ঢাকা ২৫ কার্তিক ১৪৩১, রোববার, ১০ নভেম্বর ২০২৪

এস আলম গ্রুপকে সরকারের সহযোগিতা দেওয়া প্রয়োজন

প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:২৪ এএম
আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:১৭ এএম
এস আলম গ্রুপকে সরকারের সহযোগিতা দেওয়া প্রয়োজন
নেছার আহমদ

হাজার বছরের ঐতিহ্য ও ইতিহাসের অনন্য ভৌগলিক নগরীর নাম চট্টগ্রাম। প্রাচ্যের রানিখ্যাত চট্টগ্রাম সুপ্রাচীনকাল থেকে ব্যবসাবাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত। শিল্প ও বাণিজ্য সর্বক্ষেত্রে চট্টগ্রাম দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাণিজ্যনগরী বা শিল্পনগরী হিসেবে পরিচিত পাওয়ার নেপথ্যে আদিকাল থেকে বন্দর ও পোতাশ্রয়ের সুবাধে আরব, ইউরোপীয়, চাইনিজ, আফ্রো-এশিয়ান বণিকরা বাণিজ্যের উদ্দেশে চট্টগ্রামকে প্রাধান্য দিয়েছে। ফলে হাজার বছর ধরে চট্টগ্রামের অধিবাসীরা সওদাগর বা ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। সেই সুনামের ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামে জন্ম নিয়েছে কিংবদন্তিসম সওদাগর, ব্যবসায়ী, শিল্পপতিরা। মেধা ও দক্ষতায় তাদের ব্যবসার পরিধি দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে।

ভৌগলিক অবকাঠামোগত সুবিধার কারণে ব্রিটিশ আমলে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে সদর দপ্তর চট্টগ্রামে স্থাপিত হয়েছিল। পাকিস্তান আমলে বৃহৎ শিল্পকারখানা যেমন- ইস্পাত, মোটরগাড়ি, পাট, বস্ত্র, সুতা, তামাক, ম্যাচ, ওষুধ ইত্যাদি চট্টগ্রামে গড়ে ওঠে। বাঙালি মালিকানাধীন প্রধান ব্যাংক ও বিমার দপ্তর চট্টগ্রামে স্থাপিত হয়েছিল। ষাটের দশকে মুষ্টিমেয় যে কজন বাঙালি উদ্যোক্তা ও শিল্পপতি প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন তাদের মধ্যে এ কে খান, মীর্জা আবু ও এস আর সিদ্দিকী ছিলেন চট্টগ্রামের লোক। বর্তমান সময়ে তারই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন শিল্প গ্রুপ যেমন- এ কে খান, ইলিয়াছ ব্রাদার্স, আলহাজ খলিলুর রহমানের কেডিএস গ্রুপ, আখতারুজ্জামান চৌধুরী, টিকে গ্রুপ, এস আলম গ্রুপসহ বহু শিল্প গ্রুপ স্বমহিমায় তাদের শিল্পের প্রসার ঘটিয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রামের এ উন্নয়ন ও আলোকিত অধ্যায়কে স্বার্থন্বেষী মহল কখনো ভালো চোখে দেখেনি। সেই পাকিস্তান শাসনামল থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত তাদের ঈর্ষা, ষড়যন্ত্র, প্রতিহিংসা বারবার চট্টগ্রামকে সব পর্যায় থেকে বঞ্চিত রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তাদের সাফল্য তাদের গাত্রদাহের কারণ হয়েছে। ছলে বলে কৌশলে ও প্রচারণায় চট্টগ্রামের শিল্পমালিকদের হেয় করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। বর্তমান সময়েও এর ব্যতিক্রম নয়।

দেশের একটি স্বনামধন্য পত্রিকা নিয়মিতভাবে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের চরিত্র হরণের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এমন কোনো চটকদার কাহিনি নেই যা তারা তৈরি করেনি। তাদের ভাষা দেখলেই বোঝা যায় হিংসা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা কত নিলর্জ্জ হতে পারে! প্রতিহিংসা ও ষড়যন্ত্রের প্রধান শিকার বর্তমান সময়ের চট্টগ্রামের স্বনামধণ্য শিল্প গ্রুপ এবং সাধারণ মানুষের ত্রাণকর্তা এস আলম গ্রুপ এবং এই গ্রুপের কর্ণধার ‘সাইফুল ইসলাম মাসুদ’-এর কথা বলার চেষ্টা করছি। আমি একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমার দৃষ্টিতে যা দেখছি দেশবাসীর সম্মুখে তা এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

আশির দশকে পরিবহন ব্যবসা দিয়ে যাত্রা শুরু করা এস আলম গ্রুপ আজ হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে ব্যবসা সফলভাবে পরিচালনা করেছে, নিজেও একাধিক ব্যাংকের মালিক হয়ে সেগুলোকে ব্যবসার জন্য ব্যবহার করেছে। আজ পর্যন্ত সুনামের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করেছে, ঋণ খেলাপি হয়নি কখনো। দেশের সংবাদ মাধ্যমে তাকে দোষারোপ করা হচ্ছে বিদেশে টাকা পাচার করার অপবাদে। বিদেশে বিনিয়োগ নাকি ষড়যন্ত্র? বিদেশে ব্যবসা করা মানে বিদেশে টাকা পাচার? এস আলম বৈধভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যবসায় হাত বাড়িয়েছে। বিদেশিরা যেমন এ দেশে বিনিয়োগ করেছে। তেমনি এস আলমও বিদেশে বিনিয়োগ করেছে। এতে দোষের কী থাকতে পারে? এতে যদি কোনো অসংগতি থাকে বা কোনো অনিয়ম থাকে সরকার তা সংশোধন করতেই পারে। কিন্তু এখন প্রতিনিয়ত যা হচ্ছে তা এক ধরনের দুরভিসন্ধিমূলক এবং ষড়যন্ত্রমূলক আক্রমণ, যা দেশের একটি সুপ্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাওয়ার পাঁয়তারা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

দেশের সব বিবেকবান মানুষের কাছে আবেদন, দল-মতনির্বিশেষে এস আলম গ্রুপকে রক্ষা করার জন্য সোচ্চার হন। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে এ আবেদন করতে বাধ্য হচ্ছি। আজ এ সময়ে এটা কেবল এস আলমের একার লড়াই নয়, এটা আমাদের সবার ঐক্যবদ্ধ লড়াই। একটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করতে বেশি সময় লাগে না, কিন্তু গড়ে তুলতে লাগে বছরের পর বছর। এস আলমের এই দীর্ঘদিনের কষ্টার্জিত অর্জনকে এক নিমেষে শেষ হতে দেওয়া যায় না। আসুন, আমরা সবাই মিলে এই ষড়যন্ত্রের হাত থেকে এস আলম গ্রুপকে রক্ষা করি, তাদের পাশে দাঁড়াই। আমাদের মানবিক দায়িত্ব কেবল এই শিল্প গ্রুপকে রক্ষা করাই নয়, বরং আমাদের প্রাচ্যের রানি চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক ঐতিহ্যকেও রক্ষা করা। দেশের অর্থনীতিকে রক্ষা করা, আসুন, সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে চট্টগ্রামবিরোধী এ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই। আমাদের জাতীয় স্বার্থে এবং চট্টগ্রামের বৃহত্তর কল্যাণে এস আলম শিল্প গ্রুপকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষায় আমাদের দল-মতনির্বিশেষে সবাইকে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে চট্টগ্রামবাসীর জন্য এটি একটি মহাবিপদের সময়। লাখ লাখ শ্রমিক-কর্মচারীর কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখা এখন সময়ের দাবি। এস আলম শিল্প গ্রুপ দেশি-বিদেশি মহলে একটি গৌরবের প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। আজ সেই প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রাম বিদ্বেষী কূটকৌশলে দেউলিয়া হওয়ার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। দেশের এ কঠিন পরিস্থিতি থেকে এস আলমকে বাঁচাতে দল-মতনির্বিশেষে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি এবং প্রকৃত সত্য জানার ও অনুধাবন করার অনুরোধ করছি। 

