রাজধানী ঢাকায় কমছে সবুজ, বাড়ছে কংক্রিটের পরিমাণ। ২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, গত ২৮ বছরে সবুজ এলাকা কমে ৯ শতাংশে নেমেছে। আর জলাভূমি নেমে এসেছে মাত্র ২ দশমিক ৯ শতাংশে। অন্যদিকে ১৯৯৯ সালে কংক্রিটের পরিমাণ যেখানে ছিল ৬৪ দশমিক ৯৯ ভাগ যা ২০১৯ সালে দাঁড়ায় ৮১ দশমিক ৮২ শতাংশে।
গতকাল শনিবার রাজধানীর প্ল্যানার্স টাওয়ারে ‘ঢাকায় তাপদাহ: নগর পরিকল্পনা ও উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার দায় ও করণীয়’ শীর্ষক পরিকল্পনা সংলাপে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান।
তিনি বলেন, ঢাকা শহরে সবুজ যেমন কমেছে, তেমনি গত দুই দশকে বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত ধূসর এলাকা ও কংক্রিটের পরিমাণ। যা নগর এলাকায় তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে মারাত্মক হারে। বাড়ছে আরবান হিট আইল্যান্ডের প্রভাব। ১৯৯৫ সালে সবুজ এলাকা ছিল ২০ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। ২০০৫ সালে হয় ১৫ দশমিক ৮৭ শতাংশ। ২০১৫ সালে হয় ১৪ দশমিক ১৮ শতাংশ। ২০২৩ সালে হয়েছে ৯ দশমিক ১২ শতাংশ।
বিআইপির সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে পুরো পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১ থেকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধির কথা বলা হলেও ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় এই তাপমাত্রা ৫ থেকে ৬ ডিগ্রি বেড়েছে। যার মূল কারণ ঢাকা শহরের আশপাশের প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার ও নগরায়নের নামে চালানো ধ্বংসযোগ্য।
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বিআইপির বোর্ড সদস্য (রিসার্চ অ্যান্ড পাবলিকেশন) পরিকল্পনাবিদ হোসনে আরা, পরিকল্পনাবিদ আবু নাইম সোহাগ, পরিকল্পনাবিদ রেদওয়ানুর রহমান প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। একই সঙ্গে ঢাকা মহানগরীতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও তাপদাহের প্রভাবের মূলে ভূমি আচ্ছাদনের (সবুজ, পানি ও ধূসর বা কংক্রিট আচ্ছাদন) মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট, কংক্রিটের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি, ভবনের নকশায় পরিবেশ ও জলবায়ুর ধারণা অনুপস্থিত, কাচ নির্মিত ভবন ও এসিনির্ভর ভবনের নকশা তৈরি, খাল-পুকুর ভরাট, দখল ও ধ্বংস, সবুজ এলাকা নষ্ট করে অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ, বনায়ন না করাসহ সাতটি কারণ তুলে ধরা হয়।
তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বিআইপির পক্ষ থেকে ২৩টি প্রস্তাব রাখা হয়। সেগুলো হলো- বিদ্যমান প্রতিটি সবুজ ও জলাশয় এলাকা সংরক্ষণ; জলবায়ু অভিযোজন পরিকল্পনা অনুযায়ী নগর এলাকায় সবুজায়ন বাড়াতে বৃক্ষরোপণ; খাল-বিল, জলাশয়, জলাভূমি ও ধ্বংস হওয়া সবুজ পুনরুদ্ধার; ধ্বংসকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা; কার্যকর নগর পরিকল্পনা ও ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনার মাধ্যমে সবুজ এলাকা, জলাশয় ও কংক্রিট এলাকার ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা; নগর এলাকার প্রান্তে সবুজ বেষ্টনী প্রকল্প গ্রহণ করা; সড়কের ধারে ও ফুটপাতের পাশে বৃক্ষায়নের উদ্যোগ বাড়ানো; ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জলাশয় ও জলাধার রক্ষা করা; আবাসিক এলাকা ও ভবনের মধ্যবর্তী স্থানে সবুজায়ন ও বৃক্ষায়ন বাড়ানো; সরু রাস্তার পাশে সুউচ্চ ভবন নির্মাণ করবার বিদ্যমান প্রবণতা বন্ধ করা; বেসরকারি আবাসিক প্রকল্পের বিধিমালা সংশোধন করে সবুজ ও জলাশয় এলাকা, পার্ক, উদ্যান, খেলার মাঠ বাড়ানোর যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা; দুই সিটি করপোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডের জন্য ওয়ার্ড মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন; পার্ক, উদ্যান, খেলার মাঠ উন্নয়ন প্রকল্পে সবুজবান্ধব ডিজাইন নিশ্চিত করা; বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা; মেগা প্রকল্প ও উন্নয়ন প্রকল্পে জলাশয়, জলাধার, সবুজ এলাকা, পার্ক, উদ্যান, খেলার মাঠ ধ্বংস না করা; এনার্জি এফিশিয়েন্ট ভবন ও গ্রিন বিল্ডিং কোড প্রণয়ন করা; এসির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও সীমিত করতে প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও নির্দেশনা প্রণয়ন করা; ভবনের ডিজাইনে প্রাকৃতিক আলো-বাতাস চলাচল ও এনার্জি এফিশিয়েন্সির বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে ভবনের নকশা প্রণয়ন ও যথাযথ নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবহার; প্রান্তিক, নিম্ন আয় ও বস্তি এলাকার মানুষের আবাসন পরিকল্পনা, বসতির নির্মাণ উপাদান-উপকরণসমূহের বিষয়ে যথাযথ নির্দেশনা ও নীতিমালা প্রণয়ন করা; নগর এলাকায় সবুজ ও জলাশয় রক্ষা করতে কমিউনিটিভিত্তিক সংগঠন সৃষ্টি ও নজরদারি বাড়ানো; তাপমাত্রা ও তাপপ্রবাহ বিবেচনায় নিয়ে নগর পরিকল্পনা ও ভবনের নকশা ও নির্মাণ নিশ্চিত করতে পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি, প্রকৌশলী, উদ্যানতত্ত্ববিদদের অন্তর্ভুক্তি ও সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা; জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব থেকে উদ্ধার পেতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় সরকার বিভাগ (সিটি করপোরেশন), পরিবেশ অধিদপ্তর, নগর উন্নয়ন অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরসহ ঢাকা মহানগরীর পরিকল্পনা এবং উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জলবায়ু অভিযোজন পরিকল্পনা সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা।