আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ভোটের হিসাব-নিকাশ কষছে বিএনপি ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিলে বিএনপির সঙ্গে জোট গঠন করতে পারে জামায়াত। আর জোট না হলে এককভাবে ভোটে অংশ নেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে দলটি। নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, এরই অংশ হিসেবে বিএনপিকে ছাড়াই বৃহত্তর ইসলামী জোট করার পরিকল্পনা করছে জামায়াত। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ যেহেতু মাঠে নেই, তাই বড় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবেও আবির্ভূত হতে চাইছে জামায়াতে ইসলামী।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও যুগপৎ লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের একসময় জোট ছিল। যখন নির্বাচন আসবে তখন হয়তো চিন্তা করা যাবে। নির্বাচনে তারা কী করবে, আমরা কী করব, তখন ভেবে দেখা যাবে। স্বৈরাচার সরকারের পতন হলেও তাদের ষড়যন্ত্র থেমে নেই, ফ্যাসিবাদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। আগামী নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলেরই অংশগ্রহণের অধিকার রয়েছে। এটাও একটা পলিসি হতে পারে, আমরাও আমাদের মতো করে চেষ্টা করছি। তারা তাদের মতো করে জয়লাভের চেষ্টা করবে, এটাই স্বাভাবিক বিষয়।’
নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দুই পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে বিএনপি ও জামায়াত। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিলে যুগপৎ শরিকদের সঙ্গে নির্বাচনি জোট হবে। আবার আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচন বর্জন করে তাহলে দুই দলই এককভাবে নির্বাচনে অংশ নেবে। তবে আওয়ামী লীগের মতো নিয়ন্ত্রিতবিরোধী দল করার চিন্তাভাবনা নেই বিএনপির।
আরেকটি সূত্রের দাবি, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের রাজনীতির বাঁক পরিবর্তন দৃশ্যমান। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে বিচার দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। হত্যা ও দুর্নীতি মামলায় দলটির এমপি-মন্ত্রীরা আটক হচ্ছেন। এ ছাড়া নতুন প্রজন্মের কাছেও আওয়ামী লীগ স্বৈরাচার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ফলে তাদের রাজনীতির মাঠে ঘুরে দাঁড়াতে অনেক সময় লাগবে। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে জামায়াত তাদের রাজনৈতিক লাভ-লোকসানের হিসাব কষছে। বিএনপির সঙ্গে থাকলে আগামী নির্বাচনে তাদের লাভ কী? আর বিরোধী দলের আসনে বসলে তাদের লাভ কী? তবে মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা, সাংগঠনিক শক্তি এবং নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতার ওপর নির্ভর করছে তাদের ভবিষ্যৎ। তবে জাতীয় পার্টির মতো আওয়ামী লীগের ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ হতে রাজি নয় জামায়াত।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার খবরের কাগজকে বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনমুখী দল। সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে সেই নির্বাচনে তার দল অংশ নেবে। তবে সেই নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে জোট হবে কি না, নাকি এককভাবে নির্বাচনে অংশ নেব, তা পরিষ্কার করতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। কারণ অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগসহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সংস্কার কাজে হাত দিয়েছে। এখনো নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা হয়নি। নির্বাচন রোডম্যাপ ঘোষণা করলে অনেক দল নির্বাচন অংশ নেবে, আবার কিছু কিছু দল অংশ নাও নিতে পারে। এ ছাড়া নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এখানে দেশি-বিদেশি নানা খেলা হয়। ফলে আমরা কীভাবে নির্বাচনে অংশ নেব, তা সময়ই বলে দেবে।’
জামায়াতের নেতা-কর্মীরা মনে করছেন, স্বৈরাচার ও গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগকে আর দেশের মানুষ গ্রহণ করবে না। গণহত্যার বিচার শুরু হলে তাদের রাজনীতি করার সুযোগও কম।
বিএনপি আগামী দিনে ক্ষমতায় গেলে ঐকমত্যের ভিত্তিতে ‘জাতীয় সরকার’ গঠন করবে। সূত্র বলছে, যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোকে বিএনপি গুরুত্ব দেবে। তবে তাদের জাতীয় সরকারে জামায়াতকে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা আপাতত নেই। অন্যদিকে বিএনপির সঙ্গে নির্বাচনি জোট হবে না ভেবে নিয়েই ভবিষ্যৎ রাজনীতির প্রস্তুতি নিচ্ছে জামায়াত। জোট গঠনের জন্য ইসলামপন্থি দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে। ইতোমধ্যে খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসসহ বেশ কয়েককটি ইসলামী দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু খবরের কাগজকে বলেন, আগামী নির্বাচন কবে হবে এখনো দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয়নি। তাই জোট হবে কি না এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে আওয়ামী লীগের আমলের মতো বর্তমান পরিস্থিতি নেই, তাই এককভাবে নির্বাচন করতে বিএনপিকে খুব একটা বেগ পেতে হবে না। নির্বাচনে বিএনপি এককভাবে জয়লাভ চেষ্টা করবে। বিএনপি সবার জন্য মাঠ উন্মুক্ত করে দেবে। আওয়ামী লীগের মতো কোনো দলকে নিয়ন্ত্রণ করবে না।