এস আলম গ্রুপ দীর্ঘ সময় ধরে তিলে তিলে শ্রম, মেধা এবং সৃজনশীলতায় আজকের এই অবস্থানে এসেছে। কারোর দয়ায় নয়। কোনো না কোনো কারণে আজ এটি ষড়যন্ত্রের শিকার। লাখ লাখ মানুষের ভাগ্য এই গ্রুপের সঙ্গে জড়িত, তেমনি দেশের অর্থনীতিতেও তাদের অবদান উল্লেখযোগ্য। যেখানে আমরা এখনো শতভাগ বেকারত্ব দূর করতে পারিনি, সেখানে এস আলমকে দেউলিয়া করে লাখ লাখ কর্মরত মানুষকে বেকার করার অভিশাপ থেকে বাঁচানোর জন্য আমাদের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা মহোদয়ের সরাসরি হস্তক্ষেপ কামনা করছি। আজ এ ষড়যন্ত্র শুধু এস আলমের বিরুদ্ধে নয়, এই ষড়যন্ত্র চট্টগ্রামের বিরুদ্ধে, চট্টগ্রামের উন্নয়নের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক ষড়যন্ত্রের অংশ।

এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে লাগামহীন ষড়যন্ত্রের কারণ কী হতে পারে? বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়:
প্রতিযোগিতামূলক বাজারে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে এস আলমের ব্যবসা ধ্বংস করতে ষড়যন্ত্র চলছে। এ কাজে তারা একশ্রেণির তথাকথিত বুদ্ধিজীবী এবং মিডিয়াকে ব্যবহার করছে। এ ধরনের শত্রুতা এবং অপরিণত ব্যবসায়িক কৌশলগুলো তাদের এই ষড়যন্ত্রের মূল চালিকাশক্তি।

এ গ্রুপের অতুলনীয় ধারাবাহিক সাফল্য এবং তাদের শক্তিশালী নেতৃত্ব একশ্রেণির চট্টগ্রাম বিদ্বেষী মহলকে অসন্তুষ্ট করেছে। তারা মনে করে এস আলম গ্রুপের সাফল্য তাদের স্বার্থসিদ্ধির পথে বাধা।

এর পেছনে রাজনৈতিক কারণও থাকতে পারে। অনেক সময় একটি সফল প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক প্রভাব এবং চাপ প্রয়োগ করে তার স্বার্থবিরোধী কাজ করানোর চেষ্টা করা হয়। বিরোধীদের স্বার্থ রক্ষা এবং দেশের কিছু প্রভাবশালী মহল তাদের নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে এস আলম গ্রুপকে ধ্বংস করতে চাইছে। এ ষড়যন্ত্র আওয়ামী সরকারের সময় হতেই শুরু। এদের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখা এবং অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠানকে পেছনে ফেলে রাখা।

বর্তমানে দেশ ও জনগণের স্বার্থে গণসমর্থন গড়ে তোলা জরুরি। এ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ইতিবাচক সংবাদ পরিবেশনে ও লেখার মাধ্যমে দেশবাসীকে সত্য বিষয় জানিয়ে এস আলম গ্রুপের পক্ষে জনগণের সমর্থন দেশের অর্থনীতির স্বার্থে গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি কেবল একটি প্রতিষ্ঠান রক্ষার জন্য নয়, বরং জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্যও অত্যাবশ্যক।

একটা কথা বলে রাখা প্রয়োজন, এস আলমের ঋণের চেয়েও বিনিয়োগ বেশি।

ধারাবাহিক সাফল্যের কারণে বাংলাদেশ এখন এশিয়ার পঞ্চম টাইগার অর্থনীতি হিসেবে বিবেচিত। যদিও এটি বর্তমানে অবাস্তব শোনাতে পারে, কয়েক দশক আগে এমনকি উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তিকে বিশ্বমঞ্চে একটি ‘তলাবিহীন ঝুঁড়ি’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষ, প্রাকৃতিক দুর্যোগের অভিশাপকে অগ্রাহ্য করে বাংলাদেশ বিশ্বের ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। লন্ডনভিত্তিক সেন্টার ফর ইকোনমিক্স অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর)-এর পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০৩৮ সালের মধ্যে বিশ্বের ২০তম বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

গ্রুপটির অবদান ছাড়া বাংলাদেশের এই অসামান্য সাফল্য সম্ভব ছিল না। আগেই বলেছি, চট্টগ্রাম বন্দর শহরভিত্তিক অন্যতম বৃহৎ শিল্প সংগঠন এস আলম গ্রুপ।

এই গ্রুপটি ১৯৮৫ সাল থেকে ৩৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে ধারাবাহিকভাবে তার দীর্ঘ যাত্রায় প্রয়োজনীয় পণ্য, বিদ্যুৎ খাত, আমদানি ও পরিশোধন, অর্থনৈতিক অঞ্চল, স্বাস্থ্য, টেক্সটাইল, আইটি এবং অন্যান্য ব্যবসা স্থাপনে, হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। 

দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড গুগল এবং দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের গুগল নিজউ চ্যানেলের তথ্যমতে, এ শিল্পগ্রুপের উদ্যোগের ফলে ২ লাখেরও বেশি মানুষ সরাসরি চাকরি পেয়েছে ছয়টি ভোজ্য তেল ও দুটি চিনি শোধনাগারের মাধ্যমে অধিকাংশ দেশীয় তেল, গম ও চিনির চাহিদা পূরণ করে আসছে। দেশীয় ভোক্তাদের চাহিদা মেটানোর জন্য সরকারের হাতকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে দেশের বাজারে চিনি, গম, ছোলা, পেঁয়াজ, তেলের মতো প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি ও প্রক্রিয়াকরণের অগ্রণী ভূমিকা রেখে আসছে।

পরিসংখ্যানুযায়ী ২০২৩ সালে ৭ লাখ ৫০ হাজার টন চিনি আমদানি করেছিল সংস্থাটি, মূল্য ৪৯ কোটি ডলার। গত তিন বছরে (২০২০, ২০২২, ২০২১) চিনি আমদানির পরিমাণ ১৪ লাখ ৮২ হাজার মেট্রিক টন, যার মূল্য ৮২ কোটি ৬১ লাখ ৯৮ হাজার ৫০০ ডলার।

পাশাপাশি গত বছর ৫ লাখ ২০ হাজার টন গম আমদানি করা হয়েছে, যার মূল্য ১৪ কোটি ৫৬ লাখ ডলার। তিন বছরের পরিসংখ্যানে (২০২০, ২০২২, ২০২১) আমদানিকৃত গমের পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ ১০ হাজার টন মূল্যের ৪৯ কোটি ৫৮ লাখ ৯০ হাজার ডলার।

২০২৩ সালের পাম ও সয়াবিন তেলের মোট আমাদিন ছিল প্রায় ৩ লাখ ১২ হাজার ৪৮০ মেট্রিক টন, যেখানে পাম তেল ছিল প্রায় ২ লাখ ৭৫ হাজার ৭৭৯ মেট্রিক টন এবং সয়াবিন তেল ছিল প্রায় ৩৬ থো স্যান্ড ৭০০ মেট্রিক টন। এর আর্থিক বাজারমূল্য ছিল পাম তেলের জন্য প্রায় ২৫ কোটি ৯১ লাখ ৪৭ হাজার ১৫২ ডলার এবং সয়াবিন তেলের জন্য ৪ কোটি ১৯ লাখ ১ হাজার ৭২ ডলার। গত তিন বছরে (২০২০, ২০২২, ২০২১) মোট তেল আমদানির পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ১০৬ মেট্রিক টন, যার মূল্য ছিল ১৫৬ কোটি ৮২ লাখ ৪২ হাজজার ৩৩১ ডলার।

