পদ্মার ওপারের পাঁচ জেলা নিয়ে গঠিত বিএনপির সাংগঠনিক বিভাগ ফরিদপুর। বছরের পর বছর এসব জেলা চলছে আহ্বায়ক কমিটিতে। উপজেলা, পৌর ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনগুলোর অবস্থাও নাজুক। এর মধ্যে নেতা-কর্মীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিভক্তিও প্রকাশ্য। আন্দোলনের সময় গা বাঁচাতে কেউ কেউ পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশেও। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকায় নানা সংকট যেন পিছু ছাড়ছে না। সব মিলিয়ে অগোছালোভাবেই চলছে ফরিদপুর বিএনপি।
বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ বলেন, বিগত আন্দোলনের সময় বিএনপির সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরা সরকার ও প্রশাসনের প্রচণ্ড চাপে পড়েছিল। এখানে দল বেশি শক্তিশালী বলেই নির্যাতন-নিপীড়নও হয়েছে বেশি। আন্দোলন চলাকালে অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। সম্প্রতি তারা জামিনে মুক্তি পেয়ে আবারও রাজপথে সক্রিয় হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘টানা এক-দেড় বছর আমাদের আন্দোলন ও কর্মসূচিতে মনোযোগ ছিল বেশি। সরকার ও প্রশাসন তাদের সম্মেলন করার মতো জায়গা দেয়নি। তার পরও উপজেলা-পৌর কমিটি সম্মেলনের মাধ্যমে হয়েছে। হাইকমান্ডের নির্দেশ রয়েছে কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি গঠন করতে হবে। ঘরোয়া কমিটি দিতে চাইলে আরও আগেই দিতে পারতাম।’
গ্রুপিংয়ের বিষয়ে শামা ওবায়েদ বলেন, জেলা বিএনপিতে গ্রুপিং নেই। একটি বড় দলের নেতৃত্বে প্রতিযোগিতা থাকে, এটাকে গ্রুপিং বলা যাবে না। দল ও দেশের জন্য কাজ করতে সবাই ঐক্যবদ্ধ আছে। শামা ওবায়েদের পাশাপাশি ফরিদপুর বিভাগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছেন সহসাংগঠনিক সম্পাদক সেলিমুজ্জামান সেলিম ও খন্দকার মাশুকুর রহমান।
ফরিদপুর জেলা ও মহানগর বিএনপি
বিএনপির জন্মলগ্ন ১৯৭৮ সাল থেকেই দুই ভাগে বিভক্ত ফরিদপুর বিএনপি। সেই ধারা অব্যাহত রেখেছে বর্তমান প্রজন্মও। সাবেক মহাসচিব কে এম ওবায়দুর রহমান গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন তার মেয়ে ফরিদুপর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ, কেন্দ্রীয় যুবদলের সহসভাপতি মাহমুদুল ইসলাম পিংকু। আর প্রয়াত সাবেক মন্ত্রী চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের গ্রুপে রয়েছেন চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শাহজাদা মিয়া, কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুল, কামাল ইবনে ইউসুফের মেয়ে ও মহিলা দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী নায়াব ইউসুফ। তবে গত বছরের ২৮ অক্টোবরের পর দুই গ্রুপই কর্মসূচি পালন করেছে একত্রে।
