হোর্গে মারিও বারগোগ্লিও ছিলেন রসায়নের ছাত্র। ইতালিয় অভিবাসী রেলের কর্মী হোসে মারিও বারগোগ্লিও এবং গৃহিণী রেগিনা মারিয়া সিভোরি দম্পতির বড় সন্তান। পরিবারটি মুসোলিনির ফ্যাসিবাদী শাসনামলে পালিয়ে আর্জেন্টিনায় আশ্রয় নেয়।
খুবই সাধারণ পারিবারিক আবহে বড় হওয়া হোর্গে বুয়েনস এইরেসের রামোস মেহিয়া শহরে স্কুল শিক্ষাজীবন শেষ করে পরবর্তীতে এসকেলা তেকনিকা নাসিওনাল (ন্যাশনাল টেকনিকাল স্কুল) থেকে রসায়ন প্রযুক্তিবিদ হিসেবে ডিপ্লোমা অর্জন করেন।
শিক্ষাজীবন শেষে বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত ছিলেন হোর্গে। খাদ্য পরীক্ষাগারে রসায়নবিদ থেকে নাইটক্লাবের নিরাপত্তারক্ষী ও ঝাড়ুদার হিসেবেও কাজের অভিজ্ঞতা আছে তার।
শৈশবে আমালিয়া দামোন্তে নামের এক কিশোরীর প্রতি একসময় আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। ১২ বছর বয়সেই আমালিয়াকে নিয়ে সংসার গড়ার পরিকল্পনাও করেন। এমনিকি তিনি সেসময় এই কিশোড়িকে চিঠি লিখে হুমকি দেন , ‘যদি তুমি আমাকে বিয়ে না কর, তাহলে আমি ধর্মযাজক হয়ে যাব।’
যদিও সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। এই চিঠি পড়ে আমালিয়ার বাবা-মায়ের হাতে এবং তারা এই সম্পর্ক মেনে নেননি। প্রেমে ব্যর্থ হওয়ার পর নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন হোর্গে বারগোগ্লিও। ধর্মযাজক হওয়ার পথই বেছে নেন তিনি। তবে যাজক হওয়ার প্রশিক্ষণকালে আরও একবার প্রেমে পড়েন পরবর্তী জীবনে সর্বজন সমাদৃত এই ধর্মীয় নেতা।
এ বিষয়ে ২০১৪ সালে তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি যখন সেমিনারিতে ধর্মযাজক হওয়ার প্রশিক্ষণে ছিলাম, বয়স ২২ কি ২৩ হবে, তখন একটি মেয়ে আমার মাথা ঘুরিয়ে দেয়। তার আকর্ষণ এতই তীব্র ছিল যে, আমি প্রশিক্ষণে মন বসাতে পারতাম না। শেষমেষ আমাকে এই জটিলতা থেকে পরিত্রাণ পেতে কনফেসরের (ধর্মীয় উপদেষ্টা) কাছে যেতে হয়।’
এ বিষয়ে মজা করে তিনি বলেন, তবে সেই প্রেম টিকেছিল মাত্র এক সপ্তাহ। কনফেসরের উপদেশ মাথায় নিয়ে আবার ঈশ্বরের সাধনায় মনোনিবেশ করেন তিনি।
আরও একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার কথাও তিনি একবার উল্লেখ করেন। ২০১০ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, ট্যাঙ্গো নাচার সময় বন্ধুদের মধ্যে একটি মেয়ে ছিল, যার প্রতি তিনি টান অনুভব করেন। তবে মূলত সেই সময়েই তিনি নিজের মধ্যে ঈশ্বরের আহ্বান আবিষ্কার করেন বলে জানান।
