ভারতের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শুরু হচ্ছে আজ। শেষ হবে ১ জুন। সাত ধাপের এই নির্বাচনের ফল বলে দেবে কার হাতে যাচ্ছে দিল্লির মসনদ। প্রায় ১০০ কোটি ভোটার এবারের নির্বাচনে ভোট দেবেন। আর নির্বাচনও হচ্ছে সবচেয়ে বেশি সময় নিয়ে। ফলে এ নির্বাচন হতে চলেছে বিশ্বের এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় নির্বাচন। এ ছাড়া এই ভোট ভারতের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গণতান্ত্রিক কাঠামো ও বৈশ্বিক গণতান্ত্রিকধারার জন্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এমনটাই মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি টানা তৃতীয় মেয়াদে জয়ী হওয়ার আশা করছেন। তিনি ৪০০-এর বেশি আসন পাওয়ার প্রত্যাশা করছেন। সাম্প্রতিক জরিপও বলছে, মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও এর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ) তৃতীয়বারের মতো নির্বাচনে জয়ী হবে। ২০১৯ সালের নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) একাই ৩০৩টি আসন পেয়েছিল। আর এনডিএ জোট পেয়েছিল ৩৫২টি আসন।
এবারের নির্বাচনে অন্যতম চ্যালেঞ্জ বৃহত্তম বিরোধীদল কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোটের পক্ষ থেকে। মোদির বিজেপিকে ঠেকাতে এবার বিরোধী ২৬টি দল জোট গঠন করেছে। প্রায় এক বছর আগে গড়া হয়েছে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্স (ইন্ডিয়া) নামের ওই জোট। এটি গঠনের পর ভারতের রাজনীতিতে তোলপাড় শুরু হয়েছে। মোদি বিরোধীদের মধ্যে এটি ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। ইন্ডিয়া জোট গঠনের পর কয়েকটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে সফলও হয়েছে বিরোধীরা।
ইন্ডিয়া জোট
২০২৩ সালের জুলাইয়ে ভারতের সব বিরোধী দল মিলে কংগ্রেসের নেতৃত্বে বিজেপির বিরুদ্ধে ‘ইন্ডিয়া জোট’ গঠিত হয়। সেই জোটে সর্বভারতীয় কংগ্রেস, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস, বিহারের জেডিইউ, আরজেডি, মহারাষ্ট্রের শারদ পাওয়ারের এনসিপি, উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা, দিল্লির ক্ষমতাসীন আম আদমি পার্টি, তামিলনাডুর-এএমএমকে, বামপন্থি সিপিআইএম, সিপিএম, টিডিএস, ওয়াইএসআরসহ সর্বভারতীয় ও আঞ্চলিক দলগুলোকে নেওয়া হয়।
এই জোটের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে আছেন কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট মল্লিকার্জুন খাড়গে, দুই ভাইবোন রাহুল গান্ধী ও প্রিয়াঙ্কা গান্ধী, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান মমতা ব্যানার্জি, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী বর্তমানে কারাবন্দি অরবিন্দ কেজরিওয়াল প্রমুখ।
ইন্ডিয়া জোটের মাধ্যমে বিরোধী শিবির আশা জাগানোর মতো একটি প্ল্যাটফর্ম পেয়েছিল। তবে অল্প কিছু দিনের মধ্যে জোটে ভাঙন দেখা দেয়। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতিশ কুমার যিনি ইন্ডিয়া জোটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, তিনি ইন্ডিয়া জোট ছেড়ে তার পুরনো মিত্র বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএতে যোগ দিয়েছেন এবং পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি তার রাজ্যে ইন্ডিয়া জোটকে অকার্যকর ঘোষণা করেন। এতে করে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোট বড় ধাক্কা খায় এবং জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা হতাশা ব্যক্ত করেন।