দেশীয় বাজারে তারা তেল, গম ও চিনির চাহিদার ৩০, ২০ ও ৩৫ শতাংশ পূরণ করেছে। এই বছর ৫০ শতাংশ পূরণের পরিকল্পনা ছিল।

এস আলম গ্রুপের বর্তমানে ছয়টি ভোজ্য তেল শোধনাগার এবং দুটি সক্রিয় চিনি শোধনাগার রয়েছে। আরেকটি প্রকল্প নির্মাণাধীন পর্যায়ে। স্ব-অর্থায়নে ইউরোপীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ প্রকল্পে প্রতিদিন ৪,৮০০ মেট্রিক টন ভোজ্য তেল এবং ৫,১০০ মেট্রিক টন চিনি পরিশোধন করা হয়। এর মধ্যে দুটি চিনি শোধনাগার চট্টগ্রামে অবস্থিত। ২০২৬ সালের মধ্যে নির্মাণাধীন মেগা সুগার রিফাইনারির কাজ শেষ করে উৎপাদনে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। 

চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে দেশের প্রথম বৃহৎ বেসরকারি কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্প বর্তমানে উৎপাদনে রয়েছে। প্রায় ২.৬ বিলিয়ন ডলার বা ২৮ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগে নির্মিত হয়েছে ১৩২০ মেগাওয়াট ধারণক্ষমতাসম্পন্ন এসএস বিদ্যুৎ কেন্দ্র। প্রকল্পে এস আলম গ্রুপের ৭০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে, বাকি ৩০ শতাংশ চীনা কোম্পানি, সেপকো ৩ এবং এইচটিজি প্রতিষ্ঠিত।

গত বছর বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি জাতীয় গ্রিডে একীভূত করা হয়, যেখানে দুটি ইউনিট সমন্বিত, প্রতিটি ৬৬০ মেগাওয়াট ধারণক্ষমতাসম্পন্ন। প্রথম ইউনিট ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ এবং দ্বিতীয় ইউনিট ২৬ অক্টোবর, ২০২৩ তারিখে উদ্বোধন করা হয়। এই প্রকল্পের বিশেষ দিক হলো এর উৎপন্ন শক্তি অন্যান্য অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তুলনায় বেশি।

এখানে প্রস্তাবিত সবুজ এবং পুনর্বীকরণযোগ্য শক্তি দ্বারা গৃহীত একটি মেঘা প্রকল্প। সাম্প্রতিক সময়ে তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে সম্মিলিত সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হবে এবং প্রত্যাশিত ধারণক্ষমতা ৩ হাজার মেগাওয়াট। শুরু থেকেই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ৫০ শতাংশ সবুজ শক্তি দিতে সক্ষম হবে এবং তার পর ধীরে ধীরে তা ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। প্রকল্পটিতে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার এবং এটি ২০২৭ সালে বাস্তবায়িত হবার পরিকল্পনা রয়েছে। এই প্রকল্পে প্রায় ৫ হাজার লোকের সরাসরি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি সেখানে পরোক্ষভাবে ১ লাখ মানুষ সুবিধা ভোগ করবে।

জিই, সিমেন্স এবং মিতসুবিশির মতো নেতৃত্বস্থানীয় প্রযুক্তি কোম্পানি থেকে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি সবুজ এবং পুনরায় নতুন শক্তিতে নিযুক্ত হবে। এই প্রকল্পের অনন্য প্রকৃতির কারণে প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী কার্বন ট্যাক্সেস সুবিধা পাবে দেশ।

এস আলম গ্রুপ ১৯৯৫ সালে গ্যালভানাইজিং এবং স্টিলের শিট প্রোডাকশন প্রক্রিয়া শুরু করে। চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জে এসব ফ্যাক্টরি অবস্থিত। জাপানি এবং ইতালীয় প্রযুক্তিভিত্তিক ফ্যাক্টরিগুলোতে, ‘সিআই এবং জিপি শিট, কালার কোটেড সিজিআই শিট, কোল্ড রোল্ড স্টিল শিট এবং আরও অনেক কিছু তৈরি করা হয়।

এই গ্যালভানাইজিং প্ল্যান্ট এবং ফ্ল্যাট রোলিং প্ল্যান্টগুলোতে বিনিয়োগের মূল্য ৬৪০ মিলিয়ন ডলার এবং ২০০০ এরও বেশি কর্মচারী এই শিল্পে কাজ করেন। গ্যালভানাইজিং শিল্পের চারটি ইউনিটের মোট উৎপাদনক্ষমতা প্রায় ৯৩০ মেট্রিক টন প্রতিদিন। এ ছাড়া দুটি ফ্ল্যাট রোলিং প্ল্যান্টের বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা ২ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন।

এস আলম গ্রুপ ২০০০ সাল থেকে চট্টগ্রামের চরপাথরঘাটায় পোর্টল্যান্ড কম্পোজিট সিমেন্ট ফ্যাক্টরি চালু করে। ১৩০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে নির্মিত এ প্রতিষ্ঠানে ১৫০০-এর বেশি কর্মী কাজ করেন। জার্মান প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই ইউনিটের দৈনিক উৎপাদনক্ষমতা ১২০০ মেট্রিক টন।

৫৮ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ পরিকল্পনা এবং সরকারের ভিশন ৫০ হাজার চাকরি সৃষ্টির লক্ষ্যে। এস আলম গ্রুপ দুটি বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির পরিকল্পনা করেছে, ১৮৪ একর জমি নিয়ে ‘বাঁশাখালী এস আলম ইকোনমিক জোন-১ ও ২৫৯ একর জমি নিয়ে ‘বাঁশখালী এস আলম ইকোনমিক জোন-২ এর প্রকল্পের কাজ প্রক্রিয়াধীন।

এই বিশেষ দুটি শিল্প অঞ্চলের জন্য ৫৮ হাজার কোটি টাকার দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত। যেখানে বিদ্যুৎ খাতের জন্য ৩৫ হাজার কোটি টাকা, এইচ আর কয়েল খাতের জন্য ১৫ হাজার কোটি টাকা, ডিআরআই প্ল্যান্ট খাতের জন্য ৭৫০০ কোটি টাকা এবং বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য ৫০০ কোটি টাকা। আগামী দিনে ৪০০ একর জমির অধিক জমি ‘বাঁশখালী এস আলম ইকোনমিক জোন-২ এ যোগ করা হবে এবং জাপানের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কয়েকটি মাঝারি ও ভারী শিল্প স্থাপন করার পরিকল্পনা রয়েছে।

বর্ণিত দুটি বিশেষ ইকোনমিক জোন, যা বর্তমানে চট্টগ্রামে নির্মাণাধাীন, তাদের কার্যক্রম শুরু করলে সেখানে ৫০ হাজারও বেশি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হবে এবং সরকার বিপুল পরিমাণে রাজস্ব পাবে। ৫ লাখের বেশি মানুষকে সেবা দিতে স্বাস্থ্যসেবার খাতে ২০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে এ প্রতিষ্ঠান। তাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অধীনে প্রধান শহরগুলোতে ক্লিনিক, হাসপাতাল এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার স্থাপন করেছে। তাদের লক্ষ্য হলো সুবিধাবঞ্চিতদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা এবং স্বাস্থ্যসেবাকে সবার কাছে আরও সহজলভ্য করা। মানবসেবার দিকে দৃষ্টি রেখে এস আলম গ্রুপ চালু করেছে চট্টগ্রামে এস আলম ইন্টারন্যাশনাল হাসপাতাল প্রকল্প, যা প্রায় সমাপ্তির পথে। এখানে অনকোলজি, কার্ডিওলজি, নেফ্রোলজি, এন্ডোক্রিনোলজি, অর্থোপেডিক্স, শিশুরোগ, স্ত্রীরোগ এবং মাতৃত্বের যত্ন ইত্যাদি বিভাগে মানুষকে সেবা প্রদান করবে।

