বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘কমপ্লিট শাট ডাউন’ কর্মসূচি শুরুর পর থেকে ঢাকা মহানগর বিএনপিতে আবারও মামলা-হামলা ও গ্রেপ্তার আতঙ্ক ভর করেছে। সেই আতঙ্কে ঘরে ফিরতে পারছেন না নেতা-কর্মীরা। এ ছাড়া ইন্টারনেট সংযোগ এখনো স্বাভাবিক না হওয়ায় সুস্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা না পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন ঢাকা মহানগর বিএনপির নেতা-কর্মীরা। তারা কী করবেন তাও বুঝে উঠতে পারছেন না।
জানা গেছে, পালিয়ে বেড়ানো বিএনপি নেতা-কর্মীরা বাড়ি ফিরতে পারছেন না। কারণ দেশব্যাপী তুমুল সহিংসতার পরে এখন অলিগলিতে চলছে পুলিশি তল্লাশি। এ ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের মোবাইল ট্র্যাক করে গ্রেপ্তার করতে পারে, এমন আতঙ্কে বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের অনেকে মোবাইল ফোন বন্ধ রেখেছেন। এতে তৃণমূল নেতা-কর্মীরা ঢাকা মহানগরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না।
ঢাকা মহানগরের শীর্ষ তিন নেতা সাইফুল ইসলাম নীরব, রফিকুল ইসলাম মজনু ও আমিনুল হক এখন কারাগারে বন্দি। অপর শীর্ষ নেতা তানভীর আহমেদ রবিন বাইরে থাকলেও এখনো আত্মগোপনে। তারও ফোন বন্ধ রয়েছে। অন্য যারা আছেন মোবাইল ট্র্যাকের ভয়ে অভ্যন্তরীণভাবে তাদের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে নেতাকর্মীদের সুসংগঠিত হওয়া দূরে থাক; এক ধরনের অসহায় অবস্থার মধ্যে রয়েছেন।
নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ ঢাকা মহানগর বিএনপি ও ওয়ার্ড বিএনপির কার্যালয়গুলোও বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। নয়াপল্টন কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও গ্রেপ্তার এড়াতে গা-ঢাকা দিয়েছেন। বতর্মান পরিস্থিতি জানতে ঢাকা মহানগরের দায়িত্বশীল একাধিক নেতার মোবাইলে ফোন দিয়ে তা বন্ধ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠানো হলেও তারা কোনো উত্তর দেননি। বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্যরা জানান, ঢাকাসহ সব মহানগরের নেতাকর্মীদের কমবেশি সবারই মোবাইল ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপ বন্ধ রয়েছে। দলের নেতা-কর্মীরা এখন নতুন করে ঘরছাড়া।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আমাদের জানা মতে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ সারা দেশ থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিএনপিসহ বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীরা যদি আন্দোলনে জড়িত থাকে তাহলে তাদের কেন ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তার করা হয়নি? এতেই প্রমাণিত, এরা কেউই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত নন।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপি নেতাকর্মীদের বাসায় না পেয়ে তাদের সন্তান বা পরিবারের সদস্যদের গ্রেপ্তার ও অশালীন আচরণসহ বাড়ির আসবাবপত্র ভাঙচুর করা হচ্ছে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান খবরের কাগজকে গতকাল বলেন, ‘চলমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ এবং নেতাকর্মীদের খোঁজখবর রাখছেন বিএনপির হাইকমান্ড। দলের অবস্থান তুলে ধরে বিএনপি মহাসচিব নিয়মিত ব্রিফিং করছেন।’ এর বাইরে আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
ইতোমধ্যে ঢাকা মহানগরের শীর্ষ চার নেতা ছাড়াও উত্তর বিএনপির সদ্য সাবেক আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান, দলীয় নেতা এস এম জাহাঙ্গীরসহ মহানগরের প্রায় এক হাজারের মতো নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