ইন্ডিয়া জোটের এই ধাক্কা খাওয়ার জন্য কংগ্রেস তথা রাহুল গান্ধীকে দায়ী করা হয়। অভিযোগ উঠেছে, রাহুল গান্ধীর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও নেতৃত্ব মোদির সঙ্গে টিকে উঠতে পারছে না। সে ক্ষেত্রে কংগ্রেসের উচিত আঞ্চলিক দলগুলোকে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া। তাহলে এই জোট একটি শক্ত ভূমিকা রাখতে পারবে।
সর্বভারতীয় দল হিসেবে কংগ্রেস যদি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে এবং সেক্যুলার ধারার সব রাজনৈতিক দল ও আঞ্চলিক দলগুলোকে এক ছাতার নিচে এনে উগ্র হিন্দুত্ববাদের বিপরীতে আদর্শিক লড়াইয়ে শামিল হতে পারে এবং গান্ধী পরিবার যদি নেতৃত্বের দক্ষতা দেখাতে পারে, তবেই কেবল ব্র্যান্ড মোদিকে আটকানো যেতে পারে।
রাজ্য ভেদে ভোট বিশ্লেষণ
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা দিয়েছেন, এবারের নির্বাচনে বিজেপির নেতৃত্বে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স (এনডিএ) লোকসভার ৫৪৩ আসনের মধ্যে ৪ শতাধিকে জয় পাবে।
তবে বিশ্লেষকদের উদ্ধৃতি দিয়ে গত বুধবার আল জাজিরার এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, টানা দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা এনডিএর মুখ মোদির ম্যাজিকের ধার অনেকটা কমে গেছে। এবারের নির্বাচনে এনডিএর সাফল্য আর শুধুই নরেন্দ্র মোদির ভাবমূর্তির ওপর নির্ভর করছে না। ফলে নির্বাচনি প্রচারে মোদি ‘এবার ৪০০ পার’ করার ডাক দিলেও ভোটাররা সাড়া দেবেন সেই লক্ষ্য পূরণের ম্যাজিক আর মোদির হাতে নেই! এনডিএর ভাগ্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে দক্ষিণের রাজ্যগুলো। যদিও গত নির্বাচনে ৩৫৪ আসন পেয়েছিল এনডিএ। এর মধ্যে শুধু বিজেপিই পেয়েছিল ৩০৩। এবার নির্বাচনে বিজেপির টার্গেট ৩৭০।
লোকসভা নির্বাচনের ইতিহাসে একক দল হিসেবে কংগ্রেস ৪০০ আসনের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল। ১৯৮৪ সালের নির্বাচনে সেটি সম্ভব হয়েছিল মূলত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকাণ্ডের ফলস্বরূপ জনগণের সহানুভূতির কারণে। কিন্তু এবার কংগ্রেসের অবস্থা এতটাই নাজুক যে বিজেপির সামনে ন্যূনতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারবে কি না তা নিয়ে সন্দিহান অনেক বিশ্লেষক।
তবে কংগ্রেস যে অবস্থায়ই থাকুক না কেন, হিন্দু জাতীয়তাবাদ পুঁজি করা বিজেপি এবারের নির্বাচনে ৪ শতাধিক আসন পাবে কি না সেটিই বড় প্রশ্ন। বিশ্লেষকদের মতে, এই বিষয়টি নির্ধারণ করে দেবে দক্ষিণ ভারত। কারণ, বিজেপির হিন্দুত্ব মন্ত্র দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোতে মোটেও কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। উত্তর ভারতে রাম স্লোগান যথেষ্ট প্রশংশিত হলেও দক্ষিণ ভারতে এর অতটা কদর নেই।
ভারতের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশের বাস দক্ষিণ ভারতের পাঁচ রাজ্য- তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, অন্ধ্র প্রদেশ, কেরালা ও তেলেঙ্গানায় এবং কেন্দ্রশাসিত পদুচেরি ও লাক্ষাদ্বীপে। এই অঞ্চলটিই অর্থনৈতিক দিক থেকে ভারতে সবচেয়ে সমৃদ্ধ। ভারতের জিডিপিতে দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোর অবদান ৩০ শতাংশের বেশি।
মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার ভারতে অর্থনীতিকে এগিয়ে নিলেও ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এই অঞ্চলের ১৩১ আসনের মধ্যে মাত্র ৩০টি পেয়েছিল। যার অধিকাংশই ছিল কর্ণাটকে। বাকি চার রাজ্যে বিজেপি সে অর্থে কোনো জায়গা পায়নি। বিশ্লেষকরা বলছেন, এবারের নির্বাচনেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি অবশ্যম্ভাবী।
সর্বশেষ লোকসভায় বিজেপি ৫৪৩ আসনের মধ্যে ৩০৩টিতে জিতেছিল, যার অধিকাংশই উত্তর ভারতে। দেশের এই অঞ্চল ঐতিহাসিকভাবেই বিজেপির অনুকূলে। কিন্তু লোকসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের যে আকাঙ্ক্ষা, তা বিজেপি পায়নি কেবল দক্ষিণের রাজ্যগুলোর কারণেই।
নয়াদিল্লিভিত্তিক থিংকট্যাংক সেন্টার ফর পলিসি অ্যানালাইসিসের চেয়ারম্যান মোহন গুরুস্বামী বলেন, ‘অন্ধ্র প্রদেশ ও দক্ষিণের অন্যান্য রাজ্যে বিজেপি খুবই অজনপ্রিয়। আসলে, এই অঞ্চলে যারাই বিজেপির সঙ্গে জোট করবে, তারাই এ নির্বাচনে খারাপ করবে।’
একই সুর অর্থনীতিবিদ ও বিজেপি সরকারের বর্তমান অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণের স্বামী পারাকালা প্রভাকরের কথায়ও। তিনি বলেন, আসন্ন নির্বাচনে ভোটের বাক্সে ‘উত্তর-দক্ষিণের’ বিভাজনের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোতে বিজেপির এই খাবি খাওয়া নতুন নয়। উত্তর ভারতের তুলনায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ সব সূচকেই দক্ষিণের রাজ্যগুলো এগিয়ে। একই সঙ্গে এই অঞ্চলে ধর্মীয় রাজনীতির প্রভাব কম। বিজেপির রাজনীতির ঐতিহ্যই ধর্মকেন্দ্রিক।
উত্তর ভারত ও দক্ষিণ ভারতের আর্থসামাজিক তুলনা টানা যেতে পারে কেরালা ও উত্তর প্রদেশের মধ্যে। কেরালায় নবজাতক মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে মাত্র ৬, যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সমান। অথচ একই দেশের উত্তর প্রদেশে নবজাতক মৃত্যুর হার হাজারে ৪৮, যা যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের সমান। মূলত এই তুলনামূলক অবস্থার কারণেই দক্ষিণ ভারতে বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি কখনোই হালে পানি পায়নি বলেই মনে করেন পারাকালা প্রভাকর।
ভারতের সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও তেলেগু দেশম পার্টির সাবেক নেতা কিশোর চন্দ্র দেও বলছেন, ‘উত্তর ভারতে মানুষকে ধর্মের ছাতার নিচে আনা সম্ভব হলেও দক্ষিণ ভারতে এটি সম্ভব নয়।’ কিছুদিন আগে, তেলেগু দেশম পার্টি ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিজেপির সঙ্গে জোট করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর কিশোর দল থেকে পদত্যাগ করেন।
তামিলনাড়ুর তথ্যপ্রযুক্তি ও ডিজিটাল পরিষেবাবিষয়ক মন্ত্রী পালানিভেল থিয়াগা রাজনও কিশোর চন্দ্র দেওয়ের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত। তিনি বলেন, ‘দক্ষিণে কয়েক শ বছর আগে থেকে সব ধর্মের মধ্যে সম্প্রীতিমূলক সহাবস্থানের ঐতিহ্য আছে। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের প্রচেষ্টা অবশ্যই দক্ষিণে বুমেরাং হবে।’
বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিপরীতে দক্ষিণ ভারতের সেক্যুলার অবস্থান টিকবে কি না তা আসন্ন নির্বাচনেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। তবে নির্বাচনের আগে, বিজেপি এবং মোদি অবশ্যই চেষ্টা করেছেন, দক্ষিণ ভারতে অবস্থান শক্ত করার। আর এ লক্ষ্যে মোদি বেছে নিয়েছিলেন তামিলনাড়ুকে, যেখানে লোকসভার ৩৯টি আসন রয়েছে।
