![প্রিয় মেহ্জাবীন](uploads/2024/04/19/1713529199.mehazabien1.jpg)
মেহজাবীনের চোখে জল! এ রকম দৃশ্য দেখলে অনেকেরই বুক ভেসে যায়। টিভি পর্দায় তাকে হাসতে দেখলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে হেসে ওঠে ভক্তমন। তারকা থেকে এভাবে একসময় শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন ঢাকার মেহজাবীন চৌধুরী। আজ বিনোদনের দুনিয়া টেলিভিশন, ইউটিউব, ওটিটির রানি হয়ে বসে আছেন তিনি। অভিনয় অনেকেই করেন। মেহজাবীন হয়ে ওঠেন চরিত্র। পার্থক্য এতটুকু, অন্যদের দেখে বোঝা যায় – অভিনয় করছে। মেহজাবীনকে দেখলে মনে হয়, অভিনয় না, মেহজাবীন সত্যিই পর্দায় দেখা নারীটি। তার ভ্রু, চোখ, ঠোঁট, মুখমন্ডল সত্যিকারের প্রেম, আনন্দ কি বা যাতনার বার্তা দিচ্ছে। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছেন কোটি মানুষের প্রিয় মেহজাবীন। আজ তার জন্মদিন।
বিজয়ের আগের বিজয়
এই যে মেহজাবীন এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন। এই বিজয়ের আগে তাকে জয় করতে হয়েছে আরও এক যুদ্ধ। ২০০৯ সালে লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার হয়ে বিনোদন অঙ্গনে পা রেখেছিলেন মেহজাবীন। তারপর পেছনে ফিরে দেখার আর সুযোগ হয়নি তার। অভিনয় করে দিনের পর দিন নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন তিনি। দেশে উৎসবের এমন দিনও এসেছে, মেহজাবীনহীন টিভিপর্দা ভাবা মুশকিল ছিল। কীভাবে এই পর্যায়ে নিজেকে তুলে আনলেন তিনি? একবার জানতে চাইলে বলেছিলেন, ‘লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার প্রতিযোগিতার সময় একটা গ্রুমিং হয়েছিল। সেটা আমার ভীষণ কাজে এসেছিল। যে কোনো কাজ শুরু করার আগে কাজটাকে ভালোবাসতে হবে, কাজটি সম্পর্কে জানতে হবে, জানার জন্য ছোটবড় প্রশিক্ষণ নিতে হবে, তারপর সেটা শুরু করতে হবে।’ যদি ব্যর্থ হতেন? ‘হতাশ হতাম না। অন্য কোনো কাজ খুঁজে নিতাম, যেটা আমি ভালো পারব।’
সেরা করদাতা
অভিনয় একটি পেশা! এ থেকে আয় করা যায়? সরকারকে কর দেওয়া যায়? আবার সেরা করদাতা হিসেবে স্বীকৃতিও পাওয়া যায়! বাংলাদেশে এমনটি ভেবেছিল কেউ? ২০২২ সালে সেরা করদাতার তালিকায় ছিল মেহজাবীনের নাম। অবশ্য কবি নির্মলেন্দু গুণ যে বছর কর দিয়েছিলেন, ঘটনাটি সাড়া ফেলে দিয়েছিল। তবে একজন কবি ও একজন রূপবতী অভিনেত্রীর কর দেওয়ার মধ্যে পরের ঘটনাটি বেশি আলোড়ন জাগায়। পাশাপাশি অভিনেত্রীর কাজের পরিমাণও ইঙ্গিত করে।
