ঢাকা ১০ আষাঢ় ১৪৩২, মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫
English

স্বল্প দামে মিলছে জ্বালানি, কমছে সিলিন্ডার গ্যাসের দৌরাত্ম্য

প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:৫৯ এএম
আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১০:০২ এএম
স্বল্প দামে মিলছে জ্বালানি,  কমছে সিলিন্ডার গ্যাসের দৌরাত্ম্য
ফরিদপুরের শোভারামপুরে বায়োগ্যাস দিয়ে রান্না করছেন এক গৃহিণী। ইনসেটে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট। ছবি: খবরের কাগজ

কেঁচোসারের পর বায়োগ্যাস প্ল্যান্টে সফল হয়েছেন ফরিদপুরের নারী উদ্যোক্তা তানিয়া পারভীন। জেলার শহরতলির কোমরপুরে বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট তৈরি করেছেন তিনি। এখন তার প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিদিন উৎপাদন হচ্ছে ১০০ ঘনফুট গ্যাস। ৬০টি পরিবারকে এই গ্যাস সরবরাহ করা শুরু হয়েছে। আগামী দিনে আরও ৪০টি পরিবারকে এই সেবার আওতায় নিয়ে আসার কাজ শুরু হয়েছে।

জেলা প্রাণিসম্পদ অফিস জানান, তাদের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে তানিয়াকে। 

সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, তানিয়া পারভীন একজন নারী উদ্যোক্তা। এর আগে তিনি ইউটিউব দেখে শুরু করেন কেঁচো কম্পোস্ট জৈব সার উৎপাদন। সেখানেও তিনি দেশের ভেতর একজন সফল উৎপাদনকারী হিসেবে পরিচিত। এবার তিনি সরকারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে শুরু করেছেন বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট। তার এই সফলতায় অনেকেই উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। এরই মধ্যে এলাকার ৬০টি পরিবারের মাঝে দিয়েছেন বায়োগ্যাস। সরকার থেকে ৪০ শতাংশ টাকা এবং নিজের ৬০ শতাংশ টাকা দিয়ে শুরু করেছেন এই গ্যাস প্ল্যান্ট। সিলিন্ডার গ্যাসের থেকে কম দামে বায়োগ্যাস পেয়ে খুশি স্থানীয়রা। এদিকে তানিয়ার প্রতিষ্ঠানে কাজ করে অনেক বেকার নারী-পুরুষের সংসারে ফিরেছে সচ্ছলতা। 

বায়োগ্যাসের সুবিধাভোগী কুলসুম বেগম জানান, প্রতি মাসে তাদের দুটি করে গ্যাস সিলিন্ডার লাগতো, যার বাজার মূল্য ছিল প্রায় ৩ হাজার টাকা। এখন সেখানে সারা মাসে মাত্র ১১০০ টাকা দিয়ে সেই সুবিধা পাচ্ছেন তিনি।

আরেক সুবিধাভোগী আকলিমা বেগম জানান, এই বায়োগ্যাস পাওয়াতে তাদের অনেক সুবিধা হয়েছে। পরিবারে অনেক সদস্য হাওয়ায় প্রতি মাসে দুই-তিনটি সিলিন্ডার গ্যাস লাগতো। অনেক সময় কাঠখড় পুড়িয়ে রান্নার কাজ চলতো। এখন পুরো মাসে তিনি মাত্র ১১০০ টাকায় পুরো পরিবারের জ্বালানি পাচ্ছেন।

একই এলাকার বাসিন্দা কে এম জাফর বলেন, ‘তানিয়া পারভীনই প্রথম এলাকায় কম্পোস্ট সারের উৎপাদন শুরু করেন। তিনি একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। এবার সরকারের সঙ্গে মিলে শুরু করেছেন বায়োগ্যাস উৎপাদন। এর ফলে আমাদের এলাকার প্রায় ১০০টি পরিবার উপকৃত হবে।’

তানিয়ার প্ল্যান্টে কাজ করা কবির হোসেন বলেন, ‘আমরা বেকার ছিলাম। এখানে কাজ করে স্বাবলম্বী হয়েছি। সারা বছর এখানে আমরা চার-পাঁচজন কাজ করছি। আমাদের পুরো পরিবার এখানকার কাজের ওপর নির্ভরশীল।’ 

নারী উদ্যোক্তা তানিয়া পারভীন বলেন, ‘আমি সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে এই বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট শুরু করেছি। এখন এলাকার পরিবারগুলোর মাঝে বায়োগ্যাস ছড়িয়ে দিতে কাজ চলছে। ইতোমধ্যে ৬০টি পরিবারকে এই গ্যাস দেওয়া হয়েছে। আরও প্রায় ৪০টি পরিবারের মধ্যে বায়োগ্যাস দেওয়ার কাজ চলছে। এই প্রকল্পে আমাকে সরকারের পক্ষ থেকে ৪০ লাখ টাকা ঋণ হিসেবে দেওয়া হয়েছে। বাকি ৬০ ভাগ টাকা নিজে বিনিয়োগ করেছি।’ 

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. সঞ্জীব কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘নারী উদ্যোক্তা তানিয়া পারভীনের বায়োগ্যাস প্ল্যান্টে সরকারের পক্ষ থেকে ৪০ ভাগ টাকা এবং তানিয়া পারভীন নিজে ৬০ ভাগ টাকা দিয়ে এই বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট শুরু করেছেন। তিনি এখন ৬০টি পরিবারের মাঝে গ্যাস সরবরাহ শুরু করেছেন। সামনে আরও ৪০টি পরিবারের তিনি দেবেন। ব্যবহার নিরাপদ হওয়ায় বায়োগ্যাস উৎপাদনে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সরকার।’

সম্ভাবনা ও শঙ্কা নিয়ে কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট শুরু জুলাইয়ে

প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৫, ১০:২৯ এএম
সম্ভাবনা ও শঙ্কা নিয়ে কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট শুরু জুলাইয়ে
ছবি: সংগৃহীত

আগামী জুলাই মাস থেকে কক্সবাজার বিমানবন্দরকে পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করাতে চায় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। এটি হবে দেশের চতুর্থ আন্তর্জাতিক গেটওয়ে। চালু হবে কার্গো ফ্লাইটও। তবে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের যাত্রী টানতে কতটা প্রস্তুত পর্যটন নগরী কক্সবাজার, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, বিদেশি পর্যটকদের জন্য প্রস্তুত না করেই কক্সবাজার থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা দেখতে পারে লোকসানের মুখ।

বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া খবরের কাগজকে বলেন, ‘বর্তমানে যেটুকু অবকাঠামো রয়েছে, বিশেষ করে পুরোনো বিল্ডিং, সেটি ব্যবহার করে প্রাথমিকভাবে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চলাচল শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি এখান থেকে কার্গো ফ্লাইট পরিচালনারও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে ইতোমধ্যে বৈঠকও হয়েছে।’

রানওয়ে এবং এয়ার ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টের কাজ নির্ধারিত সময়েই শেষ হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য, আগামী জুলাই মাসেই কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু করা।’

বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত কেবল এয়ার অ্যারাবিয়া কক্সবাজার থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনায় আগ্রহ দেখিয়েছে। পাশাপাশি বেবিচক থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে।

তবে অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের কক্সবাজার থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট কতটা লাভজনক হবে, তা নিয়ে শঙ্কা আছে। অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও বিমান পরিচালনা বোর্ডের সাবেক সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, কক্সবাজার থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনার জন্য তো তাকে প্রস্তুত করতে হবে। কারণ এখন তেমন কোনো অবকাঠামো নেই। বিদেশি পর্যটকরা কক্সবাজারে তেমন আসেন না। ফলে এখান থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালুর আগে অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন। 

অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ এ টি এম নজরুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, কক্সবাজারকে বিদেশি পর্যটকদের জন্য উপযুক্ত না করলে এখান থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বা কার্গো ফ্লাইট কোনোটাই কাজ করবে না। রাস্তাঘাটের উন্নয়নের পাশাপাশি কক্সবাজারকে নিয়ে মহাপরিকল্পনা প্রয়োজন। তা না হলে আয়োজন করে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু হবে ঠিকই, কিন্তু বেশি দিন চলবে না।

বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত ও পাহাড়ঘেরা অপার সৌন্দর্যের অধিকারী কক্সবাজার। কিন্তু তার পরও বিদেশি পর্যটক তেমনভাবে টানতে পারছে না কক্সবাজার। এর কারণ হিসেবে অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) সভাপতি আবদুস সালাম আরেফ বলেছেন, ‘দেশের পর্যটনশিল্প সম্পর্কে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সেভাবে প্রচারিত না হওয়ায় বিদেশি পর্যটকদের আগমন অনেক কম। তিনি বলেন, যারা কক্সবাজারে ভ্রমণে আসেন, তাদের অনেককেই নানা ধরনের ভোগান্তির সম্মুখীন হতে হয়। পর্যটন মৌসুমে দীর্ঘ যানজট, সড়ক দুর্ঘটনা এবং পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাব বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। অনেক পর্যটন এলাকা রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অবহেলিত হয়ে আছে।’ তিনি আরও বলেন, কক্সবাজারে এখনো আন্তর্জাতিক মানের কোনো অ্যামিউজমেন্ট পার্ক বা জমজমাট নাইটলাইফ নেই, যা আধুনিক পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ। এ কারণে বিদেশি পর্যটকদের আগ্রহও তুলনামূলকভাবে কম।

আবদুস সালাম আরেফ মনে করেন, কক্সবাজারসহ দেশের প্রধান পর্যটন এলাকাগুলোর আধুনিকায়ন এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি বিদেশে পর্যটন খাতের ব্যাপক প্রচার চালানো সময়োপযোগী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) আবু তাহির মোহাম্মদ জাবের খবরের কাগজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘কক্সবাজারে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে না- এই ধারণা সঠিক নয়। তবে যেভাবে বাড়ার কথা ছিল, সেই হারে বাড়ছে না, সেটি সত্য।’

তিনি আরও বলেন, ‘পর্যটন একটি সমন্বিত খাত, যার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ, যানবাহন সুবিধা, বিশ্রামের জায়গা, বিনোদনের সুযোগ, টয়লেট, মানসম্মত খাবার ও সুলভ আবাসনব্যবস্থার মতো নানা বিষয় জড়িত। পর্যটনের টেকসই উন্নয়নের জন্য এসব প্রতিটি ক্ষেত্রে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।’

আবু তাহির মোহাম্মদ জাবের জানান, কেবল দেশি পর্যটকের সংখ্যা বাড়ানোই নয়, বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করতেও সরকার নানা উদ্যোগ নিচ্ছে এবং এ নিয়ে নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে কাজ চলমান রয়েছে।

কক্সবাজার বিমানবন্দরের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও প্রস্তুতি
কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার জন্য ২০২১ সালে একটি মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এই প্রকল্পের আওতায় রানওয়ে সম্প্রসারণ ও একটি অত্যাধুনিক নতুন টার্মিনাল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। বঙ্গোপসাগরের ওপর সম্প্রসারিত ১ হাজার ৭০০ ফুট রানওয়ের নির্মাণকাজ আগামী জুলাইয়ের মধ্যে সম্পন্ন হবে, ফলে মোট রানওয়ের দৈর্ঘ্য দাঁড়াবে ১০ হাজার ৭০০ ফুট (৩.২৬ কিলোমিটার), যা দেশের দীর্ঘতম রানওয়ে হিসেবে নতুন রেকর্ড গড়বে।

প্রাথমিকভাবে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটগুলো বর্তমান টার্মিনাল ভবন থেকেই পরিচালিত হবে। পরবর্তী সময়ে নির্মিতব্য আধুনিক আন্তর্জাতিক টার্মিনাল ভবনটি সব ধরনের ওয়াইড-বডি উড়োজাহাজ পরিচালনার উপযোগী হবে। যদিও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালুর জন্য প্রস্তুতি চলছে, তবে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। বিমানবন্দরের নতুন টার্মিনালের কাজ শেষ হতে আরও ৯ মাস লাগবে। এ ছাড়া ৪ দশমিক ৬৪ একর জমি অধিগ্রহণ করা এবং এ জন্য ৩ হাজার ৩০০ পরিবারকে উচ্ছেদ করা এখনো সম্ভব হয়নি। আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনার জন্য আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার (আইকাও) অনুমোদনও এখনো মেলেনি।

আন্তর্জাতিক ফ্লাইট কতটা লাভজনক হবে, তা নিয়ে শঙ্কা থাকলেও বিশ্লেষকরা বলছেন, কক্সবাজার নিয়ে কার্যকরী পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নিলে এটি আঞ্চলিক পর্যটনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। নেপাল, ভুটান, উজবেকিস্তান এবং চীনের ইউনান প্রদেশের মতো ভূমিবেষ্টিত দেশগুলোর জন্য কক্সবাজার সবচেয়ে কাছের সমুদ্রগন্তব্য, যার পর্যটন সম্ভাবনা অপার। এই উদ্যোগের মাধ্যমে কক্সবাজারের পর্যটনশিল্পে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে, যা দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

