ঢাকা ১২ শ্রাবণ ১৪৩১, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪

এ সপ্তাহের বই

প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০২৪, ০১:৫৪ পিএম
আপডেট: ২৯ মার্চ ২০২৪, ০১:৫৪ পিএম
এ সপ্তাহের বই

ভাষা হলো মস্তিষ্কের পোশাক, আর গ্রন্থ সৃষ্টিশীল মানুষের পোশাক। এ প্রসঙ্গে মার্কিন কবি আর্চিবল্ড ম্যাকলিশের ভাষায়, ‘প্রকৃত সাহিত্যের জন্ম তখনই, যখন ভাষার সৌন্দর্য ও আবেগের ক্রিয়াশীলতা শব্দের আশ্রয়ে রূপ লাভ করে।’…

ঢাকা এখন ও আগামীতে
নজরুল ইসলাম
শ্রেণি: প্রবন্ধ
প্রকাশনী: নগর গবেষণা কেন্দ্র, ঢাকা
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২৪
পৃষ্ঠা: ১৬০; মূল্য: ৩০০ টাকা

ঢাকা একটি ঐতিহাসিক শহর, বাংলাদেশের রাজধানী ও সমকালীন বিশ্বের অন্যতম জনবহুল মেগাসিটি। বিগত প্রায় সাত দশকে ঢাকার পারিসরিক ও জনমিতিক প্রবৃদ্ধি ঘটেছে অত্যন্ত দ্রুত হারে। পাশাপাশি সুদূরপ্রসারী ভিশনের অভাব, সঠিক ও সময়োপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণের ব্যর্থতা, প্রশাসনিক ও প্রযুক্তিগত দুর্বলতা, সুশাসনের অনুপস্থিতি, সম্পদের সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি নানা কারণে ঢাকা এখন একটি সমস্যাজর্জরিত মহানগর। একই সঙ্গে ঢাকা সাংস্কৃতিকভাবে খুবই সমৃদ্ধ নগর। সম্ভাবনারও শহর। খ্যাতিমান প্রবীণ নগরবিদ ও শিল্পসমালোচক ইমেরিটাস অধ্যাপক নজরুল ইসলাম নানা দৃষ্টিতে পর্যালোচনা করেছেন রাজধানী ঢাকার বর্তমান সময়কে। আগামীর ঢাকা নিয়ে তিনি ভেবেছেন, স্বপ্ন দেখেছেন। এসব নিয়েই তার ঢাকা এখন ও আগামীতে। তার কিছু প্রণিধানযোগ্য সাক্ষাৎকারও যুক্ত হয়েছে। বইটি নগর পরিকল্পনা, নগর উন্নয়ন ও নগর প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত বিদগ্ধ গবেষকের চিন্তার খোরাক মেটাবে।...

উন্নয়ন কল্যাণ অর্থনীতি: বিচিত্র চিন্তা
সালেহউদ্দিন আহমেদ
শ্রেণি: বাংলাদেশ বিষয়ক প্রবন্ধ
প্রকাশনী: আলোঘর প্রকাশনা, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ ২০২৪
পৃষ্ঠা: ১০৫; মূল্য: ৩৫০ টাকা

‘উন্নয়ন কল্যাণ অর্থনীতি: বিচিত্র চিন্তা’ বইটিতে ৩২টি নিবন্ধ সন্নিবেশিত হয়েছে। বিষয়গুলো বিভিন্ন তবে একটি মালায় গুটির মতো সবগুলো প্রবন্ধই একটি সমন্বিত রূপরেখা তুলে ধরে। লেখকের প্রধান উদ্দেশ্য মানুষের কল্যাণ, সমাজের কল্যাণ এবং মানুষের সার্বিক উন্নয়ন অর্থাৎ শুধুমাত্র প্রবৃদ্ধি, আয়-ব্যয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তার বাইরে রয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা এসব অর্থাৎ সার্বিক উন্নয়ন। এখানেই শেষ নয়, মানুষের চিন্তার স্বাধীনতা, তার কথা বলার অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার, তার পছন্দমতো কোনো বস্তু কেনা ও ভোগ করা এগুলোও মানুষের সার্বিক চাহিদার অংশ। নির্দিষ্ট একটি সময়ের নিবন্ধ হলেও প্রত্যেকটি নিবন্ধ চিরায়ত অর্থাৎ বিভিন্ন সময়ের জন্যও প্রয়োজ্য। বইটি পড়ে পাঠকমহল বিভিন্ন বিষয়ের ওপর কিছুটা হলেও জানতে পারবেন এবং উজ্জীবিত করবে- যেন সবাই আমরা বাংলাদেশকে একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারি।

