![অভিশ্রুতি না বৃষ্টি নামে সংশয়](uploads/2024/03/02/1709354442.Avisruty.jpg)
রাজধানীর বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত হয়েছেন সংবাদকর্মী অভিশ্রুতি শাস্ত্রী। তার মৃত্যুর খবর পেয়ে দুপুরে রাজধানীর শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে অভিশ্রুতির লাশ গ্রহণ করতে আসেন শাবলুল আলম সবুজ নামের এক ব্যক্তি। তিনি নিজেকে অভিশ্রুতির বাবা হিসেবে দাবি করেন।
সবুজ জানান, শাস্ত্রীর আসল নাম বৃষ্টি খাতুন। আর মায়ের নাম বিউটি বেগম। তিনি এবং তার স্ত্রী বিউটি বেগমও ইসলাম ধর্মের অনুসারী। তবে বায়োডাটার তথ্য অনুযায়ী তার নাম অভিশ্রুতি, তিনি সনাতন ধর্মাবলম্বী। বাবার নাম অভিরূপ শাস্ত্রী আর মায়ের নাম অপর্ণা শাস্ত্রী। এতে তার পারিবারিক পরিচয় নিয়ে তৈরি হয় ধোঁয়াশা। আর পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তির কারণে অভিশ্রুতির লাশ হস্তান্তর নিয়ে সৃষ্টি হয় ধূম্রজাল।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে এমন চিত্র দেখা গেছে। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বার্ন ইনস্টিটিউটের অভ্যর্থনা কক্ষের সামনে অভিশ্রুতিকে নিজের মেয়ে বলে দাবি করছেন সবুজ। তবে জানতে চাইলে মেয়ের পেশা এবং ধর্মচর্চা নিয়ে কোনো তথ্যই দিতে পারছিলেন না তিনি। মেয়ের সঙ্গে তোলা কোনো ছবিও নেই তার কাছে। এ ছাড়া দুই দিন আগে অভিশ্রুতির সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে দাবি করলেও তার ফোনের কললিস্ট চেক করেও মেলেনি সে প্রমাণ। তবে সবুজের দাবি, ‘অভিশ্রুতি আমার মেয়ে। সে আমার তিন মেয়ের মধ্যে বড়। আমার আরও দুটি মেয়ে রয়েছে। নিজের মেয়েকে নিয়ে কেন মিথ্যা বলব?’
অন্যদিকে অভিশ্রুতির বায়োডাটায় দেখা গেছে, সেখানে তিনি বাবার নাম লিখেছেন অভিরূপ শাস্ত্রী এবং মায়ের নাম লিখেছেন অপর্ণা শাস্ত্রী। সিভিতে তিনি নিজের বর্তমান ঠিকানা লিখেছেন সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির, মৌচাক। ওই মন্দিরের সভাপতি উৎপল সাহা বলেন, ‘গত আট মাস ধরে তার সঙ্গে আমাদের পরিচয়। এই সময়ে তিনি আমাদের মন্দিরে অনেকবার এসেছেন। যে ভদ্রলোক (সবুজ) শাস্ত্রীকে নিজের মেয়ে বলে দাবি করছেন, তিনি মিথ্যা কথা বলছেন। তার পরিবারের সবাই ভারতের বানারসে থাকেন।’
এর আগে গতকাল সকালে বার্ন ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ জানায়, তাদের মর্গে এক হিন্দু নারীর মরদেহ আছে। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে অভিশ্রুতির সহকর্মী ও বন্ধুরা তার মরদেহ শনাক্ত করেন। পরে তার সাবেক সহকর্মী দ্য রিপোর্টের প্রতিবেদক গোলাম রব্বানী বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি ওই ভবনের একটি রেস্টুরেন্টে তিনি তার এক বন্ধুর সঙ্গে এসেছিলেন। গতকাল রাত থেকে তার ফোন বন্ধ ছিল এবং আমরা তার কোনো খোঁজ পাচ্ছিলাম না। আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশের হাতে থাকা লাল সুতো (মৌলি সুতো) দেখে অভিশ্রুতিকে শনাক্ত করি’।
নামে সংশয়, অভিশ্রুতি না বৃষ্টি!
