ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেটের সীমান্তবর্তী সাতটি উপজেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি উপজেলার অবস্থা ভয়াবহ। জেলা প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সাত উপজেলায় ৫ লাখ ৩৩ হাজার ২০২ জন বাসিন্দা বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছেন। আর আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন ৪ হাজার ৮০২ জন। শুক্রবার (৩১ মে) সকাল পর্যন্ত পানিবন্দি ও আশ্রয়কেন্দ্রে ওঠা লোকজনের সংখ্যা আরও বেড়েছে বলে জানা গেছে। পানিবন্দিদের তালিকায় এবার যুক্ত হয়েছে সিলেট নগরী।
সিলেট নগরীর ভেতর দিয়ে বয়ে চলা সুরমা নদীর পানি বেড়ে বৃহস্পতিবার রাত ১০টার পর থেকে নগরীর তালতলা, মেন্দিবাগ, মাছিমপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রবেশ করে। শেষ রাতে নগরীর সুবহানিঘাট, ঘাসিটুলা, শামিমাবাদ, কানিশাইল, তালতলা, মেন্দিবাগ, মাছিমপুর, যতরপুরসহ বেশ কয়েকটি এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। এসব এলাকার কারও ঘরে হাঁটুপানি, আবার কারও উঠানে হাঁটুপনি প্রবেশ করে। এর আগে বৃহস্পতিবার রাতে নগরীর তালতলায় একটি ছড়ার পানি উপচে সিলেটের ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স কার্যালয়ে প্রবেশ করে। তাৎক্ষণিক দমকলের কর্মীরা তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র অন্যত্র সরিয়ে নেন।
গতকাল নগরীর বন্যায় প্লাবিত সুবহানিঘাট, ঘাসিটুলা, শামিমাবাদ, কানিশাইল, তালতলা, মেন্দিবাগ, মাছিমপুর, যতরপুরসহ বেশ কিছু এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই বাসা থেকে মালামাল অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। ঘরের শিশু ও বয়স্কদের নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠাচ্ছেন। যাদের ঘরে পানি উঠেছে তারা খাবার রান্না করতে পারছেন না। কিন্তু বেলা ২টা পর্যন্তও এসব এলাকায় সিলেট সিটি করপোরেশনের কেউ যাননি।
নগরীর সুবহানিঘাট এলাকার নিয়তি দেব বলেন, ‘গতকাল রাত থেকে ঘরে পানি। ঘরের বেশির ভাগ মালামাল পানিতে ডুবেছে। কিছু আসবাবপত্র এখন আরেকজনের বাসায় নিয়ে রাখছি। সকাল থেকে এখন পর্যন্ত রান্নাও করতে পারিনি। সকাল গড়িয়ে দুপুর হলেও পেটে কারোরই এখনো খাবার পড়েনি।’
একই এলাকার আরেক বাসিন্দা সোহেল রানা বলেন, ‘এই পুরো এলাকায় প্রায় ৪০০ মানুষ পানিবন্দি আছেন। এখানে অনেক নিম্নবিত্ত পরিবার আছে, যারা কলোনিতে বাস করে। যাদের সম্পদ বলতে কাঁথা, বালিশ, হাঁড়িপাতিল। এসব মানুষ সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছে।’
এদিকে আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে বলে আভাস দিয়েছে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেট কার্যালয়ের তথ্যমতে, গতকাল সিলেটের নদনদীর পানি কিছুটা কমেছে। গতকাল সকাল ৯টায় সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৯৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিলেট পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ৩০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে, জকিগঞ্জ ও বিয়ানীবাজারে কুশিয়ারা দুটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে অমলসিদ পয়েন্টে ২০৭ সেন্টিমিটার ও শেওলা পয়েন্টে ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে।
এ ছাড়া ভারতের মেঘালয় ও আসামের পাহাড়ি এলাকায় টানা ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সিলেটের গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও জকিগঞ্জে বন্যা দেখা দেয়। সুরমা, কুশিয়ারা, সারি, লোভা, ধলাই ও পিয়াইন নদীর বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে ও উপচে পড়ে ওই পাঁচ উপজেলার বিস্তীর্ণ জনপদ প্লাবিত হয়। গত বৃহস্পতিবার থেকে কুশিয়ারা নদীর পানি দ্রুতগতিতে বেড়ে বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন স্থান দিয়ে প্রবেশ করলে এ দুই উপজেলাও বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে।
এদিকে সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র মো. মখলিছুর রহমান কামরানের সভাপতিত্বে বৃহস্পতিবার বিকেলে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় নগর ভবনের সম্মেলন কক্ষে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় জনস্বার্থে সিলেট সিটি করপোরেশনের বিদ্যুৎ, পানি, স্বাস্থ্য ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শাখার সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়। সভায় নগরীর কয়েকটি ওয়ার্ডকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং বৃহস্পতিবার রাতের মধ্যে ওই ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডগুলোতে কাউন্সিলরদের মাধ্যমে আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুতের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গতকাল থেকে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানি এবং প্রাথমিক চিকিৎসাসামগ্রী প্রেরণ, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় উদ্ধার কাজের জন্য নৌকার ব্যবস্থা, নিম্নাঞ্চলের বিদ্যুৎকেন্দ্র, উপকেন্দ্রগুলো বন্যার পানিতে যাতে ডুবে না যায়, সে জন্য সংশ্লিষ্ট বিদ্যুৎ বিভাগের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সহযোগিতা প্রদান, নগরবাসীর জরুরি সেবার জন্য ২৪ ঘণ্টা কন্ট্রোল রুম চালুসহ পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করলে রান্না করা খাবার পরিবেশনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সিলেট সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা সাজলু লস্কর জানান, সিসিক মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী বর্তমানে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করায় তিনি ভারপ্রাপ্ত মেয়র মখলিছুর রহমান কামরানের সঙ্গে আলোচনা করে জরুরি সভা আহ্বানের নির্দেশনা প্রদান করেন এবং ইতোমধ্যে জরুরি ত্রাণব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও আলোচনা করেছেন। দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত না হয়ে ধৈর্য ও সাহসের সঙ্গে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য নগরবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। এ ছাড়া তিনি সব ধর্মীয় উপাসনালয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষায় বিশেষ মোনাজাত-প্রার্থনা করার জন্য নগরবাসীর কাছে অনুরোধ জানান। সিসিক মেয়রের দপ্তর থেকে জানানো হয়, ইতোমধ্যে প্রাথমিকভাবে তিন টন চিড়া, তিন টন মুড়ি, গুড়, খাওয়ার পানি, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট এবং ওরস্যালাইন কেনা হয়েছে। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় সাহায্যের জন্য ২৪ ঘণ্টা কন্ট্রোল রুম (০১৯৫৮-২৮৪৮০০) অথবা ভারপ্রাপ্ত মেয়র, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সঙ্গে যোগাযোগের অনুরোধ জানিয়েছেন মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।
শাকিলা ববি/এমএ/