![শ্রেষ্ঠ রাঁধুনি পুরস্কার](uploads/2024/01/05/1704434381.uponoash.jpg)
সূর্য অস্ত গিয়েছিল অনেক আগে। অস্তমিত সূর্যের শেষ রশ্মি পশ্চিমের আকাশে ছোপ ছোপ রক্তের মতো আটকে ছিল। আর আটকে ছিল একটি ভুখারি কাকের চোখ এক কাকচক্ষু কুমারীর চোখে।
সারা দিন অন্ন জোটেনি কাকের। ডানাভাঙা বলে উড়তে পারে না। মেয়েটি একমুঠো খুঁদকুড়ো দিলেই বাঁচোয়া। কিন্তু দিন গিয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে দিকে দিকে। কখন জুটবে খাবার, জানে না সে।
সাঁঝের আঁধারে জীর্ণ ঘরের দাওয়ায় বসে ছিল রুকু। একাকী। সন্ধ্যা-আঁধারে ঢেকে গেছে চারদিক। নিজেও সে ক্ষুধার্ত। সেই দুপুরে বাবা গেছে। বাপ-বেটিতে সকালের বাসি পান্তা খেয়েছে। আর কিছু পেটে পড়েনি সারা দিন। অপেক্ষা, কখন আসবে বাবা দিনের ইনকাম দিয়ে চাল-ডাল নিয়ে।
ঘরের চাল ঘেঁষে বড় হওয়া চালতার ডালে প্রতিদিনের লেজঝোলা পাখিটি এসে বসেছে। তার হলুদ পাখায় জমা সন্ধ্যার শিশির মুক্তোর মতো ঝরে ঝরে পড়ছে। কিন্তু মুখরা পাখিটির ঠোঁটে গান নেই। যেন-বা কোনো এক অজানিত অনুভব এ জীর্ণ অঙ্গনে উপস্থিত প্রতিটি প্রাণীর কণ্ঠ চিরদিনের মতো স্তব্ধ করে দিয়েছে।
রুকুর পা উঠতে চাইছে না। তার পরও উঠল। সন্ধ্যা বলে কথা। প্রথমে বারান্দার টিমটিমে লাইট জ্বালাল সে, তারপর রেকাবিতে ঢাকা বিলিম্বি ভেজানো চালের পানি ছাড়িয়ে দিল। বাবাকে বারবার বলে দিয়েছে তার বহুদিন ধরে চর্চা করা বিলিম্বি ধোয়া চালে মাষকলাই, মাওয়া আর জায়ফল দিয়ে খিচুড়ি রাঁধবে আজ। এসব আনতে বাবার মনে থাকে কি না কে জানে। চাল কেনাই যেখানে অনেক কিছু।
কলেজপড়ুয়া একরত্তি মেয়ের কোনো আবদারই পূরণ করতে পারেন না হাসান আলী। লোকে তাঁকে কখনো কবি আবার কখনো পটুয়া ডাকে। কারণ তিনি পথচলতি মানুষের হাতে পট আঁকেন আর তার নিচে থাকে মনের মাধুরী মেশানো কবিতার লাইন। তাঁর রোজগার বলতে এইটাই। এখন অবশ্য টিয়া গণক হারাধন মল্লিক আর মসজিদের ক্যানভাসার হালিম শাহ্-এর সঙ্গে জুটি হয়েছে তাঁর। কিন্তু তিনজন মিলেও আক্রার বাজারে জুতসই ইনকাম করতে পারেণ না। আদর্শ স্কুলের মোড়ে দিন শেষে তিন বন্ধুর চোখের রেখা অস্তায়মান দিনের মতো আঁধারে ঢাকা পড়ে। সেখানে তারারা ঝিলিক মারে না কোনোদিন। কখনো চলন্ত গাড়ির আলোয় চোখের পানি চমকে ওঠে কেবল।
মায়ের দোয়া পরিবহন আসার সঙ্গে সঙ্গে মাইকে ঝড় তোলে হালিম শাহ্-
ইয়া মুসলমান,
বোবার মতো চেয়ে থাকবে জিন ও ইনসান
যেদিন বন্ধ হবে জবান
শুধুমাত্র কথা বলবে সদকায়ে দান।
ইয়া মুসলমান।
কবি হাসান আলীর কবিতার জোরে কখনো দু-একজন যাত্রী এক টাকা কী দুই টাকা ছুড়ে দেয়। বাস চলে গেলে হালিম শাহ্ চুক্তি অনুযায়ী মানুষের দানের মসজিদের প্রাপ্য অংশ দানবাক্সে ঢুকিয়ে রাখে। বাকি অংশ তিন বন্ধুতে দিন শেষে ভাগ করে নেয়। অন্য দুজনের ইনকামও একই। কিন্তু তিনজনের যৌথ প্রচেষ্টায় কখনো পকেটের কোনা ভরে না কারও। কোনোদিন।
