![একজন ভাষাসংগ্রামী ও বরেণ্য শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জামান](uploads/2024/02/16/1708064236.anissujaman.jpg)
আনিসুজ্জামানকে যারা কাছ থেকে দেখেছেন, তারা লক্ষ করেছেন, বাংলা ভাষা বা সাহিত্যের একান্ত জগৎ নিয়ে তিনি উৎসুকও কম ছিলেন না। কিন্তু পাঠক হিসেবে তার যে কৌতূহল তা শুধুই ভাষা বা সাহিত্যের নির্জলা গবেষণার দিকে কখনো গড়িয়ে যায়নি। সাহিত্য নিয়ে তিনি যখন লিখতেন, তার মধ্যে এসে পড়ত সমাজ আর দেশের বৃহত্তর পটভূমিকার ছবি। উত্থান-পতন-বন্ধুর ইতিহাসে বাঙালির জাতি হয়ে ওঠার নানা পর্ব সম্পর্কে তার অনুসন্ধানী মন সেসব লেখার সূত্রে জেগে উঠত। আর তার পর্যালোচনাময় যোগে নির্জলা সাহিত্যিক বিষয়ও সংগতি খুঁজত বাঙালির সপ্রাণ জীবনের সঙ্গে। গবেষক আনিসুজ্জামান এভাবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সীমিত ঘেরাটোপ ছাপিয়ে গিয়েছিলেন। সেই যে শুরু, তার আর শেষ হলো না। তার গবেষণা ও লেখালেখির প্রধান ভরকেন্দ্রই হয়ে দাঁড়াল বাঙালির সমাজ, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, উদার গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িকতার গুরুত্ব।...
আনিসুজ্জামান একাধারে একজন বরেণ্য শিক্ষাবিদ, লেখক, গবেষক, ভাষা সংগ্রামী, সংবিধানের অনুবাদক এবং ইমেরিটাস অধ্যাপক। এক কথায় তিনি একজন জীবন্ত কিংবদন্তি। জন্ম ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাট। পিতা এ টি এম মোয়াজ্জেম ও মাতা সৈয়দা খাতুন।
তার বর্ণাঢ্য শিক্ষাজীবন শুরু হয় কলকাতার পার্ক সার্কাস হাইস্কুল থেকে। কৈশোরে পরিবারসমেত বাংলাদেশে চলে এলে খুলনা শহরের এক স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫১ সালে ঢাকার প্রিয়নাথ হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৫৩ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন আনিসুজ্জামান। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। সেখানে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। স্নাতক জীবনে তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং ড. মুনীর চৌধুরীর মতো কিংবদন্তি শিক্ষকদের, যাদের সান্নিধ্যে তিনি নিজেকে গড়ে তোলেন। ১৯৫৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচ.ডি. শুরু করেন এবং ১৯৬৫ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করেন। অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য বিভিন্ন সময়ে তিনি বেশকিছু বৃত্তি লাভ করেন। শিক্ষা মূলত ঢাকায়, উচ্চতর গবেষণা শিকাগো ও লন্ডনে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘকাল বাংলা সাহিত্যে শিক্ষকতা করেছেন, বৃত হয়েছিলেন জাতীয় অধ্যাপক পদে। বাংলা ও ইংরেজিতে লিখিত ও সম্পাদিত তার বইপত্র প্রকাশিত হয়েছে ঢাকা, কলকাতা, লন্ডন ও টোকিও থেকে। পৃথিবীর নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তা, ভিজিটিং ফেলো ও ভিজিটিং অধ্যাপকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান ও একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে কুদরাত-এ-খুদাকে প্রধান করে গঠিত জাতীয় শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে তার গবেষণা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রকল্পে অংশ নেন এবং ‘কমনওয়েলথ একাডেমি স্টাফ ফেলো’ হিসেবে লন্ডনে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করেন।
আনিসুজ্জামান এক সাক্ষাৎসারে বলেছিলেন, ‘বাংলা পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, সাহিত্যকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে পড়া যাবে না। এই পটভূমিতেই ইতিহাসের প্রতি আমার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। পরবর্তীকালে আমার সম্পাদিত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-এর বিষয়ে অনেকে বলেন, আমি নির্ধারিত ক্ষেত্রের বাইরে চলে গেছি। আমি তা মনে করি না। যে-সমাজ থেকে সাহিত্য তৈরি হচ্ছে, সেই একই সমাজে তো ধর্মান্দোলন হচ্ছে, অর্থনৈতিক জীবনও চালিত হচ্ছে। এগুলো অবিচ্ছেদ্যভাবে দেখার ঝোঁক আমার মধ্যে সব সময় কাজ করেছে।’ ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতার পর পর্যন্ত দেশের চলমান ইতিহাসে তিনি ছিলেন রাজপথে। ছড়িয়ে পড়ে তার লেখার বিষয়।
শিল্প ও সাহিত্যকলার বিভিন্ন শাখায় জড়িত আছেন তিনি। আনিসুজ্জামানেরর বই সমগ্রতে তার প্রখর চিন্তাশক্তি ও বিশ্লেষণী ক্ষমতার পরিচয় মেলে। তার বইগুলো বেশির ভাগই গবেষণা এবং প্রবন্ধধর্মী। তার প্রথম প্রবন্ধ ও গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’ (১৯৬৪)। তিনি শিল্পকলাবিষয়ক ত্রৈমাসিক পত্রিকা ‘যামিনী’ এবং বাংলা মাসিকপত্র ‘কালি ও কলম’-এর সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ অনুষ্ঠানে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।
শিক্ষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য দেশে-বিদেশে অসংখ্য পদক-পুরস্কার এবং সম্মাননা লাভ করেছেন। পুরস্কারস্বরূপ পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭০), একুশে পদক (১৯৮৫), স্বাধীনতা পুরস্কার (২০১৫), ভারত সরকার প্রদত্ত ‘পদ্মভূষণ’ পদক (২০১৪) এবং ২০০৫ সালে কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ‘ডি.লিট’ ডিগ্রি প্রদান করে। ২০২০ সালের ১৪ মে তিনি পরলোক গমন করেন।