বাংলাদেশের নবজাগরণ ও মুসলিম সাহিত্য সমাজ: অন্বেষা-অবলোকন-তত্ত্ব

কাজল রশীদ শাহীন
শ্রেণি: সাহিত্য ও সাহিত্যিক বিষয়ক প্রবন্ধ
প্রকাশনী: দুয়ার প্রকাশনী, ঢাকা
প্রকাশকাল: প্রথম প্রকাশ ২০২৪
পৃষ্ঠা: ১৮০; মূল্য: ৪২০ টাকা

বইটির প্রকাশক ইমরান মাহফুজ বলেন, ‌‘ইতিহাসের যাত্রাপথে চলতে চলতে আমাদের অনেক অজানা জানা হয়। তার মধ্যে নবজাগরণ একটি। নবজাগরণ ছাড়া কোনো সমাজ-রাষ্ট্র দাঁড়াতে পারে না। আর আমাদের স্বাধীনতার মাধ্যমে বাংলাদেশের নবজাগরণের সার্থকতা পায়। বলা যায়, এ জাগরণ একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে, যা ইতিহাসের অসামান্য পাঠ। বইটির চিন্তা নানান সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে এলেও কাজল রশীদ শাহীনের গবেষণায় একটি মডেল হিসেবে ধরা যায়। যদিও তিনি বলেছেন, এটি প্রস্তাবনা, তবু এর মূল্য তুলনাহীন। ইতিহাস ও প্রজন্মের দায় অনুভব করে আমাদের কালের ধ্বনি প্রকাশের উদ্যোগ নেয়।’...

মহাকালের ভাবনা
জুয়েল রাজ
শ্রেণি: প্রবন্ধ
প্রকাশনী: অভ্র প্রকাশন, সিলেট
প্রকাশকাল: সেপ্টেম্বর ২০২৩
পৃষ্ঠা: ২০৮; মূল্য: ৪০০ টাকা

আজকের মুহূর্তই আগামীর ইতিহাস। ইতিহাস শুধু বৃহৎ ঘটনার সমাহার নয়, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মানুষ, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাও ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করে। সাক্ষী হিসেবে থেকে যায়। সেই সময়েরই সাক্ষী লেখক, আর সেই ভাবনা ও প্রকাশিত এই গ্রন্থ। লেখক তার গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, সংবাদপত্রে প্রকাশিত লেখা গ্রন্থাকারে প্রকাশের আদৌ কি কোনো প্রাসঙ্গিকতা আছে? এই প্রশ্নটা থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবতা হলো দৈনিক পত্রিকাগুলো প্রাত্যহিক জীবনের মতো গত হয়ে যায়। আর এই গত হয়ে যাওয়া সময়ে আমার সেই সংবাদপত্রের সংবাদ, কলাম স্মৃতি থেকে হারিয়ে ফেলি। মূলত লেখার মতো সৃষ্টিশীল একটি উপাদান সময়ের পরিক্রমায় হারিয়ে যায়। কিন্তু চলমান সময়কে একজন মানুষ কীভাবে ধারণ করেছে, তার প্রকাশ কী ছিল, সেই বিষয়গুলোকে আগামীর জন্য ধারণ করে রাখে গ্রন্থ। তাই বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লেখাগুলোকে এক জায়গায় লিপিবদ্ধ করে রাখার উদ্দেশ্যেই এই গ্রন্থ।...


Call of the Sea 
কল অব দ্য সি 
এমিলি বি রোজ
প্রকাশক: পাগ প্রেস পাবলিশিং, যুক্তরাষ্ট্র
প্রকাশকাল: ১৩ ফ্রেব্রুয়ারি ২০২৪
পৃষ্ঠা: ৪২০; মূল্য: ১৮.৯৯ ডলার 

মহাসাগরে অভিযান করে জীবন পার করবে- এমন শখ পোষণ করে স্থূল শরীরের এক রাজকন্যা। তাকে নিয়েই তৈরি হয়েছে এ উপন্যাসের কাহিনি। প্রাসাদে বন্দি অবস্থায় সামনের জীবন তার মোটেই পছন্দ নয়। যাকে ভালোবাসতে পারবে না, তাকে বিয়ে করতেও রাজি নয় সে। বরং সমুদ্রে মৎস্যকুমারীদের খুঁজে বেড়ানোর অভিযানই তার প্রিয়। কিন্তু তাকে বলা হয়েছে, মৎস্যকুমারী বলতে কিছু নেই। সে জানে, তাকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক পাঁচজন যুবকের মধ্যে শুধু একজনই রাজকুমারীর মুকুটের লোভে আসেনি। রাজকুমারী কেনা তাকেই পছন্দ করে। তাকে ধরতে যেতেই নাগালের বাইরে চলে যায়। তার পিছু নিতে নিতেই সমুদ্রের ভেতর চলে যায় কেনা। তার জাহাজ-দুর্ঘটনার পরই বুঝতে পারে তার রহস্যের বিষয়। এখন একদিকে ওই যুবককে পাওয়া, আরেক দিকে কেনার রাজ্যের মানুষদের কথা। দুই দিকই রক্ষা করতে হবে কেনাকে।

বাংলাদেশ

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০১:৪৫ পিএম
আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০১:৪৬ পিএম
বাংলাদেশ

তোমার দুচোখ ক্লান্ত ভারী, চুলও এলোমেলো
হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ে উড়ে মেঘের দেশে গেল
ঘুমাওনি কি কাল সারা রাত চোখের কোনে কালি
অনাদরে কাটছে সময়? দেয়ালজোড়া বালি?

