শেরপুরের গারো পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গায় দিনে ও রাতে দুর্বৃত্তরা আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। গ্রীষ্মের খরতাপে শুকনো পাতায় লাগা আগুনে গাছের চারা, প্রাণী, কীটপতঙ্গ মারা যাচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে মাটির গুণাগুণ, ধ্বংস হচ্ছে প্রকৃতি। অভিযোগ উঠেছে, একটি চক্র আগুন জ্বালানোর পর সেই জায়গা থেকে রাতের আঁধারে গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে। তবে বন বিভাগ জানিয়েছে, জনবলসংকটের কারণে বিশাল বনের বিভিন্ন প্রান্তে লাগা আগুন নেভাতে তারা হিমশিম খান।
স্থানীয়রা জানান, প্রতিবছরই শুষ্ক মৌসুমে এ বন পোড়ানো হয়। বনে আগুন দেওয়ার কারণে পুড়ে যায় ছোট গজারি গাছ (শালকপিচ), ঝোপঝাড়, লতাপাতা, পোকামাকড়, কেঁচো ও কীটপতঙ্গসহ বহু অজানা প্রাণী। আগুনের পোড়া জায়গায় নতুন করে কোনো গাছ জন্মায় না। নষ্ট হচ্ছে বন্য প্রাণীর আবাসস্থল। বন বিভাগের তথ্য মতে, শেরপুর জেলার শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তজুড়ে গারো পাহাড়। এ পাহাড়ে ১৯ হাজার ২৭৫ একর বনভূমি রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গারো পাহাড়ের বেশির ভাগ জমিতে শাল-গজারিসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা রয়েছে। প্রতিবছরের ফাল্গুন-চৈত্র মাসে শাল-গজারিসহ বিভিন্ন গাছপালার পাতা ঝরে পড়ে। বনাঞ্চলের মধ্যদিয়ে চলাচলের জন্য সড়কপথ থাকায় খুব সহজেই দুর্বৃত্তরা রাতে কিংবা দিনে বনে আগুন দেয়। ঝরাপাতাগুলো শুকনা থাকার কারণে মুহূর্তেই বনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আগুন দেওয়ার সঙ্গে জড়িতরা থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। আইনগত ব্যবস্থা না নেওয়ায় বছরের পর বছর চলছে বন পোড়ানোর এমন ঘটনা।
গত সোমবার বিকেল ৩টায় ময়মনসিংহ বন বিভাগের রাংটিয়া রেঞ্জের ছোট গজনী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পাহাড়ের ভেতর থেকে উড়ে আসছে ধোঁয়া। আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ছে বনের কীটপতঙ্গ, গাছপালা, লতা-গুল্মসহ ছোট ছোট চারা গাছ। কাছে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকটি স্থানে ছোট-বড় আকারে জ্বলছে আগুন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০-৩০ মিনিট আগে কে বা কারা সেখানে আগুন ধরিয়ে দিয়ে চলে গেছে। এভাবেই পুরো গারো পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে আগুনে দেওয়া হচ্ছে।
গান্ধীগাঁও গ্রামের বাসিন্দা রমজান আলী বলেন, ‘পাহাড়ের মধ্যে অনেক রাস্তা আছে। এই রাস্তা দিয়ে কে বা কারা আগুন দিয়ে যাচ্ছে তা বোঝার উপায় নেই। পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গায় এমন আগুন লাগে। এগুলো বন্ধ হওয়া প্রয়োজন।’
পাশেই থাকা স্থানীয় বাসিন্দা লাল মিয়া বলেন, ‘আগুন কারা দেয় তাতো আমরা জানি না। আমরা এই রাস্তা দিয়ে আসা-যাওয়া করি। মাঝে মধ্যেই দেখি আগুন জ্বলছে। সুযোগ থাকলে আমরা কাছের আগুনগুলো নিভিয়ে দেই। তবে, যারা আগুন দেয়, তারা নিশ্চয় কোনো উদ্দেশ্যে এটি করে। এই আগুন নতুন না, প্রতিবছরই ধরানো হয়। আমরাও দেখি। আমাদের কী বা করার আছে। ফরেস্টের লোকজনওতো আর আগুন নেভাতে আসে না।’
রাংটিয়া এলাকার বেসরকারি একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালক রহমত আলী বলেন, ‘শুস্ক মৌসুমে বনের ঝরা শুকনো পাতায় প্রতিবছরই এমন আগুনের ঘটনা ঘটে। মাঝে মধ্যে বিট কার্যালয়ের আশেপাশের বনেও আগুন জ্বলতে দেখি। এরপরও এসব বন্ধের বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেই বললেই চলে। এভাবে চলতে থাকলে একদিন বন ধ্বংস হবে।’
বার্ড কনজারভেশন সোসাইটি ঝিনাইগাতী শাখার সাধারণ সম্পাদক হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘খুব জরুরিভিত্তিতে সাধারণ মানুষকে পরিবেশ ও বন সম্পর্কে সচেতন করতে উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। মানুষকে যেহেতু পরিবেশে বাস করতেই হবে, সেহেতু তাদের উচিত নিজেদের অস্তিত্ব ও স্থায়ীত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য পরিবেশের মৌলিক উপাদানগুলো যথাযথ সংরক্ষণ করা। যদি তা না হয় পরিবেশের ভারসাম্য ক্ষতি হবে। আর এই ক্ষতিটা আমাদেরই হবে।’
পরিবেশবাদী সংগঠন ‘সবুজ আন্দোলন’র কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মেরাজ উদ্দিন খবরের কাগজকে বলেন, ‘একটি চক্র গারো পাহাড়ে আগুন দিয়ে গাছপালার ক্ষতি করছে; প্রাণী ও কীটপতঙ্গ হত্যা করছে। আমরা চাই, এই দুর্বৃত্তদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হোক। প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের দৃশ্যমান পদক্ষেপ কামনা করছি।’
ময়মনসিংহ বন বিভাগের রাংটিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা আব্দুল করিম খবরের কাগজকে বলেন, ‘এ সময়টাতে বিভিন্ন গাছপালার পাতা ঝরে পড়ে দুই-তিন ইঞ্চি উঁচু স্তরে পরিণত হয়। দুর্বৃত্তরা আগুন ধরিয়ে দিলে বাতাসের কারণে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আমরা এক জায়গা আগুন নেভালে শুনি আরেক জায়গায় লেগেছে। আমরাও পড়ে গেছি মহাবিপদে। কারণ, আমাদের জনবল খুবই কম, এই কম জনবল দিয়ে এত বড় পাহাড়ে আগুন নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়েছে। ’
তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে পাহাড় রক্ষায় কাজ করছি। এর আগে আগুন নেভাতে গিয়ে আমিসহ আমাদের দুজন স্টাফ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। তবে, আমরা আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি। একই সঙ্গে দুর্বৃত্তদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছি।’