ইডেন মহিলা কলেজের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন অভিশ্রুতি। ইডেন মহিলা কলেজের রাজিয়া হল শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন। তার সহপাঠীরা জানিয়েছেন, ইডেনে তিনি বৃষ্টি বণিক নামে পরিচিত ছিলেন। তাকে সবাই হিন্দু হিসেবে জানতেন। ক্যাম্পাসে, রুমে তিনি পূজা অর্চনাও করতেন। এক দিন রুমমেটরা ওর আইডি কার্ড দেখে জানলেন তার নাম আসলে বৃষ্টি খাতুন। তখন ওর সঙ্গে কারও কারও ঝামেলা তৈরি হলো। তার এক রুমমেট তাকে রুম থেকে বের করে দিলেন। তবে অভিশ্রুতি যেহেতু ভীষণ সরল মনের মেয়ে, তাই কেউ কেউ ওর পাশে দাঁড়ালেন। তার মুসলিম পরিচয়টা ওরাও পরবর্তী সময়ে গোপন রাখেন। বন্ধুদের কাছে অভিশ্রুতিই জানিয়েছিলেন, তিনি দীর্ঘদিন ভারতে ছিলেন। তখন একপর্যায়ে হিন্দু ধর্মের প্রতি তার এক ধরনের ভালোবাসা তৈরি হয়। ওই ধর্মের প্রতি তিনি অনুরাগী হয়ে ওঠেন। কলেজের বেশির ভাগ মেয়েই তাকে ভালোবাসতেন মিষ্টি আচরণের জন্য। কেউ কেউ কিছুটা সন্দেহ করতেন। কারণ হোস্টেলে মাঝে মাঝে তার বাবার পরিচয়ে একজন দেখা করতে আসতেন। অভিশ্রুতির গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলায়।
অভিশ্রুতি শাস্ত্রীর মৃত্যুর খবরের পরে বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মীরা বার্ন ইউনিটে ছুটে যান। সে সময় শাস্ত্রীর বাবা শাবলুল আলম সবুজ সাংবাদিকদের জানান, তার মেয়ে বৃষ্টি মৌচাকে একাই থাকত। তার সনাতন ধর্মের অনুসারী বন্ধুবান্ধব ছিল অনেক। তাদের সঙ্গেই বেশি ওঠাবসা ছিল। কিন্তু এখন সবাই বলছে, তার মেয়ে নাকি নিজেকে হিন্দু ধর্মের অনুসারী হিসেবে সবার কাছে পরিচয় দিয়েছে। এ কারণে চাকরির বায়োডাটায় তার বাবা এবং মায়ের নামেও নেই মিল! তবে রমনা কালীমন্দিরের সভাপতি উৎপল সাহার কাছে অভিশ্রুতি জানিয়েছিলেন, তার পরিবারের সবাই ভারতের বানারসে থাকেন। তবে শাস্ত্রীর জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন ও শিক্ষাগত সনদপত্রেও দেখা গেছে, তার আসল নাম বৃষ্টি খাতুন, বাবার নাম সবুজ শেখ এবং মায়ের নাম বিউটি বেগম। কর্তব্যরত পুলিশের এসআই আব্দুল জব্বার জানিয়েছেন, এনআইডিতে থাকা বৃষ্টির আঙুলের ছাপের বায়োমেট্রিক পরীক্ষায় অভিশ্রুতির আঙুলের ছাপও মিলেছে। সে হিসেবে অভিশ্রুতিকে বৃষ্টি খাতুন পরিচয়ে তার বাবা সবুজের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে।
যোগ দেওয়া হলো না নতুন কর্মস্থলে
চলতি মাসেই নতুন একটি কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার কথা ছিল সংবাদকর্মী অভিশ্রুতি শাস্ত্রীর। তিনি ইডেন মহিলা কলেজের দর্শন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। স্নাতকে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত হন। অনলাইন নিউজ পোর্টাল দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের হয়ে নির্বাচন কমিশন বিটে সংবাদ সংগ্রহে যুক্ত ছিলেন। গত জানুয়ারি পর্যন্ত সেখানেই কর্মরত ছিলেন। নির্বাচন কমিশন বিটে পরিচিত মুখ হয়ে উঠছিলেন অভিশ্রুতি। তার মৃত্যুতে শোকাহত নির্বাচন কমিশন বিটের সাংবাদিকরাও। তার মৃত্যুতে শোক ও পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন রিপোর্টার্স ফোরাম ফর ইলেকশন অ্যান্ড ডেমোক্রেসির (আরএফইডি) সভাপতি একরামুল হক সায়েম ও সাধারণ সম্পাদক মো. হুমায়ূন কবীর।
তার সহকর্মীরা জানান, অভিশ্রুতি শাস্ত্রী ও তাদের আরেক সাবেক সহকর্মী তুষার হাওলাদারসহ তিনজন ওই ভবনের একটি রেস্তোরাঁয় ডিনার করতে গিয়েছিলেন। মূলত তুষারের নতুন চাকরি পাওয়া উপলক্ষেই ছিল এই আয়োজন। অভিশ্রুতির সহকর্মীরা আরও জানান, সম্প্রতি অভিশ্রুতি ও তুষারের বাগদান হয়েছিল। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ডিআইইউ) থেকে সদ্য স্নাতক পাস করা তুষার স্টার টেক নামে একটি আইটি কোম্পানিতে ভিডিও জার্নালিস্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি ঝালকাঠিতে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গ থেকে তুষারের লাশ নিয়ে যান তার বাবা দীনেশ হাওলাদার।