লক্ষ্মীপুর জেলায় এবার সয়াবিনের বাম্পার ফলন হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবং সময়মতো বীজ বপন ও পরিচর্যা করতে পারায় সয়াবিনের ফলন ভালো হয়েছে বলে জানিয়েছেন চাষিরা। মাঠ থেকে সয়াবিন তুলে মাড়াইয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। তবে সয়াবিনের বাম্পার ফলন হলেও কাঙ্ক্ষিত দাম না পেয়ে হতাশ কৃষকরা।
জেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি রবি মৌসুমে লক্ষ্মীপুর জেলায় ৪২ হাজার ৫২০ হেক্টর জমিতে সয়াবিনের চাষ হয়েছে। দেশের মোট উৎপাদিত সয়াবিনের মধ্যে লক্ষ্মীপুর জেলায় ৭০ শতাংশ উৎপাদিত হয়। সয়াবিন উৎপাদনে লক্ষ্মীপুরের পরের অবস্থানে রয়েছে পার্শ্ববর্তী জেলা নোয়াখালী। জেলায় এবার উচ্চফলনশীল নতুন জাতের বিইউ-১, বিইউ-২, বারি-৫ ও ৬, বিনা-৫ ও ৬ জাতের সয়াবিন চাষ করে ভালো ফলন পেয়েছেন কৃষকরা। এ বছর সয়াবিন থেকে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, চলতি বছর জেলায় সয়াবিন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪২ হাজার ৫২০ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮৫ হাজার ৪০ মেট্রিক টন। তবে ফলন ভালো হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও উৎপাদন বেশি হবে বলে জানান কৃষি কর্মকর্তারা।
সরেজমিনে লক্ষ্মীপুরের রায়পুরের হায়দারগঞ্জ, চরবংশী, সদরের চররমনী মোহন, চরউভুতি, কুশাখালীসহ বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে রয়েছে সয়াবিনের খেত। সয়াবিন চাষাবাদে উৎপাদন খরচের তুলনায় লাভ বেশি হওয়ায় দিন দিন এটির চাষাবাদে ঝুঁকছেন চাষিরা। অনুকূল আবহাওয়া, উন্নত জাতের বীজ বপন ও সময়মতো সার-কীটনাশক প্রয়োগ করতে পারায় এবার সয়াবিনের বাম্পার ফলন হয়েছে।
সয়াবিন চাষিরা জানিয়েছেন, মৌসুমে বৃষ্টিপাত না হওয়া ও তীব্র দাবদাহে সয়াবিনের ফলন নিয়ে শুরুতে শঙ্কা থাকলেও মাঠে রোগবালাইয়ের আক্রমণ না থাকায় ফলনে কোনো ক্ষতি হয়নি। গত বছরের চেয়েও ফলন বেশি হওয়ায় খুশি তারা। তবে দামে হতাশ চাষিরা। গত বছর প্রতি মণ গোটা সয়াবিন মৌসুমে ২ হাজার ৩০০ টাকায় বিক্রি হলেও এবার তারা বিক্রি করছেন ২ হাজার ৩৩০ থেকে ৩৫০ টাকায়। শ্রমিকের মজুরি, সার ও কীটনাশকের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে এ দামের কোনো হিসাব মেলাতে পারছেন না চাষিরা।
কমলনগরের চরলরেঞ্চ এলাকার সয়াবিন চাষি জসিম উদ্দিন, ভবানীগঞ্জের মিজানুর রহমানসহ কয়েকজন চাষি জানান, এবার সয়াবিনের মণ ন্যূনতম আড়াই হাজার টাকা হলে চাষিরা উৎপাদন খরচ ওঠাতে সক্ষম হতেন। এ অঞ্চলে সয়াবিনভিত্তিক প্রক্রিয়াজাত কারখানা গড়ে তোলা গেলে সয়াবিনের বাজারদর আরও ভালো পেতেন তারা।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা শাহজাহান বলেন, ‘আমাদের দেশে উৎপাদিত সয়াবিন থেকে তেল উৎপাদন করা হয় না। দেশে উৎপাদিত সয়াবিন পোলট্রি খাদ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।’
নুরনবী নামে কুশাখালী এলাকার এক কৃষক চার একর জমিতে সয়াবিনের চাষ করেছেন। তার চাষ এক একর জমিতে ৩০ মণ সয়াবিন উৎপাদন হয়েছে। বাকি তিন একর খেত থেকে সয়াবিন তোলার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন তিনি। তবে বৃষ্টিপাত না থাকায় এবার সয়াবিনের ভালো ফলন হওয়ায় বেশ খুশি এ কৃষক। কিন্তু আশানুরূপ দাম না পাওয়ায় কিছুটা হতাশাও প্রকাশ করেছেন তিনি।
চররমনীর কামরুল সরকার জানান, বিভিন্ন দুর্যোগের ফলে বিগত মৌসুমগুলোতে সয়াবিন নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়তে হতো। গত বছর সয়াবিন খেতের একরপ্রতি ২৮-২৯ মণ উৎপাদন হলেও চলতি খরিপ মৌসুমে আবহাওয়া ভালো থাকায় কানিপ্রতি ৩০ মণেরও বেশি ফলন হয়েছে। উৎপাদিত সয়াবিনের গুণগত মানও ভালো। বর্তমান বাজারে মণপ্রতি ২ হাজার ৩০০ থেকে ২ হাজার ৩৫০ টাকা ধরে সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘ফলন ভালো হলেও দাম বাড়ে না। প্রতিবছর সার-কীটনাশকের দামসহ শ্রমিক খরচও বৃদ্ধি পায়। সে হারে সয়াবিনের বাজারদর বৃদ্ধি পাচ্ছে না। যার ফলে আশানুরূপ দাম পাওয়া যায় না। দাম পাওয়া গেলে কৃষকরা সয়াবিন চাষে আরও বেশি আগ্রহী হতেন।’
রায়পুর উপজেলার মোল্লারহাট এলাকার স্থানীয় কৃষক মনির হোসেন মোল্লা বলেন, ‘এবার বৃষ্টি না থাকায় সয়াবিনের বাম্পার ফলন হয়েছে। এ অঞ্চলে সয়াবিনভিত্তিক কোনো ইন্ডস্ট্রিজ বা শিল্প-কলকারখানা না থাকায় কৃষকরা তাদের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। সয়াবিনভিত্তিক শিল্পকারখানা স্থাপন করা হলে কৃষকদের ন্যায্য দাম পাওয়ার পাশাপাশি লাঘব হবে এ অঞ্চলের বেকার সমস্যা।’
এদিকে সয়াবিন চাষাবাদকে লাভজনক উল্লেখ করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সোহেল মো. শামসুদ্দীন ফিরোজ জানান, চাষিরা উন্নত জাতের বীজ বপন ও সুষম সার ব্যবহারের ফলে এবার লক্ষ্মীপুরে সয়াবিনের বাম্পার ফলন হয়েছে। কৃষি বিভাগ থেকে সয়াবিনের ভালো জাত কৃষকদের মাঝে সরবরাহ করায় আগের চেয়ে ফলন অনেক বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে হেক্টরপ্রতি দুই টন সয়াবিন উৎপাদন হলেও ভবিষ্যতে উৎপাদন আরও বাড়বে। উৎপাদিত সয়াবিন শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহার করা গেলে আমদানি-নির্ভরতা কমার পাশাপাশি সাশ্রয় হবে সরকারের অর্থ।