ঢাকা ২০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, সোমবার, ০৩ জুন ২০২৪

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের পথে!

প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৪, ১১:৩২ এএম
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের পথে!
আনু মুহাম্মদ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি একটি ধর্ষণের ঘটনায় জনমনে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। আমরা জানতে পেরেছি, যারা ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত তারা ছাত্রলীগের প্রভাবশালী নেতা। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, এটি আশ্চর্যজনক কোনো কিছু নয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এমন চিত্র প্রতিনিয়ত ঘটে যাচ্ছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটনাটি ঘটলেও আমরা যদি এ ক্ষেত্রে অপরাধীদের পরিচয়ের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করি, তাহলে দেখতে পাব যে তারা আরও অনেক অপরাধ ও অপকর্মের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। তাই এটা তাদের পক্ষ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। ছাত্রলীগ সংগঠনের ব্যানার ব্যবহার করে তারা অনেক অনৈতিক কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে যাচ্ছে।

তাহলে ছাত্রলীগ কী? নাম দেখলেই ছাত্রসংগঠনের আভাস পাওয়া যায়। কিন্তু এর বাইরেও তাকাতে হবে। তাদের সঠিকভাবে বর্ণনা করতে গেলে ভিন্ন চিত্র পাওয়া যায়। এটি কোনো ছাত্রসংগঠন নয়, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র শাখা। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রফ্রন্টের এমন প্রচলন এনএসএফ নামক আইয়ুব খানের আমলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে হুমকি, শারীরিক সহিংসতা এবং চাঁদাবাজির মাধ্যমে আতঙ্কিত করার রীতি ছিল। এনএসএফ গঠনের পেছনের কারণ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনো প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে দমন করা এবং তাদের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। অপরাধী সংগঠনের মতো কাজ করতে গিয়ে তারা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও পেয়েছিল। 

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর আমরা আশা করেছিলাম এই ধারার অবসান হবে। দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের জন্য তা ঘটেনি। ক্ষমতায় আসা প্রতিটি সরকারের ছাত্রফ্রন্টই গুন্ডাদের মতো আচরণ করে।  গত ১০ বছরে এখন এটি নতুন দানবে রূপ নিয়েছে। কারণ গত ১৫ বছরে, বিশেষ করে ২০১৪ সালের তথাকথিত নির্বাচনের পর থেকে সরকার কোনো জবাবদিহি বা সত্যিকারের বিরোধী দল ছাড়াই ক্ষমতায় এসেছে। এর ফলে ছাত্রসংগঠনগুলোও উদ্ধত আচরণ করছে। কোনো ধরনের জবাবদিহি ছাড়াই তারা তাদের খেয়ালখুশিমতো কাজ করতে পারে, এমন ধারণাই তাদের মধ্যে জন্ম নিয়েছে।

সরকার-সমর্থিত ছাত্রসংগঠনের প্রকৃত কর্মকাণ্ড কী? তারা ছাত্রদের আবাসিক হলগুলোয় অত্যাচারের বড় একটা পরিবেশ সৃষ্টি করে। হলগুলোতে তাদের টর্চার রুম আছে। তাদের ইচ্ছামতো যেকোনো ছাত্রকে ডেকে নিয়ে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত হয়রানি করে থাকে। ছাত্ররা যখন প্রথম বর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে, তখন তারা সিনিয়র ছাত্রদের কাছ থেকে স্নেহপূর্ণ অভ্যর্থনা আশা করে। এর পরিবর্তে তারা নিষ্ঠুর মানসিক ও শারীরিক হয়রানির সম্মুখীন হয়। তাদের অত্যাচার এবং হয়রানি এতটাই তীব্র হয় যে, অনেক শিক্ষার্থী তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে না। নতুনদের ‘গণরুম’-এ রাখা হয়। অথচ অনেক কক্ষ অবৈধভাবে ছাত্রলীগ নেতাদের দখলে থাকে। গণরুমে থাকাবস্থায় তারা সঠিকভাবে ক্লাসে উপস্থিত হতে পারে না এবং পড়াশোনা বাধাগ্রস্ত হয়। ছাত্রলীগ নেতাদের অমানবিক আচরণের শিকার হয় গণরুমের ছাত্ররাই। 

এসব নেতা ক্যাম্পাসের মধ্যে অবস্থিত বা এর আশপাশের দোকান এবং বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে অর্থ আদায় করে থাকে। তারা বিভিন্ন রেস্তোরাঁ বা হলের ক্যানটিনে বিনা পয়সায় খায় এবং ইচ্ছামতো সংগঠনের নামে চাঁদাবাজি করে। এর ফলে খাদ্য ও অন্যান্য পণ্যের মান খারাপ হয় এবং নিয়মিত শিক্ষার্থীদের জন্য দামও বৃদ্ধি পায়। তারা প্রতিটি নির্মাণকাজের কমিশন থেকে বড় আয় পেতে চরম ক্ষুধার্ত থাকে। ফলে নির্মাণকাজের গুণমান কমে যায় এবং একই সঙ্গে খরচ বেড়ে যায়। সরকার কোনো প্রয়োজন বিবেচনা না করেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণকাজে বিপুল অর্থ বরাদ্দ করে থাকে।

মনে হচ্ছে, এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য নয় বরং কিছু ঠিকাদারকে ব্যবসা দেওয়ার জন্য এবং কমিশনপিপাসু গোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ করা হয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অপরিকল্পিত ও নিম্নমানের নির্মাণকাজ হয়ে থাকে। তাদের কর্মকাণ্ড সেখানেই শেষ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ও বাইরে তারা রিকশা, বাস, দোকান থেকে এমনকি দর্শনার্থীদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়। কখনো কখনো তারা জমি দখলকারী বা বড় অপরাধীদের ভাড়া করা গুন্ডা হিসেবে কাজ করার প্রস্তাব গ্রহণ করে থাকে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক প্রশাসন থাকা অবস্থায় তারা কীভাবে এ ধরনের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে? না, প্রশাসনের কোনো ভূমিকা নেই, তারা কিছুই দেখছে না। আবাসিক হলগুলোতে ছাত্রলীগ বেশির ভাগই নিয়ন্ত্রণ করে আসন বণ্টনসহ হল প্রশাসনকে। প্রকৃতপক্ষে হল ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সব সময় তাদের খুশি রাখার চেষ্টা করে। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, কিছু তথাকথিত শিক্ষক আছেন, যারা তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। চাঁদাবাজি থেকে আদায় করা অর্থ এবং নির্মাণকাজসহ অন্যান্য বিষয়ে কমিশন পাওয়া টাকাও মাঝেমধ্যে ভাগাভাগি করে নেন তারা।

তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন ধরনের কর্মী, কর্মচারী বা কর্মকর্তা নিয়োগ করাটাও এক ধরনের ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। ছাত্রলীগ ও প্রশাসনে তাদের দোসররা এটা নিয়ন্ত্রণ করে এবং পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াকে প্রহসনে পরিণত করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রশাসন, প্রভোস্ট, প্রক্টররা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনকে সরকারেরই একটা অংশ হিসেবে বিবেচনা করে। বাস্তবে ছাত্রলীগ নেতারা ক্ষমতাসীন দলের মতো আচরণ করে- যারা কোনো জবাবদিহির পরোয়া কখনো করে না। অন্যটি হলো এই ছাত্রসংগঠনের কমিটি গঠন-প্রক্রিয়ায় যেখানে নির্বাচন নেই, জনগণের অংশগ্রহণ নেই। সব অফিসের নিয়োগ ওপর থেকেই করা হয়। দলীয় নির্দেশে তাদের নিয়োগ ও পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়। ছাত্রলীগ কমিটির এই পদগুলোও বিপুল অর্থের বিনিময়ে ছিনিয়ে নিতে হয়। 

প্রশাসন ছাত্রনেতাদের বিভিন্ন কাজে যুক্ত করে থাকে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক উপাচার্যের সময়ে ছাত্র-শিক্ষকরা ঐক্যবদ্ধভাবে অপরিকল্পিত ও দুর্নীতিগ্রস্ত মেগা নির্মাণকাজের প্রতিবাদ করে আসছিলেন। সাধারণ ছাত্রদের দাবি ছিল, সুচিন্তিত পরিকল্পনার আওতায় নির্মাণকাজ হোক, যাতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের জীবন, প্রকৃতি ও পরিবেশ অক্ষুণ্ন থাকে। একপর্যায়ে উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

উপাচার্য বিষয়টি সুরাহা না করে ছাত্রলীগকে ব্যবহার করে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের ওপর হামলা চালান। এমনকি শিক্ষকদেরও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। এই অপরাধমূলক হামলার করার জন্য ছাত্রলীগ নেতাদের অভিনন্দন জানিয়েছেন উপাচার্য। উপাচার্যের যাবতীয় অন্যায়-অপরাধ সবার সামনে চলে এল। ভিসিসহ অন্যদের বিরুদ্ধে চরম দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও সরকার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এমনকি ঘটনা তদন্তে কমিটিও গঠন করেনি। বরং যারা অভিযোগ করেছে তাদের হুমকি দেওয়া হয়েছে। তাই সরকার, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও ছাত্রলীগের মধ্যে একতা থেকে অপরাধ করে বলেই এত সমস্যার সৃষ্টি হয়। এর চূড়ান্ত শিকার হচ্ছে তরুণ প্রজন্ম। 

বর্তমান প্রশাসন অতীতের দুর্নীতি ও অপরাধেরই ধারাবাহিকতা। তাই এই রকম চাঁদাবাজি, হুমকি, শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন এবং নিয়মনীতির প্রতি চরম অবহেলা অনিয়ন্ত্রিতভাবে চলতেই থাকে। সংগঠনের পজিশন পেতে তারা যে অর্থ প্রদান করে তা পুনরুদ্ধার করতে এবং আরও অর্থ ও ক্ষমতার লোভে এসব শিক্ষার্থী ছাত্র হওয়ার পরিচয় সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে ফেলে। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তাদের দুর্ভাগ্যজনক রূপান্তর দেখে আমি ব্যথিত। তাদের বাবা-মা এখানে পড়াশোনা করতে পাঠান। অথচ তারা অপরাধী হয়ে ওঠে। কারণ সরকার এবং প্রশাসনের সহায়তায় এই শিক্ষার্থীরা পৃষ্ঠপোষকতা পায় এবং তাদের স্বার্থ রক্ষা করে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯৮ সালে প্রথম যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। সেই আন্দোলনের ফলে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করা হয়। আন্দোলনের একটা অংশ যা এখনো এর শক্তির উৎস হয়ে আছে। সে কারণে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন দরকার। কিন্তু আন্দোলন বা সংগ্রাম না করলে এসব অভিযুক্ত শিক্ষার্থী পুনর্বাসন পাবে। 

