![মানস সংগঠক সত্যজিৎ রায়](uploads/2024/04/19/1713504713.SATTYJIT.jpg)
সত্যজিৎ রায় লেখক। ছোটদের, বড়দের সবার। পাশাপাশি তিনি একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, শিল্পনির্দেশক এবং সংগীত পরিচালক। প্রাবন্ধিক, চিত্রকর ও চিত্রগ্রাহক। বহুমুখী প্রতিভার এই মানুষ জন্মগ্রহণ করেন কলকাতায়। তার পূর্বপুরুষের নিবাস ছিল বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার কাটিয়াদি উপজেলায় মসুয়া গ্রামে। তখন অবশ্য জেলা ছিল ময়মনসিংহ। সেই ব্রিটিশ শাসনামলে। তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন ১৯২১ সালের ২ মে এবং পরলোকগমন করেন ২৩ এপ্রিল ১৯৯২। বাবা প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক ও ননসেন্স ছড়ার জনক সুকুমার রায়। মা সংগীতশিল্পী সুপ্রভা রায় আর পিতামহ খ্যাতিমান শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী।
সত্যজিৎ রায় তার সমগ্র কর্মজীবনের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯২ সালে অস্কার পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি ভারতরত্ন এবং পদ্মভূষণসহ সব মর্যাদাপূর্ণ ভারতীয় পুরস্কার লাভ করেছেন। তার ডাকনাম ছিল মানিক।
সত্যজিৎ রায় অন্যান্য সব পরিচয় ছাপিয়ে মূর্ত হয়ে ওঠেন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক হয়ে। তার চলচ্চিত্রে সামাজিক বাস্তবতা ও রাজনীতি এসেছে স্পষ্টভাবে। যা মানুষকে অধিকার সচেতন করে তোলে আর নিজেকে প্রশ্ন করতে শেখায়।
সত্যজিৎ রায় পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে বানানো ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তি পায় ১৯৫৫ সালে। ১৯৫৬ সালে কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘পথের পাঁচালী’ বেস্ট হিউম্যান ডক্যুমেন্ট পুরস্কার লাভ করে। অনেকেই মনে করেন সত্যজিৎ রায়ের এই চলচ্চিত্র ভারতীয় চলচ্চিত্রের বাঁক বদলে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। ‘পথের পাঁচালী’ যেমন সময়ের দলিল তেমনি আটপৌরে নিত্যজীবনের এক নগ্ন অথচ শৈল্পিক উপস্থাপন। লেখক আর্থার সি. ক্লার্ক এই চলচ্চিত্র সম্পর্কে বলেছেন, পথের পাঁচালী পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর এবং হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া ছবিগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই ছবির কিছু দৃশ্য এতই হৃদয়বিদারক যে, আমি সেগুলো আর কখনো দেখিনি।
১৯৪৩-৪৪ সালের দুর্ভিক্ষপীড়িত বৃহত্তর বাংলার পটভূমিতে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা উপন্যাস থেকে ১৯৭৩ সালে সত্যজিৎ রায় তৈরি করেন ‘অশনি সংকেত’ চলচ্চিত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার সেনাবাহিনীর জন্য অতিরিক্ত খাদ্য সংগ্রহ করতে থাকে। তখন বাংলার গ্রামে তীব্র খাদ্যসংকট দেখা দেয়। সেই দুর্ভিক্ষে ৫০ লাখ মানুষ মারা যায়। দুর্ভিক্ষ কীভাবে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষকে প্রভাবিত করেছে সেই ছবি তুলে এনে সত্যজিৎ রায় ‘অশনি সংকেত’ চলচ্চিত্রে দেখিয়েছেন যুদ্ধ কেমন করে মানবতার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়।