দণ্ড

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০১:৪৩ পিএম
আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০১:৪৬ পিএম
দণ্ড

ডাকলে যদি ফিরলে কেন তবে?
স-ব দ্বিধা মেঘ ঝেড়ে ফেলে
              দাঁড়িয়েছিলাম সবে।

যেই মেলেছি আলোকিত ভোরের দিকে চোখ,
কিন্তু কেন আকাশজুড়ে নামল ব্যাকুল শোক?
সেই শোকেতে জীবনভরা নিমজ্জিত রই,
দিয়েছিলাম কবে তোমার পাকা ধানে মই?

দণ্ড দিলে দণ্ড নিলাম দু’হাত পেতে আমি,
তার বদলে সারা জীবন সুখে থেকো তুমি!

এসো তবে রাগ-বেহাগে

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০১:৪০ পিএম
আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০১:৪০ পিএম
এসো তবে রাগ-বেহাগে

আমায় নিয়ে চলছে এখন দয়াল রসের খেলা…
তোমার সঙ্গে মেলে না আর রৌদ্র-বৃষ্টির কোনো একটি বেলা?
তুমি থাকো সোমেশ্বরী কিংবা ধরো কংস পরপারে
যমনগরে তোমার পাশে, থাকি আমি- ডাকি বারে বারে।

যখনই আমি দেখব বলে মুখটি বাড়াই ধীরে
তুমি তখন বিরল-পাখি যাও চলে যাও আরও দূরে 

মৃত্যুরূপে আসো যদি, প্রণয়বিধুর, বন্ধু তো হও আগে!
যখনই হোক- এসো তবে মাতৃরূপেন রাগ-বেহাগে…

বহুমূত্র

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০১:২৪ পিএম
আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০১:২৪ পিএম
বহুমূত্র
অলংকরণ: নিয়াজ চৌধুরী তুলি

পিঠ চুলকাচ্ছে, কিন্তু হাত পেছনে নিতে পারছিল না ফজর আলি। এতটাই চুলকাচ্ছে, কোথাও দাঁড়িয়ে-বসিয়েও থাকতে পারছিল না সে। অগত্যা সরু এবং কিছুটা মসৃণ একটা আমগাছের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে ঘষতে লাগল। এতটাই ঘষাঘষি করল পিঠের ছাল-চামড়া উঠে প্রায় রক্তাক্ত; যা দেখে আমগাছও বেকুব।

তখন প্রায় দুপুর। চোত মাসের ঠা ঠা গরম। তবুও তার ঘন ঘন হিসু চাপছিল। লুঙ্গির কাছা তুলে আমগাছের গোড়াতেই সোঁ সোঁ করে বদনাখানেক হিসু করল সে; যা দেখে আমগাছ আরও বেকুব। আমগাছের মতো সে নিজেকে বেকুব ভাবল  না; বরং মজাই পাচ্ছিল; কারণ, দেখতে না দেখতে পিঁপড়েরা সারি বেঁধে তার হিসুর আশপাশ জড়ো হচ্ছিল। প্রায় দেড় যুগ ধরে খেয়াল করছে বিষয়টা; তবে আজকের মতো নয়। কোত্থেকে এত এত পিঁপড়ে এসে হাজির! তার হিসুতে চিনি আছে নাকি, মনে মনে হাসল সে। 

বয়স প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি, এখনো বিয়ে থা করেনি। শরীর ঝিমঝিম করা, হাত-পা জ্বালা, ঘাড় টনটন করা, মাথাঘোরা, চোখে অন্ধকার দেখা, ঘন ঘন হিসু- এগুলো দীর্ঘদিন ধরে, কিন্তু ডাক্তারের কাছে কখনো যায়নি সে। যাওয়ার প্রয়োজনও বোধ করেনি। খুব বেশি কাবু মনে করলে পাড়ার হাতুড়ে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতো। ডাক্তার তাকে তার নিজস্ব উদ্ভাবনী বটিকা সেবনের পরামর্শ প্রদানের পর খাদ্যতালিকাও ধরিয়ে দিত; যেখানে বেশি বেশি ভাত খাওয়ার কথা থাকত এবং শারীরিক দৌর্বল্য কাটাতে ইচ্ছেমতো আখের রস, গুড়ের সরবত কিংবা গ্লুকোজ।