ফরিদপুর জেলা বিএনপির সর্বশেষ সম্মেলন হয় ২০০৯ সালে। ১০ বছর পর ২০১৯ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সেই কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। এরপর ২০২২ সালের ১৫ এপ্রিল জেলা ও মহানগরের আংশিক কমিটি গঠিত হয়। এরপর দুই ভাগে বিভক্ত জেলা বিএনপি। এক গ্রুপের নেতৃত্ব দেন আহ্বায়ক সৈয়দ মোদাররেস আলী ও সদস্যসচিব এ কে কিবরিয়া স্বপন। তারা কামাল ইবনে ইউসুফের অনুসারী। আরেকটি অংশের নেতৃত্বে আছেন যুগ্ম আহ্বায়ক আফজল হোসেন খান পলাশ ও সৈয়দ জুলফিকার হোসেন জুয়েল। তারা শ্যামা ওবায়েদের অনুসারী।
স্থানীয় সূত্রমতে, এক দফার আন্দোলনে নগরকান্দা, বোয়ালমারী ও মধুখালী উপজেলা বিএনপির পারফরম্যান্স ছিল ভালো। আর ভাঙ্গা, সদরপুর ও চরভদ্রাসনে বিএনপির সাংগঠনিক ভিত্তি তুলনামূলক দুর্বল। নগরকান্দা ও সালথা বিএনপি শামা ওবায়েদ এবং শহীদুল ইসলামের নেতৃত্বে বিভক্ত। ভাঙ্গায় উপজেলা বিএনপির সভাপতি খন্দকার ইকবাল হোসেন ও জাসাসের কেন্দ্রীয় নেতা শাহরিয়ার ইসলাম শায়লার মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকট। বর্তমানে এলাকায় প্রভাব বিস্তার করছেন চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জহিরুল হক। কোতোয়ালি থানা বিএনপিও ভাঙনের মুখে। শহরের কাঠপট্টি এলাকার কার্যালয় থেকেই নিয়ন্ত্রণ হয় রাজনীতি। আট উপজেলার বেশির ভাগই চলছে আহ্বায়ক কমিটিতে। অঙ্গসংগঠনগুলোর কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ। তাই নতুন নেতৃত্ব গঠনের দাবি নেতা-কর্মীদের।
সদস্যসচিব এ কে কিবরিয়া স্বপন বলেন, বৃহত্তর আন্দোলনের জন্যই উপজেলা-অঙ্গসংগঠনের কমিটি পুনর্গঠন হয়নি। তবে সাংগঠনিক কাজ চলমান রয়েছে। তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। শত শত নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। আবার কেউ কেউ ফেরারি জীবনযাপন করছেন।’
শরীয়তপুর: জেলায় এক দফার আন্দোলন ছিল ‘সুপার ফ্লপ’। শীর্ষ নেতারা ছিলেন আড়ালে। তবে নড়িয়া উপজেলা যুবদলের শীর্ষ দু-একজন নেতা সক্রিয় ছিলেন। বর্তমান সভাপতি শফিকুর রহমান কিরণ ও সাধারণ সম্পাদক সরদার এ কে এম নাসির উদ্দিন কালুর নেতৃত্বে এক গ্রুপ, সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুব তালুকদারের আলাদা বলয় এবং তারেক রহমানের সাবেক এপিএস মিয়া নুরুদ্দীন অপু ও কেন্দ্রীয় কৃষক দলের সভাপতি কর্নেল ফয়সালের আরেক গ্রুপ। এই তিন বলয়ে চলছে জেলাটির রাজনীতি। পৃথকভাবে পালিত হয় কর্মসূচি।
সভাপতি কিরণ দুবাইয়ে অবস্থান করছেন। তিনি ২৮ অক্টোবরের আগেই দেশ ছেড়েছেন এবং কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে শফিকুর রহমান কিরণ দাবি করেন, বিদেশে থেকেও নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন তিনি। আন্দোলনের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
কিরণ বলেন, ‘গ্রেপ্তার হলে নির্দেশনা দিতাম কীভাবে?’ তিনি বলেন, সবাই জাতীয়তাবাদী আদর্শের সৈনিক। গ্রুপিং নয়, নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা আছে।