ইফতেখার আহমেদ ফাহমি পরিচালিত ‘তুমি থাকো সিন্ধুপারে’ দিয়ে খাতা খুলেছিলেন মেহজাবীন। এ নাটকে তার বিপরীতে ছিলেন মাহফুজ আহমেদ। এরপর একে একে মেহজাবীনকে দেখা যায় ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই’, ‘কল সেন্টার’, ‘আজও ভালোবাসি মনে মনে’, ‘আনলিমিটেড হাসো’সহ বহু নাটকে। সেসবের মধ্যে ২০১৩ সালে শিখর শাহনিয়াত পরিচালিত ‘অপেক্ষার ফটোগ্রাফি’ তার ক্যারিয়ারের বাঁক বদলে দেয়। ২০১৭ সালের ঈদুল আজহায় মিজানুর রহমান আরিয়ানের পরিচালনায় ‘বড় ছেলে’তে অভিনয় করে রীতিমতো আলোচনার ঝড় তোলেন তিনি। দেশ-বিদেশে ব্যাপক প্রশংসিত হয় মেহজাবীন ও জিয়াউল ফারুক অপূর্ব অভিনীত ‘বড় ছেলে’। এ ছাড়া আলোচিত হয়েছিল মেহজাবীন অভিনীত ‘কাজলের দিনরাত্রি’, ‘পুনর্জন্ম’র মতো বেশ কিছু নাটক।
একসময় এল সেই দিন, ভিন্ন কোনো নারী চরিত্রের কথা ভাবলে নির্মাতারা প্রথম যার কথা ভাবেন, তিনি মেহজাবীন। তালিকায় যুক্ত হলো – মনের মতো মন, ভুল ঠিকানায় যাত্রা, একটি অনাকাঙ্ক্ষিত প্রেমের গল্প, ফ্রেন্ডশিপ, লাভ এন্ড সামথিং মোর, মরীচিকার রঙ, ও রাঁধা ও কৃষ্ণ, সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, বাঘিনী, সাহেব মেমসাহেব-এর মতো শতকস্পর্শী সংখ্যার নাটক। বিভিন্ন সময়ে তিনি হয়ে উঠলেন প্রীতি, মেহু, রূম্পা, নিতু, সিমি, ইরিনা, নীলা, স্নেহা, রোকেয়া, জরিনা, তিথি, রায়া, আরিশা, বন্যা, রুবির মতো চরিত্র।
বাছবিচারিক মানুষ
এত কাজ! এত কাজ! কীভাবে সম্ভব? মেহজাবীন বাছবিচারিক শিল্পী। গণহারে কাজ করা তার ধাতে নেই। কোনো এক উৎসবে যদি দশটি নাটকের প্রস্তাব পান, সবগুলোতে সাড়া দেন না তিনি। তার ভাষায়, ‘যদি কোনো উৎসবে আমার ছয়টা নাটক থাকে, চেষ্টা করি চিত্রনাট্যগুলো বাছাই করে নাটকগুলোর প্রস্তাবে সাড়া দিতে। সেগুলোর মধ্যে হয়তো একটা থাকতে পারে ফানি, একটা সিরিয়াস, একটা সামাজিক বার্তাসমৃদ্ধ। এই বৈচিত্র্য রাখার জন্য অনেক সময় অনেক নির্মাতার কাজ আমার করা হয়ে ওঠে না। এতে অনেকে হয়তো মনক্ষুন্ন হন, কিন্তু আমার নিজের মান ও সংখ্যা ধরে রাখার তাগিদ থাকে।’
চিত্রনাট্য বাছাইয়ের কাজটি অনেক পরিশ্রমের। সেকথা স্মরণ করে মেহজাবীন বলেন, ‘হয়তো ৬০-৭০টি চিত্রনাট্য বেছে আমাকে ১০টা কাজ করতে হচ্ছে। প্রতিদিন কাজও করতে হয়, স্ক্রিপ্ট পড়তে হয়। এটা খুব কঠিন একটা কাজ। আমার কোনো ম্যানেজার নেই যে, আমাকে স্ক্রিপ্ট পড়ে ভালো-মন্দ যাচাই করে কাজটা করার পরামর্শ দেবে। আমাকেই আমার স্ক্রিপ্ট পড়তে হচ্ছে। আবার কখনও কখনও এমনও হয় যে, খুব ভালো একটা সিনোপসিস, যখন স্ক্রিপ্ট হয়ে আসছে, তখন দেখা যায় ততটা ভালো কিছু না। ১৬ ঘণ্টা কাজ করি, বাকিটা সময় কীভাবে স্ক্রিপ্ট পড়া যায়?’