তাতেও স্বাস্থ্য ফিরছিল না; বরং দিনকে দিন তালপাতার সেপাই বনে যাচ্ছিল। বাড়ির সবাই চিন্তায় পড়ল। বিশেষ করে তার মা। সবাই বলাবলি করল বিয়ে না দিলে তার স্বাস্থ্য ফিরবে না। কিন্তু যে বেটা বিয়ে করবে তার মধ্যে তো জোশ থাকতে হবে? তার মধ্যেই জোশ নেই। বিয়ের কথা শুনলে কেমন যেন গুটিয়ে যেত সে! ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালাতে চাইত। চক্ষুলজ্জার ভয়ে পালাত না ঠিকই, বিয়ের সম্বন্ধ এলেই দূরে দূরে থাকত। কিন্তু এভাবে বেশি দিন দূরে দূরে থাকতে পারল না আর। পাশের গ্রাম থেকে সম্বন্ধ এলে পরিবারের সবাই জোর করে বিয়ের কড়া পরিয়ে দিল তার হাতে।

পাত্রী বেশ নাদুসনুদুস এবং খাটো। বেঢ়পও বটে; ছোটখাটো হস্তির মানুষরূপী সংস্করণ। গুনে গুনে ধাপ ফেলত; এবং যেখানে ফেলত সেখানকার মাটি আধা ইঞ্চি দেবে যেত। মাংসজাত খাবার এবং কুম্ভকর্ণের ঘুম তার পছন্দের তালিকায়। স্বামীগৃহে পা ফেলেই রান্নাঘরে ঢুকল সে। থালায় ভাত নিলে পোষায় না; তাই গামলায় ভাত নিয়ে শক্ত চেয়ারে বসে কাঁচালঙ্কাসহকারে জাবর কাটতে লাগল। নতুন বউ দেখার জন্য বাড়িতে মানুষের ঢল; সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে হাতিমার্কা পা দু-খানা দোলাতে দোলাতে জাবর কাটার কাজ শেষ করল; তার পর হাই তুলতে তুলতে, এ-বাড়ির ঘর-দরজা তার আগে থেকেই পরিচিত এরকম ভাব করে, ঘুমুতে গেল। 

বউমার এহেন আচরণে হতভম্ব শাশুড়ি দৌড়ে গেলেন রান্নাঘরে। ভাতের হাঁড়ির ঢাকনা তোলার পর তার চক্ষুচড়ক। হাঁড়ির তলানিতে যে কটা ভাত পড়ে আছে তা চশমা ছাড়াই গোনা যায়। মাথায় হাত তুলে ছেলেকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘ওরে ফজর আলি, দে হাত তালি। এরকম বউমাই তো চেয়েছিলাম রে। এতদিন খেয়ে খেয়ে শুকেছিস, এবার না খেয়ে খেয়ে শুকাবি। বউমার পেট ভরানোর মতো ধান গোলায় আছে তো?’

তিনি যতটা হতভম্ব তার চেয়ে ফজর আলি অনেক বেশি তার নবোঢ়ার ঘুমানো দেখে। শোয়ামাত্রই তার নাকের সরব গর্জনে পুরো ঘরটাই যেন কাঁপছিল। থেকে থেকে মুখ হা করে সাইলেন্সার পাইপের মতো ভোঁস ভোঁস করে বাতাস ছাড়ছিল; ফলে খাটের ওপর মশারির যে ছাদ বেশরমভাবে নাচানাচি করছিল। মাকে ডেকে এনে উঠোনের দিকে হা করা জানালার পাশে দাঁড়াল যেন ঘরের ভেতর মজাদার কৌতুক পরিবেশিত হচ্ছে। তারা তাদের চোখ সরাতে পারছিল না; কারণ, শুধু মশারির ছাদ নাচানাচি করছিল তা না, আলনায় রাখা কাপড়-চোপড়ও। হঠাৎ বউ তাদের দিকে পাশ ফিরাল এবং নাক দিয়ে শুশুকের মতো ভোঁস করে বাতাস ছাড়ল। সেই বাতাসের ঝাপ্টা বদ্ধ ঘরের দূষিত বাতাস ঘর ছেড়ে পালানোর মতো ছুটে এল জানালার দিকে;  আর তাতেই মা-ছেলের ঝড়ের কবলে পড়ার মতো অবস্থা হলো।

সেখান থেকে সরে এসে ফজর আলি মায়ের হাত ধরে বলল, ‘আম্মা, তুমি তোমার বউমা নিয়ে থাকো, আমি পালাই।’ বলতে বলতে সে এমন ভাব করছিল যেন সে এক্ষুনি পালাবে। ছেলের হাত খপ করে টেনে ধরে মা বললেন, ‘কোথায় যাবি রে বাপ? আজ তোর বাসররাত না!’

