নারায়ণগঞ্জের দুই নারীসহ চার জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর ও নলকূপ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে গৃহহীনদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত নালিশ করেছেন চার ভুক্তভোগী।
অভিযোগ রয়েছে, চেয়ারম্যানের ছত্রচ্ছায়ায় ইউপি সদস্যরা অর্ধশতাধিক লোকজনের কাছে থেকে দেড় লাখ টাকা করে নিয়েছেন। নলকূপ বরাদ্দের প্রলোভন দেখিয়ে ৩৫ হাজার টাকা করে নিয়েছেন শতাধিক মানুষের কাছ থেকে। সবমিলিয়ে কয়েক কোটি টাকা লোপাট করেছেন অভিযুক্তরা।
যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা হলেন, নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার গোগনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফজর আলী, একই ইউনিয়নের ১, ২, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য লিপি আক্তার, ৭, ৮, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য নিলুফা বেগম ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য বিপ্লব হোসেন ওরফে হাবু।
অভিযোগের বিষয়টি গত সোমবার নিশ্চিত করেন সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা দেদারুল ইসলাম। তিনি জানান, এ নিয়ে গত বৃহস্পতিবার বিকেলে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত দুটি অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। অভিযোগের তদন্ত করছে উপজেলা প্রশাসন। আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নিয়ে যদি কেউ কোনো রকম অনিয়ম করেন, তাহলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
অভিযোগে জাহানারা বেগম নামের এক নারী উল্লেখ করেন, তিনি একজন দুস্থ ও গৃহহীন। তিনি পরিবার নিয়ে সৈয়দপুর এলাকায় মাটি ভাড়া (জায়গা ভাড়া নিয়ে ঘর তুলে বসবাস করা) থাকেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার রূপকার প্রধানমন্ত্রী আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে দুস্থ ও গৃহহীনদের জায়গাসহ ঘর এবং টিউবওয়েল বরাদ্দ করছেন জানতে পেরে গোগনগর ইউনিয়ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফজর আলী এবং ৮ নম্বর ওয়ার্ডের নারী ইউপি সদস্য নিলুফা আমার কাছে গেলে তারা ঘর দেওয়ার কথা বলে দেড় লাখ টাকা দাবি করেন। এ সময় তাদের ওপর বিশ্বাস করে স্বর্ণালংকার ও গরু-ছাগল বিক্রি করে দাবি করা দেড় লাখ টাকা দেওয়া হয়। কিন্তু প্রায় দুই বছর পেরিয়ে গেলেও তারা ঘর বা টাকা কিছুই দেননি। তাদের কাছে একাধিকবার গেলে নানাভাবে হয়রানি করেছেন। এ ছাড়া টিউবওয়েল বরাদ্দ দেওয়ার কথা বলে নিলুফা বেগম আরও ৩৫ হাজার টাকা নেন বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন সালমা নামের আরেক নারী।
অভিযোগের আরেক অংশে উল্লেখ করা হয়, একইভাবে নারীর কাছ থেকে ১, ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের নারী ইউপি সদস্য লিপি বেগম দেড় লাখ টাকা দিয়েছেন। তিন্নি আক্তারকে ঘর বরাদ্দের কথা বলে এ টাকা নিয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