সত্যজিৎ রায়ের যে চলচ্চিত্র রাজনৈতিক দৃষ্টিতে কালজয়ী হয়ে আছে তা হলো ‘হীরক রাজার দেশে’। তিনি এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন ১৯৮০ সালে। সত্যজিৎ রায় দেখিয়েছেন শিল্প, রাজনীতি আর মানস সংগঠনে সমাজ সচেতনতা একে অন্যের সঙ্গে মিশে একত্রে চলতে পারে। ‘হীরক রাজার দেশে’ চলচ্চিত্রে দৃঢ় গলায় উচ্চারিত হয়েছে, অনাচার করো যদি রাজা তবে ছাড়ো গদি। যারা তার ধামাধারী, তাদের বিপদ ভারি। এই চলচ্চিত্র যখন বানানো হয় তখন ক্ষমতায় ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস সরকার। দেশে জরুরি আইন ঘোষণা করা হয়েছে। সেই প্রেক্ষিতে মানুষকে জাগাতে, প্রতিবাদী করে তুলতে ‘হীরক রাজার দেশে’ অনন্য অবদান রেখেছে। তিনি চলচ্চিত্রে শোষিত-অবহেলিত কৃষকের কথা নিয়ে এসেছেন। কৃষিপ্রধান দেশে কৃষকরা অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। সেখানে হীরকের রাজা যন্তরমন্তর ঘরে কৃষককে ঢুকিয়ে তার মগজধোলাই করে। তাকে শেখানো হয় মন্ত্র, বাকি রাখা খাজনা, মোটে ভালো কাজ না। ভরপেট নাও খাই, রাজকর দেওয়া চাই। যায় যদি যাক প্রাণ হীরকের রাজা ভগবান। এ এক কঠিন সমাজ বাস্তবতা। যা রাষ্ট্রের জনগণকে নিষ্পেষণের বীভৎস চিত্র হয়ে আছে। যা এখনো প্রাসঙ্গিক।
নাট্যকার হেনরিক ইবসেনের ‘এনিমি অব দ্য পিপল’ নাটক অবলম্বনে সত্যজিৎ রায় ১৯৯০ সালে তৈরি করেন চলচ্চিত্র ‘গণশত্রু’। সেখানে দেখা যায় ভঙ্গুর রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভয়াবহ চিত্র। রাষ্ট্রের ব্যর্থতা, অসার রাজনীতি, আমলাতান্ত্রিকতা, দুর্নীতি এবং সমাজের নৈতিকতার অবক্ষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এই ‘গণশত্রু’ চলচ্চিত্রে।
এবার আসি সাহিত্যে। সত্যজিৎ রায় বাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয় দুই চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। তার একটি হলো ফেলুদা এবং অন্যটি বিজ্ঞানী প্রফেসর শঙ্কু। ফেলুদার আসল নাম প্রদোষ চন্দ্র মিত্র। তিনি একজন শখের গোয়েন্দা। তুখোড় ক্ষুরধার বুদ্ধির গোয়েন্দা ফেলুদা আমাদের সামনে উন্মোচন করে চলেন একের পর এক রহস্য। বাদশাহী আংটি, সোনার কেল্লা, কৈলাসে কেলেঙ্কারি, রয়েল বেঙ্গল রহস্য, জয় বাবা ফেলুনাথ- এরকম অনেক কাহিনি। পাগলাটে বিজ্ঞানী প্রফেসর শঙ্কু আমাদের নিয়ে যান বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির জগতে। গল্পগুলো প্রফেসর শঙ্কুর কাণ্ডকারখানা, মহাসংকটে শঙ্কু, শঙ্কু একাই একশ ইত্যাদি। এই দুই চরিত্র ছাড়াও আরেকজন আছেন। তিনি হলেন তারিণীখুড়ো। একজন চিরকুমার বৃদ্ধ, যিনি নিজের জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে গল্প বলতে ভালোবাসেন। এই তিন চরিত্রের পাশাপাশি সত্যজিৎ রায় বেশকিছু ছোটগল্পও লিখেছেন। যেমন ফটিকচাঁদ, সুজন হরবোলা ইত্যাদি।