তখন বিকেলের শেষ আলো ইতিউতি তাকাচ্ছিল, কখন অন্ধকারের সহিস ফিরে আসে! অবশেষে ফিরে এসে গাঢ় কণ্ঠে তাদের ডেকে নিয়ে গেল বাসরঘরে। বাপ-দাদার আমলের ঢাউস খাট। তোষকের ওপরে নতুন চাদর বিছিয়ে দিয়েছেন মা। হাজার হলেও তার একটামাত্র ছেলে। হাত-পা জ্বালা করে, তাই ছেলের জন্য গ্লুকোজের ঘন সরবত আর বউমার জন্য গরম দুধের গ্লাস তেপায়ার ওপর রেখে দিয়েছেন তিনি। সঙ্গে কিছু ফলফলাদি।

‘আমাকে পেয়ে তুমি খুশি?’
‘খুব খুশি। তোমার মতো স্লিম ফিগারের বউ কজনার ভাগ্যে জোটে?’
‘আর কোনো গুণ নাই?’
‘গুণের শেষ নাই তোমার। মুখে দুটো দাঁত 
থাকলে সার্কাস পার্টি থেকে ভালোই আয় করতে পারতাম। নাক ডাকলে পাখার বাতাসের দরকার পড়বে না। আর হ্যাঁ, বেশি দিন বাঁচলে দেশে দুর্ভিক্ষ আসতেও সময় নেবে না।’
মন খারাপ করলে ফজর আলি তার গালে টোকা দিয়ে আবার বলল, ‘মন খারাপ করছ কেন, লক্ষ্মীটি? আমি তো তোমার প্রশংসাই করছি। তোমার নামটাও অনেক সুন্দর; থত্থরি বেগম।’
থত্থরি বেগম একটু আহাল্লাদি হলো বটে; তবে অভিমানও ঝরাল, ‘শুধু নামটাই; আমার হাসিটা?’
‘আহারে! হাসিতে অমাবস্যার চন্দ্রযোগ।’
‘গায়ের ত্বক? মা বলে দুধেআলতা।’
‘তোমার মায়ের চোখ না চুলা?’
থত্থরি বেগম হেসে উঠে স্বামীর দিকে পাশ ফেরাল। তার বুকে হাত রেখে প্রসঙ্গ পাল্টাল, ‘তোমার বুকের পাটা দেখে আমার নানার কথা মনে পড়ছে।’
‘তোমার নানা কি আমার মতন?’
‘হ্যাঁ গো। দুপুরবেলা নানা শীতলপাটিতে চিৎ হয়ে শুলে আমরা নাতি-নাতিনরা তার পাটার মতো বুকের ওপর শোয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তাম। কী বাহাদুর ছিলেন! বুঝতেই দিতেন না তিনি কষ্ট পাচ্ছেন। 
নানার কথা মনে পড়ায় তোমার বুকের ওপর শুতে 
ইচ্ছা করছে।’
‘সে আর কি! শোও। তোমার ইচ্ছা পূরণ করি।’

কষ্টেসৃষ্টে তার বুকের ওপর উঠে শুয়ে পড়ল থত্থরি বেগম। যেন কোনো দরবেশ তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়ার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন; তার ওপর কুদরতি ফুঁ দিলেন। আশ্চর্যজনকভাবে সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে গেল সে। এদিকে ফজর আলির অবস্থা চিড়েচ্যাপ্টা। যেন দেয়ালচাপায় পড়েছে সে। দম বন্ধ হয়ে আসছিল তার, শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। দুহাতে দেয়াল ওপরের দিকে ঠেলছিল, কিন্তু ঠেলতে পারলে তো? গড়ানি দিয়ে কোনোরকমে বুকের ওপর থেকে দেয়ালটা নামাতে সক্ষম হলো সে; তারপর ঢকঢক করে সরবতটা গলায় ঢেলে হাঁপাতে হাঁপাতে বাইরে এল। পিঠ চুলকাচ্ছিল; উঠোনের কোণায় আমগাছ, তার বাকলে পিঠ ঘষতে লাগল। 