ক্ষমতার পালাবদলে থেমে আছে মুগদা-মান্ডা সড়কের কাজ

প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৫, ১০:১২ এএম
আপডেট: ২৪ জুন ২০২৫, ১০:১৪ এএম
ক্ষমতার পালাবদলে থেমে আছে মুগদা-মান্ডা সড়কের কাজ
ছবি: খবরের কাগজ

রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ একটি সড়ক হয়ে উঠেছে জনদুর্ভোগের প্রতীক। মুগদা বিশ্বরোড এলাকার অতীশ দীপঙ্কর সড়ক থেকে মান্ডা ব্রিজ পর্যন্ত প্রায় আধা কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কের মেরামত ও ড্রেনের সংস্কারকাজ শেষ হচ্ছে না। গত বছরের শুরুর দিকে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে রাস্তা সংস্কার ও স্যুয়ারেজ লাইনের কাজ শুরু হলেও সরকার পরিবর্তনের পর কার্যত কাজ বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানান স্থানীয়রা। দেড় বছর ধরে সড়ক খুঁড়ে রাখায় স্থানীয় বাসিন্দা ও পথচারীদের নাভিশ্বাস উঠেছে।

এ সড়কটি দিয়ে প্রতিদিন লাখো মানুষ চলাচল করেন। মুগদা হাসপাতাল, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আবাসিক এলাকার যোগাযোগের রুট হওয়ায় সড়কটির গুরুত্ব অত্যধিক। সিটি করপোরেশন এবং সংশ্লিষ্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি এ বিষয়ে এখনো কোনো নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করেনি। তাই দ্রুত কাজ শেষ করে সড়কটিকে জনসাধারণের চলাচলের উপযোগী করে তোলার দাবি জানাচ্ছেন এলাকাবাসী। একই সঙ্গে প্রকল্পের অগ্রগতির স্বচ্ছতা ও সময়সীমা নির্ধারণের আহ্বান জানিয়েছেন তারা।

সরেজমিন দেখা যায়, সড়কজুড়ে খোঁড়া গর্ত, ভাঙা ইট-পাথর, নির্মাণসামগ্রী আর ধুলার আস্তরণে পথচারীদের হাঁটা দায় হয়ে উঠেছে। বর্ষায় কাদায় পিচ্ছিল হয়ে যায় সড়ক, আবার রোদে ধুলায় চোখে-মুখে অসহ্য যন্ত্রণা। রিকশা, অটোরিকশা, ঠেলাগাড়ি চলতে পারলেও অ্যাম্বুলেন্স চলাচলের কোনো ব্যবস্থা নেই। এলাকার শিক্ষার্থী, অফিসগামী মানুষ, বৃদ্ধ ও রোগীরা পড়ছেন চরম দুর্ভোগে।

দীর্ঘদিন অচল অবস্থায় পড়ে থাকায় সড়কের ওপর ত্রিপল টানিয়ে বেচাকেনা শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা। সড়কের মাঝখানে মাছ-মুরগি ও কাঁচামাল ব্যবসায়ীদের ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা গেছে। রাস্তার মাঝে পানি জমে আছে, বসতবাড়ির ময়লা ও আবর্জনা সেখানে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। রাস্তায় মশা-মাছির ব্যাপক উপদ্রব দেখা গেছে। বৃষ্টির পর রাস্তা ও নর্দমায় পানি জমে থাকায় দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে সড়কে।

স্থানীয় বাসিন্দা, দোকানদার, শিক্ষক, চিকিৎসক সবাই এখন একটা কথাই বলছেন- প্রতিদিনের এই দুর্ভোগ থেকে যেন দ্রুত মুক্তি পাওয়া যায়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেন নিয়মিত তদারকি করে সড়কটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনে।

স্থানীয় বাসিন্দা জহিরুল ইসলাম বলেন, গত বছরের শুরুতে অনেক আনুষ্ঠানিকতা করে ড্রেনের সংস্কারকাজ শুরু হয়েছিল। কংক্রিটের পাইপ এনে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু কয়েক মাস পর কাজ ধীর হয়ে আসে, এখন একেবারে থেমে গেছে। এতে শুধু ধুলা নয়, বৃষ্টির সময় কাদা আর দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে।

স্থানীয় শিক্ষক শিউলি আক্তার বলেন, ‘সকাল-বিকেল এখানে রিকশা উল্টে পড়ছে, লোকজন মাটিতে পড়ে যাচ্ছে, কারও পা মচকাচ্ছে, কারও কোমর ভাঙছে। এতদিন ধরে খোঁড়াখুঁড়ির পরও কাজ শেষ হচ্ছে না। এটা কি উন্নয়ন না ভোগান্তি, বোঝা যাচ্ছে না।’ একই অভিযোগ করেন দোকানদার আবু সালেহ। তিনি বলেন, ‘আমার দোকানে ধুলা ঢুকে সব পণ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বিক্রিও কমে গেছে। কেউ রাস্তা দিয়ে হাঁটতেই চায় না, কেনাকাটা করবে কীভাবে?’

কাজ চলছে ধীরগতিতে, সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নেই
ড্রেনেজ উন্নয়নকাজের তত্ত্বাবধানে থাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘কাজে কিছু কারিগরি জটিলতা এসেছে, লোকবলের অভাবও রয়েছে তাই সময় লেগে যাচ্ছে। তবে দ্রুত কাজ শেষ করার চেষ্টা করছি।’

কিন্তু স্থানীয়দের অভিযোগ, রাস্তা খুঁড়ে ফেলে রেখে দীর্ঘ সময় কোনো কাজই করা হয় না। মাঝে মাঝে কিছু শ্রমিক এসে ঘুরে দেখে চলে যান। তারা দাবি করছেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেন নির্দিষ্ট সময়সীমা দিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজটি শেষ করে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম খবরের কাগজকে বলেন, কাজ কীভাবে এগোবে? একদিকে আন্দোলন (বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের আন্দোলন), অন্যদিকে রাস্তার জায়গা স্থানীয়রা ছাড়ছেন না। মাঝে স্থানীয়দের নিয়ে একটি কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কাজ শুরু হলে আন্দোলনও শুরু হয়, কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এখন পরিবেশ স্বাভাবিক হলে কাজ আবারও শুরু হবে।

আন্দোলনে বেহাল জনপ্রশাসন

প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৫, ০৯:৩৬ এএম
আপডেট: ২৪ জুন ২০২৫, ০৯:৩৭ এএম
আন্দোলনে বেহাল জনপ্রশাসন
ফাইল ফটো