সারা দেশে আমরা ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির অনেক কথাই শুনি। অতি সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ঘটেছে তা মেনে নেওয়া যায় না। অতীতে যেসব ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর শাস্তি হলে পুনর্বার এমন ঘটনা ঘটত না। তাদের বেশির ভাগই শাস্তি পায়নি। সবার সামনে দৃশ্যমান হয় যে, এরা কখনো ন্যায়বিচারের দাবি করলেও বিচার পায়নি। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা, কারখানা, কর্মক্ষেত্রে নারী বা পুরুষের যেকোনো অপরাধের বিরুদ্ধে জনসাধারণের প্রতিরোধ করা বিশেষ প্রয়োজন। 

লেখক: শিক্ষাবিদ

সরকার গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করে না

প্রকাশ: ০২ জুন ২০২৪, ১১:২৪ এএম
সরকার গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করে না
তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত

তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেছেন, সরকার গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করে না। মুক্ত গণমাধ্যমের ব্যাপারে তার সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা তুলে ধরে তিনি আরও বলেন, পেশাদার সাংবাদিকদের সঙ্গে একমত হয়ে গণমাধ্যমে শৃঙ্খলা আনার অঙ্গীকার করেছি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি সম্পর্কে প্রতিমন্ত্রী বলেন, বিএনপি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল দল হলেও তাদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপপ্রচার ও মিথ্যাচার কাউন্টার করা আওয়ামী লীগের নৈতিক দায়িত্ব। গত সোমবার নিজ মন্ত্রণালয়ে তার অফিস কক্ষে দৈনিক খবরের কাগজকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন মোহাম্মদ আলী আরাফাত। এ সময় তিনি বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী নিয়ে জার্মান সম্প্রচারমাধ্যম ডয়চে ভেলের প্রতিবেদনকে উদ্দেশ্যমূলক বলে দাবি করেন এবং মানবাধিকার প্রশ্নে সত্যিকার অর্থে সংবেদনশীল হলে গাজায় গণহত্যা নিয়ে ডয়চে ভেলেকে তথ্যচিত্র তৈরির আহ্বান জানান। প্রতিমন্ত্রী এ সময় আরও বলেন, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খবরের কাগজের বিশেষ প্রতিনিধি আবদুল্লাহ আল মামুন

খবরের কাগজ: প্রথমবারের মতো মন্ত্রী (প্রতিমন্ত্রী) হয়েছেন, এই ‘ইয়াং’ বয়সে আপনার কেমন লাগছে? 

মোহাম্মদ আলী আরাফাত: (হাসতে হাসতে) একান্ন বছর বয়স যদি মনে হয় ইয়াং, তাহলে ইয়াং। আমি তো মনে করি বাংলাদেশে আমার চেয়ে কম বয়সে অনেকে মন্ত্রী হয়েছেন। আপনি যদি দেখেন ২০০৯ সালের কেবিনেটে আজ থেকে ১৫ বছর আগে যারা মন্ত্রী হয়েছিলেন তাদের সবার বয়স এই মুহূর্তে আমার যা বয়স (হাসতে হাসতে), তার চেয়ে কম ছিল। ওই হিসাবে দেখলে ইয়াং বয়সে মন্ত্রী হয়েছি তা বলা যাবে না।     

খবরের কাগজ: আমরা যারা আওয়ামী লীগের সংবাদ সংগ্রহ করি, তারা কয়েক বছর আগেও (বিরোধী দলে থাকার সময়) আবদুল মান্নান (প্রয়াত), সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ, মাহমুদুর রহমান মান্না ও আক্তারুজ্জামান সম্পর্কে বলতে শুনেছি তারা দলের ‘তরুণ নেতা’। সেই বিবেচনায় আপনাকেও ‘ইয়াং’ বলা হচ্ছে। 

মোহাম্মদ আলী আরাফাত: সেটা ঠিক আছে (হাসতে হাসতে)। কিন্তু যদি আমরা একটু ‘স্ট্যাটিক্স’ (পরিসংখ্যান) দেখি মন্ত্রিত্ব গ্রহণের জায়গা থেকে তাহলে দেখা যাবে, ২০০৯ সালের কেবিনেটে অনেক মন্ত্রী ছিলেন। আমাকে আবারও বলতে হয়, যাদের বয়স এই মুহূর্তে আমার যে বয়স (৫১  বছর) তার চেয়ে কম ছিল এবং এই কেবিনেটেও আমার চেয়ে কম বয়সের কয়েকজন আছেন। তারপরও আপনারা ইয়াং বলতে চাচ্ছেন এটা শুনে ভালোই লাগছে (হাসতে হাসতে)। খারাপ নয়, যত দিন ইয়াং থাকা যায়।     

খবরের কাগজ: এটা (তথ্য ও সম্প্রচার) তো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়, এখানে আপনার কেমন লাগছে?    

মোহাম্মদ আলী আরাফাত: বিষয়টি হচ্ছে, আসলে ধরুন তথ্য রিলেটেড (সংশ্লিষ্ট) যে রাজনীতি তার সঙ্গে আমার সংশ্লিষ্টতা সব সময় ছিল। কখনো সামনে কখনো পেছনে এর সঙ্গে আমি ইনভলব (যুক্ত) ছিলাম। তার কারণ হচ্ছে যে, আমি দেখেছি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের শক্তি, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ, তারা সব সময় ইতিবাচক রাজনীতি করেছে এবং অপতথ্যের কাছে ‘ভিক্টিম’ হয়েছে। আমার যে বেড়ে ওঠা, রাজনীতি নিয়ে বোঝা- ‘মিড এইটিজ-লেট এইটিজে’ আমি দেখেছি ’৭২-৭৫ সালের এই সময় বঙ্গবন্ধুর শাসনামল নিয়ে এত অপপ্রচার, মিথ্যাচার হয়েছে এবং এমনভাবে হয়েছে ‘সিস্টেমেটিক, দেশি এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র এর পেছনে ছিল। 

যারা বাংলাদেশবিরোধী অপশক্তি তারা এটা করে একটা জেনারেশনের মাথায় কিছু মিথ্যা জিনিস ঢুকিয়ে দিয়েছে। তখন থেকে আমার মনে হতো যেহেতু আওয়ামী লীগ সুস্থ এবং ইতিবাচক রাজনীতি করে, সে কারণে আওয়ামী লীগের একটা দুর্বলতা ছিল এই অপতথ্যকে মোকাবিলা করা। তখন থেকেই মনে হতো এই জায়গাটা খুব জরুরি যে অপতথ্যকে ফাইট আউট (পরাস্ত) করা। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ প্রোটেক্টেড (সুরক্ষিত) হবে, বঙ্গবন্ধু প্রোটেক্টেড হবেন এবং তার যে স্বপ্ন সোনার বাংলা তৈরি করা সেটা তখনই তিনি (বঙ্গবন্ধু) এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন। এ জন্য আমি আমার জায়গা থেকে সব সময় ‘কন্ট্রিবিউট’ করার চেষ্টা করেছি। অপতথ্যের বিপক্ষে ফাইট করার জায়গা থেকে মুক্তিযুদ্ধের যে বিপক্ষ শক্তি তার বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। 

এখন মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পেয়েছি। একটা ফরমাল সেটিংসের মধ্যে একই কাজ, এখানে আরও বৃহত্তর পরিসরে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের মধ্যে একটা সুস্থ-সুন্দর পরিবেশ তৈরি করা এবং আপনি জানেন যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা গণমাধ্যমের পরিসর গত ১৫ বছরে বৃদ্ধি করেছেন। ফলে এর ব্যাপ্তি অনেক বেড়েছে। ব্যাপ্তি বাড়ার ফলে এটা উন্মুক্ত হয়ে গেছে। মুক্ত গণমাধ্যম নয়, এখন এটা উন্মুক্ত গণমাধ্যম। গণমাধ্যমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যারা তারাই বলছেন, এখানে একটু শৃঙ্খলা আনতে হবে, ডিসিপ্লিন আনতে হবে, কিছু মানদণ্ড তৈরি করতে হবে। কারণ যে কেউ সাংবাদিক হয়ে আসেন। পেশাদারত্বের সঙ্গে যারা সাংবাদিকতা করেন, তারাই বলছেন তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তো এখন আমার মনে হয়, দ্বিতীয় প্রজন্মের যে ইস্যুগুলো, সেগুলো আমাদের ডিল করে আরও সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। সেগুলোই করার চেষ্টা করছি।        

খবরের কাগজ: আপনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বললেন। তার মধ্যে আওয়ামী লীগ এবং সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের প্রসঙ্গ রয়েছে, এটা দীর্ঘদিন ধরে আসছে। বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী নিয়ে জার্মান সম্প্রচারমাধ্যম ডয়চে ভেলে যে প্রতিবেদন প্রচার করেছে, সে সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?

(র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) গোয়েন্দা শাখার কিছু সদস্য যাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের রেকর্ড আছে, তাদের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে মোতায়েন করা হয়েছিল বলে জার্মান সম্প্রচারমাধ্যম ডয়চে ভেলের সাম্প্রতিক একটি তথ্যচিত্রে অভিযোগ করা হয়েছে।)

মোহাম্মদ আলী আরাফাত: আমি দেখেছি। আমি মনে করি ন্যূনতম বোধবুদ্ধি আছে এ রকম যেকোনো মানুষের জন্য এটা বুঝতে কোনো অসুবিধা হবে না। ডিডব্লিউ (ডয়চে ভেলে) যদি মানবাধিকারের প্রতি ‘কমিটমেন্ট’ থেকে রিপোর্ট করে থাকে তাহলে আমার কিছু বলার নেই। ডিডব্লিউ যদি তার দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা পূর্ণাঙ্গ ভোগ করে এবং মানবাধিকারের অঙ্গীকার থেকে রিপোর্টটি করে থাকে, তাহলে আমি তাকে অ্যাপ্রিসিয়েট করব। সে আমার বিপক্ষে গেলেও। কিন্তু গণমাধ্যম হিসেবে তার (ডয়চে ভেলে) যে স্বাধীনতা আছে এবং মানবাধিকারের প্রতি প্রতিষ্ঠানটি অঙ্গীকারবদ্ধ, তার যে ‘কমিটমেন্ট’ আছে এবং এটি যে ‘জেনুইন’ তার প্রমাণটা ডয়চে ভেলে দিয়ে দিক। 

আমি তাদের আহ্বান জানাব যে, ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ) গাজায় যে ন্যক্কারজনকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে, জেনোসাইড করছে ডিডব্লিউ সেই জেনোসাইড এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি করুক (তথ্যচিত্র), করে চালাক। এতে দুটি জিনিস প্রমাণ হবে। এক. জার্মানিতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আছে। কারণ আমরা জানি জার্মান সরকারের অবস্থান এখানে কী। তারা হামাসের এক্সকিউজ ব্যবহার করে ইসরায়েলের যে গণহত্যা তাকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করে। সুতরাং দেখি তাদের স্বাধীনতা আছে কি না। দুই. যেটা দেখতে চাই সেটা হচ্ছে, মানবাধিকারের প্রশ্নে তাদের কমিটমেন্ট কতটুকু আছে। সেটাও প্রমাণিত হবে। 

এটা আরও আগে করা দরকার ছিল। এটা যদি তারা করতে না পারে, তখন কী মনে হবে? তারা বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার অতীত ইতিহাস যে টেনে এনেছে, সেই কবেকার ঘটনা- সেটাকে এনে শ্রীলঙ্কার যে বাস্তবতা, যেখানে সিভিল ওয়ার চলছিল। তার সঙ্গে বাংলাদেশের একটা স্টেবল গভর্নমেন্ট অপারেট করছে তাকে মিলিয়েছে। এ থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, এটা মোটিভেটেড, সিন্ডিকেটেড, সিস্টেমেটিক একটা অপপ্রচারের অংশ হিসেবে করেছে ডয়চে ভেলে। কিন্তু আমি তারপরও তা মেনে নেব, ডয়চে ভেলে যদি গাজার গণহত্যা এবং মানবাধিকার নিয়ে একটা তথ্যচিত্র করে।       

খবরের কাগজ: ডয়চে ভেলের এই যে অপপ্রচার, সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া কিংবা প্রতিবাদ করা হবে কি?  

