিষয়ে কী বলবেন?
বাংলাদেশের মানুষ এখন যে পরিমাণে ফ্যাশন সচেতন, সেটা কয়েক বছর আগেও দেখা যায়নি। এখন যেকোনো ট্রেন্ডটা তারা নিজেদের মধ্যে নিয়ে নিয়েছে, সামাজিক মাধমের একটা বড় ভূমিকা আছে। পাশের দেশের ফ্যাশন ডিজাইনার মণিশ মালহোত্রা, সব্যসাচীর পোশাকের চাহিদা আমাদের দেশে অনেক বেশি। তাদের পোশাক আমাদের দেশে বেশ প্রভাব ফেলেছে। আমি দেখছি ঘুরে ফিরে আমাদের দেশের পোশাকে এগুলোরই প্রতিফলন। দেখেন আমরা শুরুতে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে টার্গেট করে পোশাক তৈরি শুরু করলেও এখন কিন্তু সব শ্রেণির মানুষের কাছে সারা লাইফস্টাইলে পোশাকের চাহিদা ব্যাপক। আর আমাদের নতুন ক্রেতাদের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে।
বাংলাদেশের ফ্যাশন এবং ঐতিহ্যকে বিস্তৃতভাবে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় বলে মনে করেন?
আমাদের স্বচ্ছ থাকতে হবে। আমরা একটা প্রোডাক্ট বানাচ্ছি, সেটার মধ্যে সততা থাকতে হবে। আন্তর্জাতিক ট্রেন্ডটা ঠিক মতো ধরে সেটার সঙ্গে মিলিয়ে দেশীয় স্টাইলে পোশাক বানাতে পারি। দেখেন এখন প্রজন্ম একেবারে ট্রেডিশনাল পোশাকের চেয়ে ট্রেন্ডিং ট্রেডিশনাল পোশাক পরতে পছন্দ করে। আর আমরা যদি আন্তর্জাতিকভাবে যেতে চাই, তাহলে তাদের সঙ্গে মিল রেখেই আমাদের ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে পারব। সেটা মাথায় রেখে আসলে কাজ করতে হবে। আমাদের লক্ষ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি একটাই- কম দামে মানসম্পন্ন পণ্য সরবরাহ করা। আমরা এই আদর্শকে ধরে রাখতে চাই।
কলি