![নেমেসিস](uploads/2024/02/09/1707461247.Nemesis.jpg)
সারা দিন আকাশ মেঘলা ছিল। খণ্ড খণ্ড সাদাকালো ধূসর মেঘের স্তূপ ছিল আকাশজুড়ে। রোদ ছিল না, বৃষ্টিও না। কিন্তু সন্ধ্যা হতে না হতেই ঝিরঝির করে বৃষ্টি নেমে এলো। তবে অফিসফেরা মানুষের চলাচল কম ছিল না।
দোতলায় ঘরের ভিতরে বসে জানলার ফাঁক দিয়ে বৃষ্টিভেজা আধো অন্ধকারে ডুবে থাকা রাস্তার দিকে তাকিয়েছিল নুরুদ্দিন। ভেতরে একটা অস্থিরতা কাজ করছে। যত সময় যাচ্ছে অস্থিরতাটা যেন বাড়ছে।
একবার ঘড়ির দিকে তাকায় নুরু। রাত ৯টা বেজে গেছে। একটু তাড়াহুড়ো করেই রাতের খাবারটা খেয়ে নিয়ে কাজে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে নিচে নেমে এলো।
অন্ধকারের মধ্যেই সিঁড়ির নিচ থেকে বাইকটা নিয়ে বেরিয়ে এলো রাস্তায়। আষাঢ়ের ঝিরিঝিরি বৃষ্টিটা একটু ধরেছে কিন্তু একেবারে থেমে যায়নি।
বাইকে বসে মুখে কালো একটা মাক্স লাগায়, তারপর হেলমেট দিয়ে মাথাটা ঢেকে বাইক স্টার্ট দেয়। যেতে হবে শহরের এক প্রান্তে ডায়মন্ড ক্লাবে। সবাই জানে, সন্ধ্যার পর ওখানে যত দু-নম্বরি মানুষদের আড্ডা জমে। অবাধে চলে মদ, জুয়া, নানা ধরনের দুষ্কর্ম, দালালি আর তদবিরবাজি।
ওই ক্লাবেই পাওয়া যাবে সুলতান মাহমুদকে। নুরুর ৩ লাখ টাকার টার্গেট। সঙ্গী-সাথী নিয়ে এই ক্লাবে সে প্রায় প্রতিদিনই আসে রাত ৯টার পর। গভীর রাত পর্যন্ত থাকে নানা কাজে। কোনো কোনো দিন বেসামাল অবস্থায় ধরে গাড়িতে তুলে বাড়িতে নিয়ে যায় তার সর্বক্ষণের দুই সঙ্গী তসলিম আর হাবিব।
দিন দুই আগে কথাবার্তা বলে বদলি কাজের লোকের ছদ্মবেশে ক্লাবে এসে মাহমুদের সব খবর নিয়েছে নুরু। তারপর চারদিক দেখে-শুনে গুটি সাজিয়েছে নিখুঁতভাবে। শিকারি যেমন ফাঁদ পাতে শিকার ধরার জন্য, তেমনি করে।
গ্রামের বাড়িতে দেখা বেজির সাপ ধরার দৃশ্যটা মনে পড়ে নুরুর। এখানে সব মিলিয়ে মাত্র ১০ মিনিটের কাজ। তাতে কী? নিখুঁত কাজ করার জন্য নুরু কখনো কম টাকায় কাজ করে না। দরদাম নেই, কনটাক্ট ৩ লাখ টাকার। অ্যাডভান্স ২ লাখ। বাকিটা কাজ শেষ হওয়ার পর।
আধা ঘণ্টা পরে ক্লাবের সামনে পৌঁছে গেল নুরু। গেটের পেছনে থাকে দুজন সিকিউরিটি। রাস্তার পাশের গেটের পরে বেশ কিছুটা দূরে আলো-আঁধারির মধ্যে তিন তলা ক্লাব বাড়ি। ক্লাবের সামনে পেছনে সিকিউরিটির লোক আছে আরও দুজন। গেট থেকে ক্লাব পর্যন্ত চলে যাওয়া পরিষ্কার রাস্তাটার দুই পাশে ফাঁকা মাঠ। সামনের দিকে কিছু ফুলের গাছ থাকলেও তার পেছনে ঘন আগাছার জঙ্গল।
ক্লাবটার পেছনে আছে একটা ছোট্ট ঝিল। বাইরে থেকে দেখা যায় না। তারপর বাউন্ডারি ওয়াল। ওয়ালের ওপাশে বড় রাস্তা।
দোতালায় মূল ক্লাব। নিচে একতলায় ঢোকার মুখে একটা লিফট আছে। সেখান থেকে কিছুটা দূরে বেশ বড় একটা টিনশেড গ্যারেজ। বামদিকে কিচেন, তারপর টয়লেট ইত্যাদি। গ্যারেজের উল্টো পাশে আলো কম। ভেতরেও তেমন উজ্জ্বল আলো নেই। দুই পাশে বিশ-বাইশটা গাড়ি থাকে। মাঝখান দিয়ে পথ। দিন দুই দেখেই ক্লাবের ভেতর এবং তার আশপাশের পরিবেশ একেবারে মুখস্ত করে নিয়েছে নুরু।
কথাবার্তা বলেই টোপটা ফেলা হয়েছে। রাত ১০টার দিকে গেটের সামনে পরিচয় দিয়ে ফোন করলেই গেট থেকে ছেড়ে দেবে। তারপর ভিতরে গিয়ে গোপনে মাহমুদ সাহেবকে জিনিসটা দেখাতে হবে। পছন্দ হলে দরদাম হবে। না হলে পত্রপাঠ বিদায়। প্রোগ্রামটা এভাবেই করা আছে।
পরের কাজটুকু নুরুর একার। সুপারির দাম অনেক, তাই কাজটাও করতে হবে সবচাইতে কম সময়ে নিখুঁতভাবে।
প্ল্যান মাফিক বাইরের গেটের সামনে আসার আগেই ফোন দেয় নুরু। কথা শেষ করে রাস্তার উল্টো দিকে একটা গাছের নিচে বাইকটা রেখে গেটে নাম বলে প্রায় নিঃশব্দে ভিতরে ঢুকে পড়ে।
কিছুটা হেঁটে একতলায় লিফটের সামনে এসে দাঁড়াতেই সুলতান মাহমুদের ভরাট গলার ফোন।
কোথায়?