স্টেশন-লাগোয়া আল ফালাহ জামে মসজিদ। নাম গালভরা হলেও বাস্তবে কোনো এক অজ্ঞাত মানুষের করে দেওয়া ছোট্ট এক টিনশেড আর মুসল্লি কুল্লে কয়েকজন। অবশ্য গঞ্জের আজিজিয়া ফয়েজিয়া মাদরাসা থেকে একজন ইমাম আসেন নামাজ পড়ানোর জন্য। পাঞ্জেগানা মসজিদ বলে কথা। সেই ইমামের হাদিয়া আর মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যই ক্যানভাসার হালিম শাহ্ টাকা তোলেন কবি হাসান আলীর বানানো করুণ ছন্দে। সেই ছন্দ রচনা করতে গিয়ে কবির কাব্যপ্রতিভা কতটুকু বিকশিত হয়েছে বলা মুশকিল, বলা মুশকিল হালিম শাহের গায়কি কি নতুন সুর বিভঙ্গে তরঙ্গিত হয়েছে। তবে অর্থপ্রাপ্তি আর যশোপ্রাপ্তি যা-ই হোক, বিদ্যৎসমাজে অপাঙক্তেয় সেই কবিতা তিন বন্ধুকে বন্ধনের এক অনাবিল পঙক্তিতে এনে বসিয়েছে।
যখন দিনের আলো মরে আসে, তিন বন্ধুতে মসজিদের সামনের ঘাসে ছাওয়া রোয়াকে গিয়ে বসে। সেখানে তিন স্বল্পশিক্ষিত মানুষের বিদ্যার গণ্ডি পেরিয়ে ঐতিহাসিক, জটিল বিষয়সমূহ উঠে আসে। কখনো হারাধন মল্লিক কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অভিমন্যুর অনৈতিক হত্যার বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন। কখনো কারবালার যুদ্ধের করুণ কাহিনি বলতে গিয়ে হালিম শাহর দুই চোখ লোনাজলে ভরে ওঠে। হালিম শাহ্ ভাবতে থাকেন অভিমন্যুর মতো ট্র্যাজিক ঘটনা নিয়ে কেন বাংলা সাহিত্যে কেউ মহাকাব্য রচনা করল না।
এ সময় দ্রুতগামী পরিবহনের সন্ধ্যার বাস এলে হালিম শাহ্ দ্রুত মাইকে সুর তুলতে থাকেন। বাস চলে গেলে আবারও জমিয়ে আড্ডা বসে। মহাবীর আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণ থেকে বিজ্ঞানী নিউটনের মাথায় আপেল পতন কোনো কিছু বাদ যায় না। কখনো দিলদার হোটেলের সৌজন্যে চা এবং বাসি শিঙাড়া জোটে। সেই শিঙাড়া নিজের মেয়ের জন্য কখন হাসান আলীর পাঞ্জাবির পকেটে চালান হয়, দুই বন্ধু দেখেও না দেখার ভান করতে থাকে।
রাত্রিকালীন কয়টা বাস আসবে যাত্রীরাই-বা কেমন সব তিন বন্ধুর মুখস্থ। সমবায় সাতরঙ নং-১ থেকে নং-৭, ইছাখালী পরিবহন এক ও দুই, মায়ের দোয়া পরিবহন আর পারাপার সার্ভিস-এ কয়টা বাস এখনো বাকি আছে।
একেবারে গভীর রাতে চট্টগ্রাম থেকে সিনেমার শেষ শো ভাঙা যাত্রীদের নিয়ে আসবে সুন্নাত পরিবহন। নাম আর যাত্রীর বৈপরীত্য দেখে তিন বন্ধু কখনো হাসে না। কারণ এ বাসের যাত্রীরাই সবচেয়ে দিল দরিয়া। অবশ্য একাকী মেয়েকে বাড়িতে রেখে কবি হাসান আলী এ বাসের যাত্রীদের দেখতে অত রাত কখনো থাকেন না।
ফিরতি পথে হাসান আলী চাল-ডাল কেনেন। পীতাম্বর শাহের দোকান অতিক্রমকালে মেয়ের বিলিম্বি দেওয়া টক-ঝাল খিচুড়ি রান্নার জন্য মাওয়া আর জায়ফল কেনার কথা মনে পড়ে। কিন্তু পকেট হাতড়ে অবশিষ্ট দুটি মাত্র টাকা খুঁজে পান। অগত্যা দোকানে না ঢুকে বাড়ির দিকে পথ চলতে থাকেন।
চলবে...