হোর্গে বার্গোগ্লিওর প্রেমের অভিজ্ঞতাগুলো তার জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। আমালিয়া দামোন্তের সঙ্গে শৈশবের প্রেম এবং যৌবনে সেমিনারিতে ওই মেয়েটির প্রতি আকর্ষণ তাকে মানুষের সম্পর্ক ও ভালোবাসার জটিলতা সম্পর্কে শেখায়। এই অভিজ্ঞতাগুলো তার ধর্মীয় আহ্বানকে আরও দৃঢ় করে তোলে। তিনি বুঝতে পারেন যে, জীবনের উদ্দেশ্য হলো ঈশ্বরের সেবা করা এবং মানুষের মাঝে তার বাণী পৌঁছে দেওয়া।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘প্রেম ব্যর্থ হলে সেই ব্যর্থতার বেদনা অনুভব করতে হয়। যারা ছেড়ে গেল, তাদের নিন্দা করা উচিত নয়। বরং তাদের মতো নতুন করে জীবনের পথ আবিষ্কার ও সুযোগ হলে তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত।’
ধর্মের পথে যাত্রা
১৯৫৩ সালে ১৭ বছর বয়সে ফ্লোরেসের একটি গির্জায় কনফেশনের (পাপ স্বীকারের) জন্য যান হোর্গে। সময়টি ছিল গাউদেতে সানডে, অ্যাডভেন্টের তৃতীয় রবিবার; খ্রিস্টানরা দিনটিকে আনন্দের দিন হিসেবে পালন করে থাকেন।
গির্জায় একজন যাজক কিশোর হোর্গেকে এমন আন্তরিকতার সঙ্গে স্বাগত জানান, যাতে তার হৃদয় আন্দোলিত হয়। সেই যাজকের সঙ্গে ধীরে ধীরে তার সম্পর্ক বাড়তে থাকে। যাজকের সঙ্গে আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে তার জীবনে আধ্যাত্মিক জাগরণ ঘটে। তিনি অনুভব করেন যে, ঈশ্বর তাকে ডাকছেন।
১৯৫৮ সালে ২১ বছর বয়সে তিনি জেসুইট সোসাইটি অফ জিসাসে যোগ দেন। এ বিষয়ে তার বক্তব্য ছিল, জেসুইটরা গির্জার সামনের সারিতে কাজ করেন। তারা কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যে জীবনযাপন করেন এবং মিশনারি কাজ তাদের জীবনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।
এরপর ১৯৬৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর ৩৩ বছর বয়সে যাজক হিসেবে অভিষিক্ত হন হোর্গে বার্গোগ্লিও। আর্জেন্টিনার কর্দোবার আর্চবিশপ রামন হোসে কাস্তেয়ানোর মাধ্যমে তিনি অভিষিক্ত হন।
এরপর ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত আর্জেন্টিনায় জেসুইটদের প্রাদেশিক প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এসময় আর্জেন্টিনায় ‘ডার্টি ওয়ার’ বা নোংরা যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত সামরিক শাসন চলছিল।
১৯৯২ সালে তিনি বুয়েনস এইরেসের সহকারী বিশপ নিযুক্ত হন। ১৯৯৮ সালে হন আর্চবিশপ। এরপর ২০০১ সালে পোপ দ্বিতীয় জন পল তাকে কার্ডিনাল পদে উন্নীত করেন।
আর্চবিশপ হিসেবে বুয়েনস এইরেসের বস্তিবাসীদের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন হোর্গে। সাধারণ জীবনযাপন, বাসে চলাফেরা ও নিজের খাবার রান্না করার মতো কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিতে বেশি সময় লাগে না তার। ‘বস্তির বিশপ' হিসেবে এ সময় পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি।
পোপ হিসেবে অভিষেক
২০১৩ সালে তৎকালীন পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট পদ ছেড়ে দিলে সে বছরের ১৩ মার্চ নতুন পোপ নির্বাচিত হন বার্গোগ্লিও। পোপ হিসেবে অভিষেকের পর নতুন নাম গ্রহণ করেন হোর্গে- পোপ ফ্রান্সিস। ইতালির আসিসির সেন্ট ফ্রান্সিসের সম্মানে তিনি এই নাম গ্রহণ করেন।