নন পারফর্মিং লোন বা এনপিএলের সঠিক পরিমাণ নির্ণয় করতে না পারা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতা বলে মন্তব্য করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান।
রবিবার (২১ এপ্রিল) রাজধানীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে ‘ইজ দ্য বাংলাদেশ প্যারাডক্স সাসটেইনেবল’ শিরোনামে একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন দেশ-বিদেশ বরেণ্য এ অর্থনীতিবিদ।
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে বাংলাদেশের উন্নয়ন মডেল নিয়ে প্রকাশিত এ বইয়ে গত ১০ বছরের গবেষণাভিত্তিক তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশ উন্নয়ন ধাঁধা কি টেকসই হবে বা সরকারের চলমান উন্নয়ন মডেল কতটা টেকসই হবে?
অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, ঋণ পুনঃতফসিলীকরণের নামে অনাদায়ী ও খেলাপি ঋণের সঠিক পরিমাণ চেপে রাখা হচ্ছে। নতুন করে যে সংস্কার কর্মসূচি বাংলাদেশ ব্যাংক হাতে নিয়েছে, সেটিও এনপিএলের সঠিক চিত্র তুলে ধরতে সক্ষম হবে না। কারণ এখনকার সংস্কার কর্মসূচি অতীতের মতো যথার্থ অর্থবহ নয়। নব্বইয়ের দশকে সামান্য সংস্কার হয়েছিল। তখন ব্যাংকিং খাতে এনপিএল উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায়। তিনি বলেন, এখন যে এনপিএলের হিসাব দেওয়া হচ্ছে, তা হলো সেন্ট্রাল ব্যাংক ক্লাসিফিকেশন অব এনপিএল।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান বলেন, এনপিএল পরিমাণ তথা টক্সিক সম্পদ বেড়েছে। ব্যবসায়ীদের একটি প্রবণতা হলো দ্রুত ব্যবসার সংখ্যা বাড়ানো এবং এটি করার মাধ্যমে তারা নতুন ঋণ নেয়। এতে করেও নতুন ঋণটিও খেলাপি হয়ে পড়ে।
তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দক্ষতা বাড়াতে হবে। ব্যাংকগুলোতে নিয়মিত পারফরম্যান্স অডিট করতে হবে এবং সেগুলো আবার রুটিনমাফিক প্রকাশের ব্যবস্থাও করতে হবে।
দুর্নীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, করাপশন হলো অনেকটা ব্লাক বক্সের মতো। যখন আমরা ওর ভেতরটা দেখতে পাই না, তখনই বলি যে ওখানে দুর্নীতি হয়েছে।
প্যানেল আলোচক ওলস্টার বিজনিস স্কুলের অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান ওসমানী বলেন, সুশাসন ছাড়া উন্নয়ন ভালো বা টেকসই হয় না। সমস্যা হলো, আমাদের এখানে সুশাসন না থাকলেও বেশ কিছু ক্ষেত্রে ভালো উন্নয়ন হয়েছে। এটাকেই ডেভেলপমেন্ট প্যারাডক্স বলা হচ্ছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আর্থিক খাত, বিচার বিভাগ ও প্রশাসনে সুশাসন নষ্ট হয়েছে। অথচ, পোশাক খাতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে যা মূলত এসেছে শুল্ক মুক্ত কাঁচামাল আমদানি সুবিধার সূত্র ধরে।
অর্থনীতির শিক্ষক ড. এম এম আকাশ বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাষ্ট্র একটি বড় ফ্যাক্টর। এই স্টেট বা রাষ্ট্র কারা চালাচ্ছে, তারা হলো দুর্নীতিবাজ আমলা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী। এদের আবার নেক্সাস বা যোগসাজশ আছে। এ ছাড়া, এদেশের উন্নয়নে জিওপলিটিক্স বা ভূরাজনীতি দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভারত, চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের কিছুটা অংশের সমর্থন নিয়ে এদেশের উন্নয়ন চলছে। পশ্চিমারা এখানে খুব একটা নাই। যারা আছে তারা সরকারকে বলছে, ‘ভাই, চালিয়ে যাও আমরা আছি। টাকা লাগলে দেব।’
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান ড. জায়দী সাত্তার বলেন, এটা সত্যি যে আপনারা যেমনটি ভাবছেন প্রতিষ্ঠানগুলো তেমন হয়নি। তবুও বাস্তবতা হলো, দেশ এগিয়েছে। বহুমাত্রিক উন্নয়ন হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি এখানে কোনো প্যারাডক্স বা ধাঁধা নেই।
বইটির লেখক সাউথ এশিয়া নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান স্বাগত বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশে কি ধরনের উন্নয়ন হবে সে ব্যাপারে কোনো রাজনৈতিক ঐকমত্য নাই। সুতরাং এটি কতটা টেকসই হবে তা নিয়েই তিন বছরের গবেষণার ফলাফল এ বইতে স্থান পেয়েছে। বইটির কো-অথর অক্সফোর্ড পলিসি ম্যানেজমেন্টের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. ওমর সালাম এবং বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও বর্তমানে প্যারিস স্কুল অব ইকোনমিকসের প্রফেসর ইমেরিটাস ড. ফ্রাঙ্কোইজ বার্গোইগনন।