![ত্রিপুরা উপাখ্যান ও সাবিনার কথা](uploads/2024/05/10/tripura-1715318026.jpg)
গত সংখ্যার পর
পুরনো এই খামটা ডাক্তার দত্তের জীবনের বড় স্মৃতিস্মারক। মাঝেমধ্যে পা ফেলে তিনি দেয়ালটার কাছে যান। চশমা মুছে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখেন। চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে।
একদিন সকালের চা খেতে খেতে আনন্দবাজারসহ কয়েকটা দৈনিকের পাতা ওল্টাচ্ছিলেন রথীন বাবু। পাশের টেবিলে রাখা আগরতলার দৈনিক সংবাদ ও কলকাতার আরও কিছু কাগজ। হঠাৎ একটি খবরে তার চোখ পড়ল। ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বাংলাদেশের, সে নিয়ে কলকাতার সাউথ ব্লক ও ঢাকার সেগুন বাগিচার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আগাম প্রস্তুতি চলছে। নতুন দিল্লি ডেটলাইনের খবরটা তিনি মনোযোগসহকারে পড়লেন। কী মনে করে চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। ধীরে এগিয়ে গিয়ে দেয়ালে সাঁটানো পুরনো চিঠিটা হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলেন। ইদানীং তার হাত কাঁপে- তবু পিন খুলে চিঠিটা হাতে নিলেন সার্জন দত্ত। তারপর আবার চেয়ারে গিয়ে বসলেন।
চিঠিটা আগেও তিনি বহুবার পড়েছেন। তবু ইচ্ছে হল আরেকবার পড়েন। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসতেই চশমা খুলে মুখের হাওয়া দিয়ে কাচ ভেজালেন- পাঞ্জাবির কোনা দিয়ে মুছলেন। ভাবলেন অনেক বছর চলে গেছে এরই মধ্যে। কত স্মৃতি তার আগরতলার, ত্রিপুরা রাজ্যের! অনেক স্মৃতি আছে, যা মুছে যায়, কিছু স্মৃতি থেকে যায়, অক্ষয় হয়। অবসরপ্রাপ্ত সার্জন চোখ বন্ধ করে ১৯৭১ সালে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। কিছু ছবি স্পষ্ট কিছু অষ্পষ্ট। স্মৃতির সেই ছবি বেশির ভাগই আগরতলার- ত্রিপুরার। যেখানে তিনি জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন।
সকাল গড়াতেই কলকাতার সড়কগুলো সবে সরব হতে শুরু করেছে। যানবাহনের শব্দ আসছে। তার কুঞ্জবন এ রকম ছিল না। কী শান্ত একটি জনপদ! জীবনের চঞ্চলতা নেই বলা যাবে না কিন্তু তার মধ্যে বাংলার পুরনো গ্রাম আছে- যা কলকাতায় নেই! কিন্তু কলকাতা মহানগরীর ভোরের কোলাহল ছাপিয়েও তিনি যেন আগরতলা দেখতে পান, পুরনো দিনের কথা শুনতে পান! তার ফেলে আসা জীবন, শিলংয়ের স্কুল, আসামের ডিব্রুগড়ে ডাক্তারি পড়া, কলকাতায় আসা, শল্যবিদ্যা নিয়ে দেশ-বিদেশে পড়ালেখা, গবেষণা- সবকিছু মনে পড়ে তার। একের পর এক পুরনো দিনের ছবি ভেসে ওঠে। আগরতলার গোবিন্দ বল্লভ হাসপাতালের কৃতি সার্জন ডাক্তার রথীন দত্ত, এফআরসিএস, এফএফআইএমএস স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন।
হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠতেই বর্তমানে ফিরে আসেন রথীন বাবু। কাজের মেয়ে বাসন্তী তখন সকালের কাজকর্ম সারতে রীতিমতো ব্যস্ত। ঘর পরিষ্কার করে বাসন মাজতে গেছে। বাসন মাজার শব্দ শোনা যাচ্ছে। অতএব, ভজহরিকে হাঁক দিয়ে বললেন- দেখ তো কে এল সকাল সকাল?