সত্যজিৎ রায়ের লেখালেখির বৃহৎ অংশজুড়ে আছে শিশু-কিশোর। সত্যজিৎ রায়ের সাহিত্য শিশু-কিশোরদের বুদ্ধিমত্তা বিকাশে যথেষ্ট প্রভাব রেখেছে। কোনো বিষয়ের প্রতি আগ্রহ ও কৌতূহল শিশু-কিশোরদের বুদ্ধিমত্তা ও মানস সংগঠনে প্রবল ভূমিকা রাখে। তারা যুক্তি দিয়ে কোনো কিছু বিচার করতে, ধাঁধা ও অঙ্কের খেলা খেলতে, সমস্যার সমাধান করতে পছন্দ করে এবং আনন্দ পায়। তাতে তাদের মানসিক বিকাশ সম্পূর্ণ হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে সত্যজিৎ রায় অগ্রগণ্য। তিনি আগামী প্রজন্মের ভিত তৈরি করতে, শিশু-কিশোরদের মানস সংগঠনে বিশেষ অবদান রেখেছেন।
সত্যজিৎ রায়ের লেখা ফেলুদার বিভিন্ন কাহিনিতে সমস্যা সমাধানের সূত্র হিসেবে সাংকেতিক পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। এই সাংকেতিক সমস্যা ও তার সমাধানের ভেতর দিয়ে বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটে থাকে।
যেমন সত্যজিৎ রায়ের লেখা ‘রয়েল বেঙ্গল রহস্য’ শুরু হয়েছে সংকেত দিয়ে। সেখানে লেখা আছে,
মুড়ো হয় বুড়ো গাছ,
হাত গোন ভাত পাঁচ
দিক পাও ঠিক ঠিক জবাবে।
ফাল্গুন তাল জোড়
দুই মাঝে ভুঁই ফোঁড়
সন্ধানে ধন্দায় নবাবে।
এই সংকেতের অর্থ থেকে খুঁজে পাওয়া যাবে গুপ্তধন। যেখানে মুড়ো হয় বুড়ো গাছ মানে গাছটি প্রাচীন (বুড়ো গাছ)। ‘হয়’ মানে ঘোড়া আবার ঘোড়া মানে অশ্ব। মুড়ো হচ্ছে গোড়া। বুড়ো গাছের গোড়া হলো অশ্ব। অর্থাৎ অশ্বথগাছ।
হাত গোন ভাত পাঁচ। ভাত মানে অন্ন। তাতে পাঁচ যোগ করলে হয় পঞ্চান্ন। অর্থাৎ গাছের গোড়া থেকে পঞ্চান্ন হাত দূরে।
দিক পাও ঠিক ঠিক জবাবে। জবাবের শব্দার্থ হলো উত্তর অর্থাৎ উত্তর দিকে।
ফাল্গুন তাল জোড়। ফাল্গুন হলো অর্জুনের আরেক নাম। আর অর্জুন শুধু পঞ্চপাণ্ডবের একজন নয়, অর্জুন গাছও বটে।
ফাল্গুন তাল জোড়, দুই মাঝে ভুঁই ফোঁড়। একটা অর্জুনগাছ আর জোড়া তালগাছের মাঝখানে জমি খুঁড়তে হবে।
সন্ধানে ধন্দায় নবাবে। যার সন্ধান মিললে নবাবদের চোখও ধাঁধিয়ে যাবে।
এই সাংকেতিক ধাঁধা যেমন মজার তেমনি তাতে আছে যুক্তি আর বুদ্ধির সমন্বয়। যুক্তি আর বুদ্ধি ছাড়া এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। পুরো কাহিনিজুড়ে আছে রহস্য, রোমাঞ্চ, যুক্তি-বুদ্ধি আর কল্পনা শক্তির প্রয়োগ। এই চর্চা পাঠকের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে সহায়ক। তাই সত্যজিৎ রায়ের লেখা বেশি বেশি পড়া সবার জন্য অত্যন্ত জরুরি।
২৩ এপ্রিল সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুদিন। এ দিনের স্মরণে তার প্রতি রইল আমাদের হৃদয় নিংড়ানো শ্রদ্ধা।