
একটা কাপড়ের ব্যাগ আর বোনকে সঙ্গে নিয়ে শৈলী একটা বাজারে দাঁড়িয়ে আছে। বাসচালক তাকে এখানে নামিয়ে দিয়েছে। তারা বলেছে এটাই শেষ স্টেশন। কোথায় যেতে চান ফোন করে তার কাছ থেকে ঠিকানা নিতে। আসার আগে বাবা-মাকে বলেছে, এই তো পদ্মার ওপারেই কলেজের লোকেশন। থাকার ব্যবস্থা আছে মহিলা হোস্টেলে। বেতনও ভালো।
সবচেয়ে বড় কথা, করোনা মহামারির পর নতুন করে চাকরির পরীক্ষা হচ্ছে না। চাকরি একটা করতেই হবে। শৈলীর পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তার বাবা। তিনিও করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। একুশ দিনের জ্বরে তার স্মৃতি এলোমেলো হয়ে গেছে। হঠাৎ করে সবাইকে চিনতে পারেন, আবার হঠাৎ করে বাড়ির রাস্তা ভুলে অন্য কোথাও চলে যান। স্বাস্থ্যের এই অবস্থা হওয়া সত্ত্বেও শৈলীর বাবাকে কাজে যেতে হয়। ওরা তিন বোন অনার্স পাস করে ঘরে বসে আছে চাকরির অপেক্ষায়। এমন সময় মহামারি শুরু হলো। ওদের বড় বোন শান্তা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ছোটখাটো একটা চাকরি করে। তাতে তার নিজের সংসার চলে টেনেটুনে। বাবা-মায়ের সংসারে খুব একটা সহযোগিতা করতে পারে না।
লকডাউন শুরুর আগে শৈলীরা তিন বোনই টিউশনি করত। মোটামুটি ভালোই উপার্জন হতো টিউশনি থেকে। তাই চাকরি পেতে দেরি হলেও ওদের মনে অভিযোগ ছিল না। করোনা ওদের জীবনের সব সমীকরণ বদলে দেয়। শৈলীর ভালো চাকরি পাওয়ার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল। কবে আবার চাকরির পরীক্ষাগুলো হবে, কবে সে চাকরির জন্য চেষ্টা করতে পারবে- তত দিনে পড়াশোনা কিছু মনে থাকবে কি না, তাও একটা চিন্তার বিষয়।
এদিকে লকডাউন শুরুর কিছুদিন পর্যন্ত বাসায় গিয়ে পড়ানোর অনুমতি ছিল। মাস্ক পরে গেলেই হতো। কিন্তু আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় আর শিশুদের কবে পরীক্ষা হবে- এসব অনিশ্চয়তার কারণে বাবা-মায়েরা সব গৃহশিক্ষককে মানা করে দিয়েছেন। এভাবে কেটে গেছে আরও ৪টা মাস। লকডাউন শিথিল হওয়ার বদলে আরও কঠোর হয়েছে। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বড়ভাই কলেজের প্রভাষক পদে আবেদন করতে বলেন। কোনো আশা রেখে শৈলী আবেদন করেনি। আবেদন পাঠিয়ে ভুলেও গেছে। হঠাৎ একদিন সেই বড়ভাই কল করে বললেন, কলেজের অধ্যক্ষ তোমাকে বেশ কয়েকবার কল করেছিলেন। তুমি কল ধরনি কেন? উনাকে কলব্যাক করে কথা বলো।
শৈলী দেখল, একটা unknown number থেকে তিনটা কল এসেছে। শৈলী কলব্যাক করল। কথা বলার জন্য ওপাশ থেকে ফোন ধরল একজন বয়স্ক মানুষ। উনি শৈলীর পরিবারের সদস্যদের খোঁজখবর নিলেন। তার পর জিজ্ঞেস করলেন, চাকরি নিয়ে সে সপরিবারে কর্মস্থলে আসবে, নাকি একাই আসবে। পরিবার নিয়ে এলে কোয়ার্টার পরিষ্কার করে দেওয়া হবে। আর একা এলে মেয়েদের হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করা হবে। নিজের আকস্মিক সৌভাগ্যপ্রাপ্তিতে শৈলী খুশি হওয়ার চেয়ে বেশি চিন্তিত হয়ে পড়ল। রেজা ভাইকে ফোন করে জায়গাটা কতটা নিরাপদ আর তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কে কে আছে তা নিয়ে একটু কথা বলল। রেজা ভাই আশ্বস্ত করল, তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও ৪/৫ জন ওখানে কাজ করেন এবং তিনি ওদের ব্যক্তিগতভাবেও চেনেন। দুজনের নাম্বারও দিল কথা বলে নিশ্চিত হতে। সবার পরামর্শ ও ভরসা পেয়ে চাকরিতে যোগদান নিশ্চিত করেছে।
