রবীন্দ্রনাথ ছড়িয়ে আছেন বিশ্বজুড়ে। সারা বাংলা তো বটেই, বিশ্বের অনেক জায়গাতেই সযত্নে সংরক্ষণ করা আছে রবীন্দ্রস্মৃতি। তেমনই একটি জায়গা মধ্য ইউরোপের দেশ হাঙ্গেরি।
সাড়ে ৩৫০ বছর আগে হাঙ্গেরির বালাতন হ্রদের একপাশে মাটি ফুঁড়ে অলৌকিক জল বেরোনো শুরু হলো। সেই দৈবজলের কথা খুব দ্রুত চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল- সেই জল গায়ে মাখলে বা পান করলে অসুখ সেরে যায়। জায়গাটিতে দূর-দূরান্ত থেকেও মানুষ এসে ভিড় করতে লাগল। ডাক্তাররাও যখন বললেন সেই পানিতে বিভিন্ন ধরনের খনিজ পদার্থ আছে, যা হৃৎপিণ্ডের সুস্বাস্থ্য এবং রক্ত চলাচলের জন্য উপকারী, তখন তার গ্রহণযোগ্যতা আরও বেড়ে গেল।
একপর্যায়ে সেখানে গড়ে ওঠে হাঙ্গেরির সবচেয়ে বিখ্যাত হৃদরোগ হাসপাতাল ‘স্টেট হার্ট হসপিটাল’। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সেই হাসপাতালে মানুষ চিকিৎসা নিতে আসেন, হাওয়া বদলের জন্য আসেন সেই এলাকায়। ১৯২৬ সালে এক কবিতা উৎসবে যোগ দেওয়ার জন্য রবি ঠাকুর বুদাপেস্টে এসেছিলেন এবং তখন অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে দুই-তিন সপ্তাহের জন্য এই হাসপাতালটিতে রাখা হয়েছিল। তিনি ভর্তি হয়েছিলেন ড. স্মিডের অধীনে। এখন পর্যন্ত তিনিই হাসপাতালটির সবচেয়ে খ্যাতনামা রোগী। হাসপাতাল এবং বালাতন হ্রদের জনপদজুড়ে তাই আজও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে রবীন্দ্রনাথের অনেক স্মৃতি।
রবীন্দ্রনাথ এই জনপদ দেখে মুগ্ধ হয়ে হাঙ্গেরির শিল্পী এলিজাবেথ ব্রুলারকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আমি পৃথিবীর প্রায় সব দেশই দেখেছি, কিন্তু বালাতন ফুরেডের এই বেলাভূমি, আকাশ ও জলের এমন অপূর্ব ঐকতান উপভোগের সৌভাগ্য আমার অন্তরাত্মাকে উন্মীলিত-উদ্ভাসিত করে তুলেছে।’
বালাতন হ্রদের সঙ্গেই সবুজ গাছপালাসমৃদ্ধ সুন্দর একটি রাস্তা। সেটিকে হাঙ্গেরির সবচেয়ে সুন্দর রাস্তা মনে করে থাকেন অনেকে। রাস্তাটির নাম ‘ঠাকুর রোড’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হাসপাতালটিতে থাকাকালীন সময়ে ওই রাস্তা দিয়ে রোজ সকালে হাঁটতেন আর সেই স্মৃতি রক্ষার্থেই রাস্তাটির নামকরণ করা হয় ঠাকুর রোড।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে সেখানে হোটেলও আছে। তার নামসংবলিত দিকনির্দেশকাও রয়েছে। হাসপাতাল ভবনটি প্রকৃতিবেষ্টিত। লিফটের পাশে এক ফলকে হাঙ্গেরিয়ান ভাষায় লেখা- ‘১৯২৬ সালের নভেম্বরে নোবেলজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই হাসপাতালে অবস্থান করেছিলেন।’ রবি ঠাকুর হাসপাতালটির ২২০ নং কক্ষে ছিলেন। কক্ষটির বারান্দায় দাঁড়ালেই বালাতন হ্রদ দেখা যায়। ১৯২৬ সালে কক্ষটি যেভাবে সাজানো ছিল, আজও সেভাবেই সাজানো আছে। ২২০ নং কক্ষের সামনে রবি ঠাকুরের নামফলক দেওয়া আছে। তার সঙ্গে লাগোয়া এক কক্ষে হাসপাতালে থাকাকালে রবি ঠাকুরের ব্যবহৃত সব আসবাবপত্র রয়েছে। এ ছাড়াও আছে তার লেখা চিঠি, ছবি, কবিতা ইত্যাদি। এমনকি রামকিঙ্কর বেইজের একটি আবক্ষ ভাস্কর্যও আছে। এটি খুব আশ্চর্যজনক ব্যাপার যে, দূরদেশের এক কবির জন্য তারা হাসপাতালটির একটি কক্ষ প্রায় ১০০ বছর ধরে জাদুঘর করে রেখেছেন!
এখানে কাছেই একটি শতবর্ষী লাইম গাছ আছে, যা রবি ঠাকুর নিজে লাগিয়েছিলেন। গাছটির সামনে রবি ঠাকুরের একটি আবক্ষ ভাস্কর্যও রয়েছে, যা রামকিঙ্কর বেইজের দ্বারা তৈরি। ১৯৮৩ সালে মূর্তিটি এখানে স্থাপন করা হয়। মূর্তিটি এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছে যেন যুগ যুগ ধরে মুগ্ধ চোখে বালাতন হ্রদের দিকে তাকিয়ে আছে। সেখানে একটি সাদা মর্মর ফলকে লেখা ‘তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ, তাই তব জীবনের রথ/পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার বারংবার’। ইংরেজি আর হাঙ্গেরীয় ভাষায় লেখা, ‘When I am no longer on this earth, my tree/Leth the ever-renewed leaves of thy spring’। নিচে তারিখও দেওয়া ৮ নভেম্বর ১৯২৬।
এত দূরের দেশে বাংলার একজন কবির এমন সম্মান প্রদর্শনপূর্বক স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখার প্রচেষ্টা দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না আসলে।
তারেক