এক সময়ের ছায়া-শীতল কুমিল্লায় এখন গাছগাছালি তেমন নেই বললেই চলে। একে একে ভরাট হয়ে যাচ্ছে শতবর্ষী ঐতিহ্যবাহী পুকুরগুলো। ‘ইট-কংক্রিটের নগরীর’ তকমা পাওয়া এ জনপদে উন্নয়নের নামে একের পর এক কেটে ফেলা হয়েছে অসংখ্য গাছ। গড়ে উঠছে বড় বড় দালানকোঠা।
এর ফলে একদিকে এই নগরী হারিয়েছে সজিবতা, অন্যদিকে মানুষও হারাচ্ছে গাছ ও ছায়ার আশ্রয়। চলমান গ্রীষ্মের এই দাবদাহে ঘর থেকে বের হওয়া মানুষজন গাছের ছায়া পাচ্ছে না কোথাও। নেই প্রাণভরে নিশ্বাস নেওয়ার জায়গাটুকু। শেষ ভরসা হিসেবে একটু প্রশান্তির ছোঁয়া পেতে মানুষ ছুটছে নগরীর ধর্মসাগর পাড়ে। গাছপালাবিহীন এই শহরে ধর্মসাগর পাড়ের মনোমুগ্ধকর রূপ ও সবুজ-আবৃত চোখ জুড়ানো পরিবেশ নগরবাসীর একমাত্র স্বস্তির জায়গা। ফলে গরমের তীব্রতা থেকে কিছুটা রেহাই পেতে মানুষজনের শেষ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে ধর্মসাগর পাড়।
গ্রীষ্মের দাবদাহ শুরু হওয়ার পর সাম্প্রতিক সময়ে কুমিল্লা ধর্মসাগর পাড়ে গিয়ে দেখা যায়, তীব্র গরমে নগরীর বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন এসে সেখানে একান্তে সময় কাটাচ্ছেন। শহরজুড়ে সময় কাটানোর মতো সবুজে আচ্ছাদিত অন্য কোনো জায়গা না থাকায় ধর্মসাগরকেই বেছে নিয়েছেন নগরবাসী।
তীব্র গরমের হাঁসফাঁস অবস্থা থেকে কিছুটা স্বস্তি পেতে নগরীর মুরাদপুর থেকে ধর্মসাগর পাড়ে সময় কাটাতে এসেছেন নাজমুল হুদা। তিনি বলেন, ‘আমাদের কুমিল্লা শহর এখন রাজধানী ঢাকার মতো হয়ে যাচ্ছে। শহরের লোকজন গাছ কেটে দালানকোঠা নির্মাণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। যার খারাপ প্রভাব অনুভব করছি আমরা গরমের এই তীব্রতায়। বাচ্চাকে প্রাইভেটে দিয়ে গরম থেকে স্বস্তির আশায় এখানে এসেছি। গাছপালা ও ঠাণ্ডা বাতাস থাকায় এই জায়গাটা অনেক ভালো লাগে।’
কুমিল্লা শহরের মধ্যবর্তী স্থান হওয়ায় লোকজন ধর্মসাগর পাড়ে সময় কাটাতে আসেন। এর পাশেই রয়েছে নগর উদ্যান। বলা যায়, ভোরের সূর্য পূর্ব আকাশে উঁকি দিতেই শুরু হয় ধর্মসাগরের ব্যস্ততা। গরমের তীব্রতায় দিনের বেলায় জনসমাগম কম থাকলেও বিকেল নামতেই বাড়ে জনতা।
দুপুর বেলায় শহরের দালানগুলোতে গরমের তীব্রতায় তৈরি হয় নগরবাসীর হাঁসফাঁস অবস্থা। এমন অবস্থায় তীব্র গরম থেকে মুক্তি পেতে স্থানীয় স্কুল-কলেজে পড়ুয়া ছেলেরা গোসল করতে আসে ধর্মসাগরে। এখানে তারা দৌড়ে ও লাফিয়ে সাগরের পানিতে গা ভিজিয়ে শরীর ঠাণ্ডা করে।
এই গরমে ধর্মসাগরে বেশি ভালো অনুভূতি জাগে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার পর। স্নিগ্ধ বাতাস ও সাগরের মৃদু ঢেউয়ে ভেসে আসা প্রশান্তি শরীর ও মন উভয়ই শীতল করে দেয়। এখানে এলে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার সব ক্লান্তি নিমিষেই শেষ হয়ে যায়।
দীঘির পাড়জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা বড় বড় গাছের সারি ধর্মসাগরকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা, সেখানে কান পাতলে শোনা যায় পাখিদের কলরব। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর পাখির কলতানে সব সময় মুখর থাকে ধর্মসাগরের পাড়। দীঘির পশ্চিম পাড়ে রয়েছে পর্যটক ও দর্শনার্থীদের জন্য বসার ব্যবস্থা।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা জেলার সাধারণ সম্পাদক আলী আকবর মাসুম বলেন, ‘কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী পুকুর কিংবা দীঘিগুলো সংরক্ষণ ও তত্ত্বাবধানে যথাযথ কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব নেয় না। যার ফলে কুমিল্লার পুকুরগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। সরকারিভাবে নগরীর গাছগুলো কেটে ফেলা হচ্ছে। মানুষের স্বস্তির নিশ্বাস নেওয়ার জায়গাটুকু ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। বর্ষা শুরুর আগেই কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী নানুয়ার দীঘি সেচে পানিশূন্য করে ফেলা হয়েছে। রানীর দীঘিরও একই অবস্থা। বাপা এবং নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে আমরা সব সময়ই এ বিষয়গুলো নিয়ে বলে থাকি। কিন্তু আমাদের চাহিদার কোনো মূল্যায়ন থাকে না। ধর্মসাগর ছাড়া মানুষের আর যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। এখন এই পরিস্থিতিতে বিষয়গুলো নিয়ে ভাববার সময় এসেছে। আশা রাখছি যথাযথ কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেবে।’