পদোন্নতি, নিয়োগ-বদলি, সুযোগ-সুবিধাসহ নানা দাবিতে একের পর এক আন্দোলনে বেহাল হয়ে পড়েছে জনপ্রশাসন। দীর্ঘদিন ধরে চলা এসব আন্দোলনের কারণে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন সংকট।

গত বছরের ৮ আগস্ট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। পটপরিবর্তনের ফলে সে সময় নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে দেখা দেয় অস্থিরতা ও ভয়। অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের পর পদোন্নতিবঞ্চিত ও অসময়ে বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। বঞ্চিত, বিক্ষুব্ধ এসব কর্মকর্তা একপর্যায়ে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেন। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটে। একপর্যায়ে সরকার দীর্ঘদিন প্রশাসনের বাইরে থাকা বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিব পদে নিয়োগ দেয়। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, চুক্তিভিত্তিক এসব নিয়োগের পর গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সিনিয়র সচিব ও সচিবরা চলমান কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সমন্বয় করতে পারছেন না। ফলে প্রশাসনের স্বাভাবিক কাজের গতি মন্থর হয়েছে। 

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই জনপ্রশাসনে প্রশাসন ক্যাডার ও অন্য ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তাদের মাঝে অস্থিরতা চলছে। অন্য ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তারা বলছেন, একই অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনে আন্দোলন করছে অন্য ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত ‘আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’। প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া বিসিএসের (বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস) পুলিশ ক্যাডার, পররাষ্ট্র ক্যাডার, অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস ক্যাডার, ইকোনমিক ক্যাডার, কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট ক্যাডার, ট্যাক্সেশন ক্যাডার, সমবায় ক্যাডার, খাদ্য ক্যাডার, ডাক ও টেলিযোগাযোগ ক্যাডার, রেলওয়ে পরিবহন ও বাণিজ্য ক্যাডার, পরিবার পরিকল্পনা ক্যাডার, পরিসংখ্যান ক্যাডার, মৎস্য ক্যাডার, আনসার ক্যাডার, বন ক্যাডার, তথ্য ক্যাডার, সড়ক ও জনপথ ক্যাডার, গণপূর্ত ক্যাডার, স্বাস্থ্য ক্যাডার, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল ক্যাডার, রেলওয়ে প্রকৌশল ক্যাডার, পশুসম্পদ ক্যাডার, কৃষি ক্যাডার, সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার ও কারিগরি শিক্ষা ক্যাডাররা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে গঠন করেছেন আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ। 

‘ক্যাডার যার, মন্ত্রণালয় তার’ বাস্তবায়ন, উপসচবি পদে কোটা পদ্ধতি বাতিল করে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ; সব ক্যাডারে সমতা স্থাপন; শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারসহ সব ক্যাডারকে একই কমিশনের আওতায় রাখা; পরিবার পরিকল্পনা ও পরিসংখ্যান ক্যাডারকে সার্ভিসের অন্তর্ভুক্ত রাখাসহ ১৪ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নের দাবিতে আন্দোলন করছেন ‘আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মতপ্রকাশের কারণে অন্য ২৫ ক্যাডারের ১২ জন সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করার বিরুদ্ধেও নিজেদের অবস্থান জানিয়েছেন তারা। পরিষদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে বিষয়টি সমাধানের আশ্বাস দেওয়া হলেও সমাধান করা হয়নি। তা ছাড়া জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন উপসচিব পুলে প্রশাসন ক্যাডার থেকে শতকরা ৫০ ভাগ ও অন্য ২৫টি ক্যাডার থেকে অবশিষ্ট ৫০ শতাংশ কোটা রেখে পরীক্ষার ভিত্তিতে নিয়োগের সুপারিশ করে। এমন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে ‘আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’। এ ছাড়া অন্য ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তারা অভিযোগ করে বলেন, একটি নির্দিষ্ট ক্যাডারের গোষ্ঠী-স্বার্থে উদ্দেশ্যমূলকভাবে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিসংখ্যান, ডাক, পরিবার-পরিকল্পনা, কাস্টমস ও ট্যাক্স ক্যাডারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি করা হয়েছে। তারা অভিযোগ করেন, পক্ষপাতদুষ্ট জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ‘আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’-এর সঙ্গে কোনো রকম আলোচনা ছাড়া একটি ক্যাডারের এজেন্ডা বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছে। 

‘আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’ বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করায় প্রশাসনের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে কি না জানতে চাইলে পরিষদের সমন্বয়ক ড. মুহম্মদ মফিজুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, তা তো হচ্ছেই। মানসিক প্রশান্তির সঙ্গে দাপ্তরিক কাজ করতে না পারলে বিঘ্ন তো ঘটবেই। তিনি বলেন, ‘আমাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করে রাখা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মতপ্রকাশের কারণে পরিষদের ১২ জন সদস্যের (কর্মকর্তা) বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অথচ একই অপরাধে ২১ জন প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তা অভিযুক্ত হলেও এখনো তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের এসব অপরাধের বিবরণ প্রমাণসহ উপদেষ্টা ও সংশ্লিষ্টদের কাছে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়নি জনপ্রশাসন।’ 

অন্যদিকে কালাকানুন ও নিবর্তনমূলক আখ্যা দিয়ে ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ বাতিলের দাবিতে প্রতিদিন সচিবালয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত ঐক্য ফোরাম। ইতোমধ্যে সংগঠনটি অধ্যাদেশ বাতিলের দাবি জানিয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন। কর্মচারীদের আন্দোলন চলমান থাকায় প্রশাসনের স্বাভাবিক কাজকর্মে প্রভাব পড়ছে জানিয়ে সংযুক্ত ঐক্য ফোরামের কো-চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘কর্মচারীরা যে প্রতিদিন কর্মঘণ্টা নষ্ট করে আন্দোলন করছেন, তাতেই তো প্রশাসনের কাজকর্মে ব্যাঘাত ঘটছে। সরকার আমাদের আন্দোলনকে মূল্যায়ন করছে কি না, সেটা তো আমরা বুঝতে পারছি না। আমাদের ডাকা হবে আলোচনার জন্য, সরকারের পক্ষ থেকে এ কথা বলা হলেও এখনো তেমন কোনো ইঙ্গিত পাইনি। আন্দোলন চলছে, স্বাভাবিক কাজকর্মে ব্যাঘাত হচ্ছে। এটা যাতে না হয়, তার দায়দায়িত্ব তো সরকারেরও রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের দাবিদাওয়া প্রসঙ্গে আইন উপদেষ্টাকে প্রধান করে ইতোমধ্যে একটি পর্যালোচনা কমিটি গঠন করেছে সরকার। সেই কমিটি বৈঠক করেছে। অথচ কী আলোচনা হয়েছে তা আমরা এখনো জানি না। সরকার কেন এই আইনটি করেছে বা তাদের মোটিভ কী তাও আমরা জানি না।’ 