মোহাম্মদ আলী আরাফাত: না, এই ব্যাখ্যা তো বাংলাদেশ ও গোটা বিশ্বের মানুষ জানেই। গাজায় যে গণহতা চলছে, ডয়চে ভেলে আইডিএফের বিরুদ্ধে একটা কথা বলেছে? তাদের তো কোনো ক্রেডিবিলেটিই নেই। এত নারী-শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে, হাসপাতালে আক্রমণ হচ্ছে, ডয়চে ভেলে কি এগুলো তুলে ধরেছে? তার তো সত্য বলার সেই স্বাধীনতাই নেই, মানবাধিকারের বিষয়ে অঙ্গীকারও নেই। তাই তাদের ক্রেডিবিলেটিই নেই। কাজেই তারা কী বলল তা কেউ বিশ্বাস করবে কেন? এটা নিয়ে কথা বলা বাতুলতা।

খবরের কাগজ: আপনি সাংবাদিকতায় শৃঙ্খলার কথা বলেছেন। এ নিয়ে আপনার একটা পর্যবেক্ষণ রয়েছে। এ বিষয়ে আপনি কী চিন্তা করছেন?

মোহাম্মদ আলী আরাফাত: সাংবাদিকতায় শৃঙ্খলা আনার যে বিষয় সেটা আমি বলছি না। এটা পেশাদার সাংবাদিকরা বলছেন। তাদের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হয়ে ‘অ্যাড্রেস’ করার জন্য অঙ্গীকার করেছি। পেশাদার ২৩টি সংগঠনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে সাংবাদিকতায় শৃঙ্খলা আনার জন্য কী করা যায়, সেটা করা হবে। তবে এটা সরকার আলাদাভাবে করবে না। তাদের (পেশাদার সাংবাদিক) সুপারিশ ও চিন্তাধারার ভিত্তিতে করা হবে।  
  
খবরের কাগজ: শুধু সরকারই নয়, ডিজিটাল মাধ্যমে ব্যক্তির বিরুদ্ধেও অনেক ধরনের অপপ্রচার হয়, তথ্য মন্ত্রণালয় এ ক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপ নেবে কি না? 

মোহাম্মদ আলী আরাফাত: এটা একটা ভালো প্রশ্ন করেছেন। এখানে আমরা যেটা প্ল্যান করছি, প্রেস কাউন্সিলকে আমরা আরও শক্তিশালী করব। প্রেস কাউন্সিলের একটা আইন নিয়ে আমরা আলাপ করছি। সেখানে আমরা গণমাধ্যমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পেশাদার এবং সিনিয়র সাংবাদিক যারা আছেন তাদের মতামত নেব। একই সঙ্গে পিআইডির অধীনে একটি ‘ফ্যাক্ট চেকিং বডি’ ক্রিয়েট করার কথা ভাবছি। এই বডিটা অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে অর্থাৎ ইনক্লুসিভ। এটা সরকারি উদ্যোগ হলেও শুধু সরকারি লোকজন থাকবে না। 

প্রাইভেট সেক্টরে যারা শুভ চিন্তা করেন, কমিটেড, অর্থাৎ কমিটমেন্ট যাদের আছে তাদেরও আমরা ইনক্লুড করব। এটা এখনো দাঁড়ায়নি পুরোপুরি, প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। এমন একটা সিস্টেম করতে চাই যে, গণমাধ্যমে যদি কোনো অপপ্রচার হয়, আনপ্রফেশনাল মোটিভেটেড জার্নালিজম হয়, তার কারণে যদি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে সে যাতে প্রতিকারের একটা জায়গা পায়। এই প্রতিকারের জায়গাটা আমরা তৈরি করব প্রেস কাউন্সিল এবং ‘ফ্যাক্ট চেকিং বডি’র একটা কো-অর্ডিনেশনের মাধ্যমে। এটা একতরফা সরকার করবে না। 

কাউকে এক্সক্লুড করে করব না, সবাইকে ইনক্লুড করে করব। কারণ সবাই একমত হয়েছেন যে অপপ্রচার, অপসাংবাদিকতা, মিথ্যাচার ভালো নয়। এটা বন্ধ করতে হবে। যারা একমত হয়েছেন, তাদেরই আমি ইনক্লুড করব। তাদের অনেকে সরকারের ক্রিটিকও আছেন। তাদেরও ইনক্লুড করব। যাতে এটার একটা ক্রেডিবিলেটি থাকে। এই প্রতিষ্ঠানের ওপর কনফিডেন্স থাকে এবং এই প্রতিষ্ঠান যখন যাচাই-বাছাই করে একটা বক্তব্য দেবে, তখন এর গ্রহণযোগ্যতা থাকবে। আমরা জেনুইনলি এটা করতে চাই। 
       
খবরের কাগজ: আপনি সৎ উদ্দেশ্যের কথা বলছেন। কিন্তু এর আগেও আমরা দেখেছি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যা সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট বলা হচ্ছে, সে নিয়েও সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক কথা বলা হয়েছিল।   

মোহাম্মদ আলী আরাফাত: এ নিয়ে বহুবার বলেছি। ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট’ নিয়ে আর কথা বলার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে করি না। কারণ এটা এখন আর নেই। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ছিল যখন, তখন কিছু ‘প্রব্লেমেটিক প্রভিশন’ ছিল। সাংবাদিকতা করতে গিয়ে যদি ‘ডিফেমেশ’ করেন, তাহলে জেলে নেওয়ার একটা প্রভিশন ছিল এবং জেলে নেওয়ার পর জামিনেরও ব্যবস্থা ছিল না। সে ক্ষেত্রে সেটা অপব্যবহারের বড় একটা সুযোগ তৈরি হয়েছিল। এটা (জেলে নেওয়া) এখন আর নেই। এটা এখন হয়ে গেছে সিএসএ (সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট)। এখানে ডিফেমেশনের ক্ষেত্রে জেলের কোনো বিষয় নেই এবং জামিনের বিষয়টি একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। 

অর্থাৎ বিশাল ডেভেলপমেন্ট হয়ে গেছে। কিন্তু প্রতিকারের ব্যবস্থা রাখা আছে, অপব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। অপব্যবহারের সুযোগ কেন নেই, কারণ আপনি জেলে নিতে পারছেন না। এখনো যদি কেউ ভুক্তভোগী হন, তাহলে তিনি মামলা করতে পারবেন। যার বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে, তিনি আবার লড়তে পারবেন। সর্বোচ্চ আদালতে গিয়ে যদি অপরাধ প্রমাণিত না হয়, তাহলে তিনি মুক্তি পেয়ে যাবেন। আবার কেউ যদি দোষী প্রমাণিত হন, তাহলে তাকে জরিমানা করা যাবে। তাও আবার ২৫ লাখ টাকার নিচে, যা বিচারক নির্ধারণ করবেন। সেটাও নির্ধারিত হবে তার (অভিযুক্তের) অপরাধের ওপর ভিত্তি করে। 

কারও বিরুদ্ধে জরিমানা ৫ টাকা হতে পারে, ১০ টাকাও হতে পারে, আবার ৫ লাখ টাকাও হতে পারে। এমনকি জরিমানা ২৫ লাখ টাকাও হতে পারে। তবে ২৫ লাখ ১ টাকা হতে পারবে না। যদিও পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ‘সিভিল’ মামলায় ‘আনলিমিটেড ফাইন’-এর ব্যবস্থা আছে। কিন্তু বাংলাদেশে একটি ‘ব্যালেন্সড’ আইন করা হয়েছে। এখানে দুই পক্ষেরই প্রটেকশন আছে। যিনি প্রতিকার চাচ্ছেন তার প্রটেকশন আছে, সাংবাদিকদেরও প্রটেকশন আছে।
        
খবরের কাগজ: তারপরও বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে, মানুষের বাকস্বাধীনতা নেই। সরকার কণ্ঠ স্তব্ধ করে রেখেছে। গণমাধ্যমেরও স্বাধীনতা নেই। 

মোহাম্মদ আলী আরাফাত: যদি কণ্ঠ স্তব্ধ থাকে তাহলে এ কথা বলছে কীভাবে? কণ্ঠই স্তব্ধ থাকত। এই যে বলছে স্বাধীনতা নেই। এটা কোন সমাজে বলতে পারে। উত্তর কোরিয়ায় কিংবা ইরানে বলতে পারে? যদি বলি চীন বা রাশিয়া- দেশ দুটিতে বলতে পারে? এটা বলতে পারে কোথায়- আমেরিকা, ইউরোপ, ইন্ডিয়া ও বাংলাদেশে বলতে পারে। এতেই তো বোঝা যায়, সারা দিন ধরে কথা বলে তারপরও অভিযোগ করে কথা বলতে পারি না। তবে একটা জায়গায় রশি টেনে ধরা আছে। 

তা হচ্ছে মিথ্যা কথা বলার ক্ষেত্রে কিছু অ্যাকাউন্টেবল করা আছে। অপপ্রচার, অপতথ্যের ক্ষেত্রে কিছু আইনের ব্যবস্থা আছে। সেটা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে আছে, আমেরিকাতেও আছে, পৃথিবীর সব দেশেই আছে। আমার মিথ্যা বলার স্বাধীনতা নেই, অপপ্রচারের স্বাধীনতা নেই, এটাই সত্যি। আইনে তা আটকে দেওয়া আছে। সঠিক তথ্য এবং প্রচারের স্বাধীনতা নেই, এটা বলার কোনো সুযোগ নেই। কারণ এটা আছে এবং বলছেও সবাই। 

খবরের কাগজ: বিএনপি ১৭ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে। তারপরও সরকারি দলের নেতা এবং মন্ত্রীরা এই দলটিকে নিয়ে প্রতিদিনই কোনো না কোনো মন্তব্য করছেন। কেন করছেন, তার কি প্রয়োজন আছে? 