অপর আরেক অভিযোগে নূরু মৃধা নামের এক ব্যক্তি উল্লেখ করেন, তিনি তার পরিবার নিয়ে গোগনগর ইউনিয়নের সৈয়দপুর এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে মাটি ভাড়া করে ঘর তুলে থাকেন। প্রায় দুই বছর আগে গৃহহীনদের সরকারি ঘর বরাদ্দ করা হবে জানতে পেরে তার স্ত্রী ফরিদা বেগম স্থানীয় চেয়ারম্যান ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্যের কাছে গেলে তারা দেড় লাখ টাকা দাবি করেন। তাদের বিশ্বাস করে গরু-ছাগল বিক্রি করে দাবি করা দেড় লাখ টাকা দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে তারা আর ঘর দেননি। টাকা চাইতে গেলে নানাভাবে হয়রানি করছেন। গত তিন মাস আগে চেয়ারম্যান ফজর আলী ফরিদা বেগমকে ডেকে এনে ২০ হাজার টাকা দিয়ে বাকি টাকা পরে দেওয়া হবে বলে জানান। প্রায় দুই বছর ধরে টালবাহানা করেও টাকা ফেরত না দেওয়ায় ইউপি সদস্যসহ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।
জাহানারা বেগম জানান, কিস্তি তুলে নিলুফা মেম্বারকে টাকা দিয়েছেন। তবে ঘর বা টাকা কিছুই দেওয়া হয়নি বরং হয়রানি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, অন্তত ২০ থেকে ২৫ জনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন নিলুফা মেম্বার।
তিন্নি বলেন, ‘টাকা চাইলে নানাভাবে কথা শোনান। আমি কথা রেকর্ড করে রেখেছি। লিপি মেম্বারের বাড়িতে গিয়ে টাকা দিয়েছি, ছবিও আছে। কিন্তু টাকা ফেরত দেয় না। তাই বাধ্য হয়ে ডিসির কাছে গেছি। এমনি আরও যারা টাকা দিয়েছেন তাদের সংখ্যা অন্তত ৭ থেকে ৮ জন।’ তারা ভয়ে এখনো মুখ খুলছেন না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
ছালমা নামের এক নারী বলেন, ‘নিলুফা শতাধিক মানুষের কাছ থেকে ৩৫ হাজার টাকা করে নিয়েছেন। কারও কারও কাছ থেকে ৪৫ হাজার টাকা করে নিয়েছেন। নলকূপ বা টাকা চাইতে গেলে টালবাহানা করেন, কিন্তু কিছুই দেন না।’
নুর মৃধা বলেন, ‘আমি ঝগড়া করায় চেয়ারম্যান আমাকে ২০ হাজার টাকা দিয়েছেন। এখনো বাকি আছে ৩০ হাজার। মেম্বার হাবু টাকা দেন না খালি ঘোরান। আমার মতো আরও ২০ থেকে ২৫ জনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন।’
এ বিষয়ে অভিযুক্ত নারী ইউপি সদস্য লিপির মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমি এ বিষয়ে জানি না। এটা রটানো কথা।
একইভাবে অস্বীকার করেছেন আরেক নারী ইউপি সদস্য নিলুফাও। তিনি মুঠোফোন বলেন, ‘আমার আত্মীয় মারা গেছে। আমি এ ব্যাপারে জানি না। তারপর তার বাড়িতে গেলে তার মেয়ে পরিচয়ে একজন জানান নিলুফা বেগম বাড়িতে নেই। ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য বিপ্লব হোসেন হাবু বলেন, আমি জানি ভাই, আপনে গোগনগর আইসেন ভাই। আপনার সঙ্গে কথা বলবোনে ভাই। ফোনে কথা না বলি।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সদর উপজেলার তথ্য বলছে, এখানে ১৫৬টি ঘর বুঝিয়ে দেওয়া হয় গৃহহীনদের কাছে। তবে যাদেরকে ঘর দেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে অনেকেই এখন সে ঘরে থাকে না। শুধু সরকারি লোক আসার খবর পেলে তারা হাজির হয়ে যায় বলে জানিয়েছেন গোগনগরের সৈয়দপুর এলাকায় অবস্থিত মুজিব নগরের একাধিক বাসিন্দা।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মাহমুদুল হক বলেন, অভিযোগ পেয়েছি। সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অভিযোগের সত্যতা পেলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে নলকূপ বরাদ্দের প্রলোভন দেখিয়ে টাকা নেওয়ার সঙ্গে কেউ জড়িত থাকলে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়েছেন জেলা জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নারায়ণগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মাহমুদ খান। নলকূপ বরাদ্দ দেয় এমপি ও উপজেলা প্রশাসন। এখানে অন্য কারও সুযোগ নেই বলে উল্লেখ করেন তিনি।