তিনি বলেন, ‘আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ ছাড়া চাকরি থেকে বরখাস্তের অধ্যাদেশের বিধান বাতিল না করলে প্রয়োজনে সারা দেশে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে কঠোর আন্দোলনে যাব। আমাদের সেই প্রক্রিয়া চলছে। সারা দেশের মাঠ প্রশাসনসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তর, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর ও সংস্থার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আন্দোলন নিয়ে আলোচনা চলছে।’ 

কো-চেয়ারম্যান বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শাস্তি দেওয়ার মতো আইন বর্তমানে রয়েছে। তারপরও কেন এই অধ্যাদেশ জারি করা হলো, তা আমরা জানি না।’ নিবর্তনমূলক এই কালো আইন প্রশাসনের কেউ চান না দাবি করে নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের একটাই দাবি, এই কালাকানুন বাতিল করতে হবে।’

অপর কো-চেয়ারম্যান মো. বাদিউল কবির খবরের কাগজকে জানান, ২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইন সংশোধন করে অধ্যাদেশ জারি করায় ক্ষুব্ধ সব পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। অধ্যাদেশের খসড়ায় শৃঙ্খলা বিঘ্নিত, কর্তব্য সম্পাদনে বাধা, ছুটি ছাড়া কাজে অনুপস্থিত, কর্তব্য পালন না করার জন্য উসকানির জন্য কোনো ধরনের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে চাকরিচ্যুতির বিধান যুক্ত করা হয়েছে। অধ্যাদেশ বাতিলের এই দাবি ধীরে ধীরে সারা দেশে ছড়িয়ে দেব। সরকার জারি করা অধ্যাদেশ বাতিল করবে কি না, জানতে চাইলে বাদিউল কবির বলেন, ‘ইতোমধ্যে কয়েকজন উপদেষ্টা আমাদের কাছে স্বীকার করেছেন যে এই অধ্যাদেশ অপপ্রয়োগের সুযোগ রয়েছে। তাই সরকার অযৌক্তিক মনে করলে বাতিল করে দিতে পারে। আমরা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এই কালো আইন সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের দাবি জানাই।’

প্রসঙ্গত, গত ২৫ মে ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করে সরকার। এর আগে গত ২২ মে উপদেষ্টা পরিষদের সভায় অধ্যাদেশটির খসড়া অনুমোদনের পর ২৪ মে থেকেই আইনটি প্রত্যাহারের দাবিতে সচিবালয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সব কটি সংগঠন সম্মিলিতভাবে আন্দোলন করে আসছিল। তারা এই অধ্যাদেশটিকে নিবর্তনমূলক ও কালো আইন হিসেবে অভিহিত করছেন।

আবারও আলোচনায় মব ভায়োলেন্স

প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৫, ০৮:৩৮ এএম
আপডেট: ২৪ জুন ২০২৫, ০৮:৫৬ এএম
আবারও আলোচনায় মব ভায়োলেন্স
খবরের কাগজ ইনফোগ্রাফ

‘মব ভায়োলেন্স’ থামছেই না। নানা রকম অভিযোগ-অজুহাতে একশ্রেণির মানুষ মব সৃষ্টির মাধ্যমে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছেন। মব সৃষ্টি করে টার্গেট ব্যক্তির বাসাবাড়ি বা অফিসে ভাঙচুর চালাচ্ছেন। মারধর ও হেনস্তার পাশাপাশি কোথাও কোথাও ‘গণপিটুনির’ নামে হত্যার ঘটনাও ঘটানো হয়েছে। নতুন করে আবারও মব ভায়োলেন্স নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদাকে জুতার মালা পরিয়ে হেনস্তা করে পুলিশে সোপর্দ করার ঘটনাটি।

যদিও সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে বারবার মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু কোনো হুঁশিয়ারিতেই বন্ধ হচ্ছে না এই জাতীয় অপরাধ। বরং প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে পুলিশ বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর অবস্থান বা ভূমিকা। এই পরিপ্রেক্ষিতে অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, মব ভায়োলেন্সের এমন বহু ঘটনা ঘটলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে নামমাত্রই। মব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপের অভাবে বারবার এই ধরনের অপরাধের প্রবণতা বাড়ছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের বিষয়ে ইতোমধ্যেই প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে। তারপরও বলতে গেলে আমাদের পুলিশের যে রকম কার্যক্রম, সেটাও শতভাগ চালু হয়নি। রাস্তা অবরোধ করে অনেকে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করছেন, এটাও মব ভায়োলেন্স। পুলিশের সামনেই সেটা করা হচ্ছে। কিছু বলতে গেলেও সমস্যার সৃষ্টি করা হচ্ছে। এ অবস্থাতেও আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি, যাতে এই ধরনের অপরাধ না ঘটে।’

গত রবিবার মব ভায়োলেন্সর মাধ্যমে রাজধানীর উত্তরায় সাবেক সিইসি কে এম নূরুল হুদাকে হেনস্তা করে পুলিশে সোপর্দ করার ঘটনাটি আরও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়িয়েছে সচেতন সাধারণ মানুষের মধ্যে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ওই ঘটনার তীব্র আলোচনা-সমালোচনা হয়। অনেকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের বেশ কিছু মব ভায়োলেন্সের তুলনামূলক আলোচনা-সমালোচনা করেন। তবে অধিকাংশই যেকোনো ধরনের মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ জানান। যদিও এই ঘটনার পর প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ঘটনার রাতেই কড়া বিবৃতি দিয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে।

পাশাপাশি গতকাল এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান মব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। এমনকি প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষ থেকেও মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে স্পষ্ট কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া সাবেক সিইসির প্রতি অপমানজনক ও সহিংস আচরণের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।

সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরের গত দুটি প্রেস ব্রিফিংয়ে মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়। সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও মবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন একাধিকবার। কিন্তু তারপরও কেন মব ভায়োলেন্স বন্ধ হচ্ছে না? মব জাস্টিসের নামে আইন হাতে তুলে নিয়ে সামাজিক শৃঙ্খলা যারা বিপন্ন করছেন তাদের বিরুদ্ধে আদৌ কি কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে- সেটাও প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে অপরাধ বিশ্লেষকদের কাছে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘যেকোনো ধরনের মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখানো হবে। ডিএমপির সব থানায় এ বিষয়ে আবারও কড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এদিকে গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর সারা দেশে মব ভায়োলেন্স ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। মানবাধিকার সংস্থা ‘আসকের’ তথ্যমতে, গত সাড়ে ১০ মাসে (আগস্ট থেকে ২৩ জুন পর্যন্ত) সারা দেশে মব সৃষ্টির মাধ্যমে গণপিটুনি বা মারধর করে ১৭৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে চলতি বছরের সাড়ে ৫ মাসে নিহত হয়েছেন ৮৩ জন। এসব হত্যাকাণ্ডের বাইরে মব ভায়োলেন্স বা মব সৃষ্টির মাধ্যমে হামলা, ভাঙচুর ও মারপিটের ঘটনা আরও অনেক বেশি বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।