এ ছাড়া গ্রুপটি দেশের বিভিন্ন জায়গায় মেডিকেল ও নার্সিং কলেজ ও অন্যান্য চিকিৎসা সুবিধা স্থাপন করে স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এ প্রকল্পের অধীনে পূর্বাচল, বসুন্ধরা এবং অন্যান্য অঞ্চলে ভূমি উন্নয়নে কাজ করেছে।

এস আলম গ্রুপের স্বাস্থ্যসেবার এ উদ্যোগে ৫ হাজারেরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। ইউরোপীয়, ইন্ডিয়ান এবং পূর্ব এশীয় ব্যবসায়িক অংশীদারির ওপর ভিত্তি করে ২০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের মাধ্যমে ক্রামাগতভাবে এ প্রকল্পে ৫ লাখ লোকের সেবা দেওয়া সম্ভব হবে। 

পরিশেষে, বর্ণিত বিষয়াদি এবং এস আলম গ্রুপের ব্যবসায়িক বিনিয়োগ ও পরিকল্পনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, একটি প্রতিষ্ঠান দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে কী পরিমাণ উদ্যোগী হতে পারে? আমি দক্ষিণ কোরিয়ায় দেখেছি, একটি দেশকে কীভাবে ব্যবসায়ীরা উন্নত অর্থনীতির দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে? আমাদের দেশেও দক্ষিণ কোরিয়ার শিল্প গ্রুপ ‘ইয়ংওয়ান’ বিশাল বিনিয়োগ করে দেশকে সমৃদ্ধ করছে। সে হিসেবে দেশের অর্থনীতির উন্নয়নের ক্ষেত্রে এস আলম গ্রুপের অবদানকে খাটো না করে সরকারি পর্যায় থেকে সহযোগিতা করা প্রয়োজন। যাতে তারা দেশের উন্নয়নে সহযোগী হতে পারে। ধ্বংস নয়, সৃষ্টিই হোক আমাদের লক্ষ্য। কাউকে বড় করা বা খাটো করা আমার উদ্দেশ্য নয়। দেশের স্বার্থে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসা প্রয়োজন।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক

বৈষম্য নিরসনের যুগে বড় বৈষম্যের শিকার শিল্পকলা একাডেমির কণ্ঠশিল্পীরা

প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৩৬ পিএম
আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৪৮ পিএম
বৈষম্য নিরসনের যুগে বড় বৈষম্যের শিকার শিল্পকলা একাডেমির কণ্ঠশিল্পীরা

বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের দেশীয় সংস্কৃতিকে উপস্থাপন করার লক্ষ্যে একাডেমির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে যারা কাজ করে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন তাদের মধ্যে দেশবরেণ্য কণ্ঠশিল্পী মো. খুরশিদ আলম, শাকিলা জাফর, আবিদা সুলতানা, শহীদুজ্জামান স্বপন সম্পৃক্ত ছিলেন। নৃত্যশিল্পী হিসেবে একুশে পদকপ্রাপ্ত শামীম আরা নিপা, শিবলী মোহম্মদ, দীপা খন্দকার। যন্ত্রশিল্পীদের মধ্যে  ছিলেন বাঁশিতে শিল্পকলা একাডেমি পদকপ্রাপ্ত মো. মনিরুজ্জামান, বেহালায় সুনীল কর্মকার, বাদশা মিয়া, সরোদে ইউসুফ খান, তবলায় স্বপন নাগ, চন্দন দত্ত ও ওস্তাদ মেহের হোসেন, কিবোর্ডে জাহিদ হোসেন। 

সংগীত, নৃত্য ও যন্ত্রশিল্পে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নিজস্ব শিল্পীরা অসামান্য অবদান রাখলেও তাদের প্রায় সাবাইকে চরম হতাশা ও অতৃপ্তি নিয়ে চাকরি করে কেউ কেউ চাকরি শেষ করেছেন আবার অনেকে বৈষম্যের কারণে স্বেচ্ছায় নিজেকে বিযুক্ত করছেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি থেকে। এদের মধ্যে কেউ কেউ আক্ষেপ করে বলেন, শিল্পীদের জন্য সৃষ্ট দেশের একমাত্র বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানেই যদি চাকরি করার সব যোগ্যতা, দক্ষতা ও জাতীয় পর্যায়ে আলোড়ন সৃষ্টি করার অবদান রাখা সত্ত্বেও  যে গ্রেডে চাকরির শুরু সেই গ্রেডেই চাকরি শেষ করতে হয় এটা শিল্পীদের জন্য চরম আপমানের ও হতাশার।

 শিল্পীরা ঈশ্বর প্রদত্ত সৃজনশীল মানসিকতা নিয়ে জন্মায় বিধায় তার এই উদ্ভাবনী চিন্তা যখন ব্যক্তি বা জাতীয় পর্যায়ে বাস্তবায়ন করতে পারে তখন দেশ ও জাতির কাঙ্ক্ষিত সংস্কৃতির বিকাশ ঘটিয়ে বিশ্বসংস্কৃতিতে বাংলাদেশের মান বৃদ্ধি ও প্রতিনিধিত্ব করতে সক্ষম হয়। বর্তমানে শিল্পী বা চিন্তকদের ভাবনার পরিবর্তে টাকাওয়ালা ও ক্ষমতাবানদের অসংলগ্ন ও অপসংস্কৃতি চর্চার জয়-জয়কার শুরু হয়েছে বিগত কয়েক দশক ধরে, যার ফলে আমাদের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটলেও মানবিক ও সাংস্কৃতিক কোনো উন্নয়ন ঘটেনি বললেই চলে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির একজন শিল্পী বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শিল্পীদের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে চাকরিরত কণ্ঠশিল্পীরা সব থেকে বড় বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছেন সেই ১৯৮৯ সাল থেকে। কীভাবে একই যোগ্যতা ও নিয়োগ প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত কণ্ঠশিল্পীদের জাতীয় বেতন স্কেল দশম গ্রেড আর যন্ত্রশিল্পী ও নৃত্যশিল্পীদের বেতন স্কেল নবম গ্রেড হয়- সেই প্রশ্ন আমি জাতির কাছে রাখতে চাই।

সংগীত-নৃত্য-যন্ত্রশিল্পীদের মধ্যে এই বৈষম্য হওয়ায় কণ্ঠশিল্পীরা সার্বক্ষণিক হীনম্মন্যতায় ভোগেন, যা তার সৃষ্টিশীলতা ও পরিবেশনায় চরম নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ১৯৮৯ সাল থেকে এই বৈষম্য নিরসনের চেষ্টা চলছে বলে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ বলে আসছেন। এই বৈষম্য দ্রুততার সঙ্গে দূর করে শিল্পীদের জন্য একমাত্র বিশেষায়িত জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির শিল্পীদের প্রাধান্য ও যৌক্তিক পদোন্নতির ব্যবস্থা রেখে  আইন ও প্রবিধানমালা প্রণয়ন করার সাহসী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করার মাধ্যমে শিল্প-সংস্কৃতির মানুষের চিন্তার প্রতিফল ঘটাতে হবে দেশের এই একমাত্র বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানে।

লেখক: কবি ও গবেষক

খাসলত

প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ০১:০৮ পিএম
খাসলত
সাদেকুর রহমান সাদিক

শনিবার, সাপ্তাহিক ছুটির দিন। কর্মস্থলে যাওয়ার তাড়া নেই। সকাল সকাল ঘুম ভাঙলেও আলস্যে শয্যা ছেড়ে উঠতে মন সায় দিচ্ছিল না। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি আশ্বিনেও শ্রাবণের অঝোরধারা। তাই ভাবলাম আর একটু ঘুমিয়ে নিই। ব্যাচেলর জীবনের এই এক অবারিত সুযোগ- সকাল সকাল বউয়ের তাড়া খেয়ে লম্বা ফর্দ নিয়ে থলি হাতে বাজারে দৌড়াতে হয় না। তার আগে পাঠককে জানিয়ে রাখা ভালো- আমি বিবাহিত ব্যাচেলর। অর্থাৎ কর্মসূত্রে ঢাকায় একা থাকি। স্ত্রী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে মফস্বল শহরে থাকে। মাঝে মাঝে তার দেখা পাই, চিরদিন... । 