মোহাম্মদ আলী আরাফাত: বিএনপি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলে। আমি জানতে চাচ্ছি, গত ১৫ বছরে কয়জন এডিটর জেলে গেছেন? বিএনপির কি লাজশরম নেই। যারা ২১ আগস্টের মতো ঘটনা ঘটায়, বিরোধী দলের নেতাকে গ্রেনেড মেরে উড়িয়ে দিতে চায়- তারা এখন গণতন্ত্রের কথা বলে। দেশের মানুষ ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের ইতিহাস জানে। জিয়াউর রহমান, যিনি মার্শাল ল দিয়ে ক্ষমতায় আসেন। যে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি ও চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর, সেটা কি গণতন্ত্র ছিল? দলটির প্রতিষ্ঠাতাই তো রাজনীতির মধ্যে ঢুকে পড়া একজন মিলিটারি শাসক। তাদের মুখে এখন গণতন্ত্রের কথা শুনতে হয়। 

পরবর্তী সময়ে খালেদা জিয়ার আমলে কী হয়েছিল, তাও তো আমরা জানি। তারা একুশে টেলিভিশনকে বন্ধ করে দিয়েছিল। বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমের সঙ্গে তাদের যে আচরণ দেখেছি সেই তুলনায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার গত ১৫ বছরের শাসনামলে এত যে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার আত্মপ্রকাশ ঘটেছে, এত হলো কীভাবে? যদি গণমাধ্যমবিরোধী অবস্থান সরকারের থাকত! সরকার যদি গণমাধ্যমকে কন্ট্রোল করতে চাইত, তাহলে তো সংখ্যা বাড়ত না। কারণ সংখ্যা বাড়লেই তা কন্ট্রোল করা জটিল হয়ে যায়। কাজেই সংখ্যা বাড়ানোর এ চিত্র থেকেই প্রমাণিত বঙ্গবন্ধুকন্যা গণমাধ্যমকে অবারিত করেছেন। আর এই অবারিত করতে গিয়ে মুক্ত নয়, উন্মুক্ত হয়ে গেছে। এটাকে শৃঙ্খলায় আনার জন্য এখন আপনারাই (সাংবাদিকরা) বলছেন। মুক্ত থেকে উন্মুক্ত হয়ে বিশৃঙ্খল হয়ে গেছে। তারপরও যদি বলা হয় কথা বলতে পারছে না, তাহলে এটা বলার জন্য বলা। যুক্তি ও তথ্য এটা সমর্থন করে না।  

খবরের কাগজ: রাজনীতিতে বিএনপিকে এখন কি প্রাসঙ্গিক মনে করেন? 

মোহাম্মদ আলী আরাফাত: বিএনপির অস্তিত্ব তো আছে এবং তারা অ্যান্টি আওয়ামী লীগ ‘পলিটিক্স’ করে। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস। স্বাধীনতার এই ঘোষণা বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন। তার বিপরীতে বিএনপি একটা ‘ক্যারেক্টার’ তৈরি করেছে জিয়াকে। যে (প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান) বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে, তাকে ‘ঘোষক’ বানিয়ে একটা বিপরীত ইতিহাস দাঁড় করিয়েছে। জয় বাংলার বিপরীতে তারা জিন্দাবাদ দাঁড় করিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বলতে গেলে তারা ৭ মার্চ, ১৭ এপ্রিলের কথা বলে না। ইতিহাসকে বিকৃতি করা বিএনপির রাজনীতি। 

এ ছাড়া জামায়াতের সঙ্গে তাদের গাঁটছাড়া বাঁধা এবং ৩০ লাখ শহিদ হয়েছে কি না- খালেদা জিয়া সংশয় প্রকাশ করেন। এই যে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনীতিটা- তার প্রতিনিধিত্ব এখনো বিএনপি করছে। তাদের সাংগঠনিক অবস্থা দুর্বল হয়েছে, মানুষের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা কমেছে। কিন্তু প্রত্যেক দিন গণমাধ্যমে তাদের খবর আসছে এবং বিএনপি এর সুযোগ নিচ্ছে। হাটে, মাঠে, ঘাটে তাদের কোনো অবস্থান নেই। তাদের অবস্থান আছে প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও ডিজিটাল মিডিয়ায়। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ভোগ করে তারা মুক্তিযুদ্ধ ও আওয়ামী লীগের বিরোধিতা এবং মিথ্যাচার করছে। এটাকে আওয়ামী লীগ ‘কাউন্টার’ না করে থাকবে? যেহেতু আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে- মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল। 

কাজেই বিএনপি সংগঠন হিসেবে যতই দুর্বল হোক, তার অস্তিত্ব যতই বিপন্ন হোক- মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বক্তৃতাগুলো সব গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়া প্রচার করছে। কাজেই এটাকে ‘কাউন্টার’ করা আওয়ামী লীগের নৈতিক দায়িত্ব। তাই এটা আমাদের করতে হবে। 

খবরের কাগজ: রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের সর্বশেষ (৩ মে, ২০২৪) প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশ আরও দুই ধাপ পিছিয়ে ১৬৫তম হয়েছে। গত বছর ছিল ১৬৩তম। এই প্রতিবেদন সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?

মোহাম্মদ আলী আরাফাত: এ ব্যাপারে আমার স্পষ্ট কথা। তারা (রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স) যে র্যাঙ্কিংটা করে একটা স্টাডির ভিত্তিতে- এই স্টাডিটা কীভাবে করে? প্রতিটা স্টাডির একটা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য মেথোডোলোজি আছে। গবেষণা পদ্ধতি আছে। সেই পদ্ধতিটা অনুসরণ করে কি না? আপনারাই বের করেন, আপনারাই বলেন। আমার কাছ থেকে শুধু প্রশ্ন আর উত্তর না- তাহলেই আপনারা দেখতে পারবেন যে দুর্বল একটা গবেষণা পদ্ধতি তারা (রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স) ব্যবহার করেছে। 

যেটা থেকে একটা দেশের, পুরো বাংলাদেশের চিত্র র্যাঙ্কিংয়ের প্রতিফলন করানো সম্ভবই নয়। বৈজ্ঞানিকভাবে সম্ভব নয়। আপনি ১০-১২ জনের ওপেনিয়ন নিচ্ছেন, নিয়ে আপনি র্যাঙ্কিং করছেন। এটা ১০-১২ জনের ওপেনিয়ন। সেটা গোটা দেশের ১৭ কোটি মানুষের, এতগুলো ভাইব্রেন্ট গণমাধ্যমের চিত্র নয়। তাই আমি মনে করি, অ্যাবসুলেটলি একটা অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় র্যাঙ্কিংটা করা হচ্ছে। তাই এ নিয়ে কথা বলা উচিত নয়। গবেষণার পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলা উচিত। ভুলভাল তথ্যের কারণে তাদের ক্রেডিবিলেটি থাকছে না। আমি তাদের চিঠি দিয়েছি। এরপর সেটাকে (প্রতিবেদন) তারা সংশোধন করল। তার অর্থ তারা তথ্য যাচাই করে না। সেটা তারাই প্রমাণ করেছে। এখন যে তথ্য দিয়েছে তার মধ্যেও ভুল আছে। এটা নিয়েও আমি চিঠি দেব। 

তাই আপনাদের প্রশ্ন করা উচিত যে, তোমরা যাচাই না করে কেন তথ্য দিয়েছ? তোমাদের পদ্ধতিটা কী? কেউ কি জানে? জানে না, কারণ এটা অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া। কিন্তু গবেষণার ক্ষেত্রে সবার আগে বলতে হয়, এটা কোন পদ্ধতিতে করা হয়েছে। তাই যেটার স্বচ্ছতা নেই তার বক্তব্যের কোনো মূল্য নেই। আসলে তারা একটা এনজিও দিয়েছে, বিভিন্ন স্থান থেকে অনুদান এনে চালায়। একটা র্যাঙ্কিং করে ছেড়ে দেয়। এটা না করলে প্রতিষ্ঠান চালাবে কীভাবে? তবে আমি মনে করি উদ্যোগগুলো খুবই ভালো। গোটা বিশ্বের গণমাধ্যমের চিত্র যদি তুলে সত্যিকারের র্যাঙ্কিং করতে চায়, তাহলে করতে পারে। র্যাঙ্কিং দেশে দেশে গণমাধ্যমকে শক্তিশালী করতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এটা তখনই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে যদি স্বচ্ছতা না থাকে এবং বৈজ্ঞানিক মানদণ্ড অনুসরণ না করা হয়। 

খবরের কাগজ: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, একটি দেশ বাংলাদেশে এয়ার বেজ বানাতে চায়। ওই দেশটির পরিকল্পনায় রয়েছে মায়ানমার ও বাংলাদেশের কিছু অংশ নিয়ে একটি খ্রিষ্টান রাষ্ট্র বানানো। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর আমরা উদ্বেগের মধ্যে আছি। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের ভাবনা কী? আপনারা কি জাতিসংঘে যাবেন?

