![কাঁচি](uploads/2024/05/10/kaci-1715321625.jpg)
শাহজাদি বেগমের মন মোটেই ভালো নেই। শরীর ভালো না থাকলে মনও ভালো থাকে না। এক শ একটা অসুখ শরীরজুড়ে। তারপরও চলছিলেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। বরাবরের স্বাবলম্বী মানুষ। কারও সাহায্য নিতে পছন্দ করেন না। খারাপ শরীর নিয়ে চলছিলেন। কিন্তু হাতে মোটেও জোর নেই। বুড়ো হয়েছেন বলে জোর নেই, এমনটা নয়। সারা জীবনই হাতে শক্তি কম। একটা বোয়েমের মুখও তিনি খুলতে পারেন না। অন্যের হাতে সহজে যা খুলে যায় তিনি সর্বশক্তি দিয়েও তা খুলতে পারেন না। পানির বোতল, কোকের ছিপি এমনকি চিপস-চকলেটের প্যাকেটও খুলতে অন্যের সাহায্য লাগে। চাকরি জীবনে লোকজন ছিল। তারপরও বলতে চাইতেন না বলে বেশির ভাগ সময় পানি বা কোক না খেয়েই চলে আসতেন। এখন তিনি অবসরে। চাইলেই হাতের কাছে লোক পাওয়া যায় না। ভীষণ অসুবিধা হয়। হয়তো একটু আচার খেতে ইচ্ছে করল। আচারের বয়াম কিছুতেই খুলতে পারেন না। ডিম ভাজবেন, তেলের শিশির মুখ খুলতে পারেন না। কেউ এক প্যাকেট চিপস দিয়েছে, খেতে ইচ্ছে করছে। প্যাকেট খুলতে পারেন না। এটা একটা জীবন হলো! সবসময় হাতের পাশে লোকও থাকে না। আর লোক বলতে তো সেই এক মেয়ে। সকালে উঠে চাকরিতে চলে যায়, ফিরতে ফিরতে রাত। দুপুরে কাজের মেয়ে আসে। আসে বললে ভুল হবে। মাঝে মাঝে আসে ইচ্ছেমাফিক। তিন ঘরে তিন বাড়ি আর ধাপুর-ধুপুর কিছু প্লেট-গ্লাস ছুড়ে বেঁকিয়ে দিয়ে তার কাজের হিসেব বুঝিয়ে চলে যায়। হিসেব বোঝানো কথার কথা। ওর কাজের হিসেব নিতে গেলে পরদিন থেকে আসবে না। কাজেই সে চেষ্টা শাহজাদি করেন না। একা একা দুপুরের খাবার খান। আর খেতে বসলেই নানান বিপত্তি হয়। এখন তো আর আগের দিন নেই। গরম তরকারি কড়াইতে থাকে না। থাকে বক্সে বক্সে, ফ্রিজে। সেই বক্স বের করে ওভেনে গরম করতে হয়। কোনো কোনো সময় ভাত-তরকারির বক্সের ঢাকনিও খুলতে পারেন না। এমনও হয়েছে ঢাকনি খুলতে না পেরে শুধু ভাত-মরিচ-পেঁয়াজ ডলে খেয়েছেন। কিন্তু বলবেন কাকে! দোষারোপ করলে তো সময়কেই করতে হয়, আর করতে হয় শরীরকে।
ওষুধ খেতেও সমস্যা তার। পাতা থেকে ওষুধ বের করতে পারেন না বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। মনে মনে বাপ-মাকে গালিগালাজ করেন, ছেলেবেলায় ঠিকমতো স্বাস্থ্যবিধি মেনে বড় করেননি বলে। সেটা করলে নিশ্চয়ই তার হাত এত কমজোর হতো না! তার ওপর আবার নাম রেখেছেন শাহজাদি। শাহজাদি না ফকিরজাদি। ফকিরজাদি তবু খাবারের সময় ভাতটুকু পায়! শাহজাদির একবারও মনে পড়ে না অন্য ভাইবোনদের কব্জির জোর ঠিকই আছে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ওপর রাগ শাহজাদির। রাগ প্রয়াত স্বামীর ওপর। দিব্বি তো আছে একা একা আজিমপুর কবরস্থানে মহাআনন্দে শুয়ে! বয়াম খোলা, প্যাকেট খোলার ঝক্কি নেই। স্বার্থপর, প্রবল স্বার্থপর! এ কেমন জীবন। হাতের কাছে ভরা কলস তৃষ্ণা মেটে না।