যথা ভাবনা তথা কাজ, অর্থাৎ আবার ঘুমানোর আয়োজন। কিন্তু বাদসাধল মুঠোফোনে সাবেক সহকর্মীর খুদে বার্তা। লিখেছে- কাছাকাছি এসেছে, বিশেষ জরুরি প্রয়োজন। পারলে আমি যেন দেখা করি। কী আর করা। অগত্যা শয্যা ছেড়ে গামছাটি কাঁধে চাপিয়ে, ব্রাশে টুথপেস্ট লাগিয়ে প্রক্ষালন কক্ষে ঢুকে পড়লাম। সাফসুতরো হয়ে পোশাক পরিবর্তন করে বেরিয়ে পড়লাম সহকর্মীর উদ্দেশে। ভাবলাম, দুজনে একসঙ্গে প্রাতঃরাশ সারব। বাইরে বেরিয়েই পড়লাম মহাবিপদে। কাছাকাছি কোথাও কোনো রিকশা পাচ্ছিলাম না। তাই, বৃষ্টি মাথায় নিয়েই গলির মোড়ের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তখনই মধ্যবয়সী এক রিকশাওয়ালা আমার উদ্দেশে হাঁক ছাড়ল- মামা কোথায় যাবেন? আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না, তার মা আমার কোন কুলের বোন। আমি আমার গন্তব্যস্থল উল্লেখ করে ভাড়া জানতে চাইলাম। উত্তরে সে জানাল, ৫০ টাকা। আমি বললাম, ভাড়া তো ৪০ টাকা, আপনি ৫০ টাকা চাচ্ছেন কেন? বলল, মামা বৃষ্টির দিন ১০টা টাকা বাড়ায়ে দিয়েন। ভাবলাম, গরিব বেচারা, পেটের দায়ে এই ঝুম বৃষ্টিতেও রিকশা নিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছে। তাই, আর কোনো কথা না বাড়িয়ে উঠে পড়লাম।

গন্তব্যে পৌঁছে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে ১০০ টাকার একটা নোট রিকশাওয়ালার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম, আমার কাছে ভাঙতি নেই। উনি ১০০ টাকার নোটটি হাতে নিয়ে অসহায়ের মতো আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। বললাম, কী হলো, তাড়াতাড়ি করেন, বৃষ্টিতে তো ভিজে যাচ্ছি। উনি বাঁ-হাতে পরনের লুঙ্গির খুঁট ধরে খানিকটা ওপরে তুলে আমাকে দেখিয়ে বললেন, মামা লুঙ্গিটা ছিঁড়ে গেছে, নামাজ পড়তে অসুবিধা হয়। যদি কয়টা টাকা বাড়িয়ে দেন, তাহলে কম দামে একটা লুঙ্গি কিনতে পারতাম। নামাজ পড়ে আপনার জন্য দোয়া করব। বুঝলাম, দুর্বল জায়গায় আঘাত। ধর্মীয় অনুভ‚তি বলে কথা। যদিও নিজে নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি না। এমনকি ধর্মীয় অনুশাসনগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ পালন করি, তাও বুকে হাত দিয়ে বলতে পারব না। তবুও বুকের গভীরে এক ধরনের ধর্মীয় চেতনাবোধ জেগে উঠল। না, এটা পরকালে বেহেশতের কোনো সেকেন্ড হোম টিকিটের আশায় নয়। স্রেফ মানবতার খাতিরে, একজন দরিদ্র-অসহায় গরিব রিকশাওয়ার কিছুটা কষ্ট লাঘবে। বললাম, ঠিক আছে, বাকি টাকা ফেরত দিতে হবে না, পুরোটা রেখে দিন।

এই বলে যখন সামনে পা বাড়ালাম, তখনই পেছন থেকে আবার ডাক পড়ল- মামা। এবার অনেকটা বিরক্তভাব নিয়েই পেছন ফিরে তাকালাম। বললাম, আবার কী? উনি দুই ঠোঁটে কিছুটা জড়তা নিয়ে বললেন, আর একটা উপকার করবেন? বললাম, তা কী করতে হবে আমাকে? উনি কিছুটা কাচুমাচু করে বললেন- না, মানে আমার কাছে তো কোনো মোবাইল নেই। অনেকদিন হলো গ্রাম থেকে এসেছি, পোলাপানের খোঁজখবর নিতে পারি না। বুঝলাম আমার মোবাইল ফোন দিয়ে উনি পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছেন। কী আর করা। অগত্যা পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে বললাম- নম্বর দিন। উনি কোমরে লুঙ্গির গাঁট খুলে একটুকরো কাগজ বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমি নম্বরটা মোবাইলে উঠিয়ে ডায়াল বাটনে চাপ দিয়ে বললাম- নিন কথা বলুন। উনি মোবাইলটা নিয়ে হাত দুয়েক সরে গিয়ে কথা বলা শুরু করলেন। ততক্ষণে বৃষ্টিটা একটু থেমে গেছে। তাই উনার কথাগুলো আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম। (পাঠকের জ্ঞাতার্থে বলছি, উনি আঞ্চলিক ভাষায় কথা বললেও সংশ্লিষ্ট জেলার মানুষকে খাটো না করার অভিপ্রায়ে আমি তার কথাগুলো প্রমিত ভাষায় লিখলাম।)

যতটুকু শুনতে পেলাম তাতে বুঝলাম, প্রথমে উনার গিন্নি কথা বলা শুরু করেছেন। কুশলাদি বিনিময়ের পর জানতে চাইলেন- গরুগুলোর কী অবস্থা? ঠিকমতো খড়-বিচালি দেওয়া হয় কিনা? এর পর জানতে চাইলেন এ সপ্তাহে কত টাকার দুধ বিক্রি করা হয়েছে? তার পর যেটা বললেন তাতে আমার ভিরমি খাওয়ার অবস্থা। বলতেছিলেন- এই হাটবারে ছেলেকে দিয়ে যেন মণ-পঞ্চাশেক ধান বিক্রি করা হয়। কারণ বাজারে ধানের দাম চড়া। তাই এখনই বিক্রির উপযুক্ত সময়। এর পর গিন্নিকে বললেন ছেলেকে ডেকে দিতে। অর্থাৎ ছেলের সঙ্গেও তার কথা বলতে হবে। এসব দেখে আমার ধৈর্যসীমা চরমে ওঠার উপক্রম। একদিকে সহকর্মীকে দাঁড় করিয়ে রেখেছি, অন্যদিকে মোবাইলের অপর্যাপ্ত ব্যালান্স আমাকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। তার পরও নিজেকে অনেক কষ্টে সংযত রাখলাম নাটকের শেষ দৃশ্য দেখার জন্য। বুঝতে পারলাম ইতোমধ্যেই অপরপ্রান্তে উনার ছেলে কথা বলতে শুরু করেছে। উনি ছেলেকে ধমকের সুরে বলছেন- কাজকর্ম ফেলে সারা দিন কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াস? বৃষ্টিতে পুকুরের পাড় ডুবে সব মাছ বেরিয়ে গেছে, সেদিকে তোর খেয়াল আছে? উত্তরে ছেলে কী বলেছে তা আল্লাহ মলুম। কিন্তু এটুকু বুঝলাম, গ্রামের বাড়িতে তার একটি বড় সাইজের পুকুর আছে, যেটাতে মাছ চাষ করা হয়। 

