জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হওয়া এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের ২৩ নাবিককে উষ্ণ অভ্যর্থনার মাধ্যমে বরণ করা হয়েছে। দীর্ঘ ৬২ দিন নানা শঙ্কা ও উৎকণ্ঠায় কাটিয়ে অবশেষে চট্টগ্রামের ভূমিতে নেমেছেন নাবিকরা। চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি জেটিতে তাদের স্বজন, জাহাজের মালিকপক্ষ ও বন্দরের কর্মকর্তাদের আনন্দ উচ্ছ্বাসের অবতারণা হয়।
মঙ্গলবার (১৪ মে) বিকেল ৪টায় কেএসআরএম গ্রুপের অপর লাইটার জাহাজ এমভি জাহান মণি-৩ কুতুবদিয়া থেকে নাবিকদের নিয়ে বন্দরে আসে। জাহাজ ভেড়ার আগেই নাবিকরা ব্রিজের ওপর এসে হাত নাড়তে থাকেন। এদিক থেকে স্বজনরা হাত নেড়ে অভ্যর্থনা জানান। পরে ওই জাহাজের সঙ্গে একটি সিঁড়ি যুক্ত করা হলে একে একে ২৩ নাবিক নেমে আসেন। প্রথমেই নামেন জাহাজের ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদ।
নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে আবদুর রশিদ বলেন, ‘জীবন নিয়ে ফিরে আসব, সেটা কখনো ভাবিনি। নিজের ভেতরে ভয় ছিল, তবু সাহসের সঙ্গে জলদস্যুদের হ্যান্ডেল করেছি। জিম্মি হওয়ার দিন আমার বুকে একে ৪৭ রাইফেল ধরেছিল। আমার অন্য নাবিকরা ভয় পেয়ে যান। প্রথমেই আমি বলেছি আমরা মুসলিম, আমরা রোজা রেখেছি। তোমরা আমাদের ক্ষতি করো না। জলদস্যুরা আমাদের ওপর পরে তেমন খারাপ আচরণ করেনি। তারা সব সময় অস্ত্রে সজ্জিত অবস্থায় ছিল, যা দেখলে যে কেউ ভয় পাবে।’
বন্দরের জেটিতে নাবিকদের স্বজনরা উপস্থিত ছিলেন। ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভির আহমদের মা জ্যোৎসা বেগম ছেলের বউকে নিয়ে উপস্থিত হন। তাদের চোখেমুখে আনন্দের উচ্ছ্বাস। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা ছেলের জন্য উপস্থিত হয়েছেন মা। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ছেলের জন্য শিমের বিচি, গরুর মাংস, শুঁটকি রান্না করেছেন। কারণ তার ছেলে এগুলো পছন্দ করেন। বাসায় ফিরে তা দিয়ে ভাত খেতে দেবেন ছেলেকে।
বন্দরে উপস্থিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘জিম্মি হওয়ার পর থেকে আমরা খুবই বিচলিত ছিলাম। কখন কী হবে, আমাদের নাবিকরা ফিরে আসতে পারবেন কি না। কখন ফিরে আসবেন? সবকিছুর অবসান ঘটিয়ে তারা দেশে ফিরে এসেছেন। এটিই আমাদের বড় পাওয়া। সরকারের কূটনৈতিক পদক্ষেপের জন্য আজ তারা দেশে ফিরে এসেছেন। আজ আমি আনন্দিত। আবেগ ধরে রাখতে পারিনি বলেই আমি ছুটে এসেছি। আমি নাবিকদের সুস্থতা কামনা করি।’
এ সময় ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘এর আগে এত দ্রুত জাহাজ মুক্ত হয়নি। এ জাহাজ মুক্ত করার জন্য বিদেশি জাহাজ বলপ্রয়োগ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আমরা অনুমতি দিইনি। জাহাজের মালিকপক্ষ কবির গ্রুপও সেটা চায়নি। এতে জাহাজের নাবিকরা মৃত্যুর শঙ্কায় পড়তে হতো। আমরা নাবিকদের জীবনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ফলে শান্তিপূর্ণ সমাধানের মাধ্যমে আজ নাবিকরা আমাদের দেশে ফিরে এসেছেন। এটি আমাদের সমন্বিত প্রচেষ্টার ফসল। আমি ধন্যবাদ জানাই বন্দর কর্তৃপক্ষ, জাহাজের মালিক কেএসআরএম গ্রুপকে।’
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল বলেন, ‘নাবিকদের দেশে ফিরিয়ে আনতে পারা একটি বড় অর্জন। কারণ জলদস্যুরা খুব জঘন্য হয়, নির্যাতন ও মারধর করে। এর মধ্যে আমাদের নাবিকরা একেবারেই অক্ষত অবস্থায় ফিরে এসেছেন।’
মালিকপক্ষ কবির গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শাহরিয়ার জাহান বলেন, ‘আমাদের ভাইয়েরা দেশে ফিরে এসেছেন। এটি আমাদের দেশের জন্য বড় অর্জন। আমরা সমুদ্র জয় করেছি। এবার জিম্মি জাহাজের নাবিকদেরও জয় করেছি। কারণ নাবিকদের ফিরে আনা খুবই কঠিন একটা ব্যাপার ছিল। তবে আমরা যখন যেটি সরকারকে বলেছি তাতে দ্রুত সাড়া পেয়েছি। নাবিকরা দেশে ফিরেছেন, এটি দেশের জয়।’