ভজহরি দুয়ার খুলে বাইরে গেল- ফিরেও এল ঝটপট। এসে জানাল- টিভির লোকজন। ওরা বলল- আপনি নাকি আজ সকালের দিকেই ওদের আসতে বলেছিলেন।
ওরা ফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেই এসেছে কিন্তু রথীন বাবু মনে রাখতে পারেননি। আগে এমনটা হতো না। পেশাগত জীবনের গোটা সময়টা ছিল গোছানো- টিপটপ। অ্যাপয়েন্টমেন্ট খাতায় সবকিছু লেখা থাকত। অ্যাসিসট্যান্টরা ঠিক সময়ে মনে করিয়ে দিত। অতএব, ভুলে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। খানিক ভেবে নড়েচরে বসলেন সার্জন দত্ত। ভজহরিকে বললেন- ও হ্যাঁ, বলেছিলাম তো, দেখ তো একেবারেই ভুলে গেছি! ঠিক আছে আমি পোশাকটা পাল্টে আসি, তুই ওদের ভিতরে এনে বসা। চা-নাস্তাও কিছু দিতে বলিস, সকাল সকাল এসেছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির আয়োজন চলছে। বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা থেকে যারা যুক্ত হয়েছিলেন, তাদের বেশির ভাগই এখন বেঁচে নেই। যারা আছেন তাদের মধ্যে রথীন দত্ত একজন। কারণ আগরতলার এই কৃতিসার্জনের সঙ্গে যেমন ত্রিপুরার গোবিন্দ বল্লভ হাসপাতালের ইতিহাস জড়িয়ে আছে তেমনি আছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের হাজারো আহত মানুষের জরুরি চিকিৎসাসেবার ইতিহাস। ইদানীং রথীন বাবুর শরীর ভালো যায় না বটে, এরপরও ত্রিপুরার কয়েকটি দৈনিক ও টেলিভিশন চ্যানেল এসেছিল। ওরা আগেভাগেই সাক্ষাৎকার নিয়ে গেছে। এড়াতে পারেননি। এবার এসেছে কলকাতার সংবাদকর্মীরা।
টিভির চটপটে নারী সাংবাদিক, ঘরে ঢুকেই রথীন বাবুকে প্রণাম করল। বোঝা গেল, ইন্টারভিউ নেওয়ার কৌশলটা সে ভালোভাবেই রপ্ত করেছে। এক টুকরো হাসি ছুড়ে দিয়ে সে বলল- স্যার, আমার নাম মল্লিকা, মল্লিকা সেনগুপ্ত। আপনার কথা অনেক শুনেছি, আজ সামনাসামনি দেখবার সৌভাগ্য হলো। আমাদের মতো নবীনরা আপনার মতো মহীরুহের সান্নিধ্য পেয়ে ধন্য বোধ করছি। এখন আপনার শরীর কেমন, স্যার?
মেয়ের চাইতেও কম বয়েসী বালিকার মুখে কথাগুলো শুনে রথীন বাবু খুশি হলেন। হেসে বললেন- এই তো চলছে, একেবারে মন্দ বলি কী করে? তা ক’ বছর আছ তুমি জার্নালিজমে?
মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল- বছর আটেক হবে, স্যার। তবে আমি বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করি, বারকয়েক গেছিও, বর্ডার ক্রাইম- বর্ডার কিলিং ইত্যাদি নিয়েও রিপোর্ট করেছি। সামনের বছরেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, এ নিয়ে ভারতেও নানা আয়োজন চলছে। তাই ভাবলাম, আপনার মতো মানুষের কিছু স্মৃতিসম্ভার ধরে রাখি, নতুন প্রজন্ম উপকৃত হবে।
ঠিক এভাবে কোনো সংবাদকর্মী আগে কথা বলেনি। অতএব, সার্জন দত্ত খুশি হলেন। বললেন- ঠিক আছে। শরীরটা ততটা ভালো থাকে না, সবকিছু মনেও নেই এখন, তবু দেখি কতটা কী মনে করতে পারি।
এরই মধ্যে ভজহরি চা-নাস্তা নিয়ে এল। রিপোর্টার ও ক্যামেরাম্যান গৌরব ঘোষ প্রায় একসঙ্গে বলে উঠল- আমরা কিন্তু চা-নাস্তা সেরে এসেছি স্যার,
শুধু শুধু-
-খেয়েছ তো কী হয়েছে, আরেকবার খাও। আমিও তোমাদের সঙ্গে বসব।
সার্জন দত্ত এরপর হাতের ইশারায় ওদের টেবিলে বসতে বললেন। সোফার একপাশ থেকে তিনি সাবিনার চিঠিটা সরিয়ে রাখলেন। কিন্তু রথীন বাবুর এই সাধারণ কাজটিও রিপোর্টারের চোখ এড়াল না। এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল- অনেক পুরনো চিঠি মনে হয়, স্যার?
দত্ত বাবু বললেন- হ্যাঁ, পুরনো তো বটেই। এই ধর বাংলাদেশের বয়স যদি ৫০ হয় এ চিঠির বয়সও কম হবে না।
চলবে...