বাংলাদেশে যত গানের ব্যান্ড রয়েছে তার মধ্যে ‘মাইলস’ অনন্য নাম। যার জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গানপ্রিয় মানুষের হৃদয় থেকে হৃদয়ে আছে মাইলসের গান। যদিও তিনি প্রিয় মাইলস ব্যান্ড ছেড়েছিলেন বেশ আগেই। নতুন করে গড়ে তুলেছিলেন ব্যান্ড ‘ভয়েস অব মাইলস’। তবুও মাইলস ব্যান্ডের গান মানেই শাফিন আহমেদকে বোঝেন, মানেন ও জানেন শ্রোতারা। কারণ মাইলসের প্রায় ৯০ ভাগ জনপ্রিয় গানই গেয়েছেন কিংবদন্তি এই ব্যান্ড তারকা।
হঠাৎ করেই দূরদেশ থেকে ভেসে এল একটি দুঃসংবাদ। জানা গেল, দেশের প্রাচীন এবং জনপ্রিয় এই ব্যান্ডের অন্যতম গায়ক ও গিটারিস্ট শাফিন আহমেদ আর নেই।
শাফিন আহমেদ যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন কয়েকটি কনসার্টে অংশ নিতে। সেখানেই নিভে গেল তার প্রাণপ্রদীপ। যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় সেনটারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় সকাল ৬টা ৫০ মিনিটে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান এই তারকা। এই খবর নিশ্চিত করেছেন শাফিন আহমেদের বড় ভাই ব্যান্ড তারকা হামিন আহমেদ। মৃত্যুকালে শাফিন আহমেদের বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। তিনি স্ত্রী ও তিন সন্তান রেখে গেছেন।
হামিন আহমেদ জানান, কনসার্টে অংশ নিতে শাফিন সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে যান। গত শনিবার ভার্জিনিয়ায় তার কনসার্ট হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু কনসার্টের আগে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় তা বাতিল করা হয়। অসুস্থ শাফিনকে শনিবারই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তবে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অর্গানগুলো অকার্যকর হতে শুরু করলে শাফিনকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় চিকিৎসকরা শাফিনকে মৃত ঘোষণা করেন।
শাফিন আহমেদের অসুস্থতার কথা প্রথমে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জানান দেশের আরেক জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী সামিনা চৌধুরী। তিনিও বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। গত বুধবার বাংলাদেশ সময় মধ্যরাতে ফেসবুক এক পোস্টে সামিনা চৌধুরী লেখেন, ‘আহারে জীবন…সেই জীবনের কোথায় কখন কী হতে যাচ্ছে আমরা কেউই জানি না। দেশের এই পরিস্থিতি মানতে কষ্ট হচ্ছে…তার মধ্যে আরেক দুঃখের খবর। এখানে (যুক্তরাষ্ট্রে) অনুষ্ঠান করতে এসে আগের দিন শাফিন ভাই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। দেশের সম্পদ শাফিন আহমেদের জন্য আমাদের সবার দোয়া প্রয়োজন। দয়া করে সবাই শাফিন ভাইয়ের জন্য দোয়া করবেন। পরের দিন সকালে সামিনা চৌধুরী এক আবেগঘন স্ট্যাটাসে এই তারকার মৃত্যুর খবরও জানান।
শাফিন আহমেদের জন্ম ১৯৬১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি, ভারতের কলকাতায়। তার বাবা উপমহাদেশের কিংবদন্তি সুরকার ও সংগীতশিল্পী কমল দাশগুপ্ত এবং মা নজরুল সংগীতের কিংবদন্তি শিল্পী ফিরোজা বেগম।
শাফিন আহমেদ ছোটবেলা থেকেই সংগীত সাধনা শুরু করেন। বাবার কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীতের তালিম নেওয়ার পাশাপাশি মায়ের কাছে শেখেন নজরুল গীতি।
এরপর যুক্তরাজ্যে পড়াশোনা করতে গিয়ে পাশ্চাত্য সংগীতের প্রতি আকৃষ্ট হন এই তারকা গায়ক। ১৯৭৯ সালে বড় ভাই হামিন আহমেদকে নিয়ে ‘মাইলস’ ব্যান্ডে যোগ দেন। এই ব্যান্ডের ভোকাল ও বেইজ গিটারিস্ট ছিলেন তিনি।
বাংলা গানের পাশাপাশি ইংরেজি ও হিন্দি গানও গেয়েছেন এই তারকা। এ ছাড়া তার জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ‘পথিকার’ নামের একটি গ্রন্থও। এটি লিখেছেন লেখক সাজ্জাদ হুসাইন। ‘পথিকার’ বই সম্পর্কে শাফিন আহমেদ বলেছিলেন, ‘বিভিন্ন ধরনের মিউজিকের সঙ্গে পরিচিত হতে হতে একসময় ব্যান্ড মিউজিকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া। এবং মাইলস ব্যান্ডের সঙ্গে কয়েক যুগের পথ চলা। বাংলাদেশের ব্যান্ড মিউজিকের শুরু খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। নানান ঘটনা আর অভিজ্ঞতার জীবন অবশেষে লিপিবদ্ধ হয়েছে পথিকার নামে।’
শাফিন আহমেদ মাঝে রাজনীতিতে জড়িয়েছিলেন নিজেকে। জাতীয় পার্টির হয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মেয়র প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন তিনি। তবে মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ায় আর ভোট করা হয়নি তার। রাজনীতিতে সরব না থাকলেও গানে কখনো ছেদ পড়েনি তার। নতুন গান প্রকাশের পাশাপাশি স্টেজ শোতেও ছিলেন নিয়মিত। গানের মতোই শাফিন আহমেদ ভক্তদের আকৃষ্ট করেছেন তার নিজস্ব স্টাইল দিয়ে। মাথায় ক্যাপ, চোখে কালো সানগ্লাস যেন শাফিন আহমেদের নিত্যসঙ্গী ছিল। স্টেজ থেকে স্টেজে পরিপাটি পোশাক পরে কণ্ঠ ও সুরে মাত করেছেন প্রতিনিয়ত। একজন শাফিন আহমেদের মৃত্যুতে বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীতের ভিত কেঁপে উঠেছে যেমন, তেমনি শোকে পাথর প্রায় প্রতিটি ব্যান্ডের সদস্যসহ শ্রোতারাও।
জাহ্নবী