মতপার্থক্য থাকলেও দূরত্ব বাড়েনি বিএনপি-জামায়াতের
বিএনপি ও জামায়াতের মিত্রতা প্রায় ২৫ বছর। কিন্তু গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নির্বাচন ইস্যুতে দল দুটির শীর্ষ নেতাদের বক্তব্য ঘিরে রাজনৈতিক মহলে বিতর্ক শুরু হয়। রাজনৈতিক বিষয়ে দল দুটি বিপরীতমুখী অবস্থান নিচ্ছে। ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের ক্যাম্পাসে অবস্থান নিয়েও বিরোধ প্রকাশ্যে এসেছে। যদিও বিএনপি ও জামায়াতের একাধিক নেতার দাবি, মতপার্থক্য থাকলেও তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক বিদ্যমান। পৃথক রাজনৈতিক দল হওয়ার তাদের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা থাকবে এটি স্বাভাবিক বিষয়। তবে দীর্ঘদিনের জোট এখন আর নেই।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘রাজনীতি রাজনীতির ধারায় চলে, একেক সময় একেক দিকে মোড় নেয়। গতিপ্রকৃতি পরিবর্বতন হয়। কারও কথায় হয়তো একটু এদিক-সেদিক হয়, কিন্তু তা নিয়ে আদৌ সম্পর্কের টানাপোড়েন হয়েছে? কোনো দূরত্ব হয়নি। বিএনপির মূল লক্ষ্য জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য সবাই চেষ্টা করছে।
বিএনপি ও জামায়াতের নেতারা আলাপকালে খবরের কাগজকে জানান, বিএনপি ও জামায়াতের রাজনৈতিক আদর্শ ভিন্ন। আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যায়-গুম-খুনের প্রতিবাদে রাজপথের আন্দোলনও পৃথকভাবে করেছে। তবে আগামী নির্বাচন পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে আগামী দিনের সম্পর্ক।
বিএনপির সূত্রমতে, বিএনপি ও জামায়াতের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ আলাদা। এই পার্থক্য রাজনৈতিক দল হিসেবে শুরুতেই ছিল, এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক মূলত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। কখনো তাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়ে, আবার কখনো কখনো দূরত্ব কমে। তবে জোট ভাঙার মতো কঠিন পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি এবং আগামীতে না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বিএনপি ও জামায়াতের চলমান সম্পর্কে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করছে পরাজিত ফ্যাসিবাদী শক্তিরা বলেও মনে করছেন দল দুটির একাধিক নেতা।
তাদের দাবি, গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তিদের মধ্যে বিভেদ তৈরি হলে আবারও ফ্যাসিবাদি শক্তির উত্থান হতে পারে। এমনকি তৃতীয় শক্তিরও উত্থান হতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ তৈরির ষড়যন্ত্র চলছে এবং বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বাধা দিয়ে পরাজিত শক্তিরা আবারও প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। এ ব্যাপারেও সতর্ক দৃষ্টি বিএনপির হাইকমান্ডের।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে আমাদের কোনো দূরত্ব বাড়েনি। রাজনৈতিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সুসম্পর্ক রয়েছে। দলের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ এবং যোগাযোগ রয়েছে। তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক শুধু রাজনৈতিক।’
জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগর উত্তরের সেক্রেটারি জেনারেল রেজাউল করিম খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিএনপি ও জামায়াত আলাদা রাজনৈতিক দল। আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা আছে। তবে খুবই ভালো সম্পর্ক রয়েছে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জাতিগতভাবে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।’
তিনি বলেন, ১৫ বছরে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকার যে ক্ষতি করেছে তা আগামী ১০০ বছরেও পূরণ করা সম্ভব হবে না। তাই নিজেদের মধ্যে দূরত্ব বাড়লে ফ্যাসিবাদ আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে। তাই ফ্যাসিবাদ শক্তিকে আর প্রতিষ্ঠা হওয়ার সুযোগ দেওয়া যাবে না।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু খবরের কাগজকে বলেন, ‘জোটবদ্ধ থাকা অবস্থায় বিএনপি-জামায়াত একসঙ্গে আন্দোলন করেছে। জোট ভেঙে গেলেও যুগপৎ আন্দোলন করেছে। তবে আমার মনে হয়, কোনো দূরত্ব সৃষ্টি হয়নি। স্ব-স্ব রাজনৈতিক দল হিসেবে আলাদা চিন্তা-ভাবনা থাকতেই পারে। তবে গণতন্ত্রের পক্ষে শক্তিদের মধ্যে দূরত্ব বাড়েনি।’
উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগকে ঠেকাতে ১৯৯৯ সালে জামায়াতের সঙ্গে জোট বাঁধে বিএনপি। ২০০১ সালে জোটবদ্ধ নির্বাচন করে সরকার গঠন করে। ২০১০ সালে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াত নেতাদের বিচার শুরু হলে দলটিকে ছাড়ার জন্য বিএনপি ঘরে-বাইরে চাপে পড়ে। তবে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের অবস্থানের কারণে জোট ভাঙেনি। আবার মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ইস্যুতে জামায়াতের পাশেও দাঁড়ায়নি। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ আন্দোলন করে বিএনপি ও জামায়াত। ২০১৮ সালের নির্বাচনে নিবন্ধন হারানো জামায়াতের নেতারা বিএনপির প্রতীকে প্রার্থী হন। তবে ২০২২ সালে দুই দল আনুষ্ঠানিকভাবে জোট ভেঙে দিয়ে সরকার পতনের যুগপৎ আন্দোলনে নামে। নানা সম্পর্কে উত্থান-পতন হলেও সুসম্পর্ক এখনো রয়েছে।