মোহাম্মদ আলী আরাফাত: নতুন করে এই বক্তব্য শোনার পর উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। আমাদের উদ্বেগ সহজাতভাবে থাকা উচিত। এটার কারণ হচ্ছে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। যখন পাশ্চাত্যরা এখানে এসে কলোনি গড়ে তুলল- তার আগে পৃথিবীতে সব চেয়ে বেশি সম্পদশালী দেশ ছিল চীন এবং এই উপমহাদেশ। যখনই সম্পদ থাকে তখনই এরা আকৃষ্ট হয় এবং বিভিন্ন ফর্মে ঢুকে পড়ে ও আমাদের শোষণ-শাসন করে। তো কলোনিয়াল শাসনের অবসান ঘটিয়ে আমরা যখন স্বাধীন দেশ করে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় যাচ্ছি, তখন নতুনভাবে জিও পলিটিক্সে বাংলাদেশ আকর্ষণীয় একটা জায়গা হয়ে গেছে। 

এখন বঙ্গোপসাগর একটা গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এখানে অনেকেরই চোখ আছে। একবারে কেন্দ্রে বাংলাদেশের অবস্থান। তাই পৃথিবীর বড় বড় মোড়লের তাদের স্বার্থকে বেজ করে ব্যাপক চিন্তা থাকবে। এটাকে আমাদের লড়াই করেই মোকাবিলা করতে হবে এবং এটার জন্য শক্ত নেতৃত্ব দরকার। এই শক্ত নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধুকন্যাকে আমরা পেয়েছি। তিনি যত দিন আছেন, আমি মনে করি আমরা সবাই যদি তার পেছনে ঐক্যবদ্ধ থাকি, তার হাতকে শক্তিশালী করি, তাহলে এ দেশকে প্রটেকশন দিতে পারব। যদিও এ দেশে মীরজাফরের জন্মের ইতিহাস আছে, খন্দকার মোশতাকের জন্ম হয়েছে। এরা অল্প টাকার বিনিময়ে বিদেশি মোড়লদের কাছে বিক্রি হয়ে যায়, তারা তাদের স্বার্থে বিদেশি মোড়লদের পুশ করার চেষ্টা করে। 

কিন্তু পুশ করলে মানুষ নেবে না জেনে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এগুলোকে বিক্রি করে। এই মীরজাফর ও খন্দকার মোশতাকদের আপনি চিনবেন, তারা বিদেশি মোড়লদের সুরেই কথা বলে। আজকের বাস্তবতায় মোড়লরা সরাসরি আর্মি পাঠিয়ে দখল করতে পারে না। তাই তারা কী করে? দেশটির সিভিল সোসাইটির কিছু মানুষ কিনে, গণমাধ্যমের কিছু মানুষকে কিনে, ব্যবসায়ীদের কিছু কিনে এবং তাদের মাধ্যমে সরকারবিরোধী একটা আবহ তৈরি করে। আর গণতন্ত্র, মানবাধিকারের মোড়কে একটা সিন্ডিকেট তৈরি করে। এই সিন্ডিকেট এখানে অপারেট করছে ওই মোড়লদের পক্ষে। মোড়লরা তাদের পয়সা দেয় বিভিন্ন এনজিও তৈরি করে। এরা এখানে পয়সা পায় আর মোড়লদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করে। যদিও অ্যাপারেন্টলি তাদের দেখে মনে হবে তারা তো ভালোই কথা বলছেন। গণতন্ত্রের কথা বলে নির্বাচনের কথা বলে। কিন্তু আসলে সে কিন্তু মোড়লদের এজেন্ডা পুশ করছে। সেখান থেকে আমাদের সতর্ক ও সাবধান থাকতে হবে। আর ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে হবে।  

খবরের কাগজ: খবরের কাগজকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

মোহাম্মদ আলী আরাফাত: আপনাকেও ধন্যবাদ। খবরের কাগজের জন্য রইল শুভকামনা।

মূল্যস্ফীতির অভিঘাত রোধে বাজার মনিটরিং জোরদার করুন

প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৪, ১০:৫৯ এএম
মূল্যস্ফীতির অভিঘাত রোধে বাজার মনিটরিং জোরদার করুন
ড. মোস্তাফিজুর রহমান

অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে সরকার নানাবিধ সমস্যায় রয়েছে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে অর্থসংকট দেখা দেবে। বিদেশি ঋণ নিলে পরিশোধের চাপ আরও বাড়বে। এ পরিস্থিতিতে রিজার্ভে ইতিবাচক প্রভাবের আশায় এডিপিতে বেশি পরিমাণ বিদেশি ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে বিদেশি ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে, যাতে পরিশোধের চাপ আরও অসহনীয় না হয়। ঋণের অর্থের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বিচক্ষণতার সঙ্গে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রকল্প সাজাতে হবে। যাতে ঋণের অর্থের ব্যবহার লাভজনক হয়, সময়মতো প্রকল্প শেষ হয়। এ ক্ষেত্রে সুশাসনের বিষয়ে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি তৎপর থাকতে হবে। 
 
এদিকে বিদেশি ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে বেশ চাপে আছে অর্থনীতি। ঋণ মেটাতে গিয়ে অর্থসংকটে রয়েছে সরকার। পুরোনো দেনার বোঝা নামাতে গিয়ে বাধ্য হয়ে নতুন ঋণের দিকে ঝুঁকতে হচ্ছে। এ কারণে আগামীতে আরও মাশুল গুনতে হতে পারে। একদিকে অতিমাত্রায় ঋণ নেওয়া, অন্যদিকে ডলারের বিনিময়ে টাকার ধারাবাহিক দরপতনের কারণে চাপের বৃত্ত থেকে কোনোভাবেই বের হওয়া যাচ্ছে না। এ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে বিদেশি ঋণের সুদ-আসল পরিশোধে ৬৭ শতাংশ বেশি টাকা খরচ করতে হয়েছে। ডলারের হিসাবে যা ৪৮ শতাংশ। এ সপ্তাহের শুরুতে ডলারের দাম আরেক দফা বেড়েছে। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমেই তলানিতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে রিজার্ভ এখন ১৮ বিলিয়ন ডলার, যা গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম।

আগামী অর্থবছরের এডিপির আকার ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। ১ লাখ কোটি টাকা হিসাবে মোট এডিপিতে বিদেশি ঋণের প্রস্তাবিত পরিমাণ প্রায় ৩৮ শতাংশ। এ অর্থবছরের এডিপিতে এ উৎসের বরাদ্দ ছিল ৯৪ হাজার কোটি টাকা। পরে সংশোধিত এডিপিতে তা ৮৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় কমিয়ে আনা হয়। আগামী অর্থবছরের এডিপিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা সংস্থার বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পের বরাদ্দ নির্ধারণের জন্য চার দিনের ধারাবাহিক বৈঠক হয়। 

বৈঠকগুলোতে বিস্তারিত আলোচনার পরই প্রকল্পভিত্তিক বরাদ্দের প্রাথমিক খসড়া তৈরি হয়। গত তিন অর্থবছর এডিপিতে বিদেশি ঋণের বরাদ্দ প্রবণতায় দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের এডিপিতে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯২ হাজার ২০ কোটি টাকা। সংশোধিত এডিপিতে তা কমিয়ে ৭৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে মূল এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ৮৮ হাজার ২৪ কোটি টাকা, সংশোধিত এডিপিতে কমিয়ে ধরা হয় ৭২ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরের এডিপিতে বৈদেশিক অংশে বরাদ্দ ছিল ৭০ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ কমিয়ে ধরা হয় ৬৩ হাজার ১ কোটি টাকা।

বলা বাহুল্য, ডলারের মূল্য ও সুদহার বৃদ্ধির প্রভাবে মূল্যস্ফীতিতে নেতিবাচক অভিঘাত থাকবে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থাপনা আরও জোরদার করতে হবে। সামষ্টিক অর্থনীতির উৎকর্ষে আরও বেশি নজর দিতে হবে। বাজারভিত্তিক সুদহার নির্ধারণে ঋণের সুদ আপাতত আরও বেড়ে যাবে। ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণের ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। একই সঙ্গে ডলারের দাম বাড়ানো হয়েছে, এটা ঠিক। 

যদিও আগে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত ডলারের দর ১১০ টাকা ছিল, তখন ব্যাংকগুলো থেকে ১১৭-১১৮ টাকায় কিনতে হয়েছে। এই দর সমন্বয় করতে ডলারের মূল্য বাড়ানো হয়েছে। এখন নতুন সিদ্ধান্তের পর তাৎক্ষণিকভাবে খোলাবাজারে ডলারের দাম ১২৪-১২৫ টাকা উঠলেও তা আবার নেমে আসবে। এই মুহূর্তে অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণে এটা ছাড়া বিকল্প উপায় ছিল না। দেশের প্রয়োজনে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই সিদ্ধান্ত অনেক আগে নেওয়া দরকার ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার নিয়ন্ত্রণ করতে আমানতের সুদ ৬ শতাংশ এবং ঋণের সুদ সর্বোচ্চ ৯ শতাংশে বেঁধে রেখে ছিল। ডলারের দাম দীর্ঘদিন আটকে রাখায় সমন্বয় হয়নি। যার বিরূপ প্রভাব এখন পড়ছে। এই সিদ্ধান্ত আগে নেওয়া হলে অর্থনৈতিক ভারসাম্য অনেক নিচে থাকত। মূল্যস্ফীতির বিরূপ প্রভাব এতটা পড়ত না। কম আয়ের মানুষের ওপর চাপ কম হতো।

এখন ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে আমদানি পণ্যে মূল্যস্ফীতি কিছুটা বাড়াবে, যা ভোক্তাদের আরও চাপে ফেলবে। তবে যারা আগে থেকে ১১৭-১১৮ টাকা দরে আমদানি করেছে, সেখানে এখন মূল্যস্ফীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার কথা নয়। সরকার ১১০ টাকা ডলারে যেসব পণ্য এতদিন আমদানি করেছে, সেখানে ৭ টাকা বেড়ে যাওয়ার চাপ থাকবে, এটা সত্যি। তবে নতুন করে ডলারের দামে অস্থিরতা তৈরি না হয়, সেদিকে এখন নজর দিতে হবে। ডলারের নেতিবাচক প্রভাবে মূল্যস্ফীতির অভিঘাতে আমাদের পড়তে হবে। এ ক্ষেত্রে বাজার মনিটরিং জোরদার করতে হবে। এখন থেকে পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাজার ব্যবস্থাপনা ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। এ ছাড়া সুশাসন নিশ্চিত করে সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক ভারসাম্য আনতে সরকারের বড় ভূমিকা নেওয়ার এখনই সময়।

মধ্য মেয়াদে মূল্যস্ফীতি কমাতে উৎপাদন বাড়াতে এবং বাজারে পণ্য সরবরাহ পর্যাপ্ত নিশ্চিত করতে আরও জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। শিল্পের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সহায়ক সহযোগিতা দিতে হবে। পণ্যের জোগান ও চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য এনে মনিটরিং জোরদার করলে বাজার সহনীয় পর্যায়ে আসবে। সুদহার বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি খাতে ব্যয় বৃদ্ধির চাপ তৈরি হবে। এতে যেমন বিনিয়োগ কমবে; পাশাপাশি ঋণ পরিশোধের ব্যয় বেড়ে যাবে। ফলে কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ জন্য ব্যবসার পরিচালন ব্যয় কমানো ও ব্যবসার প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে সহযোগিতা লাগবে। এটি করতে পারলে নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলা কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে থাকবে। এ ক্ষেত্রে সরকার উদ্যোগী হলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের নেতিবাচক প্রভাব কিছুটা প্রশমিত করা যাবে।

লেখক: বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো 

খুশির হিসাব

প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৪, ১০:৫৭ এএম
খুশির হিসাব
ড. পবিত্র সরকার