২০১৬ সালের ১৩ নভেম্বর গঠিত ১৬ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে চলছে শরীয়তপুর জেলা বিএনপি। উপজেলা, থানা ও অঙ্গসংগঠনের অবস্থা নড়বড়ে। ২০১৭ সালের সুপার ফাইভ কমিটি দিয়ে চলছে জেলা যুবদল এবং তিন গ্রুপে বিভক্ত। কমিটি ছাড়াই চলছে ছাত্রদল এবং ভুগছে নেতৃত্বের খরায়। অন্য সংগঠনগুলোর একই অবস্থা। উপজেলা-পৌর কমিটির মেয়াদ নেই। বিএনপির কার্যালয়ও নেই।
সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন কালু বলেন, শরীয়তপুরে প্রকৃত অবস্থা খারাপ। একদিকে সরকারদলীয় ক্যাডার, অন্যদিকে প্রশাসন। কর্মসূচি পালন করা ছিল বেশ কঠিন। এখনো নেতা-কর্মীরা বাড়িতে থাকতে পারছেন না বলেও অভিযোগ করেন।
রাজবাড়ী: দীর্ঘদিন ধরে জেলা বিএনপিতে মতবিরোধ-দ্বন্দ্ব চলছে। এতে দুই ধারায় বিভক্ত নেতা-কর্মীরা। পৃথকভাবে পালিত হয় কর্মসূচি। গ্রুপিং-হামলা-মামলায় জর্জরিত হয়ে ক্রমেই শক্তি কমছে। শীর্ষ নেতাদের গ্রুপিংয়ে বিরক্ত তৃণমূল। নেতা-কর্মীদের দাবি, দ্বন্দ্ব-বিভক্তি যেকোনো মূল্যে দূর করতে হবে। এতে বিএনপি আরও শক্তিশালী হবে।
জানা গেছে, এক পক্ষের নেতৃত্বে রয়েছেন বতর্মান আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট লিয়াকত আলী, সাবেক সহসভাপতি অ্যাডভোকেট আসলাম ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশীদ। তারা তাদের অনুসারীদের নিয়ে জেলা বিএনপি কার্যালয়ে কর্মসূচি পালন করেন। অপর পক্ষের নেতৃত্ব দেন সাবেক সভাপতি আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়ম। তার অনুসারীরা পার্টি অফিসে আসেন না, খৈয়মের বাসভবনে পালিত হয় কর্মসূচি। অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো দুই ধারায় বিভক্ত। খৈয়ম গ্রুপে রয়েছেন যুবদলের আহ্বায়ক খায়রুল আনাম বকুল, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ, কৃষক দলের আহ্বায়ক আইয়ুব আলী। আর লিয়াকত গ্রুপে রয়েছেন স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান লিখন, যুবদলের সদস্যসচিব আমিনুল ইসলাম ঝন্টু, কৃষক দলের সদস্যসচিব সিরাজুল ইসলাম।
২০১৯ সালের ২৫ নভেম্বর অ্যাডভোকেট লিয়াকত আলীকে আহ্বায়ক এবং অধ্যক্ষ মঞ্জুরুল ইসলামকে সদস্যসচিব করে ৪৭ সদস্যের জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয়। দুই বছর পর মঞ্জুরুল ইসলামকে সরিয়ে কামরুল ইসলামকে সদস্যসচিব করা হয়। প্রায় সাড়ে চার বছর পরও জেলা কমিটি পূর্ণাঙ্গ হয়নি। কালুখালী, বালিয়াকান্দি, রাজবাড়ী উপজেলা ও পৌর বিএনপি চলছে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে। ছাত্রদল চলছে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে। যুবদলের আহ্বায়ক কমিটিও কয়েক বছর আগের। বাকি সংগঠনগুলোর বেশির ভাগের নেই মেয়াদ। সদরের বাইরে কর্মসূচি পালিত হয় না।