পুরো তামিলনাড়ুতেই ১৯ এপ্রিল ভোট অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে, মোদি এই রাজ্যে অন্তত ছয়বার সফর করেছেন। এমনকি নিজের তামিল ভাষার অজ্ঞতা ঢাকতে তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) সাহায্য নিয়ে সমাবেশে হিন্দি ভাষণ তামিল ভাষায় শুনিয়েছেন। চেষ্টা করেছেন, তামিল ভোটারদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে ভোটার টানতে।
ভোটের পাল্লা ভারী করতে মোদি তামিল জনগণকে বিভাজিত করতে ৫০ বছর আগে নির্ধারণ হয়ে যাওয়া কাচ্চাথিভু দ্বীপের বিষয়টি হাজির করেছেন। তার সরকারের দাবি, তৎকালীন ভারত সরকার ইচ্ছা করে ভারতের সীমান্ত থেকে মাত্র ৩৩ কিলোমিটার দূরের দ্বীপটি শ্রীলঙ্কাকে উপহার দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তিনি মূলত তামিলদের মধ্যে সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদী আবেগ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।
কাচ্চাথিভু ইস্যুতে তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের প্রতি তোপ দাগার পাশাপাশি মোদি তামিলনাড়ুর ক্ষমতাসীন দল দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাঝাগাম বা ডিএমকের বিরুদ্ধে হিন্দুবিরোধী মনোভাবের অভিযোগ তুলেছেন। গত বছরে সেপ্টেম্বরে মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিনের ছেলে ডিএমকে নেতা উদয়ানিধি স্ট্যালিন হিন্দু তথা সনাতন ধর্মকে ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গুর সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি মূলত হিন্দুধর্মে বর্ণপ্রথার সমালোচনা করতে গিয়ে এই মন্তব্য করেছিলেন।
এই অবস্থায় দিল্লিভিত্তিক কিছু জরিপ সংস্থা বলছে, বিজেপি হয়তো সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ ভোট বাগাতে পারবে। তবে আসনসংখ্যা খুব বেশি হবে বলে মনে হয় না। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিজেপির জন্য বিষয়টি ‘বলা সহজ, করা কঠিন’- প্রবাদের মতোই।
তামিলনাড়ুর রাজনীতিতে কয়েক দশক ধরেই ব্রাহ্মণ্যবাদবিরোধী মনোভাব প্রবল। জাতীয়তাবাদী যেকোনো ধারণাই দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে দীর্ঘকাল ধরেই সন্দেহের চোখে দেখা হয়েছে। এই মনোভাবের কারণে, তামিল রাজনৈতিক নেতা রামাস্বামী নাইকার- যিনি পেরিয়ার নামেই বেশি পরিচিত- নিজের দল কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। তার অভিযোগ ছিল, কংগ্রেসের উচ্চপর্যায় ব্রাহ্মণদের নিয়ে গঠিত।
বিজেপি নেতারা প্রায়ই পেরিয়ারের সমালোচনা করেন। তবে ডিএমকে ও প্রতিদ্বন্দ্বী অল ইন্ডিয়া আন্না ডিএমকে (এআইএডিএমকে) উভয়ই পেরিয়ারের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার বহনের অঙ্গীকার করেছে। ফলে কংগ্রেসই যেখানে ছাড় পায়নি, সেখানে বিজেপি ঘাঁটি গেড়ে বসবে- এমনটা ভাবা অমূলকই।
তবে কর্ণাটকে বিজেপির অবস্থান তুলনামূলক রমরমাই বলা চলে। বিগত দুই দশকে দক্ষিণ ভারতে বিজেপির জন্য অনেক বেশি উর্বর ভূমি ছিল রাজ্যটি। ২০০৮ থেকে ২০১৩ এবং ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত রাজ্যটি বিজেপি শাসিত ছিল। এমনকি ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যটির ২৮ আসনের মধ্যে ২৫টিই জিতেছিল বিজেপি। তবে সর্বশেষ বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ক্ষমতায় ফিরেছে। ফিরেই লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখেছে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে ‘অন্যায়’ ও ‘বঞ্চনার’ অভিযোগ তুলেছে। ধারণা করা হচ্ছে, কংগ্রেসের এই কৌশল কাজে দেবে। এ বিষয়ে ‘দক্ষিণ বনাম উত্তর: মহাবিভাজন’ বইয়ে লেখক আর এস নীলাকান্তন বলেন, ‘উত্তরের তুলনায় এই দক্ষিণের রাজ্যগুলোর জনগণ গড়ে যে পরিমাণ কর দেয়, সেই তুলনায় কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ থেকে খুব সামান্যই পায়।’