ডিএমপির তথ্য বলছে, কোটা সংস্কারের আন্দোলন ঘিরে শুধু রাজধানীতে ২০১টি মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২ হাজার ২০৯ জনকে। এসব মামলার আসামিরা অধিকাংশই অজ্ঞাতনামা।
বিএনপির দেওয়া তথ্য মতে, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আওতায় ২৫টি থানা ও ৭৫টি ওয়ার্ড রয়েছে। এর মধ্যে দক্ষিণের ২৫টি থানা কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। কিন্তু ৬ সদস্যবিশিষ্ট আগের ওই আহ্বায়ক কমিটিকে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে বলা হয়েছিল দক্ষিণে। ন্যূনতম ৫ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি হিসেবে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ২৫টি থানা কমিটিতে ১২৫ জন নেতা রয়েছেন। এ ছাড়াও ন্যূনতম ১৩১ সদস্যবিশিষ্ট ওয়ার্ড কমিটিতে রয়েছেন ৯ হাজার ৮২৫ জন নেতা-কর্মী।
অন্যদিকে, ঢাকা মহানগর উত্তরের ২৬টি থানায় ৩১ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ও ৫৬ ওয়ার্ড কমিটি সক্রিয় রয়েছে। থানা কমিটিতে ৮০৬ জন নেতা-কর্মী রয়েছেন। ১৩১ সদস্যবিশিষ্ট ওয়ার্ড কমিটিতে ৭ হাজার ৩৩৬ জন নেতা-কর্মী রয়েছেন। সেই হিসেবে ঢাকা মহানগর বিএনপির নেতা-কর্মীর সংখ্যা ১৮ হাজারের বেশি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চলমান চিরুনি অভিযানে এই নেতাকর্মীদের অধিকাংশ এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে জানা গেছে।
একইভাবে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, রাজশাহী রংপুর, খুলনা ও বরিশাল মহানগরের নেতা-কর্মীরা গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে চলে গেছেন। নেতা-কর্মী শূন্য এসব মহানগর বিএনপির কার্যালয়গুলো। এতে ছন্দ হারিয়েছে মহানগর বিএনপির রাজনীতি।
বর্তমান পরিস্থিতিতে নেতাকর্মীদের সাহস জুগিয়ে রাজপথে চলার পরামর্শ দিচ্ছেন বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা। জানা গেছে, ঢাকা মহানগর বিএনপির নেতারা নিজ নিজ এলাকার কর্মীদের সঙ্গে বিভিন্নভাবে যোগাযোগ করছেন। যারা মামলার শিকার হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, তাদের এখন জামিন নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন শীর্ষ নেতারা। যারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলার শিকার হয়েছেন তাদেরকে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়েছেন।
মহানগর বিএনপি নেতাদের দাবি, কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরে যে সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তাতে বিএনপির নেতা-কর্মীরা যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু তাদের আসামি করা হয়েছে, চলছে তল্লাশি। সারা দেশেও একইভাবে বিএনপির নেতাকর্মীদের আসামি করা হচ্ছে।
তারা বলেন, পাশাপাশি হতাহতের ঘটনা আড়াল করতে বিএনপির নেতাকর্মীদের নামে ‘ট্যাগ’ দিয়ে ছাত্র আন্দোলন ভিন্ন দিকে নিতে চাইছে আওয়ামী লীগ সরকার। চলমান আন্দোলনে সারা দেশে দুই শতাধিকের মতো মানুষ মারা গেছে। এত মানুষের হতাহতের ঘটনা আড়াল করতেই এখন বিএনপির ওপর দোষারোপের রাজনীতি শুরু করেছে আওয়ামী লীগ।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সাবেক ১ নম্বর সদস্য তাবিথ আউয়াল খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরকারের বিরুদ্ধে আমরা প্রতিবাদ ও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। অবৈধ সরকার বিএনপিকে নানাভাবে দমন করতে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এতে মহানগরের নেতা-কর্মীরা মোটেও বিচলিত নয়। আমরা সত্য ও ন্যায়ের পথে আছি। আন্দোলন এখনো থেমে যায়নি, আমরা সবকিছু মোকাবিলা করেই সামনের দিকে এগিয়ে যাব।’