ছোটবেলা থেকেই বাবার সান্নিধ্য তেমন একটা মেলেনি। জীবিকার তাগিদে বাবা আমৃত্যু ছিলেন দূর প্রবাসে। তবে কিছু মুহূর্ত তার সঙ্গে কাটানো, কিছু স্মৃতি আজও বুকের মাঝে আগলে রেখেছি।
হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ‘আমার ওপর সবচেয়ে বেশি হকদার কে?’
তিনি তিনবার মায়ের কথা বলার পর চতুর্থবার বলেছিলেন, ‘তোমার বাবা।’ (সহিহ বুখারি: ৫৯৭১; সহিহ মুসলিম: ২৫৪৮)
এই উপদেশ না জানলে হয়তো জীবনের কোনো কোনো জায়গায় আমি মায়ের থেকে বাবাকেই বেশি এগিয়ে রাখতাম। যাইহোক এবার কিছু স্মৃতি হাতড়াই।
ছোটবেলায় মায়ের মুখে শুনেছি, বাবা আমার গালের বদলে পায়ে বেশি চুমু দিতেন। কারণ হিসেবে বলতেন তার দাড়ি বা গোঁফের খোঁচা যেন আমার কোমল গালে আঘাত না করে তাই তিনি এই পন্থা অবলম্বন করছেন।
তখন বাবা নারায়ণগঞ্জের আদনান টেক্সটাইল মিলে চাকরি করতেন। বাসা এবং মিল কাছাকাছি থাকায় তিনি প্রায়ই কাজের ফাঁকে জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখতেন, কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে আবার কাজে ফিরে যেতেন।
পরে আমাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে তিনি পাড়ি জমান সৌদি আরবে। আমি তখন মাত্র দেড়-দুই বছরের শিশু। স্পষ্টভাবে মনে নেই সেই সময়ের কথা, তবে বাবার প্রথমবার দেশে ফিরে আসার কিছু মুহূর্ত মনে আছে। একবার আমরা মংলায় ফুফুর বাসায় বেড়াতে যাই, বাসে আমার ছোট ভাইয়ের প্রিয় জুতা হারিয়ে গেলে বাবা ক্লান্ত শরীর নিয়েও বাস ও জুতা খুঁজতে বেরিয়ে পড়েন। এক সাধারণ ঘটনা, কিন্তু বাবার নিঃশব্দ ভালোবাসার গভীরতা বোঝাতে এটুকুই যথেষ্ট।
২০১৮ সালে বাবা শেষবারের মতো দেশে এসেছিলেন মাত্র তিন মাসের ছুটিতে। আমি তখন ডিপ্লোমার প্রথম বর্ষের ছাত্র। এক সন্ধ্যায় নারিকেলের শুকনো পাতাকে সাপ ভেবে আঁতকে উঠে বাবা আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরেছিলেন। শেষবারের মতো বাবার শক্ত হাতের স্পর্শ অনুভব করেছিলাম সেদিনই। মনে হয়েছিল, বাবা যেন আমার মধ্যে নির্ভরতা দেখছেন।
ছুটির শেষের দিকে বাবাকে অনুরোধ করেছিলাম, যেন আর প্রবাসে ফিরে না যান। কিন্তু বাবা বললেন, ‘এবার যাই, পরের বার এসে থেকে যাব।’
বিমানবন্দরে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলেছিলাম, ‘না গেলে হয় না?’
বাবা একই কথা বলেছিলেন, ‘পরেরবার থেকে যাব।’
জানি না কেন, তখনই মনে হয়েছিল বাবার সঙ্গে হয়তো এটাই শেষ দেখা।
২০১৯ সালের জানুয়ারির শেষ দিকে হঠাৎ একদিন মা ফোন হাতে নিয়ে বিছানায় লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে থাকলেন। জানতে পারলাম, বাবা অসুস্থ। বাবার সঙ্গে কথা হলো। বললেন, ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি, পরে কথা বলি। কিন্তু সেই পরে আর কখনো আসেনি।
পরে জানলাম, তিনি হাইপোগ্লাইসেমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে কোমায় চলে গেছেন। দুদিনের ব্যবধানে খবর এল বাবা আর নেই।
আমার বা আমাদের ওপর বাবার যে অধিকার ছিল তা পূরণ করার সুযোগ না দিয়ে তিনি আমাদের দায়িত্বমুক্ত করলেন। আমরা হারালাম ছায়া দেওয়া বাবা নামক বটবৃক্ষ।
বাবা সৌদির মাটি ভালোবাসতেন, মাকে প্রায়ই বলতেন সৌদিতে তার মৃত্যু হলে যেন তাকে সেখানেই দাফনের ব্যবস্থা করা হয়। সেখানেই তার কবর হয়েছে মদিনার জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে। শুনেছি, তার কবর ঠিক সাহাবিদের কবরের পাশে। এটা হয়তো মহান আল্লাহর সুন্দর পরিকল্পনার একটি অংশ।
তরুণ বাঙালি লেখক কাইকর একবার লিখেছিলেন ‘কেউ একজন কইছিল, পৃথিবী শূন্যস্থান বেশিদিন পছন্দ করে না। তাইলে আব্বা মইরা যাওনের পর পৃথিবী কার শূন্যস্থান পূরণ করতে হারায় গ্যাছে?’
আমার পৃথিবীও সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। মুখোমুখি হই কঠিন বাস্তবতার। আমার মেজো ভাইয়ের এসএসসি পরীক্ষা ছিল বাবার মৃত্যুর দুদিন পরেই। ছোট ভাইয়ের বয়স ১২ থেকে ১৩ বছর।
বাবা শেষবার যখন আমার কাঁধে হাত রেখেছিলেন, সেদিনই তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন এবার দায়িত্ব তোর।
আজ আর শুধু হাত নয়, শক্ত কাঁধে তুলে নিতে হয়েছে বাবার সব দায়িত্ব।
তবুও প্রতি রাতে ঘরে ফিরে মনে হয়, কোথায় যেন কিছু বাকি রয়ে গেছে। কাউকে হয়তো তার অধিকারটা পুরোপুরি দিতে পারিনি।
বাবা বলেছিলেন, ‘ভয় পাস না, আমি আছি’।
আজও তোমার সেই কথার ভরসায় সব ভয়কে জয় করি, বাবা।
মনে আছে বাবা প্রায়ই ‘ওরে নীল দরিয়া’ গানটি শুনতেন।
তখন আমার কাছে সেটা ছিল এক সাধারণ গান, এখন জীবনের বাঁকে সেই গানের অর্থ বুঝতে পারি-
‘বাবারা এমন হয়,
কাছের মানুষ দূরে থুইয়া
তারা অন্তরে দারুণ জ্বালা লইয়া
ধরফরাইয়া মরেন…’
এই গানেরই আরেকটা চরণ
‘এই না পথ ধরিয়া
আমি কত না গেছি চইলা’
এই চরণটির মতো বাবা আজ অনেক দূরে চলে গেছেন। তবে বাস্তবে বাবারা দূরে হারিয়ে যান না, তারা থেকে যান প্রতিটি সন্তানের অন্তরে।
মুখ ফুটে কখনো বলা হয়নি তোমায় অনেক ভালোবাসি বাবা। তোমার দেওয়া সাহস নিয়ে বেঁচে আছি বাবা।
বাবা কতদিন, কতদিন দেখি না তোমায়।
দত্তপাড়া, বাইশারী, বানারীপাড়া, বরিশাল
তারেক