নির্বাচনে বড় ইস্যুগুলো কী?
প্রধানমন্ত্রী মোদি দাবি করতেই পারেন যে, ভারতের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভালো সম্পর্কের কারণে বিশ্বে দেশটির অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চায় চীনের বিরুদ্ধে ভারতকে তাদের মিত্রদেশ করে রাখতে।
সম্প্রতি মোদি ভারতের ৮০ কোটি গরিবের জন্য একাধিক উদার কল্যাণমূলক কর্মসূচি চালু করেছেন। এর মধ্যে বিনামূল্যে শস্য সরবরাহ এবং কম আয়ের পরিবারের নারীদের মাসে ১ হাজার ২৫০ রুপি ভাতা দেওয়ার মতো বিষয় রয়েছে।
এদিকে, কংগ্রেস তাদের ইশতেহারে বলেছে, ভারতে এখন বেকারত্বের হার অনেক। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে। ইশতেহারে বাড়তি কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নারীদের ভাতা বৃদ্ধি এবং কলেজ উত্তীর্ণদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। ভারতকে স্বৈরাচারের পথ থেকে সরিয়ে আনা হবে এমন প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে কংগ্রেস।
সংখ্যালঘুদের অভিযোগ, তারা প্রায়ই বৈষম্য ও হামলার শিকার হন। মোদির শাসনামলে তারা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বাস করতে বাধ্য হচ্ছেন। তবে বিজেপি এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
আন্তর্জাতিক নাগরিক অধিকার সংস্থা ফ্রিডম হাউজ বলেছে, বিজেপি সরকারের সমালোচনা করা ব্যক্তিদের, বিশেষ করে সাংবাদিকদের হয়রানি করার ঘটনা বাড়ছে। সংস্থাটি ভারতকে ‘আংশিকভাবে স্বাধীন’ হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করে।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে এনডিএ জোট। আর প্রধানমন্ত্রী হন তৎকালীন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেদ্র মোদি। তবে ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মোদি দেশ ও বিদেশে ব্যাপক সমালোচিত হন। জাতিসংঘ, আমেরিকা এবং ইউরোপ নরেন্দ্র মোদিকে ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এক প্রকার দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েন মোদি। কিন্তু এই প্রতিকূলতা কাটানোর জন্য মোদি নজর দেন গুজরাটের আর্থ-সমাজিক উন্নয়নের ওপর এবং সেই উন্নয়নের ওপর ভিত্তি করে একধিকবার তিনি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন। সেই সঙ্গে জাতীয় রাজনীতিতে নিজের অত্যাবশ্যকীয়তা প্রমাণ করেন।
এরপর ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের এক বছর আগে অনুষ্ঠিত হয় তিন রাজ্য- রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়ে বিধানসভা নির্বাচন। ওই সব রাজ্য বিধানসভায় বিজেপি পরাজিত হয়। কিন্তু তার এক বছর পর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ওই সব রাজ্যে ব্যাপক ব্যবধানে জয় লাভ করে।
তখন রাজনৈতিক বিশ্বেষকরা মনে করেন, মোদির জন্যই লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি একচেটিয়াভাবে জয়লাভ করে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে আবার মোদি বিজেপিকে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা এনে দিতে সক্ষম হন।
মোদি এত জনপ্রিয় কেন?
গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় মোদি গুজরাটে ব্যাপক বিদেশি বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে সমর্থ হন এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে গুজরাটকে শিল্পবাণিজ্যে সমৃদ্ধ করেন। পাশাপাশি গেরুয়া রাজনীতিতে নিজের অবস্থান সু-সংহত করতে থাকেন।
২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর মোদি ভারতের রাজনৈতিক কৌশল পাল্টানোর জন্য তার অত্যন্ত আস্থাভাজন অমিত শাহকে গুজরাট থেকে দিল্লি নিয়ে এসে বিজেপির সভাপতি করেন। অমিত শাহের রাজনৈতিক কৌশলের কাছে বিরোধীদলগুলো ধরাশায়ী হতে থাকেন এবং অমিত শাহকে বলা হয় বর্তমান ভারতের রাজনীতির চাণক্য।
বিজেপির কেন্দ্রীয় কমিটি প্রতিটি রাজ্য এবং সরকারে নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতা একচ্ছত্র হতে থাকে। কারণ, পুরো পার্টির নিয়ন্ত্রণ অমিত শাহের হাতে। আর সরকারের নিয়ন্ত্রণ নরেন্দ্র মোদির হাতে চলে আসে। পাশাপাশি পুরো ভারতে গেরুয়াকরণের জন্য হিন্দুত্ববাদকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় এবং এতে ব্যাপক সফলতা আসে।
জাত-পাত, ধর্মীয় বিভাজনের কঠিন সমীকরণ ডিঙ্গিয়ে ভারতজুড়ে মোদি হিন্দুত্ববাদের একক অপ্রতিরোধ্য নেতাতে পরিণত হন। বাবরি মসজিদের স্থলে রামন্দির নির্মাণ বিজেপির রাজনৈতিক এজেন্ডা ছিল। মোদি সেটার বাস্তবায়ন করেছেন এবং রামমন্দির ইস্যুতে সংখ্যালঘুদের আবেদন অগ্রাহ্য করে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের সমর্থন নিজের দিকে নিতে সমর্থ হন।
প্রকান্তরে একসময় ভারতের উচ্চবর্ণের হিন্দুরা ব্যাপক হারে বিজেপিকে ভোট দিত। কিন্তু মোদি উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণ-দলিত সব সম্প্রদারের বৃহৎ অংশের সমর্থন নিজের দিকে নিতে পেরেছেন। এটাকে মোদির অন্যতম বড় রাজনৈতিক সফলতা বলে বিশ্বাস করেন রাজনৈতিক বোদ্ধারা।
২০২৩ সালে জি-২০ আয়োজন করে তা সফলভাবে সমাপ্ত করার কারণে মোদির কূটনৈতিক সফলতা পরিলক্ষিত হয়। পাশাপাশি ব্রিকসকে শক্তিশালীকরণ- আমেরিকা, রাশিয়া, ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যে মোদির কূটনৈতিক সফলতা এবং রাশিয়া-আমেরিকা ভারসম্যের কূটনীতি মোদি খুব দক্ষতার সঙ্গে সামলান। এতে করে বিশ্বব্যাপী মোদির একটি ভালো কূটনৈতিক ইমেজ তৈরি হয়, যা তাকে ভোটের মাঠে যোজন যোজন এগিয়ে রেখেছে। সূত্র: আল জাজিরা, বিবিসি।