উনি ছেলেকে আরও কী সব বলছিলেন, তা শোনার ধৈর্য ও সময় কোনোটাই আমার অবশিষ্ট নেই। এক মিনিটের কথা বলে ইতোমধ্যে আট মিনিট অতিবাহিত করেছেন। নিজেকে সংযত করে কাছে গিয়ে বললাম, আমার তাড়া আছে, যেতে হবে। উনি পান খাওয়া মুখে তরমুজের বিচির মতো দু-পাটি কালো দাঁত বের করে একগাল হেসে বললেন, মামা বড় উপকার হলো, আল্লাহ আপনার ভালো করবে। আমি বললাম, তথাস্তু। 

এর পর মোবাইলটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি আর মাত্র এক মিনিট সময়কালের ব্যালান্স অবশিষ্ট আছে। অতঃপর বিরস বদনে মোবাইলটি পকেটস্থ করে মনুষ্যস্বভাবের ওপর প্রশ্নবোধক চিহ্ন রেখে সহকর্মীর উদ্দেশে পা বাড়ালাম।

লেখক: সংবাদকর্মী

পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় সাংস্কৃতিক ইশতেহার

প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২৪, ১০:০৫ এএম
পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় সাংস্কৃতিক ইশতেহার
নাজমুল হুদা আজাদ

গত ১৭ বছরের আওয়ামী ফ্যাসিবাদী রাজনীতির সাংস্কৃতিক ও দার্শনিক ভিত্তি যে চিন্তাধারার উপর দাঁড়িয়ে ছিল তা হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সন্দেহাতীতভাবে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। সাতচল্লিশের দেশভাগ পরবর্তী সময়ে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অন্যতম দুটি মোমেন্টাম। আমরা আলাদা জাতি, আলাদা স্বার্থভিত্তিক চিন্তাপ্রসূত যে জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা তার লালন ও বিস্তারে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

পাকিস্তানের দীর্ঘ ২৩ বছরের দুঃশাসন, শোষণ নিপীড়ন থেকে মুক্তির লক্ষ্যে মানুষের ন্যায়বিচারভিত্তিক, বৈষম্যহীন এবং অসাম্প্রদায়িক সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণের যে আকাঙ্ক্ষা মূলত তাই এ দেশের আপামর ছাত্র-জনতাকে মুক্তিযুদ্ধে ধাবিত করেছে। পরবর্তী সময়ে অভিজ্ঞতা ও চর্চায় মুক্তিযুদ্ধের ধারণায় আমজনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ যেখানে অনিবার্য ছিল সেখানে এটি হয়ে উঠেছে একটি নির্দিষ্ট দলের ইজারা নেওয়া ইম্যাটেরিয়াল সম্পত্তি। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে দিন যত গড়িয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ধারণাও ক্রমে তার মৌলিক জায়গা থেকে বিচ্যুত হয়েছে। বিশেষত আওয়ামী লীগের গত ১৭ বছরের দুঃশাসনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সচেতন ছাত্র-জনতার অভিজ্ঞতায় অনেকটা আরোপিত এবং আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সুবিধা আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে হাজির হয়েছে।

চেতনার জায়গায় সাযুজ্য বিচারে মুক্তিযুদ্ধ ও ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের মিলের যে জায়গা তা হলো ন্যায়বিচারভিত্তিক, বৈষম্যহীন এবং অসাম্প্রদায়িক সমাজ ও রাষ্ট্র বিনির্মাণ। সমাজ ও রাষ্ট্র একটি সামষ্টিক প্রয়াস ও প্রতিশ্রুতি। ট্র্যাকচ্যুত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মৌলিকত্বের সঞ্চার ঘটিয়ে আদিরূপে ইনকরপোরেশন ঘটবে ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের অন্তর্ভুক্তিমূলক সাংস্কৃতিক প্রতিশ্রুতিতে। দল-মতনির্বিশেষে সবার সামাজিক-সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা সংরক্ষণ ও চর্চায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এ গণ-অভ্যুত্থান। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি গত সময়ে কাওয়ালি চর্চায় যেখানে তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীদের আক্রমণে কাওয়ালি চর্চা ভণ্ডুল হয়েছে সেখানে চব্বিশের এর অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে এই কাওয়ালি হয়ে উঠেছে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও উদযাপনের বলিষ্ঠ সাংস্কৃতিক পরিভাষা। সংখ্যা বিচারে উল্লেখযোগ্য জনগোষ্ঠী হওয়া সত্ত্বেও কওমি অঙ্গনের শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যেখানে কখনো যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তেমন একটা অংশগ্রহণ লক্ষ করা যায়নি সেখানে অভ্যুত্থান ও অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে গ্রাফিতি ক্যালিগ্রাফি ও সংগীতের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও অভ্যুত্থানের বিজয় উদযাপনে তারা হয়ে উঠেছে প্রোঅ্যাকটিভ।

অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে আমাদের উচিত গণসংস্কৃতিতে মনোনিবেশ করা। সংস্কৃতির লালন, চর্চা, উৎপাদন, পুনরুৎপাদন, বণ্টন ও উপভোগ যেন কখনোই একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের হাতে বন্দি হয়ে না যায় সেদিকে আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখা জরুরি। সংস্কৃতি হবে আগ্রাসনবিরোধী ও প্রভাব মুক্ত। সেই প্রভাব হতে পারে বৈদেশিক, দলীয়, ফ্যাসিবাদী অথবা মৌলবাদী।

দেশীয় সংস্কৃতির চর্চায় হীনম্মন্যতা, শিথিলতা ও দেশীয় রাজনৈতিক, সামাজিক অথবা সাংস্কৃতিকসহ বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধকতা যখনই আসবে তখনই এই জায়গা দখল করে নিবে ভিনদেশীয় সংস্কৃতি। এমন না যে বিদেশি সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ আমাদের মধ্যে গ্রহণ-বর্জন একেবারেই হবে না। নিজেদের মৌলিকত্বকে অগ্রাধিকার দিয়ে সচেতনতার সঙ্গে বৈশ্বিক সাংস্কৃতিক বিষয় গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে আত্মীকরণ বর্তমান বৈশ্বিক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে একটি অনিবার্য বাস্তবতা।

ছোট-বড় যেকোনো ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ হিসেবে যেটাকে বিচার করা যায় সেটাকে ধর্মীয় দৃষ্টিতে না দেখা বা গ্রহণ না করার প্রবণতা সৃষ্টি হওয়ার মতো সাংস্কৃতিক মনন সৃষ্টি করার সর্বজনীন প্রচেষ্টা একান্ত জরুরি। সিরাত মাহফিলে অনেকের অনাগ্রহ থাকতেই পারে তবে যদি সিরাত মাহফিলকে ধর্মীয় অনুষঙ্গ হিসেবে বিচার না করে সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ হিসেবে বিচার করার চিন্তন-মনন আমাদের মধ্যে সৃষ্টি করা যায় তবে এটা হয়ে উঠবে সংস্কৃতি হিসেবে সংস্কৃতিপ্রেমীদের একটি মিলনস্থল। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে সামনে রেখে আমাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও তৎপরতাগুলো এমন হওয়া উচিত যাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নানা পথ ও মতের সম্মিলন ঘটে। 

প্রায় ২ হাজার প্রাণ, হাজার হাজার মানুষের পঙ্গুত্ব ও অন্ধত্ব বরণের বিনিময়ে যে গণ-অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছে কোনোভাবেই তার সুফল বেহাত হতে দেওয়া যাবে না। এই অভ্যুত্থানের যে স্পিরিট তার সংরক্ষণ ও চর্চা হবে তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত অভ্যুত্থানে স্মৃতি সংরক্ষণ ও ছাত্র-জনতার কালেকটিভ মেমোরিতে স্থান করে দেওয়ার সব নিদারুণ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে। অধিকন্তু এ সচেতন প্রয়াস হবে আমাদের জাতীয় সংহতি বিনির্মাণের অন্যতম কৌশল।