কবির গ্রুপের প্রধান নির্বাহী (সিইও) মেহেরুল করিম বলেন, ‘জিম্মি হওয়ার পর থেকেই জাহাজ কীভাবে মুক্ত করব, সেই বিষয় নিয়ে কাজ শুরু করেছি। আন্তর্জাতিক সব অ্যাঙ্গেলে চেষ্টা করেছি জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগের। অবশেষে সফল হয়েছি। খুব কম সময়ের মধ্যে নাবিকরা ফিরে এসেছেন। আল্লাহর কাছে শোকরিয়া।’
এর আগে গত সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় জাহাজটি নোঙর করেছিল কুতুবদিয়ায়। মঙ্গলবার বিকেলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয় নাবিকদের। এরপর ২৩ নাবিক চলে যান পরিবারের কাছে।
প্রসঙ্গত, আফ্রিকার মোজাম্বিক থেকে ৫৬ হাজার মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে দুবাই যাওয়ার পথে গত ১২ মার্চ সোমালিয়ার জলদস্যুরা ২৩ বাংলাদেশি নাবিকসহ এমভি আবদুল্লাহ জাহাজটি জিম্মি করেছিল। গত ১৪ এপ্রিল ভোররাতে জাহাজটি জলদস্যুমুক্ত হয়। এ সময় ৬৫ জন জলদস্যু জাহাজটি থেকে বোটে নেমে যায়।
গত ২২ এপ্রিল বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা সোয়া ৭টার দিকে জাহাজটি দুবাইয়ের আল হামরিয়া বন্দরে ভেড়ে। কয়লা খালাস শেষে ২৭ এপ্রিল স্থানীয় সময় বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে নতুন ট্রিপের পণ্য লোড করতে ইউএইর মিনা সাকার বন্দরে যায় জাহাজটি। সেখান থেকে চুনাপাথর নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দেয় এমভি আবদুল্লাহ।
প্রায় ৬ মাস পর পরিবারের কাছে ফিরেছেন ২৩ নাবিক। গত ২৯ নভেম্বর এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে উঠেছিলেন তারা। কোরিয়া থেকে সিঙ্গাপুর হয়ে আফ্রিকার মোজাম্বিকে যায় জাহাজটি। ৪ মার্চ মোজাম্বিক থেকে আরব আমিরাতে যাওয়ার পথে ১২ মার্চ হাইজ্যাক হয় এটি।
৪ মার্চ থেকে টানা ৭০ দিন নাবিকদের সময় কাটে জিম্মিদশায়, নানা দুশ্চিন্তা-দুর্দশায়। নাবিকরা হলেন জাহাজের মাস্টার মোহাম্মদ আবদুর রশিদ, চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান, সেকেন্ড অফিসার মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, থার্ড অফিসার এন মোহাম্মদ তারেকুল ইসলাম, ডেক ক্যাডেট সাব্বির হোসাইন, চিফ ইঞ্জিনিয়ার এ এস এম সাইদুজ্জামান, সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. তৌফিকুল ইসলাম, থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. রোকন উদ্দিন, ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদ, ইঞ্জিন ক্যাডেট আইয়ুব খান, ইলেকট্রিশিয়ান ইব্রাহীম খলিল উল্লাহ এবং ক্রু মো. আনোয়ারুল হক, মো. আসিফুর রহমান, মো. সাজ্জাদ হোসেন, জয় মাহমুদ, মো. নাজমুল হক, আইনুল হক, মোহাম্মদ শামসুদ্দিন, মো. আলী হোসেন, মোশাররফ হোসেন শাকিল, মো. শরিফুল ইসলাম, মো. নুরুদ্দিন ও মো. সালেহ আহমদ।
এর আগে ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর আরব সাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল কেএসআরএম গ্রুপের এসআর শিপিং লিমিটেডের আরেকটি জাহাজ ‘এমভি জাহান মণি’। ওই জাহাজের ২৫ বাংলাদেশি নাবিকের পাশাপাশি এক ক্যাপ্টেনের স্ত্রীসহ ২৬ জনকে ১০০ দিন জিম্মি করে রাখা হয়েছিল। সরকারি উদ্যোগসহ নানা প্রক্রিয়ায় ২০১১ সালের ১৪ মার্চ জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হয়। ১৫ মার্চ তারা বাংলাদেশে ফিরে আসেন। সে সময় ৪০ কোটি টাকা মুক্তিপণ দেওয়া হলেও এবার কত টাকা মুক্তিপণ দেওয়া হয়েছে তা জানা যায়নি।