এ প্রসঙ্গে সামাজিক অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘যেকোনো ধরনের মব ভায়োলেন্স সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা ও আইনশৃঙ্খলার দুর্বলতাকে জানান দেয়। গত ৫ আগস্টের প্রেক্ষাপটে মব ভায়োলন্সে যেভাবে বেড়েছিল, সেখান থেকে এখনো যদি একই রকমভাবে চলতে থাকে সেটা অবশ্যই হতাশাজনক। সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে কথা বললেও দৃশ্যমান পদক্ষেপ সেভাবে জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারেনি। মব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর বা দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া না হলে এই জাতীয় অপরাধ প্রবণতা বাড়তেই থাকবে। ফলে সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে এই বিষয়ে আরও সোচ্চার হতে হবে।’

মব ভায়োলেন্স দেশের সংবিধান, আইন ও মানবাধিকারের মূল্যবোধে সরাসরি আঘাত 
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সিনিয়র সমন্বয়কারী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আসক গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছে যে, গত ২২ জুন রাজধানীর উত্তরায় সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদাকে কিছু উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তি বেআইনিভাবে সমবেত হয়ে গলায় জুতার মালা পরিয়ে মারধর করে এবং পরে তাকে পুলিশের কাছে সোর্পদ করা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত ভিডিও ফুটেজে প্রকাশিত এই দৃশ্য শুধু একজন ব্যক্তির প্রতি নয়, বরং দেশের সংবিধান, মানবাধিকারের ন্যূনতম মূল্যবোধ ও আইনের শাসনের প্রতি সরাসরি আঘাতের নামান্তর।

আসক মনে করে, একজন নাগরিকের বিরুদ্ধে যদি কোনো গুরুতর অভিযোগ থেকেও থাকে, তা নিষ্পত্তির একমাত্র পথ হচ্ছে সংবিধান ও প্রচলিত আইনের নির্ধারিত প্রক্রিয়া। বিচারব্যবস্থার বাইরে গিয়ে যেকোনো অপমানজনক ও সহিংস আচরণ শুধু ব্যক্তি অধিকারকেই লঙ্ঘন করে না, তা একটি সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দুষ্কৃতকারীরা যদি এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটিয়ে থাকে, তা বিচারহীনতার একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত তৈরি করে, যা ভবিষ্যতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথকে আরও জটিল করে তুলতে পারে এবং আইনের শাসনের পরিবর্তে ‘মব সংস্কৃতি’কে যেন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার প্রচ্ছন্ন সংকেত দেয়।

আসক আরও বলেছে, শুধু ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকে জুন পর্যন্ত উচ্ছৃঙ্খল জনতার হাতে কমপক্ষে ৮৩ জন মানুষ নিহত হয়েছেন, যা একটি সভ্য রাষ্ট্রে ঘোরতর নৈরাজ্যের ইঙ্গিত বহন করে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে দু-একবার সতর্কতা উচ্চারণ করা হলেও সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের সংঘবদ্ধ সহিংসতার বিরুদ্ধে এখনো পর্যন্ত কোনো কার্যকর ও জোরালো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। বরং আপাতদৃষ্টিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তা এসব সহিংস গোষ্ঠীর অপকর্মে পরোক্ষভাবে উৎসাহ জোগাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।

আসক বলেছে, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা রাষ্ট্রের একজন নাগরিক এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাকে এভাবে লাঞ্ছিত করা শুধু ব্যক্তির অপমান নয়, এটি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও আইনের শাসনের অবমাননার শামিল।

লবণাক্ত জমিতেই ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন মানুষ

প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৫, ০৭:০০ এএম
লবণাক্ত জমিতেই ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন মানুষ
পতিত জমিতে সবজির বাগান গড়ে তুলেছেন শ্যামনগর উপজেলার দক্ষিণ ঝাঁপা গ্রামের সবিতা রানী। ছবি: খবরের কাগজ

জমির দিকে তাকালেই স্বামী জামিরুলের কথা মনে পড়ে সালমা খাতুনের। লবণাক্ততা বাড়ায় এই জমি হয়ে পড়েছিল নিষ্ফলা। দুমুঠো আহার জোটাতে হিমশিম খেতে খেতে প্রথমে এলাকা, পরে দেশ ছেড়েছিলেন জামিরুল। এরপর আর ফিরে আসেননি তিনি। মৃত্যু তাকে কেড়ে নিয়েছে চিরতরে।  

জামিরুলের অবর্তমানে তার স্ত্রী সালমা আবার ফিরেছেন সেই জমিতেই। লবণাক্ত সেই জমিই এখন ভরসা তার। লবণসহিষ্ণু জাতের ফসল উৎপাদন করে এখন সংসারে গতি ফিরিয়েছেন তিনি।   

সালমা খাতুনের মতোই ভাগ্য সোরা গ্রামের কুলসুম বেগমের। ঘূর্ণিঝড় আইলার সময় নদীগর্ভে চলে যায় তাদের বাসস্থান। তার স্বামী আশরাফুল হোসেন ভাগ্য ফেরাতে পাড়ি জমান অন্যত্র। কিন্তু সেখান থেকে আর কখনো ফিরে আসেননি,  খোঁজখবর নেননি কুলসুমসহ তাদের সন্তানদের। লবণপানির ব্যবহারে জরায়ু হারাতে হয়েছে কুলসুমকে। তবে তিনি থেমে যাননি। গৃহপালিত পশুপাখি ও লবণসহিষ্ণু বিভিন্ন ফসল ও সবজি আবাদ করে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন ধীরে ধীরে।

জামিরুলের মতো মানব পাচারের শিকার হয়ে বিদেশে গিয়েছিলেন শিউলি খাতুন (ছদ্মনাম)। তিনি বেঁচে ফিরেছেন বটে, কিন্তু স্বামী তাকে গ্রহণ করেননি বিদেশে যৌন হয়রানির শিকার হওয়ায়। শিউলিও দেশ ছেড়েছিলেন সংসারে সচ্ছলতা আনতে। তাদের জমিও লবণাক্ত হয়ে পড়ায় ফসল চাষের উপযোগিতা হারিয়েছিল। 