নিচে।
ওপরে আসবেন?
না। নিচেই ভালো।
কোনো অসুবিধা আছে?
না। একা আসেন।
ঠিক আছে। গ্যারেজের দিকে গিয়ে দাঁড়ান।
নুরু হাতের প্যাকেটটা নিয়ে গ্যারেজের দিকে সরে আসে।
মিনিট দশেক পর লিফটের দরজা খুলতেই বেরিয়ে আসেন সুলতান মাহমুদ। একটু দাঁড়িয়ে চারদিকটা একবার দেখে নিয়ে নুরুকে হাতের ইশারা করে গ্যারেজের ভিতরে ঢুকে যান।
কই দেন’, হাত বাড়ান মাহমুদ। নুরু হাতের প্যাকেটটা মাহমুদকে দিলে সেটা নিয়ে আলোর নিচে গিয়ে মাথা নিচু করে খুলতে থাকেন।
নুরু সময় নষ্ট না করে কোমর থেকে মোটা তামার তারটা বার করে এক পা সামনে এগিয়ে এসে মুহূর্তের মধ্যে সেটা মাহমুদের মাথা গলিয়ে গলার নিচে ফাঁসির দড়ির মতো লাগিয়ে হ্যাচকা টান দেয়। তারপর মাথাটা সোজা হতেই পেছনদিকে কনুই দিয়ে একটা জোর চাপ দেয়। সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে একটা কট করে শব্দ হয়। পরমুহূর্তে মাথাটা একপাশে হেলে পড়ে।
মাহমুদের হাত থেকে আধ খোলা প্যাকেটটা নিচে পড়ে যায়। আবছা ম্লান আলোয় প্যাকেটের ভেতরে থাকা পিস্তলের বাটটা চকচক করে ওঠে।
এদিকে মাহমুদের শরীরটা ভাঁজ হয়ে উপুড় হয়ে পড়ে যাওয়ার আগেই নুরু ধরে ফেলে টেনে নিয়ে পাশের ওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসিয়ে দেয়।
কাজ শেষ। মুখের কালো মাক্সটা খুলে পকেটে নিয়ে সাদা মাক্সটা পড়ে নেয় নুরু। ১০ মিনিটের পাঁচ মিনিট হয়ে গেছে। পড়ে যাওয়া প্যাকেটটা হাতে তুলে নিয়ে দ্রুত গ্যারেজের পেছন দিকে চলে যায় নুরু, তারপর গ্যারেজের শেষ প্রান্তের ভাঙা অংশটা দিয়ে বেরিয়ে মাঠের অন্ধকারে মিশে যায়।
মাঠ পেরিয়ে রাস্তায় উঠতেই আবার ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। থামে না নুরু, বৃষ্টির মধ্যেই বাইক নিয়ে দ্রুত চলতে থাকে। অন্ধকারে ভেজা রাস্তায় জল ছেঁটানোর শব্দ ছড়িয়ে যানবাহন ছুটে চলেছে দুই দিকেই।
কিছু দূরে পথে একটা ইউটার্ন আছে, নুরু জানে। কিছুটা দূর থেকে সে জায়গাটা দেখে স্পিড কমিয়ে ঘুরতে গিয়েই হঠাৎ একটা হেডলাইটের তীব্র আলোর সামনে পড়ে যায়। আর ঠিক তখনই একটা গুলির আবছা আওয়াজ শুনতে পায়। হেলমেট ছুঁয়ে সেটা বেরিয়ে যায় পেছনদিকে। সামনে বিপদ, টের পায় নুরু।
কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই দ্বিতীয় গুলিটা চলে আসে। নুরু মাথা নিচু করে, কিন্তু গুলিটা এসে লাগে সরাসরি বুক আর পেটের মাঝামাঝি জায়গায়। মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু যেন থমকে যায়। চারদিকজুড়ে তখন শুধু বৃষ্টির শব্দ।
চোখের সামনে গাঢ় অন্ধকার যেন কুণ্ডলী পাকিয়ে ওঠে। অবস হাতের মুঠো থেকে বেরিয়ে চলন্ত বাইকটা সামনের দিকে ছুটে যায়। আর নুরু একটা পাক খেয়ে পেছন দিকে রাস্তার ওপর জমে থাকা বৃষ্টির জলের মধ্যে ছিটকে পড়ে।
একটু পর কিছু দূরে আধো অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা একটা বাইক ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে আসে। তারপর বৃষ্টিভেজা কালো রাস্তার ওপরে চিৎ হয়ে নিথর পড়ে থাকা নুরুর শরীর লক্ষ্য করে আরও একটা গুলি ছোড়ে বাইকে বসে থাকা দুজনের একজন, তারপর দ্রুত চলে যায়। তুমুল বৃষ্টিতে তখন চারদিক ভেসে যাচ্ছে।