কী সর্বনেশে ব্যাপার, হঠাৎ দেখি খবর এসে গেল আমরা, মানে বিশ্বগুরু ভারতের অধিবাসীরা পৃথিবীর ‘খুশি-সূচকে’ ১২৬ নম্বরে আছি। এমনকি পাকিস্তানেরও নিচে। আট সংখ্যায় যদি সর্বসুখ হয়, পাকিস্তানের নম্বর ৪.৭ আর আমাদের ৪.১। এই খবরটা আমাদের একেবারে পেছন থেকে শত্রুর ভোজালির আঘাতের মতো লেগেছে। আর কোনো দেশের নিচে হলে আমাদের আপত্তি ছিল না, এমনকি সুরিনাম বা মোজাম্বিকের নিচে আছি আমরা, সে খবরটা আমাদের খুশি-সূচককে ওপরে ঠেলে দিত; কিন্তু ‘চিরশত্রু’ পাকিস্তানের নিচে, তাতেই আমাদের বুক ভেঙে গেছে। 

যে দেশে এই সেদিন ‘অমৃত মহোৎসব’ হয়ে গেল, রাস্তায় ঢেলে অমৃতের স্রোত বইয়ে গিয়েছিল, লোকে হাপুস-হুপুস করে অমৃত খেয়ে এখনো হজম করে উঠতে পারেনি, সে কিনা ‘খুশি-সূচকে’ আর কারও নয়, পাকিস্তানেরও নিচে! এই ক্ষোভ আর অপমান আমরা রাখব কোথায়? কাকে দায়ী করব? শুনেছি ফরাসি দেশে আদালতের এক বিচারক মশাই আদালতে কোনো অপরাধের মামলা উঠলেই পুলিশকে হুকুম দিতেন, ‘শের্শে লা ফেম’, অর্থাৎ মহিলাটির খোঁজ করুন। তা তখন হয়তো নারীরা এখনকার মতো প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পারেননি, ফলে সব অপরাধের পেছনেই একটি নারীর যোগ আছে এই মিথ্যে আর একপেশে কথাটার কোনো আইনগত প্রতিবাদ করে উঠতে পারেননি।

কিন্তু আসল কথাটা হলো, একজন কাউকে তো দায়ী করতে হবে, নইলে আমরা বাঁচব কী করে। পাকিস্তানের লোক আমাদের চেয়ে সুখী- এই অপমানের শোধ কার ওপরে নেব তা হলে? সম্রাট নেপোলিয়নের সভায় একবার নাকি একটা অভিযোগ এসেছিল যে, ফরাসি দেশে ভালো কবির অভাব ঘটেছে। সম্রাট ভ্রূকুটি করে নাকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘আপনি কী করতে আছেন? ব্যাপারটা এক্ষুনি দেখুন!’ তা আমরা কি আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দিকে আঙুল তুলে বলতে পারব, এই যে আমাদের এত খুশির অভাব ঘটেছে, আপনি স্যার ব্যাপারটা দেখলেন না! আমাদের ঘাড়ে কয়টা মাথা! তাই ভাবি, এ দুঃখ রাখব কোথায়?

বলতেই পারি যে, ওই অক্সফোর্ড ওয়েলবিয়িং রিসার্চ সেন্টার কোথাকার কোন শাহেনশাহ যে তার কথায় এত দাম দিতে হবে, তাদের লিস্টি বেদমন্ত্রের মতো গ্রাহ্য করতে হবে? তা তো আর বলতে পারি না। আমাদের একসময়কার রাজার দেশ বলে কথা, তার ওপর অক্সফোর্ড। শুনলেই কেমন গা কেঁপে ওঠে। এ তো আর আগেকার বাংলা পঞ্জিকার জলন্ধর সিটি নয়, স্বয়ং অক্সফোর্ড। তার ওপর সারা পৃথিবীর মিডিয়া এই নিয়ে তোলপাড় করে ফেলছে, আমাদের আর ব্যাপারটাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার উপায়ই নেই। হ্যাঁ, আমরা জানি যে আজকাল নানা দেশে এ রকম সব কোম্পানি তৈরি হয়েছে, প্রয়াত কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী যাকে বলতেন ‘হত্তুকির কল’। 

এর দু-রকম ভ্যারাইটি আছে বলে শুনেছি। আরও কয়েক রকম থাকতে পারে। এক. তারা আপনার কাছে একটা মোটা চাঁদা নেবে, তার পর সেই টাকার একটা অংশ দিয়ে আপনাকে একটা পুরস্কার দেবে। আপনি ঢাকঢোল পিটিয়ে পুরস্কারের কথাটা সবাইকে জানাবেন, কিন্তু আপনার পুরস্কারের দ্বিগুণ চাঁদা দেওয়ার কথাটা চেপে যাবেন। আর একটা পদ্ধতি পশ্চিম বাংলা আর বাংলাদেশের মধ্যে খুব চলে বলে শুনেছি। আপনি এখানে বাংলাদেশের কাউকে আমন্ত্রণ করে হরিপদ পুততুণ্ড পুরস্কার দিলেন: আর বাংলাদেশের তিনিও আপনাকে পরের বছর আপনাকে আমন্ত্রণ করে ‘জেবউন্নিসা বেগম’ পুরস্কার দেবেন, আপনার সিভি বা বায়োডেটায় এগুলো উজ্জ্বল হয়ে জ্বলজ্বল করতে থাকবে। 

যতদূর পারি, মিডিয়ার খোঁজখবর নিয়ে জানলাম, অক্সফোর্ডের এই কোম্পানিটি ওই হত্তুকির কল জাতীয় কিছু নয়। কাজেই এদের কথাকে ‘যাঃ দ্দাদা, ডাহা গুল দিচ্ছেন’ বলে উড়িয়ে দেওয়ার কোনো উপায় নেই। ‘আজকাল’-এর স্নেহাস্পদ সম্পাদকই দেখলাম এ নিয়ে একটা সম্পাদকীয় লিখে ফেলেছেন। মিডিয়া এ ব্যাপারটা নিয়ে যথেষ্ট ঝামেলা করেছে, তারা ভারত যে এক বছরে ১৩৬ থেকে ১২৬-এ উঠে এসেছে, সে খবরটা বেমালুম চেপে গেছে। তার বদলে কী নিয়ে হইহই করছে? না, সে এখনো পাকিস্তানের কাছে ধ্যাড়াচ্ছে। তা ধ্যাড়াচ্ছে বেশ করছে, তোমাদের তাতে কী হে! সাধে কি আমাদের সরকার মিডিয়াকে ঢিট করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে, মাঝে মাঝে সাংবাদিকদের জেলটেলে পাঠাচ্ছে?

ঠিকাছে ঠিকাছে, এটা রাগের কথা নয়, মিডিয়াকে গালাগাল দিয়েও কোনো লাভ নেই, সেটা বুঝি। কিন্তু ভারত যে নাপিয়ে নাপিয়ে ধাপে ধাপে ওপরে উঠছে সেটা বলবি তো হতভাগারা? তা না করে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে লাগাচ্ছে। পাকিস্তানে এ পর্যন্ত একটা চলনসই গণতন্ত্রই খাড়া হলো না, আর সে কিনা আমাদের তুলনায় সুখে আছে! এ যদি আমাদের বিশ্বাস করতে হয় তবে এও বিশ্বাস করতে হবে যে, সজারুর শিং গজিয়েছে। 

তবু জানেন, আমাদের মনটা খচখচ করতে ছাড়ে না। কেন পশ্চিমের লোকেদের এত একচোখামি বলুন তো? তারা কি দেখল না যে, এই যে ৩ হাজার না কত কোটি টাকার সর্দার প্যাটেলের মূর্তি বসল নর্দমার ধারে, স্ট্যাচু অব লিবার্টির চেয়েও উঁচু, তাতে আমাদের খুশির পাত্র উপচে পড়ল? এই যে নতুন পার্লামেন্টের বাড়ি হলো, সেটা একটা খুশির ব্যাপার নয়? কেউ যদি খুশি না হয়, সে দেশদ্রোহী। তার ওপরে, দেশের আর সব কীর্তিকে যা তুরুশ্চু করে দিয়েছে, সেই রামের মন্দির, পৃথিবীর নবম আশ্চর্য, তাতে তো দেশবাসীর খুশি পেট থেকে সোডার মতো ভসভসিয়ে ওঠার কথা, সেটা কি অক্সফোর্ডের ওই পোড়াকপালেরা দেখতে পায় না? 

আমি ভাবছি, পাকিস্তানের কী করে এই আস্পর্ধা হলো- সে কী করে ভারতের চেয়ে খুশি-সূচকে এগিয়ে যাওয়ার সাহস পেল! জানি না অক্সফোর্ডের ওই কোম্পানির সঙ্গে তাদের কোনো ষড় আছে কি না, কোনো গোপন আদান-প্রদান হয়েছে কি না। কিন্তু একজন দেশপ্রেমিক হিসেবে মনে করি, খুশি-সূচকে ভারতের চেয়ে এগিয়ে থাকার এই চরম অসভ্যতার জন্য পাকিস্তানকে শায়েস্তা করা দরকার। তাদের সঙ্গে এ পর্যন্ত যুদ্ধ যা হয়েছে, ১৯৪৮ বা ১৯৬৫ বা ১৯৭১এ-আমাদের জয়ের রেকর্ড অম্লান থেকেছে। একটা ভালো কাজে আর একটা যুদ্ধ হলে ক্ষতি কী? একটাই প্রশ্ন, জয়ী হলেও আমাদের খুশি-সূচক সত্যি সত্যি বেড়ে যাবে কি না।

লেখক: ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ ও গবেষক এবং সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় 

আইসিসি টি-২০ বিশ্বকাপ

প্রকাশ: ০১ জুন ২০২৪, ১০:৫৪ এএম
আইসিসি টি-২০ বিশ্বকাপ
ডা. নাফিসুর রহমান

আইসিসি আয়োজিত টি-২০ ক্রিকেট বিশ্বকাপের আসর বসছে ১ জুন। দুই বছর পরপর আয়োজিত এই টুর্নামেন্টের এবার বসছে নবম আসর। খেলা চলবে ২৯ জুন পর্যন্ত। তবে আমাদের দেশে আমরা খেলাগুলো দেখতে পাব জুন মাসের ২ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত। কেননা আয়োজক দেশগুলোর সঙ্গে রয়েছে আমাদের বিস্তর সময়ের ব্যবধান। 

এবারের আয়োজক যৌথভাবে দুটি দেশ– ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৬টি এলাকার ৬টি স্টেডিয়ামে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ৩টি শহরের ৩টি স্টেডিয়ামে মোট খেলা হবে ৫৫টি। এবারই প্রথম রেকর্ডসংখ্যক ২০টি টিম অংশ নিচ্ছে ক্রিকেটের বিশ্বকাপে। এর আগে ১৬ দলের বেশি টিম কোনো ফর্মের ক্রিকেট বিশ্বকাপে খেলেনি। 