সপ্তাখানেক পরেই কুরবানির ঈদ এসে হাজির। শ্বশুরবাড়ির পক্ষ থেকে লোকজন এসে জামাই ও তাদের মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে গেল। ফজর আলির শাশুড়ি মাশআল্লাহ! কুমায়ন অঞ্চলে চড়ে বেড়ানো হস্তিনীর মতো দেখতে। নিজে সামনে যা পান তাই খান, অন্যকেও সেভাবে খাওয়াতে চান। নতুন জামাইকে গণ্ডেপিণ্ডে খাওয়াচ্ছিলেন; জামাই বাধা দিলে বললেন তিনি, ‘কোরবানির গোশত খেলে কিচ্ছু হয় নারে বাবা। আল্লার বরকত আছে। পেট ঠ্যাসে খাও। হকনল্লি পর্যন্ত ডুবে খাও।’ পরক্ষণে হাসলেন, ‘তোমার শ্বশুর হরিপদ গোয়ালার কাছ থেকে মিষ্টি দই আর লক্ষণের দোকান থেকে রসগোল্লা এনেছে। গোশতে বেশি বেশি ঝাল-মসল্লা দিয়েছি, যাতে দই-মিষ্টি খাইতে মজা পাও।’ শ্লেষ্মা ঝেড়ে এবার কণ্ঠ ভেজালেন অহংবোধে, ‘আমাদের সবাই হাতির বংশধর রে বাবা। কয়েকদিন এই শাশুড়ির হাতের রান্না খাও, দেখবে তোমার পাতলাপুতলা শরীর কেমন মোটাতাজা হয়।’

কেন সে পাতলাপুতলা, তার ভেতরে কী সমস্যা, একমাত্র ফজর আলির দেহের কলকব্জারা তা ভালো জানে। এমনিতে মিতবাক সে। কথার পিঠে কথা বলা অনাবশ্যক মনে করল; তবে তার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে রহস্যময় হাসি ফুটল।

চিলমচিতে হাত ধুয়ে উঠে দাঁড়াল সে। তার পর কাঁচা সুপারি দিয়ে মুখভর্তি পান চিবাতে চিবাতে শোবার ঘরে এল। তার খুব ঘুম পাচ্ছিল; যাকে বলে মরণঘুম। পিঠও চুলকাচ্ছিল। চন্দ্রকলার চক্রে তখন অমাবস্যা। ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে বাইরে যেতে মন সায় দিল না। বিছানায় এসে বুকের নিচে বালিশ দিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল; তার পর বউকে ইঙ্গিত করল তার পিঠ চুলকে দিতে। তার পাশে আসনপিঁড়ি হয়ে বসতে থত্থরি বেগমের কষ্ট হচ্ছিল; তবুও তার পিঠ চুলকে দিচ্ছিল সে। ফজর আলির চুলকানির অত্যাচারের অসহনীয় মাত্রা কমছিল না তো বটেই; বরং বেড়ে যাচ্ছিল। অসন্তুষ্ট চিত্তে শরীর ঝাঁকাল সে, ‘হাতির মতো শরীর; হাতে কি জোর নাই?’

থত্থরি বেগমও রেগে ফায়ার; কড়া জবাব তার, ‘তিন ইঞ্চি করে লম্বা নখ দিয়ে চুলকে দিচ্ছি তা-ও হচ্ছে না! কোদাল আনব?’

‘কোদাল দিয়ে তো কবর খোঁড়ে,’ শীতল কণ্ঠে জবাব দিল ফজর আলি।

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠছিল না সে। চারদিকে বলাবলি শুরু হলো ফজর আলি মানুষটা অনেক ভালো মানুষ ছিল। ঘুমের মধ্যে আল্লাহ তাকে তার কাছে নিয়ে গেছেন।

ধারাবাহিক উপন্যাস ত্রিপুরা উপাখ্যান ও সাবিনার কথা

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০১:১৬ পিএম
আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০১:২০ পিএম
ত্রিপুরা উপাখ্যান ও সাবিনার কথা

গত সংখ্যার পর

তোমরা আজ হয়তো ভাবতে পারবে না- এ সময় দিনেরাতে নদীর স্রোতের মতো ছিন্নমূল মানুষ প্রবেশ করতে থাকে ত্রিপুরার নানা অঞ্চল দিয়ে। এত বড় শরণার্থী বিপর্যয় আগে কোথাও ঘটেনি পৃথিবীতে! একটি হিসাব থেকে বুঝতে পারবে ত্রিপুরার মানুষ বাংলাদেশের যুদ্ধের দাহন কতটা ভোগ করেছে। ১৯৭১ সালে রাজ্যের মোট লোকসংখ্যা যেখানে ১৫.৫৬ লাখ, সেখানে বাংলাদেশ থেকে শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩.৪২ লাখ বা প্রায় ১৪ লাখ। পরের দিকে এই সংখ্যা আরও বেড়েছে। ফলে ত্রিপুরার জনজীবন ও অর্থনীতিতে প্রচণ্ড চাপের সৃষ্টি হয়। কী করবে মানুষ বুঝে উঠতে পারে না। 

মল্লিকা সেনগুপ্ত: স্যার, একটি প্রশ্ন করি। সমাজ, অর্থনীতিতে এই যে ভয়ংকর রকম চাপ, সাধারণ মানুষের এত যে কষ্ট, এর পরও কেন সবকিছু মেনে নেয় ত্রিপুরার মানুষ? 

