যেকোনো নির্বাচনের ভোট গ্রহণের দিনটিকে উৎসব হিসেবে মনে করে মানুষ। এ জন্য দলে দলে এসে ভোটাধিকার প্রয়োগ করে তারা। রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ঝঞ্ঝা উপেক্ষা করেই তারা এ উৎসবে অংশ নেয়। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতও এর ব্যতিক্রম নয়। ২০০৪ সাল থেকে শুরু করে টানা পঞ্চমবার এই অসহ্য গরমের মৌসুমে ভারতীয়রা ভোট দিচ্ছে। বুথের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে ঘর্মাক্ত শরীর নিয়েও তাদের স্বতঃস্ফূর্ত দেখা যায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এত গরমে কেন এ নির্বাচন অনুষ্ঠান? এটি কি শরৎ বা শীতের মনোরম আবহাওয়াতে করা যেত না?
ভারতে আজ ১৯ এপ্রিল থেকে ১ জুন পর্যন্ত মোট সাতটি ধাপে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ১৮তম লোকসভা নির্বাচন। দেশটিতে তীব্র গরমের মাসগুলোতেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে এ ভোট উৎসব। অথচ এর আগে মাঝে দু-একটা ছাড়া গত শতাব্দী পর্যন্ত ভারতে সাধারণ নির্বাচন কিন্তু শরৎ বা শীতের মনোরম আবহাওয়াতেই হয়েছে।
কিন্তু দুই দশকের বেশি হলো গ্রীষ্মেই ভারতে লোকসভার ভোট হচ্ছে। আর এত গরমে ভোট হওয়ার পেছনে দায়ী করা হয় দেশের একজন সুপরিচিত রাজনীতিবিদকে। পেছনে তাকালে দেখা যায়, ভারতে ১৯৫১-৫২ থেকে শুরু করে ১৯৮৯ পর্যন্ত দেশের প্রথম ৯টি সাধারণ নির্বাচনই সম্পন্ন হয়েছে অক্টোবরের শেষ দিক থেকে মার্চের মাঝামাঝিতে। এই সময়কালের মধ্যে শরৎ বা শীতকাল ছিল। কিন্তু ১৯৯১ সালে তখনকার প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখর আচমকা পদত্যাগ করলে নবম লোকসভা ভেঙে দিতে হয়। সেই প্রথমবারের মতো ভারতে সাধারণ নির্বাচন হলো মে-জুন মাসের ভয়ংকর গরমে।
পাঁচ বছর পর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনও হয়েছিল এপ্রিল-মে মাসের তাপপ্রবাহে। কিন্তু পরপর দুটি লোকসভা তাদের মেয়াদ পূর্ণ করতে না পারায় ঘটনাচক্রে আবার পরের দু-দুটি নির্বাচন হয়েছিল শরতে বা শীতকালে। ১৯৯৯ থেকে ভারতে প্রতিটি লোকসভাই তাদের মেয়াদ পূর্ণ করেছে বা করার মতো অবস্থায় ছিল। কাজেই ১৯৯৯ সালে যেভাবে অক্টোবর মাসে শরতের মনোরম আবহাওয়ায় দেশে নির্বাচন হয়েছিল, সুযোগ ছিল যে তারপর থেকে সব নির্বাচনই বছরের ওই সময়টায় হবে।
কিন্তু সাংবাদিক রাজদীপ সারদেশাই জানাচ্ছেন, দেশের একজন সুপরিচিত রাজনীতিবিদের জন্যই সেটা সম্ভব হয়নি। আর তার নাম চন্দ্রবাবু নাইডু। অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ও তেলেগু দেশম পার্টির নেতা। ২০০৪ সালেও ভারতে নির্বাচন অক্টোবর মাসেই হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু তখন চন্দ্রবাবু নাইডু প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়িকে অনুরোধ করেন, লোকসভা নির্বাচনটা বরং কয়েক মাস এগিয়ে আনুন। তেলেগু দেশম তখন ছিল বিজেপি জোটের খুব গুরুত্বপূর্ণ শরিক– তাদের অনুরোধ ফেলা প্রধানমন্ত্রীর পক্ষেও বেশ কঠিন ছিল।
রাজদীপ সারদেশাইয়ের কথায়, চন্দ্রবাবু নাইডু চেয়েছিলেন তার রাজ্যের বিধানসভা ভোট ও দেশের লোকসভা ভোট একসঙ্গে করাতে– যাতে বাজপেয়ির উজ্জ্বল ভাবমূর্তিকে কাজে লাগিয়ে তিনি রাজ্যেও জিতে যেতে পারেন।
বাজপেয়ি ও তার প্রবল আস্থাভাজন প্রমোদ মহাজন সেই অনুরোধ রক্ষা করে লোকসভা ভোট ছয় মাস এগিয়ে আনলেন। আর নির্বাচন হলো এপ্রিল-মে মাসে! সেই নির্বাচনেই বিজেপি ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’ ক্যাম্পেইনে ভর করে তুমুল প্রচার চালিয়েছিল, আর অটল বিহারি বাজপেয়ির ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল তেলেগু দেশমও।
‘তাতে অবশ্য শেষরক্ষা হলো না– শেষে দেখা গেল বাজপেয়ি ও চন্দ্রবাবু দুজনেই সেই ভোটে হেরে গেলেন!’ জানাচ্ছেন রাজদীপ সারদেশাই। কিন্তু ততক্ষণে যাদের যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে এবং সেই ২০০৪ সাল থেকে এই নিয়ে টানা পঞ্চমবার অসহ্য গরমেই গোটা ভারতকে ভোটের লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে! এতদিন তবু এপ্রিল-মে মাসের মধ্যেই ভোট গ্রহণ সীমাবদ্ধ ছিল, এবার তা গড়িয়েছে জুন মাসেও।
অটল বিহারি বাজপেয়ি ও প্রমোদ মহাজন দুজনেই আজ প্রয়াত। ফলে এত গরমে ভোট হচ্ছে বলে যারা বিরক্ত, তাদের গালিগালাজ শোনার জন্য আছেন শুধু চন্দ্রবাবু নাইডুই! অবশ্য গত ২০ বছর ধরে অন্যদের মতো চন্দ্রবাবু নাইডুকেও তীব্র গরমে লোকসভা ভোটের প্রচার চালাতে হচ্ছে। সূত্র: বিবিসি ও এএফপি