![দর্শকশূন্যতায় ডুবল দেশের ৫ সিনেমা](uploads/2024/02/26/1708927015.b2.jpg)
বাংলা সিনেমার দুর্দিনের কথা কম-বেশি সবারই জানা। গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখলে অনেকেই মনে করতে পারেন, হয়তো ঘুরে দাঁড়াচ্ছে দেশীয় সিনেমা। খোঁজ করলে দেখা যাবে প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন সিনেমার শুটিং হচ্ছে দেশের আনাচে-কানাচে। সেগুলো আবার নিয়মিত মুক্তিও দেওয়া হচ্ছে প্রেক্ষাগৃহে। এতে কি ঢালিউডের মরচে পড়া কপাল থেকে শনির দশা কাটছে? এর সদুত্তর দিতে পারেননি কেউই। এসব সিনেমাসংশ্লিষ্টরা ঢাকাঢোল পিটিয়ে জানান দিচ্ছেন, তারা এবং তাদের সিনেমাই সেরা। অন্যদিকে সমালোচকরা এসব সিনেমাকে আবার সিনেমা বলতেও নারাজ। এসব তর্ক-বিতর্ক পেছনে রেখে দর্শক কিন্তু মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন মানহীন এই সিনেমাগুলো থেকে। এ কারণে সিনেমায় টাকা লগ্নি করে প্রযোজক পথে বসছেন। সিনেমা থেকে মোট খরচের একভাগও ফেরত পান না প্রযোজক। ভারাক্রান্ত মনে অনেকেই গণমাধ্যমকে তাদের নিঃস্ব হওয়ার কথা বলেছেন বহুবার। এ জন্য নতুন প্রযোজক এলেও একটি সিনেমার পর অধিকাংশই মুখ ফিরিয়ে নেন ঢালিউড থেকে।
অনেক প্রযোজক এর আগে গণমাধ্যমে বলেছেন, সিনেমার পরিচালকরা নানান স্বপ্ন দেখিয়ে তাদের সিনেমায় নিয়ে আসেন। পরে তাদের কথা ও কাজের কোনো মিল পাওয়া যায় না।
চলতি মাসে মুক্তি পেয়েছে দেশীয় পাঁচ সিনেমা ‘পেয়ারার সুবাস’, ‘ট্র্যাপ’, ‘ছায়াবৃক্ষ’, ‘শ্রাবণ জ্যোৎস্নায়’ ও ‘টালমাতাল’। ৯ ফেব্রুয়ারি নুরুল আলম আতিকের পরিচালনায় জয়া আহসান অভিনীত ‘পেয়ারার সুবাস’ মুক্তি পায় দেশের ২৭ প্রেক্ষাগৃহে। মুক্তির আগেই সিনেমার প্রিমিয়ার শোয়ে যোগ দিতে যাওয়ার সময় মারা যান অভিনেতা আহমেদ রুবেল। এরপর সিনেমাটির স্বাভাবিক প্রচারে বিঘ্ন ঘটে। শোক নিয়ে পরিচালক অভিনেতা-অভিনেত্রীরা সিনেমাটি নিয়ে দর্শকদের কাছে পৌঁছাতে পারেননি।
একই তারিখে মুক্তি পায় ‘ট্র্যাপ’। অপু বিশ্বাস ও জয় চৌধুরী জুটির দ্বিতীয় সিনেমা এটি। পরিচালনা করেছেন দ্বীন ইসলাম। এ সিনেমাটি একেবারেই মুখ থুবড়ে পড়েছে। চা-শ্রমিকদের জীবনের গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে ‘ছায়াবৃক্ষ’। ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকারি অনুদানে নির্মিত সিনেমাটির চিত্রনাট্য ও পরিচালনা করেছেন বন্ধন বিশ্বাস। এতে জুটিবদ্ধ হয়েছেন নিরব ও অপু বিশ্বাস। এ সিনেমাটিও মুক্তি পায় ১৬ ফেব্রুয়ারি। সিনেমাটির প্রচার জোরালো হলেও মুক্তির পর দর্শকশূন্যতায় ডুবেছে এটি। একই তারিখে মুক্তি পায় দীঘি অভিনীত সিনেমা ‘শ্রাবণ জ্যোৎস্নায়’। আব্দুস সামাদ খোকন পরিচালিত সরকারি অনুদান পাওয়া সিনেমাটিতে দীঘির বিপরীতে রয়েছেন গাজী আবদুন নূর। কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের ‘শ্রাবণ জ্যোৎস্নায়’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে সিনেমাটি। দর্শক টানতে ব্যর্থ হয়েছে ছবিটি। মুক্তির এক সপ্তাহও চলেনি অধিকাংশ প্রেক্ষাগৃহে। কোনো কোনো সিনেমা হল থেকে মুক্তির দুদিন পরই নামিয়ে দেওয়া হয়েছে।