প্রান্তিক পর্যায়ে যেকোনো ধরনের সাংস্কৃতিক চর্চাকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়ে থাকে। বিশেষ করে এসব সাংস্কৃতিক চর্চায় নারীদের অংশগ্রহণকে একটি রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিবেচনা করা হয়। চর্চায় ও লালনে নারীদের অংশগ্রহণকে সহনশীল ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে গ্রহণ করার মতো মন মননের উন্নয়ন কীভাবে সাধন করা যায় সাংস্কৃতিক প্রতিশ্রুতিতে তার সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ জরুরি। সমান্তরালে রাষ্ট্রের ছোট মাঝারি, বড় (সংখ্যায়) সব সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ, চর্চা ও উন্নয়নে রাষ্ট্রের গঠনমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসার ঘটানো উচিত। 

আমাদের দেশে জাপানের ‘মেইজি রিফর্মেশন’-এর মতো সম্ভাবনাময়ী সংস্কার ঘটানোর মতো যথেষ্ট উপায়-উপাদান আছে। গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে মানুষের মন-মননে যে সংস্কারবাদী এবং স্বপ্নালো রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে সেটাকে এই ভূখণ্ডের আদি উপায়- উপাদানের সঙ্গে মিশেল ঘটিয়ে একটি সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ অসম্ভব কিছু নয়। পরিশেষে দল-মতনির্বিশেষে সব সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণে আগামীর বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল হয়ে উঠবে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, অশুভ প্রভাবমুক্ত, সাম্য ও ন্যায্যতাভিত্তিক একটি সাংস্কৃতিক অঙ্গন।

লেখক: প্রভাষক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
[email protected]

নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করুন

প্রকাশ: ২২ অক্টোবর ২০২৪, ১০:০৩ এএম
আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০২৪, ১০:০৬ এএম
নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করুন
তরিকুল ইসলাম

প্রতিদিন সড়কে ঝরছে অসংখ্য তাজা প্রাণ। কেউ মা, কেউ বাবা, আবার কেউ হারাচ্ছেন সন্তানসহ আপনজনদের। কেউ কেউ পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। শত শত পরিবার হয়ে যাচ্ছে অসহায়। নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলন, ধর্মঘট, মিছিল, সমাবেশ কত কিছুই না হলো। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থেকে শুরু করে দেশে নানা কাণ্ড ঘটে গেল ২০১৮ সালে। যার মধ্যে সাড়া জাগানো বিষয়, নিরাপদ সড়কের জন্য দেশ কাঁপানো আন্দোলন করেছিলেন শিক্ষার্থীরা। তখন তৎকালীন সরকারে দিক থেকে সড়ক নিরাপদ করতে নানা আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। তবে বাস্তবতা এখন ভিন্ন। দেশের সড়ক-মহাসড়ক দিন দিন আরও প্রাণঘাতী হয়েছে। জনমনে আজও প্রশ্ন, আদৌ কি এই নিরাপদ সড়ক আমরা পেয়েছি? থেমেছে কি সড়কে মৃত্যুর মিছিল?

সড়ক নিয়ে কাজ করা বেসরকারি একটি সংস্থার তথ্যানুযায়ী, দেশে সেপ্টেম্বরে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩৯২টি। এতে ৪২৬ জন নিহত এবং ৮১৩ জন আহত হন। গত আগস্টে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৩৮ জন নিহত হন। সেই হিসাবে প্রতিদিন গড়ে নিহত হয়েছিল ১৪.১২ জন। সড়ক পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্যানুযায়ী, গত বছর দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫ হাজার ৪৯৫টি। 


এসব দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৫ হাজার ২৪ জন। আহত হয়েছেন ৭ হাজার ৪৯৫ জন। তবে সড়কে মৃত্যুর সরকারি এই হিসাবের সঙ্গে বেসরকারি সংগঠনগুলোর তথ্যের পার্থক্য অনেক। অন্যদিকে, ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনার বিআরটিএর হিসাবে ৫ হাজার ৮৪ জন মানুষ মারা গেলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে দেশে মারা গেছে ৩১ হাজার ৫৭৮ জন। অর্থাৎ বিআরটিএর তুলনায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া তথ্যানুসারে পাঁচগুণেরও বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। সড়কে বাংলাদেশে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়লেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দেওয়া তথ্যানুসারে পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশেই এটা কমে আসছে। 


২০১০ সালের তুলনায় মৃত্যুর হার কমেছে অন্তত ১০৮টি দেশে, যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কাও। সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহের বৈজ্ঞানিক ও স্বীকৃত কোনো পদ্ধতি বাংলাদেশে নেই। ফলে দুর্ঘটনার তথ্য নিয়ে ভিন্নতা দেখা যায়। বাংলাদেশ পুলিশের দেওয়া দুর্ঘটনার তথ্যের সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে পার্থক্য থাকে প্রায় পাঁচগুণ।


আমি পরিসংখ্যান নিয়ে টানাটানি করব না। কারণ পরিসংখ্যান ঘাটলে হতাশা আর কষ্ট ছাড়া কিছুই পাব না। আমি শুধু বলতে চাই, সড়কের প্রাণহানি কমিয়ে আনার কি কোনো উপায় নেই? দেশে কোনোভাবেই সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা কমানো যাচ্ছে না। ঈদে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। পত্রিকার পাতা খুললে কিংবা টিভি চ্যানেলের সংবাদের দিকে চোখ রাখলে প্রায় প্রতিদিনই চোখে পড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহত হওয়ার খবর। দেশে প্রতিনিয়ত মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। 


সড়ক দুর্ঘটনারোধে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও এখন দুর্ঘটনার লাগাম টেনে ধরা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। ফলে প্রায় প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে; পাল্লা দিয়ে বাড়ছে হতাহতের ঘটনা। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার, নতুনভাবে দেশ পরিচালনা করার আগে মনে করিয়ে দিতে চাই নিরাপদ সড়কের কথা। যে সড়কের জন্য শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমেছে, যে সড়কের জন্য স্বজনদের হৃদয় পুড়েছে, যে সড়কের জন্য হাজার হাজার পরিবার ধ্বংস হয়েছে। বর্তমান সরকার যদি এ বিষয়ে সুনজর না দেয় তাহলে সড়কে মৃত্যুর মিছিল কখনোই থামবে না। সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বর্তমান বিদ্যমান আইন ও বিধি যথেষ্ট নয়। আইনটিতে হেলমেট পরিধানের বাধ্যবাধকতা থাকলেও এর মানদণ্ড ও ব্যবহারবিধি আইনে অনুপস্থিত। আইনে গতিসীমা লঙ্ঘনে শাস্তির বিধান বর্ণিত থাকলেও গতিসীমা নির্ধারণ, এর বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণের নির্দেশনা, গাইডলাইন সন্নিবেশিত হয়নি, যা বাস্তবায়ন অযোগ্য। এ ছাড়া যাত্রীদের সিটবেল্ট ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা ও শিশুদের জন্য নিরাপদ বা সুরক্ষিত আসন ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা আইনটিতে সংযোজন করা হয়নি। তাই সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দ্রুত একটি ‘সড়ক নিরাপত্তা আইন’ প্রণয়নের দাবি জানাচ্ছি। বাংলাদেশের মানুষ আর সড়কে মৃত্যু দেখতে চায় না।


সড়কে রোজ মৃত্যু হচ্ছে। অথচ এ সেক্টরের কারও কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেই। আইন থাকলেও কার্যকর হয় না। কারণ আইনেও এখন চলছে অঙ্কের হিসাব। তাই সুশাসন এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করলে সব দিকেই জনগণের উন্নয়ন হবে। আর জনগণের উন্নয়ন মানেই দেশের উন্নয়ন। আমাদের বর্তমান সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এবং সড়ক পরিবহন বিধিমালা-২০২২ মূলত সড়ক পরিবহন আইন এবং সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা সংক্রান্ত। এই আইন ও বিধিমালা সড়ক নিরাপত্তা বিধিমালা নিশ্চিতকরণে যথেষ্ট নয়। সব ধরনের সুরক্ষা সম্পর্কিত সমস্যাগুলো মোকাবিলা করার জন্য পৃথক ‘সড়ক নিরাপত্তা আইন’ প্রণয়ন করতে হবে।


দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উপদেষ্টার প্রতি আমার অনুরোধ, দেশের উন্নয়ন করছেন দেশের মানুষের জন্য। কিন্তু দেশের মানুষ যদি বেঁচে না থাকে, তবে দেশের উন্নয়ন করাটা বৃথা হয়ে যাবে। তাই শ্রদ্ধার সঙ্গে বলছি, দেশে সাজানোর পাশাপাশি দেশের মানুষ বাঁচান। 


সড়ক অবকাঠামো ও যানবাহনের নিরাপত্তা, দুর্ঘটনার পর উদ্ধার ও চিকিৎসা, সিট বেল্ট ও যানবাহনে শিশুদের নিরাপত্তার মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে একটি সমন্বিত ‘সড়ক নিরাপত্তা আইন’ প্রণয়ন করুন। আমার বিশ্বাস, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এই সেক্টরকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে পারবে। সেই সুন্দরের অপেক্ষায় রইলাম আমি এবং আমার দেশের মানুষ।

লেখক: অ্যাডভোকেসি অফিসার (কমিউনিকেশন)
স্বাস্থ্য সেক্টর, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন
[email protected]

কায়েস চৌধুরীকে হারানোর তিন বছর

প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০২৪, ১০:৫৪ এএম
কায়েস চৌধুরীকে হারানোর তিন বছর
কায়েস চৌধুরী

‘রাতের আকাশে নিশ্চুপ সাক্ষী দূরের ওই ধ্রুবতারা’, ‘আজ সারা দিন তুমি তুমি করে কষ্টে থেকেছি আমি’, ‘জীবনটা শুধু হিসেবের যন্ত্র নয়, বেহিসেবী জীবনের মন্ত্র নয়’সহ অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় গানের স্রষ্টা কায়েস চৌধুরীর চলে যাওয়ার তিন বছর পূর্ণ হতে চলল। প্রয়াণ দিবসে নিভৃতচারী, বহুমাত্রিক সৃষ্টিশীল এ মানুষটির জন্য রইল অন্তর গভীরতম শ্রদ্ধাঞ্জলি।

তিনি ছিলেন নাট্যকার, নির্মাতা, চিত্র পরিচালক, শিক্ষক, অভিনেতা, ট্রেইনার, উপস্থাপক, গণযোগাযোগ ও অডিও ভিজুয়াল বিশেষজ্ঞ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকবিষয়ক পরামর্শকসহ নানামাত্রিক পরিচয়ে অনন্য এক ব্যক্তিত্ব। অল্প কথায় তাকে নিয়ে কিছু বলা আমার জন্য কঠিন ও দুঃসাধ্য। তার সুবিশাল কর্মযজ্ঞকে যদি শুধু সংখ্যাগত মানদণ্ডে হিসাব করা হয়, তাহলেও তার পরিধি হবে ছোট কোনো উপন্যাসের মতো দীর্ঘ; আর গুণগত উৎকর্ষ যদি বলতে হয়- সেটি সময় নির্ধারণ করবে। 

স্ত্রী হিসেবে এই সৃষ্টিশীল মানুষটিকে আমি পেয়েছি ১১ বছর। সংখ্যার হিসেবে ১১ বছর দৈর্ঘ্যে নির্দিষ্টি হলেও প্রন্থে’ বলা যায় এটি ছিল বেশ দীর্ঘ। তাকে আমার খুব কাছ থেকে দেখা ও অনুভবের সুযোগ ঘটেছিল প্রতিদিনের প্রাত্যহিকতায়। আমাদের যৌথ জীবনের টানাপড়েন, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আনন্দ-বেদনা, মত-মতভেদ, পছন্দ-অপছন্দ- সবকিছুর ঊর্ধ্বে আজ তিনি। 

বহুমাত্রিক এই মানুষকে নিয়ে আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের নানা প্রসঙ্গ অন্যদিন লিখব। আজ তার বিস্তৃত কর্মযজ্ঞের কিছু চুম্বক অংশ তুলে ধরব। নব্বইয়ের দশকে তার রচনা, পরিচালনায় প্রথম ধারাবাহিক নাটক ‘না’ বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। এটি সে সময় সাড়া জাগানো ও দর্শক জরিপে শ্রেষ্ঠ ধারাবাহিক হিসেবে নির্বাচিত হয়। 

ওই সময়ের নাটক, সিনেমাগুলো কায়েস চৌধুরীর মতে অনেকটাই ‘ফুল দাও, ফুল নাও’ ওরিয়েন্টেড ছিল। সময়ের চাহিদা এবং সমাজ পরিবর্তনে বলা যায় এটি ছিল আধুনিক ও সময়োপযোগী একটি সৃষ্টিকর্ম। পরবর্তীকালে এনটিভি, এটিএন বাংলা ও বৈশাখী টেলিভিশনেও এটি প্রচারিত হয়। 

তার উল্লেখ্যযোগ্য আরও একটি নির্মাণ ‘হজ পারফরম্যান্স স্টাডি’ এটি সৌদি সরকারের অর্থায়নে নির্মিত। পৃথিবীর ৬৫টি দেশে এটি প্রচারিত হয়, ‘দ্য গোল্ডেন ম্যারিন পয়েন্ট’-এটি সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকারের অর্থায়নে নির্মিত হয়। তিনি সাত শতাধিক দেশি ও আন্তর্জাতিক করপোরেট প্রোফাইল নির্মাণ করেন। 

তার পরিচালনায় উল্লেখযোগ্য তথ্যচিত্র- ‘জনগণের পালা’ (লোক-কাহিনি ও গাননির্ভর পালা), ‘নারী ও শিশু পাচার’ প্রচারিত হয় জার্মান টেলিভিশন এআরডি-১-এ। বিবিসিতে প্রচারিত হয় ‘ভাসমান যৌনকর্মী’; জাপানে প্রচারিত হয় ‘সুন্দরবন, দ্য ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট অ্যান্ড অ্যামাজিং ফিশিং ওয়ে’; শিশু শ্রমের ওপর নির্মিত তথ্যচিত্র ‘হিউম্যান মেশিন’ বিবিসিতে প্রচারিত হয়, ‘আরব ডেজার্ট লাইফ’ সৌদি আরব টেলিভিশনে প্রচারিত হয়: ‘চাইল্ড লেবার ইন বাংলাদেশ’ বিবিসিতে প্রচারিত হয়; নারীশ্রম নিয়ে তথ্যচিত্র ‘সময়ের এক ফোঁড়’ বিবিসির শ্রেষ্ঠ তথ্যচিত্র ও শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার অর্জন করে ২০০০ সালে। 

গ্রামীণ চেক নিয়ে নির্মিত তাঁতীদের জীবন নিয়ে তথ্যচিত্র ‘জীবন চরকা’ তার সবচেয়ে সাড়া জাগানো তথ্যচিত্র। ‘আর্সেনিক অ্যালার্ট’ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে টিউবওয়েলে তোলা পানিতে আর্সেনিক উপাদানের জন্য মানুষের রোগ শোক ও সম্পূরক বিষয়ে নির্মাণ করেন। এটি সেরা তথ্যচিত্র নির্মাতার পুরস্কার লাভ করে, আয়োজনে ছিল ওয়ার্ল্ড ওয়াটার ফোরাম নেদারল্যান্ড (২০০০)।

তিনি ৬৫টি বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণের পাশাপাশি ১০৫টি টেলিভিশন নাটকের চিত্রনাট্য লিখেছেন এবং পরিচালনা করেছেন। তার ব্যক্তি জীবনও ছিল বর্ণাঢ্য। জাতীয় পর্যায়ে তার সৃষ্টিকর্মগুলো যেন সংরক্ষিত হয় সেই দাবি রাখছি।

লেখক: কায়েস চৌধুরীর সহধর্মিণী, শিক্ষক ও নজরুল সংগীতশিল্পী