শিল্পীর কর্মতৃষা
২০২১ সালের কথা। সে বছরও খুব ভালো একজন অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে দেখতে চেয়েছিলেন মেহজাবীন। টিভি নাটকে তখন তার অবস্থান রীতিমতো মধ্যগগনে। তবু তৃষ্ণা ফুরোয় না তার। আরও ভালো করতে চেয়েছেন। মনে হয়েছে, তার সামনের সারিতে আছেন আরও কয়েকজন অভিনেত্রী। মনে হয়েছিল, তাকে আরও অনেক দূর এগোতে হবে তাকে। এক সাক্ষাৎকারে সে বছর মেহজাবীন বলেন, ‘তারা দূর্দান্ত কাজ করেন, তাদের দ্বারা আমি ভীষণ অনুপ্রাণিত হই।’ একজন শিল্পীর জন্য এই তৃষ্ণা, এই আকাঙ্ক্ষা অত্যন্ত জরুরি, সেটা স্বীকার করবেন যে কেউ। মেহজাবীনের লক্ষ্য, দিনে অন্তত একটি ভালো সিকোয়েন্স করা। তার এই কর্মতৃষা তাকে আগের চেয়ে ভালো একটি সিকোয়েন্সের জন্য তাড়া করে। ফলাফল – দর্শক দেখতে পান পর্দায়।
ছোট্ট আক্ষেপ
পৃথিবীর কোথাও হয়তো আর্টিস্টকে কস্টিউম নিয়ে ভাবতে হয় না। মেহজাবীনদের ভাবতে হচ্ছে। শিল্পী শুটিং সেটে যাবেন, মনোযোগ দিয়ে শেষবারের মতো চোখ বুলিয়ে নেবেন চিত্রনাট্যে তারপর শুরু করবেন সংলাপ! এ রকম কি হচ্ছে? আক্ষেপ নিয়ে মেহজাবীন বলেন, ‘আমাদের শুটিংয়ে যেতে হচ্ছে, স্ক্রিপ্ট বাছাই করতে হচ্ছে, চুল ঠিক করতে হচ্ছে, কস্টিউম ঠিক করতে হচ্ছে, আবার কাউকে অ্যাক্টিং শিখিয়ে দিতে হচ্ছে, কখনও শিখে নিতে হচ্ছে। সাপোর্টিং আর্টিস্টেরও এখানে ঘাটতি আছে।’
ঘাটতির এখানে শেষ নেই। চিত্রনাট্যকারকে বলে দেওয়া হয়, একদিনের মধ্যে যেন শুটিং শেষ করতে পারি, সে রকম একটা স্ক্রিপ্ট লিখতে হবে। হাসপাতালের দৃশ্য হবে, কিন্তু হাসপাতালে শুট করা হবে না। স্টুডিওর ভেতরেই হাসপাতাল বানানো হবে। রেলস্টেশনের দৃশ্য আছে, কিন্তু সেখানে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া যাবে না। দৃশ্যটা করতে হবে বাসস্টপেজে। প্রোডাকশন ম্যানেজারকেও এ রকম নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়। এভাবে কেউই নিজের শতভাগ শ্রম ও মেধা কাজের ভেতর দিতে পারে না। একজন শিল্পীর সঙ্গেও এ রকম ঘটনা ঘটে। মেহজাবীন বলেন, ‘এই লিমিটেশনের মধ্যেই এখানে সবাই কাজ করে যাচ্ছে। এরা সবাই সুপারম্যান। মন থেকে যদি এই পেশাটাকে ভালো না বাসতো, তারা এত কিছু করতে পারতেন না।’
যেখানে আক্ষেপ নেই