আমরা যারা ক্রিকেট খেলা দেখি বা উপভোগ করি, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট ঐতিহ্যের সঙ্গে আমরা প্রায় সবাই পরিচিত। গত কয়েক বছরে তাদের ক্রিকেটের মান অনেকটা দুর্বল হলেও মাত্র এক-দুই দশক আগেও বিশ্ব কাঁপানো দুর্ধর্ষ বোলার, ব্যাটসম্যান আর অলরাউন্ডারদের সমন্বয়ে গড়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিমগুলোর কথা প্রায় সবারই মনে থাকার কথা। 

ক্রিকেট খেলার উৎপত্তি যে ইংল্যান্ডে, এ তথ্য কারও অজানা নয়। তবে সঠিক ইতিহাস হয়তো অনেকেরই জানা নেই। আনুমানিক ১১০০ খ্রিষ্টাব্দে দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডের এক গ্রামে কিছু দুরন্ত ডানপিটে ছেলের হাতে আদি ক্রিকেটের উৎপত্তি। সেটিই ধীরে ধীরে রিফর্ম হয়ে আধুনিক ক্রিকেট খেলায় পরিবর্তন হয়েছে। 

বড়দের খেলা হিসেবে ক্রিকেটের জানা ইতিহাস ১৬১১ সাল থেকে। এ বছরই প্রথমবারের মতো ক্রিকেট শব্দটি অভিধানে যুক্ত হয়। যদিও এর আগে ১৫৫০ সালে একটি জমিসংক্রান্ত মামলায় সংশ্লিষ্ট জমিতে ক্রিকেট খেলার অভিযোগটি উঠে এসেছিল। তত দিনে অবশ্য আন্তগ্রাম পর্যায়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে খেলাটি। ১৭০০ শতাব্দীর মাঝামাঝি ইংল্যান্ডে বিভিন্ন গ্রামের সেরা খেলোয়াড়দের নিয়ে কাউন্টি পর্যায়ে ক্রিকেট খেলা আরম্ভ হয়। আন্তকাউন্টি খেলা আরম্ভ হয় ১৭০৯ সালে। 

কয়েক দশকের মধ্যেই খেলাটি লন্ডন শহরেও জনপ্রিয়তা পেতে আরম্ভ করে। ১৭৪৪ সালে এই খেলাটির জন্য প্রথমবার নিয়মাবলি রচনা করা হয়। এর পরের বছর, অর্থাৎ ১৭৪৫ সালে ইংল্যান্ডের সারিতে (Surrey) পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের মধ্যেও খেলাটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। গোটা ইংল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়ে খেলাটি।

১৭০০ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকেই ব্রিটিশ কলোনাইজেশনের অংশ হিসেবে ক্রিকেট খেলাটিকে ছড়ানো আরম্ভ হয় বিশ্বব্যাপী। সর্বপ্রথম ক্রিকেটের সম্প্রসারণ করা হয় আমেরিকা ও কানাডায়; এরপর ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং ভারতে আসে ক্রিকেট। তারপর ১৮০০ শতাব্দীতে ক্রিকেট নিয়ে যাওয়া হয় অস্ট্রেলিয়া ও ১৯০০ শতাব্দীতে নিউজিল্যান্ডে। 

লন্ডন শহরে ব্রিটিশ লর্ডদের ক্লাবে সুনির্দিষ্টভাবে ক্রিকেটকেন্দ্রিক ক্লাব হিসেবে মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব (এমসিসি) সৃষ্টি করা হয় ১৭৮৭ সালে। সে বছরই লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ড উদ্বোধন করা হয় এবং ক্রিকেট খেলা পরিচালনা করার দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব এমসিসির ওপর ন্যস্ত করা হয়। এরপর প্রায় দুই শতাব্দীজুড়ে ইংল্যান্ডের প্রফেশনাল ক্রিকেটারদের টিম হিসেবে এমসিসি ক্লাবের টিমকেই বোঝানো হতো। 

আন্তর্দেশীয় ক্রিকেট সর্বপ্রথম আয়োজন হয় ১৮৪৪ সালে। তবে এই খেলাটি ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়া বা ওয়েস্ট ইন্ডিজ বা ভারতের টিমের মধ্যে খেলা ছিল না। কানাডা থেকে একটি টিম খেলতে যায় যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে, সেন্ট জর্জেস ক্রিকেট ক্লাব টিমের সঙ্গে। ২৪ সেপ্টেম্বর ১৮৪৪ তারিখে আরম্ভ হওয়া এই তিন দিনের ম্যাচটিতে জয়লাভ করে কানাডা দল। তবে দুই টিমের কোনো প্লেয়ারই প্রফেশনাল ক্রিকেটার ছিলেন না। তারা সবাই ছিলেন শৌখিন প্লেয়ার। 

১৮৫৯ সালে ইংল্যান্ডের পক্ষ হয়ে এমসিসির প্রফেশনাল ক্রিকেটারদের একটি টিম আমেরিকায় যায় খেলতে। মূলত এটিই ছিল প্রফেশনাল ক্রিকেটারদের সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক ট্যুর। কিন্তু তাদেরও সব খেলা হয় যুক্তরাষ্ট্রের শৌখিন প্লেয়ারদের সঙ্গে। ১৮৬২ সালে ইংল্যান্ডের ক্রিকেট টিম প্রথমবারের মতো ভ্রমণ করে অস্ট্রেলিয়া। ১৮৬৮ সালের অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী ক্রিকেটারদের একটি টিম ফিরতি ভ্রমণ করে ইংল্যান্ডে। কিছুদিনের মধ্যে লন্ডনে খবর আসে, অস্ট্রেলিয়ায় দুর্দান্ত কিছু প্রফেশনাল ক্রিকেটার তৈরি হয়েছে। 

১৮৭৭ সালের মার্চ মাসে এমসিসি টিম অস্ট্রেলিয়া যায় খেলতে। ১৫ মার্চ মেলবোর্ন শহরের এক মাঠে আরম্ভ হয় ইতিহাসের প্রথম টেস্ট ম্যাচ। খেলায় অস্ট্রেলিয়া ইংল্যান্ডকে পরাজিত করে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অফিশিয়াল জন্ম এই খেলা থেকেই… আজ থেকে ১৪৭ বছর আগে। সেই মাঠটি আজ মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড (এমসিজি) নামে বিশ্বখ্যাত ক্রিকেট স্টেডিয়াম। 

কালের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ক্রিকেটেও এসেছে বিবর্তন। নিয়মকানুনে যেমন পরিবর্তন এসেছে, টেস্ট ক্রিকেটের পাশাপাশি সীমিত ওভারের খেলাকেও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ১৯৭১ সালের ৫ জানুয়ারি এই এমসিজি মাঠেই ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া মুখোমুখি হয় প্রথম এক দিনের সীমিত ওভারের আন্তর্জাতিক ম্যাচে। আরম্ভ হয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের একটি নতুন অধ্যায়। সে খেলাতেও জয়ী হয় অস্ট্রেলিয়া। 

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রথম টি-টোয়েন্টি খেলাটি আয়োজন হয় ২০০৪ সালের ৫ আগস্ট, ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের নারী দলগুলোর মধ্যে। 

এই প্রথম খেলাতেও ইংল্যান্ড দল পরাজিত হয়। যে কারণে পুরুষদের প্রথম আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলাটিতে ইংল্যান্ড খেলতে রাজি হয় না। সেটি আয়োজন হয় অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মধ্যে, ২০০৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে। এই খেলাতেও জয়ী হয় অস্ট্রেলিয়া। অর্থাৎ টেস্ট ম্যাচ, ওয়ানডে ইন্টারন্যাশনাল (ODI) এবং টি-টোয়েন্টি ইন্টারন্যাশনাল (T20I)– আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের স্বীকৃত তিনটি ধারার খেলাতেই সর্বপ্রথম খেলায় জয়ী হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। 

সর্বপ্রথম আন্তর্দেশীয় ক্রিকেট খেলার প্রায় দুই শতাব্দী পর আজও সেই দুটি দেশ– যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় প্রফেশনাল ক্রিকেট সেভাবে গড়ে ওঠেনি। তারা বরং ইংল্যান্ড থেকেই পরবর্তী সময়ে আমদানি করা বেজবল (Baseball) খেলাটিকেই বেশি পছন্দ করে ফেলে। বিশ্বকাপের এবারের আসরে প্রথম ম্যাচে সর্বপ্রথম আন্তর্দেশীয় ক্রিকেট খেলার সেই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দল স্বাগতিক দেশ যুক্তরাষ্ট্র আবার মুখোমুখি হচ্ছে কানাডার সঙ্গে। এবার আর ক্লাব পর্যায়ের খেলা নয় এটি। দুই দেশের অফিশিয়াল টিম খেলছে বিশ্বকাপে, প্রথম খেলার প্রায় ১৮০ বছর পর। অথচ এই ম্যাচটির ঐতিহাসিক গুরুত্বটি হয়তো আমাদের অনেকেরই জানা ছিল না।  
তথ্যসূত্র: Wisden Cricketers' Almanack, Cricinfo

লেখক: মানবাধিকারকর্মী এবং ক্রিকেটপ্রেমী 

ভারতের ১৮তম জাতীয় নির্বাচন: পিলে চমকানো তথ্য

প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৪, ১১:২৯ এএম
ভারতের ১৮তম জাতীয় নির্বাচন: পিলে চমকানো তথ্য
ড. তোফায়েল আহমেদ

‘ভারতের নির্বাচনের ফলাফল কী হবে, জরিপ কী বলছে’- এই শিরোনামে গত ২৪ এপ্রিল একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত পাঁচটি সংস্থার আটটি জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণ করে মোদির এনডিএ জোটের ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ ভোট ও ৩৭৩ থেকে ৪১১ আসন প্রাপ্তির একটি সম্ভাব্য ফলাফল দেখা যায়। সে ক্ষেত্রে ইন্ডিয়া জোটের ১০৫ থেকে ১৫৫ আসন জয়ের ইঙ্গিত ছিল। তা ছাড়া অন্য দলগুলোর ভোটসংখ্যা ২০ শতাংশ এবং আসন ৫০-এর ঘরে দেখানো হয়। এসব ছিল এপ্রিল ২০২৪-এর আগের, অর্থাৎ ভোট-পূর্ব জরিপ। পরে নানাভাবে জানা যাচ্ছিল যে, এসব জরিপ একটি বিশেষ কেন্দ্রনিয়ন্ত্রিত। মোদির বক্তৃতার ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে সমন্বয় করে এসব জরিপের ফলাফল এক গ্রন্থিতে গাঁথা। এখন দেখতে দেখতে সাত ধাপের ভোট পর্বের ছয় পর্ব শেষ। মোদিজির ভোটসভার বক্তব্যের নানা দিক পরিবর্তনও লক্ষণীয়। 