কব্জির শক্তি বাড়ানোর অনেক কসরত করেছেন তিনি। একজাতীয় বল টিপলে নাকি শক্তি বাড়ে। বছরের পর বছর টিপে গেছেন। বিন্দুমাত্র উপকার হয়নি। ইউটিউব দেখে ব্যায়াম শিখেছেন। নিয়মিত করেন। লাভ নেই, যা তা। বোতল-বয়াম খোলার ব্যবস্থা তিনি করতে পারেননি। চেষ্টা করেন বুয়া এলে প্রয়োজনীয় জিনিসের মুখ খুলিয়ে রাখতে। মনে থাকলে হয়। তবে ওষুধ বের করা, প্যাকেট খোলার একটা ব্যবস্থা করে নিয়েছেন তিনি। মেয়েকে বলেছেন যতটা সম্ভব বয়াম বাদ দিয়ে প্যাকেটে জিনিসপত্র আনতে। আজকাল প্রায় সব জিনিসই প্যাকেটে পাওয়া যায়। মেয়ে তাই আনে। শাহজাদি বেগম হাতের পাশের টেবিলে একটা কাঁচি রেখেছেন। ছোট্ট একটা ধাঁরালো কাঁচি। যেকোনো প্যাকেট খোলার কাজে এখন তিনি এই কাঁচি ব্যবহার করেন। তার কষ্ট এখন অনেকটা কমে গেছে।
সেই কাঁচিটাই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না দুই দিন ধরে। চরম বিপদে পড়েছেন তিনি। না খেতে পারছেন ওষুধ, না খুলতে পারছেন কোনো প্যাকেট। মহাবিরক্ত তিনি। মেয়েকে বলেছেন,
: কাঁচিটা খুঁজে পাচ্ছি না।
: আছে কোথাও।
: রুকসানা নিয়ে গেল নাকি?
: ও কাঁচি নিতে যাবে কেন? নিলে তো অনেক দামি জিনিসই আছে নেওয়ার। খুঁজে দেখ। পেয়ে যাবে।
খুঁজে না দেখে কি আর মেয়েকে বলেছেন শাহজাদি। মেয়ের নির্লিপ্ত উত্তরে ভীষণ বিরক্ত শাহজাদি! ও কী করে বুঝকে কী যাতনায় আছেন তিনি! রান্নাঘরে কাঁচি-ছুরি আছে। কিন্তু প্রতিটি কাজে ঘর থেকে রান্নাঘরে যাওয়া আবার রান্নাঘরে জিনিস রেখে আসা ঝামেলা। তাছাড়া প্রেসার ওঠানামা করে তার। হঠাৎ উঠতে গেল পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা। শাহজাদি বেগম হতাশ!
দুপুরে খেতে বসে অনেক চেষ্টা করেও তেঁতুলের আচারের বয়ামটা খুলতে পারলেন না। আজকাল সব কিছু মুখে বিস্বাদ লাগে। ভাত না খেয়েই উঠে গেলেন। টেবিলে সাজানো অনেকগুলো আপেল। একটা আপেল নিয়ে কাটতে চেষ্টা করলেন। পারলেন না। চিবিয়ে খেতে গেলেন। দুটো দাঁত ভেঙে আছে অনেকদিন। যাই যাই করে ডাক্তারের কাছে যাওয়া হয়নি। দাঁতের ডাক্তার মানে অনেকদিনের ব্যাপার। অভুক্ত অবস্থায় বিছানায় গেলেন। মেয়ের ওপর প্রচণ্ড রাগ তার। মেয়ে আর একটা কাঁচি এনে দিল না। প্রচণ্ড কান্না পেল। অভুক্ত পেটে চোখের জল ফেলতে ফেলতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলেন, চমৎকার এক মহলের বাগানে ঘুরছেন তিনি। সে বাগানের গাছে গাছে পাকা আম, কমলা, আপেল আরও কত নাম-না জানা ফল। ক্ষুধার্ত শাহজাদি ফল খাওয়ার জন্য ছিঁড়তে গেলেন। পারলেন না। বারবার চেষ্টা করলেন। কাঁচি খুঁজলেন। নেই। প্রচণ্ড হতাশা নিয়ে গেলেন বাগানের পাশের মহলে। সেখানে নানান রকম খাবার বাক্সভর্তি। আপ্রাণ টানলেন বাক্সের ঢাকনি। খুলতে পারলেন না। প্যাকেটবোঝাই কত বাদাম, আখরোট আরও কত কী। প্যাকেট খুলতে পারলেন না। আশ্চর্য এত বড় মহল, এত খাবার, একটা ছুরি-কাঁচিও নেই! অদ্ভুত! কাঁদতে লাগলেন তিনি। কাঁদতে কাঁদতে এক সময় ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভেঙে তীব্র ক্ষুধা অনুভব করলেন। মনে পড়ল রাতে খাওয়া হয়নি। তুফানের মতো ধেয়ে এল কান্নার বেগ! দ্বিগুণ বেগে ধেয়ে এল অভিমান। মেয়ে কেন বোঝে না মার কষ্ট! শাহজাদি ভুলে গেলেন মেয়ে বরাবর চায় সর্বক্ষণ তার পাশে একটা লোক থাকুক। দু-একবার রেখেছেও। শাহজাদি ছাড়িয়ে দিয়েছেন। সর্বক্ষণ তার চারপাশে একজন ঘুরঘুর করবে এটা তার পছন্দ না। এখন শাহজাদি কী করবে। বাড়িতে অনেক খাবার। কোনোটাই তিনি খেতে পারছেন না। রান্নাঘর থেকে ছুরি-কাঁচি এনে তিনি চানাচুরের প্যাকেট খুলতে পারেন। কিন্তু না, তিনি খুলবেন না। না খেয়ে মরে যাবেন। তার যখন কেউ নেই, তার কথা যখন কেউ ভাবে না তিনি মরেই যাবেন। মরার কথায় ধড়ফড় করে উঠে বসলেন। হ্যাঁ, তিনি মরেই যাবেন। এ যন্ত্রণাময় জীবনের চেয়ে মরে যাওয়া ভালো। মরে যাওয়ার সহজ পথ আছে। প্রতি রাতে ঘুমের ওষুধ খেতে হয় তাকে। আনকোরা দু-পাতা ওষুধ আছে। সবগুলো একসঙ্গে খাবেন। তারপর চিরশান্তি!
শাহজাদি বিছানা থেকে উঠলেন। ঘুমের বড়ির পাতা দুটো বের করলেন। পানি রেডি রাখলেন। একখানা চিরকুট লিখলেন, আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। লিখে পড়লেন। ছিঁড়লেন। এ লেখা লিখলে পুলিশ বুঝে যাবে তিনি আত্মহত্যা করেছেন। মেয়ের বিপদ হতে পারে। তার চেয়ে ভালো, কিছু না লেখা। সবাই মনে করবে ঘুমের ওষুধের ওভারডোজে মারা গেছেন। বাড়িটার দিকে একবার তাকালেন। দেয়ালের ছবিগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখলেন। স্বামীর ছবির দিকে তাকিয়ে কান্না গলায় আটকে রইল। মেয়ের ছবিতে হাত দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। পরক্ষণে নিজেকে সামলালেন। দুর্বল হলে চলবে না। তিনি ট্যাবলেট খুলতে দিয়ে ধাক্কা খেলেন। খুলতে পারলেন না। অনেক কষ্টে ঘেমে-নেয়ে দুটো ট্যাবলেট বের করলেন। এতে কিছু হবে না। ডুকরে কেঁদে উঠলেন তিনি! মরবেনই তিনি আজ। রান্নাঘর থেকে ছুরি এনে পাতা কেটে ওষুধ বের করবেন। ওষুধের পাতা ফেলে রেখে কাঁদতে কাঁদতে দরজা দিয়ে বের হতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। মেয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চেহারায় প্রবল দুঃশ্চিন্তা!
: মা কী হয়েছে। শরীর খারাপ নাকি? বহুক্ষণ ধরে দরজার সামনে হাঁটাহাঁটি করছি। তোমার ঘুম ভেঙে যাবে বলে ডাকিনি। আমার ভয় করছিল!
: তুই বাসায়?
: আজ ছুটি, শুক্রবার। বসো বসো। তোমাকে কেমন যেন দেখাচ্ছে। আর এই যে তোমার নতুন কাঁচি। দুটো এনেছি। একটা হারালে যাতে আরেকটা থাকে। আর এই যে তোমার পছন্দের স্ট্রবেরি। খোসা ছাড়িয়ে রেখেছি তুমি পার না তাই!
শাহজাদি মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদেন।
: কাঁদছ কেন মা। সামান্য একটা কাঁচি হারিয়ে কেউ এমন কাঁদে! পাগল মা আমার
: ভাগ্যিস হারিয়েছিল!
: মানে?
: ও তুই বুঝবি না।
লেখক: কথাশিল্পী ও গবেষক