চলচ্চিত্রে অভিনয় করা বা না করা নিয়ে মেহজাবীনের কোনো আক্ষেপ নেই। পর্দায় যা চলমান, সেটাই তার কাছে চলচ্চিত্র। তার ভাষায়, ‘প্রতিদিন একটা ব্যতিক্রম চরিত্র করে মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারছি, হাসাতে-কাঁদাতে-ভাবাতে পারছি এতেই আমি তৃপ্ত। সুতরাং সিনেমা, ওটিটি, বড় পর্দা এসব নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই।’ যদিও সিনেমা বলতে যা বোঝায়, সে রকম কাজ এরই মধ্যে তিনি করে ফেলেছেন। শিহাব শাহীনের ‘নীল জলের কাব্য’, ভিকি জাহেদের ‘আমি কী তুমি’, আশফাক নিপুনের ‘সাবরিনা’সহ আরও বেশ কিছু ওয়েব ফিল্মে তাকে দেখেছেন দর্শক। তবে আর আক্ষেপ থাকতে আছে? ওটিটি নিয়ে ইতিবাচক ভাবনা এই শিল্পীর। তার মত, ‘ওটিটিতে একটু সময় নিয়ে কাজ করা যায়, ভালো কাজের সুযোগ হয়। সেখানে গল্প বলার স্বাধীনতা আছে, সবকিছু নিয়ে একটু নিরীক্ষা করা যাচ্ছে। ক্যারিয়ারের এই পর্যায়ে আমি তো নিরীক্ষাধর্মী কাজ করতে চাই। সবচেয়ে বড় কথা, ওটিটিতে এখন পরিকল্পিত কাজ হচ্ছে। সে কারণে ওটিটিতে আমার আগ্রহ বেড়েছে।’
গোপন সংসার
ভাইরাল কয়েকটি ছবি সাক্ষ্য দেয়, নাটক ও বিজ্ঞাপন নির্মাতা আদনান আল রাজিবের সঙ্গে গোপন সংসার পেতেছেন মেজহাবীন চৌধুরী। এই অঙ্গনের অন্দরমহলের মানুষ যারা, বিষয়টি কেবল তারাই জানেন। বাকিরা গুঞ্জনে ভর করে এ বিষয়ক সিদ্ধান্তে এক পা এগোন, দুই পা পেছান। সে রকম একটি ছবিতে দেখা গেছে, আদনান আল রাজিব ও মেহজাবীন মোনাজাত ধরেছেন। একই ভঙ্গিতে একটু দূরে মোনাজাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকির বর্তমান প্রধান নির্বাহী রেদওয়ান রনি, নির্মাতা আশফাক নিপুনসহ কয়েকজন নারী, ছবিতে যাদের চেনা যায় না।
আরও একটি ছবিতে পারিবারিক আবহে আধশোয়া অবস্থায় দেখা গেছে মেহজাবীন ও আদনানকে, খুব কাছাকাছি। দুজনার মাঝে একটি ৫-৬ বছরের শিশুও রয়েছে। শিশুটি তাদের নয়, সেটা ওর ভঙ্গিই বলে দিচ্ছিল। বিয়ে নিয়ে কেন এই রাকঢাক? মেহজাবীনকে যখনই বিয়ে প্রসঙ্গে কিছু জিজ্ঞেস করা হয়েছে, তখনই তিনি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সেটা এড়িয়ে গেছেন। কখনও বলেছেন, ‘আমার কি বিয়ের বয়স হয়েছে?’ কখনও বলেছেন, ‘আরও পাঁচ বছর পর বিয়ের খবর দেব।’ কথাটা মিথ্যে লাগেনি শুনতে। বিয়ে তিনি করেছেন, সেই খবরটি একটু দেরিতে দেবেন, তাতে কী? হয়তো তাতে গণপরিসরে বিবাহোত্তর সংবর্ধনার আয়োজন করতে হবে না।