সব কূল হারিয়ে শিউলি এখন বাবার বাড়িতে ঠাঁই নিয়েছেন এবং ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন কৃষিকাজ করে। ফসল ফলাচ্ছেন সেই লবণাক্ত জমিতেই।   

সাতক্ষীরা জেলার উপকূলীয় অঞ্চল শ্যামনগর ও আশাশুনিতে এমন গল্প অসংখ্য। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে জমিতে লবণাক্ততার মাত্রা এতটাই বেড়েছে যে কৃষির কথা অনেকেই ভুলেছেন। ক্ষুধা-দারিদ্র্যের কারণে ওই উপজেলার অনেক মানুষই পাড়ি জমিয়েছেন প্রবাসে। যাদের বেশির ভাগই হয়েছেন আসলে পাচারের শিকার।

যেভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন মানুষ

বিদেশে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়ে ফিরে আসা শিউলি খাতুনরাই এখন সংসারের হাল ধরছেন। নিজ বসতবাড়ির আঙিনায় সবজি উৎপাদন করছেন। নিজ পরিবারের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি উদ্বৃত্ত ফসল বাজারে বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করছেন। একই সঙ্গে গৃহস্থালি পশুপাখিও পালন করছেন।  

যে জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিলেন এবং ভাগ্য বদলের আশায় বিদেশ গিয়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন, বর্তমানে সেই বিপর্যয়কে মোকাবিলা করে কৃষি বিভাগ ও আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরামর্শ ও তথ্য অনুযায়ী লবণসহিষ্ণু জাতের ধান ও সবজি চাষ করে ধীরে ধীরে অনেকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তারা। 

 শিউলি বলেন, “দেশে ফেরার পর মানসিকভাবে ভেঙেছিলাম। নানাজনে নানা কথা বলত। ওই সময় মানব পাচার রোধে কাজ করা সংস্থা ‘অগ্রগতি’ আমার পাশে দাঁড়ায়। আমাকে কাউন্সেলিং করাসহ জলবায়ু বিপর্যয়কে মোকাবিলা করেও যে স্বাবলম্বী হওয়া যায়, সেটা তারা আমাকে বোঝান। একপর্যায়ে তাদের সাহায্যে লবণসহিষ্ণু জাতের বিভিন্ন ফসল চাষ করি। যেটার দেখভাল আমার বাবা করেন।”  

এ পর্যন্ত সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট ও বরিশাল অঞ্চলের দেড় হাজারের অধিক পাচারের শিকার মানুষকে নিয়ে কাজ করেছেন অগ্রগতি সংস্থার নির্বাহী পরিচালক আব্দুস সবুর বিশ্বাস। বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে ইতোমধ্যে ৬৩৫ জন মানুষকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলেছেন তিনি। 

আব্দুস সবুর বলেন, ‘লবণপানির আগ্রাসনে উপকূলের মানুষ পাচারের শিকার হন। এ জন্য পাচারের শিকার ওই সব মানুষকে আমরা নিয়মিত কাউন্সেলিং করি। তাদের স্থানীয় প্রযুক্তি, জ্ঞান ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তুলি এবং বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে আর্থিকভাবে সহযোগিতা দিই। লবণপানির আগ্রাসন মোকাবিলা করে তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করেছেন।’

এক ফসলি জমিগুলো তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর 

সাতক্ষীরায় লবণাক্ত জমিতে এখন দেখা দিয়েছে অভাবনীয় কৃষি সাফল্য। দিগন্তজুড়ে শস্যের খেতগুলোতে ভুট্টা ও সবজির আবাদে সবুজ হয়ে গেছে। এক ফসলি জমিগুলো এখন তিন ফসলিতে রূপান্তর হয়েছে। লবণাক্ত জমিতে লাউ, কুমড়া, পেঁপে, ঢেঁড়স, পুঁইশাক, উচ্ছে, শসা, লালশাকসহ বিভিন্ন প্রকার সবজি উৎপাদন করে সফল হয়েছেন প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকরা।

অথচ গত কয়েক দশক ধরেই লবণাক্ততার কারণে জমিতে ফলেনি ফসল। মিঠাপানির আধারগুলো গেছে শুকিয়ে। গ্রামের পাশ দিয়ে খাল প্রবহমান থাকলেও পানির অভাবে শস্য আবাদ করতে পারেননি উপকূলের কৃষকরা। শুষ্ক মৌসুমে দিগন্তজুড়ে দেখা দেয় খরা। এরই মধ্যে সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখছেন এই এলাকার কৃষকরা। পতিত থাকা ফসলি জমির কোনায় পুকুর করে মিঠাপানির সংস্থান করছেন তারা। সেই পানি দিয়ে এখন ফলানো হচ্ছে শস্য।

সাতক্ষীরার উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলার কাশিমারি ইউনিয়নের খুটিকাটা গ্রামে গেলে স্থানীয়রা জানান, আগে এখানকার কৃষকরা শুধু আমন ধান আবাদ করতে পারতেন। এখন সেই লবণাক্ত জমিতে বিভিন্ন প্রকার সবজি উৎপাদন করছেন। তারা সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন আশপাশের কৃষকদের। পতিত জমি এখন আশা দেখাচ্ছে। 

খুটিকাটা গ্রামের প্রান্তিক নিহার সরকার জানান, লবণাক্ততার কারণে তাদের এলাকার শত শত হেক্টর কৃষিজমি পতিত থাকে। তা ছাড়া মিঠাপানির আধারগুলো শুকিয়ে গেছে। তবে গত বছর একটি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় লবণাক্ত জমিতে ফসল উৎপাদন করে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তিনি।

নিহার বলেন, তার এলাকার অধিকাংশ কৃষককে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে পুকুর খনন করে দিয়েছে ওই প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া আবাদের জন্য ভার্মি কম্পোস্ট সার, গাছের চারা, শস্যবীজ এবং অন্যান্য কৃষি-উপকরণ সরবরাহ করেছে। কৃষকরা লবণাক্ত জমিতে বৃষ্টির পানি ব্যবহার করে নানা প্রকার ফসল উৎপাদন করে লাভবান হচ্ছেন। চলতি মৌসুমে প্রতি বিঘা জমিতে একেকজন কৃষক ৩০-৫০ হাজার টাকা লাভ করেছেন। আরও অধিকসংখ্যক পুকুর খনন এবং গ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া খালগুলো খনন করে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করলে বারো মাসই সবজিসহ বিভিন্ন প্রকার ফসল উৎপাদন করা সম্ভব বলেও জানান তিনি।