প্রথম যে স্লোগান দিয়ে নির্বাচনি প্রচার শুরু হয়, তা ছিল- ‘আপকা বার, ৪০০ পার’। এ স্লোগানের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয় সব গণমাধ্যমজুড়ে। তারপর একের পর এক ‘লুঙ্গি’, ‘শ্রাবণ মাসে মাছ খাওয়া’, ‘মুসলমানদের বাচ্চাদানের আধিক্য’, ‘হিন্দুদের ভেড়া-মহিষ কংগ্রেস মুসলমানদের দিয়ে দেবে’- এসব নানা ‘ঘৃণা ভাষণ’ আসতে থাকে। ভাষণে বারবার উচ্চারিত হতে থাকে পাকিস্তান। প্রধান নেতার মুখের বাণী ছোট নেতাদের মুখে আরও নতুন রং ও রূপ লাভ করে। পঞ্চম ও ষষ্ঠ ধাপের মধ্যবর্তী সময় থেকে সুর ভিন্ন হতে থাকে। তখন মোদি বলেন, তিনি প্রতিবেশী মুসলমান বাড়িতে ঈদের উৎসব করেছেন এবং খানাপিনা করেছেন। করে থাকলেও আগে কখনো এসব কথা বলেননি। পুরোনো কথা ‘সব কা সাথ সব কা বিকাশ’ ইত্যাদি নতুনভাবে বলা হচ্ছে।

ভারতের গণতন্ত্র ও নির্বাচনের সৌন্দর্যের একটি বিশেষ প্রকাশ হচ্ছে, সে দেশের কিছু অত্যন্ত মেধাবী, প্রতিশ্রুতিশীল ও পেশাদার একাডেমিক ও গবেষকদের মনোগ্রাহী নির্বাচন বিশ্লেষণ এবং নানা পত্রপত্রিকা ও গবেষণা সাময়িকীতে পূর্ণাঙ্গ গবেষণা নিবন্ধ। আর প্রথম শ্রেণির ইংরেজি সংবাদপত্রগুলোর সংবাদ বিশ্লেষণ ও নানা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন। ইলেকট্রনিক মাধ্যমে কিছু মেধাবী, অধ্যয়নশীল, অভিজ্ঞ ও ক্ষুরধার সাংবাদিকের তীক্ষ্ণ প্রশ্নবাণ ও বিশ্লেষণ এত উপভোগ্য, মনে রাখার মতো। ড. প্রণয় রায়ের এনডিটিভি এসব আলোচনা ও বিশ্লেষণের একটি ভালো জায়গা ছিল। এখন সে চ্যানেলটি নেই। 

ভারতের নির্বাচন বিশ্লেষকদের মধ্যে দুজনকে আমি এখন অনুসরণ করার চেষ্টা করি। একজন প্রশান্ত কিশোর, অপরজন যোগেন্দ্র যাদব। প্রথমজন পেশাদার সেফোলজিস্ট এবং দ্বিতীয়জন গবেষক, একাডেমিক ও রাজনীতিবিদ। প্রশান্ত কিশোরের সর্বশেষ বিশ্লেষণে বলা হয়, এনডিএ জোট ও মোদি কিছু আসন হারিয়েও ৩১০-এর কাছাকাছি যাবেন। তিনি রাজ্যওয়ারি লাভ-লোকসান হিসাব করে তা দেখিয়েছেন। বিপরীত দিকে যোগেন্দ্র যাদব মহাশয়ও রাজ্যভিত্তিক একটি হিসাব কষেন; যা তার ভাষায় খুবই রক্ষণশীল হিসাব, তাতে ষষ্ঠ ধাপ শেষে সর্বভারতীয় ফলাফলে এনডিএ ২৪৮, অর্থাৎ ২৫০-এর কম আসনে এগিয়ে আছে বলে ষষ্ঠ ধাপ শেষ হওয়ার পরপরই  মন্তব্য করা হয়। সপ্তম ধাপে তা পূরণ হয়ে ২৭২-এ যাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে যোগেন্দ্র যাদব মহাশয় দৃঢ় মন্তব্য করেন।

তিনি উত্তর প্রদেশ, বিহার, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব, হরিয়ানাসহ আরও কিছু রাজ্যে বিজেপির হার ও ইন্ডিয়া জোটের বেশ কিছু অর্জন দেখছেন। তিনি সারা ভারত ঘুরেছেন এবং প্রতিটি রাজ্যের একটি সাধারণ বিশ্লেষণ, আবার ঝুঁকিপূর্ণ বা দোদুল্যমান আসনগুলোর নানা গতিধারা বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি নিজে ষষ্ঠ দফায় হরিয়ানায় ভোট দিয়েছেন। সেখানে তিনি ইন্ডিয়া জোটের তিন-চারটি আসন অর্জনের পূর্বাভাস দেন। একইভাবে দিল্লিতেও কংগ্রেস-আম আদমির চারটি অর্জন দেখতে পান। বিহারে তেজস্বী যাদবের রুপালি রেখা তার কাছে স্পষ্টতই দৃশ্যমান। উত্তর প্রদেশে অখিলেশ-রাহুলের ‘গাঁটবন্ধন’ ভালো ফল দেবে বলে তার স্থির অনুমান। বাংলায়ও অবস্থা আশাপ্রদ বলে তিনি মনে করেন। তবে এটি মনে রাখতে চাই- যোগেন্দ্র যাদব ‘পোল স্টার’ নন। তিনি মূলত রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তিনি আত্মপ্রত্যয়ী ও সূক্ষ্ম বিশ্লেষক। তার বিশ্লেষণ অবহেলা করাও সহজ নয়।

পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবস্থান ইন্ডিয়া জোটের সঙ্গে থাকলে হয়তো এনডিএ-ইন্ডিয়া মেরূকরণ এবং ইন্ডিয়া জোটের অর্জন আরও সুসংহত হতো। কিন্তু তার কাছে বোধ হয় ‘বাংলাই প্রধান, বাংলাই প্রথম’। বাংলায় তিনি কারও জন্য কোনো পরিসর দিতে বা ‘সূচ্যগ্রমেদিনী’ ছাড়তে নারাজ। বাংলায় যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাম এবং কংগ্রেসকে সঙ্গে নিতেন তা হলে হয়তো বড়জোর ২+২=৪টা আসন ছাড়তে হতো। 

কিন্তু বিজেপিকে হাত ধুয়ে দিতে পারতেন। পুরো বাংলায় উত্তেজনা কমে আসত। ভবিষ্যতেও জ্যোতি বসুর ‘বামফ্রন্ট’ মডেলের মতো একটা কিছু দাঁড় করিয়ে রাজ্য স্তরে শাসন পাকাপোক্ত রাখতে পারতেন আরও অন্তত দুটি টার্ম। এখন তৃণমূল দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের মধ্যে ঢুকে পড়েছে, এটি সম্ভবত আগামী রাজ্যসভা নির্বাচনে তৃণমূলকে ভোগাবে। এবারে দুর্বল দুটি পক্ষ বাম এবং কংগ্রেসকে সঙ্গে নিয়ে রাজ্যে নির্বাচন করলে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সংগঠন থাকলেও তারা আসনের দিক থেকে অনেক পেছনে পড়ে যেত। আবার কংগ্রেস ও বামরা বলেন, মমতা সুযোগ বুঝে বিজেপির সঙ্গেও ভিড়তে পারেন। 

সম্প্রতি রাজ্যের বাইরে মমতা জোর দিয়ে বলছেন, তিনি শুধু ইন্ডিয়া জোটের সঙ্গে আছেন তা নয়, তিনি নিজেকে ইন্ডিয়া জোটের রূপকার বলেও দাবি করেন। এটি ইন্ডিয়া জোটের সাফল্য এবং এনডিএ জোটের খারাপ ফলাফলের আভাস-ঈঙ্গিত দেখেই বলছেন কি না জানি না। তবে মল্লিকার্জুন খাগড়ে সংসদে কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরীকে মমতার বিরুদ্ধে কথা বলায় কড়া ধমক দিয়েছেন। রাহুল গান্ধীও মমতার ইন্ডিয়া জোটের প্রতিশ্রুতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন। জোটে যেন কোনো বিভক্তি না আসে নিশ্চয়ই সে স্বার্থে তারা এই মুহূর্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইগোকে আঘাত করতে চান না।

এ নির্বাচনে সার্বিকভাবে বাংলাদেশ নিয়ে অনেকবার অনেক প্রসঙ্গ এসেছে। এনডিএ জোট কিংবা ইন্ডিয়া জোট কেউই বাংলাদেশকে সম্মানের চোখে দেখছে, তা আমার মনে হয়নি। মোদিজি সরাসরি ‘বাংলাদেশ’ শব্দ উচ্চারণ না করেও তার সরকারের এনআরসি ইস্যু ও মুসলিম বিষয়কে যেভাবে ঘৃণা ভাষণের অংশ করেছেন, তাতে শেষ পর্যন্ত সবকিছু বাংলাদেশের ওপরই এসে পড়ে। সম্প্রতি ঐতিহাসিকভাবে কংগ্রেসের সাফল্য গাঁথার বর্ণনা দিতে গিয়ে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাগড়ে কোনো রকম কূটনৈতিক রাখঢাক না রেখেই বলেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানকে ভেঙে দিয়ে বাংলাদেশ সৃষ্টি করে কংগ্রেস মিসেস গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতের একটি জটিল সমস্যার সমাধান করেছে। 

ভোটের সময় গণহারে বাংলাদেশের অভিবাসী ও রোহিঙ্গা ভারতে যাচ্ছে এসব কথা প্রায়শই বলা হয়। আসাম, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতাদের এটি একটি সাধারণ বুলি। তা ছাড়া পানি ও যৌথ নদীগুলোর প্রবাহমানতার সমস্যা, সীমান্তে গুলি করে মানুষ মারা এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রাজনীতি, নির্বাচন ও নিরাপত্তাব্যবস্থায় নানা হস্তক্ষেপ বাংলাদেশের মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পায়। নির্বাচনে এসব কীভাবে দেখা হবে, সেটি ভেবে শঙ্কা অনুভব করি। তবে ভারতের নির্বাচনের নানা ঘটনা থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল, দলের নেতা, আমাদের গণমাধ্যম এবং নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও একাডেমিক সমাজের অনেক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে।
 
লেখক: শিক্ষক ও স্থানীয় শাসন বিশেষজ্ঞ
[email protected]