আজ ৬ আগস্ট কলেজে এসে সশরীরে হাজির থাকতে বলা হয়েছে। শৈলী এক ধরনের চাপা উত্তেজনা ও ভয়কে ভেতরে চেপে রেখে এই নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা শুরু করতে চেয়েছিল। পথগুলো চিরায়ত গ্রামের পথ হলেও বাজারে নামিয়ে দেওয়ার পর মনে হচ্ছে- কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। এমন সময় আবার ফোন এল। কলেজের অধ্যক্ষ কল করেছেন। জিজ্ঞেস করলেন, ম্যাডাম আপনি কোথায়? শৈলী বলল বাজারের বাসস্ট্যান্ডে। উনি বললেন, গাড়ির চালকের কাছে ফোনটা দেন একটু কথা বলি। চালককে ফোন দিলাম। অধ্যক্ষ কী বলেছেন শৈলীর ধারণা নাই। তবে হেল্পার ছেলেটা এসে একটা ভ্যান ডেকে দিল। ভ্যানওয়ালাকে বুঝিয়ে বলল ম্যাডামকে ভালো করে পৌঁছে দিবি, কোনো অসুবিধা যেন না হয়। তাদের যত্ন দেখে একটু ইতিবাচক চিন্তা এল শৈলীর মনে।
চারদিক থেকে যখন কিছুই হচ্ছিল না, কোনো আশা ছিল না তখন এই চাকরিটার জন্য সে রেজা ভাইকে যথেষ্ট অনুনয়-বিনয় করেছে। এখন চাকরিটা কিছুদিন না করে ফিরে গেলে এখানে কাজ করা তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট ভাই, রেজা ভাই সবাই লজ্জা পাবেন। তা ছাড়া শহরেও তো তেমন কোনো ব্যবস্থা হয়নি।
এখানে আসার সময় শুধু কাপড় ছাড়া কিছুই আনেনি সঙ্গে। তাই নিজের জন্য কিছু দরকারি জিনিসপত্র, পানির জগ, বালতি, ময়লার ঝুড়ি এসব কিনে ঘরে ফিরল শৈলী। হোস্টেলে মেয়েরা নেই। শুধু পাশের রুমে আরেকজন শিক্ষক থাকেন। আর তার দুইটা বাচ্চা থাকে। শৈলী ঘর পরিষ্কার করে ফ্রেশ হতে হতে রাত হয়ে গেল। তার পর অধ্যক্ষ তাকে বাসায় ডেকে নিয়ে গেল চা খেতে। চা খেতে খেতে সে আশ্বস্ত করল- এখানে কোনো কিছুর অসুবিধা হবে না। আর নিরাপত্তা নিয়েও কোনো সমস্যা নাই। ফিরে এসে হোস্টেলের মূল দরজা বন্ধ করতে করতে পাশের রুমের ম্যাডামের সঙ্গে পরিচয় হলো তার। এর পর দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। সারা দিন জার্নির ক্লান্তির কারণে ঘুমিয়ে পড়ল সঙ্গে সঙ্গেই। খুব সকালে ঘুম ভাঙল পাখির ডাকে।
হোস্টেলের উঠানে পেয়ারা আর পেঁপে গাছ আছে। তাতে বুলবুলি, মুনিয়া, শালিক আরও কত পাখি এসেছে! খাবার নিয়ে তাদের মধ্যে চলছে ঝগড়া ও প্রতিযোগিতা। দেখতে দেখতে শৈলীর মন ভালো হয়ে গেল। যদিও শহরের ব্যস্ততা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তবুও কাজের ফাঁকে ফাঁকে পাখির কিচিরমিচিরের শব্দ শুনতে তার খারাপ লাগবে বলে মনে হলো না। এরই মধ্যে পাশের রুমের মেয়ে বাচ্চাটা পাশে এসে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল তুমি চা খাও না। শৈলী বলল, হ্যা খাই। তবে তোমার মায়ের কাছ থেকে একটা পাতিল ধার নিতে হবে চা খেতে- বলেই হেসে ফেলল। ছোট মেয়েটাও হাসতে লাগল। শৈলীর মনে হলো, নিরুদ্দেশের যাত্রাটা একদম খারাপ হয়নি।
যাত্রাবাড়ী, ঢাকা
তারেক