রথীন দত্ত: সঠিক প্রশ্নই করেছ। ব্যাপারটা স্বভাবতই ভাববার। তবে আমার কী মনে হয় জান, প্রকৃতির, মাটির একটা টান আছে, যা ভঙ্গুর নয়, নানা টানাপোড়েনে ভূখণ্ড ভাগ হয়ে গেলেও সেই অবিভাজ্য টান ধরে রাখে প্রকৃতি। এর মধ্যে আছে ভাষা-সংস্কৃতি ও জলবায়ুর এক গন্ধ। হয়তো সে কারণেই কষ্টকে কষ্ট বলে ভাবেনি ত্রিপুরাবাসী। 

ইতিহাসগতভাবে ত্রিপুরায় যে বাঙালি তার ৯৫ ভাগ পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসেছে- প্রায় সবাই ওপারের মানুষ- বলতে পার দেশ ভাগে বিতাড়িত মানুষ। এই মানুষদের সবাই হিন্দু ধর্মালম্বী, যারা নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে নতুন ভারতে পাড়ি দিয়েছে ১৯৪৭-এর দাবানলে পুড়ে। আবার এমন অনেকে আছেন যাদের পূর্বপুরুষ ছিলেন রাজ দরবারের কর্মচারী। কিন্তু এদের সবার আশা-আকাঙ্ক্ষা, রাগ-বিরাগ বৈশিষ্ট্য এক। অতএব, ১৯৪৭-এর আগে-পরের যে বিভেদ তা টিকে থাকেনি- নিমিশে উবে গেছে! হিন্দু, মুসলমান, পাহাড়ি ও নানা ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত জনগোষ্ঠীর ভেতরে বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক মুসলমান এবং হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান নির্বিবাদে ঠাঁই করে নিয়েছে- মানুষের ভেতরে মানুষ যেভাবে ঠাঁই করে নেয়! এই আত্মীয়তার ক্ষেত্রে ধর্ম ও কলোনিয়াল লিগেসি বিরোধ টানেনি। ধর্ম যে ব্যক্তির একান্ত আপনার বিষয়, রাষ্ট্র বা সমাজের নয় এবং ধর্ম বিশ্বাস যে ভাষা-সংস্কৃতির বিভাজন মানে না, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তা নতুন করে শিখিয়ে দিয়েছে। 

মল্লিকা সেনগুপ্ত: হয়তো তাই হবে। কিন্তু এপার ওপারে দুই পারেই যেভাবে উগ্রবাদ ছড়িয়ে পড়ছে, নতুন করে বিভেদ তৈরি হচ্ছে, তাতে কিন্তু শঙ্কার কারণ আছে। 

সার্জন রথীন দত্ত: নিশ্চয়ই, শঙ্কার কারণ তো আছেই। দেখ, ১৯৭১ কেবল বাংলাদেশের নয়, ভারতেরও সমানভাবে। ভারতের সেনাবাহিনী হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের মিত্রবাহিনী। অকাতরে প্রাণ দিয়েছে মুক্তিবাহিনী, রক্ত গেছে মিত্রবাহিনীরও। অতএব, দুই দেশকে এক রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ করেছিল ১৯৭১, নতুন ইতিহাস তৈরি করেছিল। সেই ভাতৃত্বকে উগ্র ধর্মবাদ চর্চা দিয়ে বিনষ্ট করা কখনো সমীচীন নয়। 
মল্লিকা সেনগুপ্ত: ঠিক বলেছেন, স্যার। এবার তাহলে আগের প্রসঙ্গে যাই আমরা। 

সার্জন রথীন দত্ত আবারও আগের প্রসঙ্গে ফিরলেন। ফেরার আগে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে নিলেন। 

বুঝলে, পরিস্থিতি যথেষ্টই ঘোলাটে তখন। কী হবে, কীভাবে পরিস্থিতি সামলানো যাবে? ভারত সরকার শেষ পর্যন্ত কতটা নামবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে- কিছুই নিশ্চিত নয়। মুজিবকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তিনি সশরীরে থাকলে পরিস্থিতি একরকম হতো। কিন্তু তিনি তো নেই। এদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ও দলের হুইপ ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামসহ কয়েকজন শীর্ষ নেতা পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিয়েছেন। বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স তাদের দেখাশোনা করছে। অন্য নেতাদের কেউ কেউ গোপন পথে মেঘালয় ও আসামে পাড়ি দিয়েছেন। কে কোথায় উঠেছেন কেউ খবর রাখে না। একটা সুখবর খবর হলো তাজউদ্দীন আহমদ এরই মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। বুঝতেই পার সাক্ষাৎকারটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ- ভারতের সমর্থনের প্রশ্নে কত বড় ইতিবাচক ঘটনা। 