গত ২৩ ফেব্রুয়ারি মোট ৭ সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছে ‘টালমাতাল’। হাবিব খানের পরিচালনায় এতে অভিনয় করেছেন কাজী হায়াৎ, দেশ ইসলাম, জারা প্রমুখ। প্রচার ছাড়াই নীরবে মুক্তি দেওয়া হয়েছে ছবিটি। দর্শক তো দূরের কথা, খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিনেমাসংশ্লিষ্টরাও এ ছবি সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেন না।
চলতি মাসে মুক্তি পাওয়া বাংলাদেশি পাঁচ সিনেমা নিয়ে কথা বলেছেন দেশের বিভিন্ন সিনেমা হল মালিক এবং ব্যবস্থাপকরা। এসব সিনেমা নিয়ে ব্যবসা প্রসঙ্গে খবরের কাগজকে তারা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। শ্যামলী সিনেমা হলের ম্যানেজার আহসানুল্লাহ বলেন, ‘পেয়াবার সুবাস’, ‘শ্রাবণ জ্যোৎস্নায়’ সিনেমাগুলো তেমন চলেনি। আমাদের সিনেমায় দুদর্শা চলছে। ব্যবসায়িক সিনেমা এখন আসছে না। এখন শ্যামলীতে পুরাতন ছবি ‘প্রিয়তমা’ চালাচ্ছি। তবে পুরাতন ছবি আর কত রিপিট করা যায়? প্রথম কদিন ‘পেয়ারার সুবাস’ ভালোই চলেছে। তবে দ্বিতীয় সপ্তাহ টানতে পারেনি। আর ‘শ্রাবণ জ্যোৎস্নায়’ এক সপ্তাহও চালাতে পারিনি। দুদিন পর সেটি নামিয়ে ‘প্রিয়তমা’ চালাচ্ছি।’
খুলনা সংগীতা সিনেমা হলের ম্যানেজার বাবু বলেন, ‘ট্র্যাপ এক সপ্তাহ চালিয়েছি। সেল রিপোর্ট একদমই ভালো না। খবরে দেখেছি, অনেক হল থেকেও দু-তিনদিন পরই ছবিটা নামিয়ে ফেলা হয়েছে। এই রকম ছবি দর্শক কেন দেখবে! একমাত্র অপু বিশ্বাস ছাড়া আর কোনো ভালো আর্টিস্ট নাই এখানে। আর যদি নায়ক ভালো না হয়, তাহলে দর্শক কীভাবে সিনেমা দেখবে? ‘প্রিয়তমা’ কিন্তু আমরা আট সপ্তাহ চালিয়েছি। ‘পরান’, ‘হাওয়া’ অনেক সপ্তাহ চালিয়েছি। ছবিতে আসলে জোর থাকতে হয়। সিনেমা যদি নাটক, টেলিফিল্মের মতো হয়, তাহলে সমস্যা। এসব ছবি দর্শক দেখতে চায় না। ‘ট্র্যাপ’ এক সপ্তাহ চালিয়ে মাত্র ২০ হাজার টাকা তুলেছি। বিদ্যুৎ বিলের খরচও ওঠেনি। ২০ হাজার টাকার মধ্যে ১০ হাজার টাকা নিয়েছে ছবির প্রযোজক, মাইকিং, পোস্টারিংয়ে খরচ হয়েছে ৩ হাজার। আটজন স্টাফ আছে, বাকি ৭ হাজার টাকায় কীভাবে খরচ ওঠে? সিনেমা হল এ জন্যই বন্ধ করে দেই আমরা। খুব কষ্টে আছি। এগুলো জাতের কোনো ছবি না। সবচেয়ে বেশি খারাপ হচ্ছে, সরকারের কাছে অনুদান নিয়ে যে সিনেমা বানাচ্ছে এগুলো। সরকারের কাছে টাকা নিয়ে তাইরে-নাইরে করে আবোল-তাবোল দিয়ে ছবি বানিয়ে সিনেমা হলে রিলিজ করে। এসব ছবি কেউ দেখে না। দুই চারটা হলে চালিয়ে সরকারকে দেখায়।’
চট্টগ্রাম সুগন্ধা সিনেমা হলের কর্ণধার সাইফ বলেন, “আমার সিনেমা হলে এখন ‘মুজিব’ চলছে। এ মাসে ‘পেয়ারার সুবাস’ ও ‘ছায়াবৃক্ষ’ দুইটা নতুন সিনেমা চালিয়েছি। সিনেমা দুটি ভালো চলে নাই। ভালো চললে দুই সপ্তাহ চালাতাম। আমাদের খরচও ওঠেনি।”
কেরানীগঞ্জ লায়ন সিনেমাস কর্তৃপক্ষ বলেন, ‘ছায়াবৃক্ষ ও শ্রাবণ জ্যোৎস্নায় সিনেমা দুটি চলছে আমাদের এখানে। আমাদের কালেকশন ওভাবে কাউকে বলি না। তবে আনফরচুনেটলি যদি বলতে হয়, সিনেমা দুটি তেমন চলছে না। বাংলা সিনেমা নিয়ে আমাদের প্রত্যাশা অনেক, কিন্তু সিনেমা দুটি দাঁড়াতেই পারেনি। আমাদের আশা পূরণ হয়নি।’
চলতি মাসে মুক্তি পাওয়া দেশের এই সিনেমাগুলো দর্শক তো টানতেই পারেনি, বরং হতাশ হয়েছেন বাংলা সিনেমার দর্শকরা। চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এভাবে চলতে থাকলে দেশীয় সিনেমা একসময় স্মৃতি হয়ে যাবে।
জাহ্নবী