একই উপজেলার দক্ষিণ ঝাঁপা গ্রামের তপন কুমার মণ্ডলের স্ত্রী সবিতা রানী বলেন, ‘স্বামীর আয়ের ওপর নির্ভর ছিল সংসার। একজনের আয়ে সংসারে সচ্ছলতা না আসাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদীতে চিংড়ি পোনা ধরতাম। এতে শারীরিক অনেক সমস্যা দেখা দিত। তবে একটি এনজিওর সহযোগিতা নেওয়ার পর বর্তমানে নদীতে মাছ ধরা বাদ দিয়েছি। এখন ভেড়া পালন ও সবজি চাষ করে আমি স্বাবলম্বী। এখন আর স্বামীর কাছে কিছু চাইতে হয় না। নিজের টাকা দিয়ে নিজের প্রয়োজন মেটাতে পারি।’

অনুসন্ধান যা বলছে

সাতক্ষীরার শ্যামনগর, কালীগঞ্জ ও আশাশুনি উপজেলার শতাধিক মাছচাষি ও কৃষকের সঙ্গে কথা বলেছে খবরের কাগজ। তাদের অনেকে লবণাক্ততা মোকাবিলা করে সফল, আবার অনেকে লবণপানিতে সর্বস্বান্ত হয়ে বদলে ফেলেছেন নিজের দীর্ঘদিনের পেশা, হয়েছেন ঋণগ্রস্ত। আবার অনেকে জড়িয়েছেন বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। ওই সব মানুষের কাছে প্রশ্ন রাখা হয় কীভাবে তারা সফল হয়েছেন? আর কেনইবা বাকিরা সফল হতে পারেননি?

অনুসন্ধানে দেখা যায়, যারা সফল হয়েছেন তাদের সফলতার পেছনে বড় অবদান বিভিন্ন বেসরকারি এনজিও, সংগঠনসহ স্থানীয় কৃষি ও মৎস্য বিভাগের। তাদের প্রশিক্ষণ পেয়ে কোন মাটি ও পানিতে কোন ফসল বা মাছের উৎপাদন ভালো হবে সে অনুযায়ী তারা চাষাবাদ করেছেন। বাকি যারা সফল হতে পারেননি, তাদের লোকসানের নেপথ্যের কারণ হচ্ছে জানা ও বোঝার ঘাটতি। আবার অনেক এলাকার ক্ষেত্রে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার মতো ব্যবস্থা নেই। আবার পুকুর করার মতো মূলধন নেই অনেকের। এ জন্য ইচ্ছে থাকলেও  এসব জমি চাষাবাদের আওতায় আনতে পারছেন না অনেকে। 

জলবায়ু পরিবর্তনে নেতিবাচক প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে কী হতে পারে সমাধান? প্রশ্ন রাখা হয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা লিডার্সের নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার মণ্ডলের কাছে। দুই দশকের অভিজ্ঞতার আলোকে মোহন কুমার মণ্ডল বলেন, ‘আমাদের প্রয়োজন বহুমুখী ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ, যেখানে অভিযোজন, পুনর্বাসন এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা থাকবে একসঙ্গে। উপকূলীয় অঞ্চল ও নদীতীরবর্তী এলাকাগুলোতে টেকসই অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যেন জনবসতি বিপর্যয়ের মুখে না পড়ে। কৃষিকে করতে হবে জলবায়ুসহনশীল। শুধু অবকাঠামো বা প্রযুক্তি দিয়ে এই সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। মানুষের জীবন ও জীবিকা টিকিয়ে রাখতে হলে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য সুষ্ঠু পুনর্বাসনব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। 

সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যা বলছে

জেলা মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ২ লাখ ৬২ হাজার হেক্টর জমিতে ছোট-বড় মিলিয়ে ৫৫ হাজার ঘেরে সনাতন পদ্ধতিতে বাগদা চাষ হয়। এ পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করে প্রতিবছর লোকসানে জর্জরিত হতো সাতক্ষীরার চাষিরা। ভাইরাস ও দাবদাহের কারণে ঘেরে বাগদা চিংড়ি উজাড় হয়ে যাওয়ায় দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার উপক্রম হতো তাদের। পরবর্তী সময়ে আধা নিবিড় পদ্ধতিতে বাগদা চাষ করা হলেও তেমন সফলতা ছিল না। ফলে দিন দিন বাগদা চাষে অনাগ্রহ তৈরি হচ্ছিল চাষিদের।

তবে এ বিপর্যয় থেকে চাষিদের রক্ষায় এগিয়ে আসে মৎস্য বিভাগ। ‘সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ’ নামক একটি প্রকল্পের আওতায় উন্নত সনাতন পদ্ধতিতে বাগদা চাষ করতে চাষিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পানির গভীরতা ঠিক রাখা ও বায়োসিকিউরিটি নির্বাহ করা এ চাষের প্রধান বৈশিষ্ট্য। নতুন এ পদ্ধতিতে বাগদা চাষ করতে জেলার সব চাষিকে পরামর্শ দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে কালীগঞ্জের সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা নাজমুল হাসান বলেন, ‘সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের আওতায় শিবপুরের ২৩ জন চাষিকে নিয়ে কাজ শুরু করি। সেখানে সফলতা ব্যাপক। বায়োসিকিউরিটি ও ভাইরাসমুক্ত পোনা ব্যবহার করা হয় ঘেরে। সেখানে মাত্র ৩ মাসে ২০টি চিংড়িতে ১ কেজি ওজন হচ্ছে। চাষিদের এ পদ্ধতিতে বাগদা চাষ করা উচিত।’

এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (খামারবাড়ি) উপপরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘লবণাক্ততার প্রভাবে ফসলে সেচের সমস্যা হয়। লবণপানিতে সব ধরনের ফসল চাষ করা সম্ভব হয় না। এ কারণে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। ইতোমধ্যে উপকূলীয় এলাকার পতিত জমিতে লবণসহিষ্ণু জাতের ধান ও সবজি চাষের আওতায় এনেছি।’ যেটা আগামীতে আরও বৃদ্ধি পাবে বলে জানান তিনি।

সাতক্ষীরা জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ডা. বিষ্ণুপদ বিশ্বাস বলেন, ‘লবণপানি পশুপাখির জন্য ক্ষতির কারণ। এ জন্য আমরা চেষ্টা করছি বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে খামারিদের লজিস্টিক সাপোর্ট দেওয়ার। তা ছাড়া আমরা খামারিদের পরামর্শ দিয়েছি লবণাক্ত পানি পরিহার করে লবণাক্ত পানিকে পিউরিফাইড করে মিষ্টি পানিতে পরিণত করার জন্য।’