মল্লিকা সেনগুপ্ত: স্যার, পক্ষে-বিপক্ষে নানা কথা আছে, থাকবেও। তবু শ্রীমতি গান্ধী সম্পর্কে আপনার অভিমত কী? 
সার্জন রথীন দত্ত: দেখ, আমি রাজনীতির মানুষ নই। মিসেস গান্ধীর রাজনৈতিক বিরোধীরা যা ইচ্ছে বলতে পারেন। কিন্তু যদি ১৯৭১ সালের কথা বল, তাহলে আমার মতামত খুবই স্পষ্ট। আমার মনে হয় কি জান, ১৯৭১ সালে ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী না হয়ে যদি অন্য কেউ থাকতেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন যদি ভারতের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তির সঠিক রূপয়ানে গুরুত্ব না দিত এবং বাংলাদেশ যুদ্ধের রাজনৈতিক মূল্যায়ন মস্কোর ভূমিকা যথার্থ না হতো, তাহলে নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিলম্বিত হওয়ার কারণ ছিল। 

মল্লিকা সেনগুপ্ত: বুঝলাম স্যার, এবার আগের কথায় ফিরি আমরা। 

শোন, তাজউদ্দীনের সঙ্গে শ্রীমতি গান্ধীর পরপর দুটি বৈঠক হয়। বিস্তারিত আলোচনার পর স্থির হয়, অনতিবিলম্বে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে বাংলাদেশের সরকার গঠন করা হবে, যে সরকার যুদ্ধ পরিচালনা করবে। আরও ঠিক হয় ভারত তার ভূমি ব্যবহার করে রেডিওসহ সব ধরনের প্রচার কাজ চালাতে দেবে। আরও বড় সিদ্ধান্ত হয় ভারতের মাটিতে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠবে- যার দেখাশোনা করবে বাংলাদেশ ও ভারত যৌথভাবে। কিন্তু সবচেয়ে বড় সংকট দেখা দিল বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয় নেওয়া নেতৃবৃন্দের মধ্যে কার্যকর যোগাযোগ স্থাপিত না হওয়ায়। এ ক্ষেত্রে বিএসএফ সহায়তা করল। অতি অল্প সময়ের মধ্যে সবাইকে খুঁজে বের করা সম্ভব হলো। 

এদিকে আগরতলায় আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা, বিশেষ করে যারা ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে এমএনএ বা এমপিএ হয়েছেন তারা পাকিস্তান বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার উদ্যোগ নিলেন। ২ এপ্রিল ১৯৭১ তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বসলেন মেলারমাঠে অনিল ভট্টাচার্যের বাড়িতে। 

সেদিনের বৈঠকটি ছিল পাকিস্তানি গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ, যা এক মাইলফলক। জহুর আহমদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভা থেকে আওয়ামী লীগের ৩৫ জন এমএনএ, এমএলএ সর্বপ্রথম বিশ্ববাসীর সামনে একটি যৌথ বিবৃতি প্রচার করলেন। বিবৃতিটি পাঠানো হয় জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট-এর কাছে। Stop this Genocide- ‘বন্ধ কর এই গণহত্যা’ শিরোনামে ইংরেজিতে তৈরি হয় বাংলাদেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের প্রথম যৌথ বিবৃতিটি।

চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল্লাহ-আল-হারুন, টাইমস অব ইন্ডিয়ার সাংবাদিক সুভাষ চক্রবর্তী এবং পান্নালাল দাশগুপ্ত সম্পাদিত ‘কম্পাস’ সাময়িকীর নিজস্ব প্রতিনিধি অমর রাহা এটি রচনা করতে সহায়তা করেন। এরা সবাই তখন আগরতলায়। প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া (পিটিআই) বার্তা সংস্থার অফিসের একটি পুরনো টাইপ রাইটারে এই বিবৃতি টাইপ করা হয়। পিটিআইয়ের বিশেষ প্রতিনিধি মধুসুধন গুহ রায় তখন বাংলাদেশের যুদ্ধ ‘কভার’ করতে আগরতলায় আছেন। মধুবাবু টেলিফোনে কলকাতায় হেয়ার স্ট্রিটের পিটিআই অফিসে খবরটি পাঠিয়ে দিলেন। এটি ছিল তার ‘স্কুপ নিউজ’। কারণ অন্য কাউকেই খবরটি তখনো দেওয়া হয়নি। পরদিন সব জাতীর স্তরের খবরের কাগজে খবরটি ফলাও হয়ে বেরোল। এরপর গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল। 

চলবে...

১ম পর্ব

২য় পর্ব

৩য় পর্ব

৪র্থ পর্ব

৫ম পর্ব

৬ষ্ঠ পর্ব

৭ম পর্ব

৮ম পর্ব

৯ম পর্ব

১০ম পর্ব

১১তম পর্ব