অ্যাডভোকেট লিয়াকত আলী বলেন, ‘আন্দোলন বেগবান করতে যা যা করার প্রয়োজন ছিল সবই করেছি। নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকলেও ঐক্যবদ্ধভাবে কর্মসূচি পালন করেছি।’
মাদারীপুর: ১৯৭৯ সালের পর মাদারীপুরের তিনটি সংসদীয় আসনে এখনো জয়ী হতে পারেনি বিএনপি। ২০০৬ সালের পর থেকেই কার্যালয়বিহীন চলছে দলীয় কার্যক্রম। মাঝে সাড়ে তিন বছর আহ্বায়ক কমিটির কার্যক্রম বন্ধ ছিল। নেতাদের মধ্যেও আছে দ্বন্দ্ব-বিভক্তি। কেউ কেউ ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আঁতাত করে চলছেন বলেও গুঞ্জন রয়েছে। নেতা-কর্মীরা বলছেন, এতে বিএনপি আরও দুর্বল হচ্ছে। গত আন্দোলনে মাদারীপুর সদর, কালকিনি ও শিবচর উপজেলার ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। সাংগঠনিক দুর্বলতার জন্য হাইকমান্ডকে দায়ী করছেন।
জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১৯ জুন অ্যাডভোকেট জাফর আলী মিয়া আহ্বায়ক ও জাহান্দার আলী জাহানকে সদস্যসচিব করে ৪৩ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয়। ইতোমধ্যে কমিটির তিনজন মারা গেছেন। ২০২০ সালের ২৯ মার্চ এই কমিটি স্থগিত করা হয়। পরে ২০২৩ সালের ১২ সেটেম্বর সেই আদেশ প্রত্যাহার করা হয়। পৌর-উপজেলা কমিটি কেন্দ্রের নির্দেশে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ছাত্রদল, যুবদল চলছে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে। বর্তমানে সদস্যসচিবের বাড়িতে চলছে দলীয় কার্যক্রম।
সদস্যসচিব জাহান্দার আলী জাহান বলেন, ‘জেলার সম্মেলন ও কর্মসূচি পালনের মতো জায়গা সরকার ও প্রশাসন দেয়নি। তার পরও স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিটি কর্মসূচি পালন করেছি।’
গোপালগঞ্জ:দেশের রাজনীতিতে আলোচিত নাম গোপালগঞ্জ। এই জেলা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাড়ি। তিনি গোপালগঞ্জ-৩ থেকে নির্বাচনে অংশ নেন। এই কারণে এখানে বিএনপির কর্মসূচি পালন করা অনেক কঠিন। কোনো রাজনৈতিক কার্যালয়ও নেই। নেতা-কর্মীরাও শহরে আসতে পারেন না। জাতীয় দিবস বা মিলাদ মাহফিলের মতো কর্মসূচিও পালন করতে পারেন না বলে জানান নেতা-কর্মীরা। তাদের দাবি, ঘরোয়াভাবে কিছু কর্মসূচি পালন করলেও রাজপথে আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের বাধা বেশি।
জানা গেছে, ২০১৯ সালের ৩৭ সদস্যবিশিষ্ট তিন মাসের আহ্বায়ক কমিটিতে চলছে জেলা বিএনপি। কমিটির সদস্যসচিব এম মনসুর আলীসহ পাঁচজন মারা গেছেন। গোপালগঞ্জ সদর পৌর ও উপজেলা কমিটি রয়েছে। বাকি উপজেলা চলছে ২০১৯ সালের কমিটি দিয়ে। অঙ্গসংগঠনের মেয়াদ নেই। জেলাজুড়ে প্রভাব বিএনপির সহসাংগঠনিক সম্পাদক সেলিমুজ্জামান সেলিমের।
আহ্বায়ক শরীফ রফিকউজ্জামান বলেন, ‘কালো পতাকা বা মিলাদ মাহফিলের মতো কর্মসূচি পালনেও প্রশাসন বাধা দেয়। তার পরও শহরের বাইরে ঝটিকা আকারে প্রতিটি কর্মসূচি পালন করেছি। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এতদিন কমিটি দেওয়া যায়নি।’