ঢাকা ৩ বৈশাখ ১৪৩২, বুধবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৫
English

বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস ২০২৫: ‘একটি টেকসই জীবনধারায় ন্যায়সঙ্গত রূপান্তর’

প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২৫, ০১:০১ পিএম
আপডেট: ১৫ মার্চ ২০২৫, ০১:০২ পিএম
বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস ২০২৫: ‘একটি টেকসই জীবনধারায় ন্যায়সঙ্গত রূপান্তর’
এস এম নাজের হোসাইন

অন্যান্য বছরের মত এবারও আগামি ১৫ মার্চ বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস ২০২০ বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বব্যাপী উদযাপিত হতে হচ্ছে। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে ‘ভোক্তাবাদ’ আন্দোলন জোরদার হয়। ১৯৬২ সালের ১৫ মার্চ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি কর্তৃক মার্কিন কংগ্রেসে ক্রেতা-ভোক্তা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার ঐতিহাসিক দিনটির স্মরণে প্রতি বছরের ১৫ মার্চ বিশ্ব জুড়ে দিবসটি বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ক্রেতা-ভোক্তা আন্দোলনে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ভোক্তা সংগঠনগুলো নানামুখী কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্বে ভোক্তা আন্দোলনের মূল প্রবক্তা মার্কিন সিনেটর ও মাল্টিন্যাশনাল মনিটর পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা রাল্ফ নাদের। ক্রেতা-ভোক্তাদের আর্ন্তজাতিক সংগঠন কনজুমারস ইন্টারন্যাশনাল বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ভোক্তা আন্দোলনে নেতৃত্বদান ও এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ভোক্তা অধিকার সুরক্ষায় এসব সংগঠনগুলো প্রয়োজনীয় কর্মসূচি চালিয়ে আসছে। কিন্তু ক্রেতা-ভোক্তাদের অধিকার কতটুকু সংরক্ষিত হচ্ছে সেটা আজও এক বড় ধরনের প্রশ্ন। একই সাথে ভোক্তা বা ক্রেতা হিসেবে অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে আমরা কতটুকু সচেতন ও কার্যকর করতে পেরেছি বা করেছি এ প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচক নয়। 

১৫ মার্চ বিশ্ব ক্রেতা-ভোক্তা অধিকার দিবসটি ১৯৮৩ সালের থেকে যথাযোগ্য মর্যাদায় বিশ্বের দেশে দেশে পালিত হয়ে আসছে। সারা বিশ্বের ভোক্তা সংগঠনগুলোর ফেডারেশন Consumer International (CI) ভোক্তা অধিকার প্রচারণার একমাত্র সম্মিলিত কণ্ঠস্বর বা দাবি আদায়ের বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক। সারা বিশ্বের ১১৫টি দেশের ২২০টিরও বেশি সংগঠন এর সদস্য। বাংলাদেশের একমাত্র ও শীর্ষস্থানীয় ভোক্তা সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কনজুমার ইন্টারন্যাশনাল এর পূর্ণাঙ্গ সদস্য। বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য হলোঃ টেকসই ভোক্তা (A Just Transition to Sustainable Lifestyles)!। বাংলাদেশে বিষয়টি মুজিবর্ষের সাথে সামঞ্জস্য রেখে নির্ধারন করা হয়েছে “একটি টেকসই জীবনধারায় ন্যায়সঙ্গত রূপান্তর”। বিষয়টি আমাদের সকলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ন। কারন ভোক্তা অধিকার কী রাস্ট্র, সমাজ, ব্যবসায়ী, উৎপাদক, প্রশাসন-আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ সবাই ভোক্তা হলেও ভোক্তার করনীয় ও দায়িত্ব সর্ম্পকে ধারনার অভাব রয়েছে। 

“ভোক্তা” শব্দের সাথে আমরা সকলেই পরিচিত। ভোক্তার ইংরেজী শব্দ কনজুমার যার অর্থ ভোগকারী। অর্থাৎ কেউ কোন পণ্য, খাদ্য, পানীয় দ্রব্য বা সেবা প্রদানকারীর সেবা গ্রহণ করে অর্থাৎ যারা ভোগ করে তাদেরকে ভোক্তা বলে। দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ ২০০৯ এর আওতায় ভোক্তা হলেন “তিনিই যিনি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ব্যতীত, সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করে বা সম্পূর্ণ বাকিতে পণ্য বা সেবা ক্রয় করেন, অথবা কিস্তিতে পণ্য বা সেবা ক্রয় করেন”। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ কোনো না কোনোভাবে একজন ভোক্তা। আবার অনেকে বলে থাকেন “মানুষের জীবন ও জীবিকার সাথে যে সমস্ত অধিকার ও সুযোগ-সুবিধাগুলি রাস্ট্র ও জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত” এগুলিই ভোক্তা অধিকারের আওতায়। জাতিসংঘ স্বীকৃত ভোক্তা অধিকারগুলির মধ্যে “অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের মৌলিক চাহিদা পুরনের অধিকার”, “নিরাপদ পণ্য ও সেবা পাওয়ার অধিকার”, “পণ্যের উপাদান, ব্যবহারবিধি, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ইত্যাদির তথ্য জানার অধিকার”, “যাচাই বাছাই করে ন্যায্য মূল্যে সঠিক পণ্য ও সেবা পাবার অধিকার”, “কোন পণ্য বা সেবা ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্থ হলে ক্ষতিপুরণ পাওযার অধিকার”, “অভিযোগ করার ও প্রতিনিধিত্বের অধিকার”, “ক্রেতা-ভোক্তা হিসাবে অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষা লাভের অধিকার”, “স্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ ও বসবাস করার অধিকার” অন্যতম। তবে অধিকারের পাশাপাশি কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কেও বলা হলেও এ বিষয়গুলি সম্পর্কে আমাদের উদাসীনতা একেবারেই কম নয়। বিষয়গুলো হলো; “পণ্য বা সেবার মান ও গুনাগুন সম্পর্কে সচেতন ও জিজ্ঞাসু হোন”, “দরদাম করে সঠিক পণ্যটি বাছাই করুন”, “আপনার আচরনে অন্য ক্রেতা যেন ক্ষতিগ্রস্থ না হন সে ব্যাপারে সচেতন থাকুন”, “পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সচেতন ও সক্রিয় হোন”, “ক্রেতা-ভোক্তা হিসাবে অধিকার সংরক্ষনে সেচ্ছার ও সংগঠিত হোন”।

বিশ্বের সর্বাপেক্ষা অর্থনৈতিক গোষ্ঠি ভোক্তাদের স্বার্থ চিন্তা করে প্রতি বছর ১৫ মার্চ বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস পালন করা হয়ে আসছে। যদিও বাংলাদেশে সরকারিভাবে এই দিবসটি পালনের কোন কর্মসূচি নাই। ব্যবসায়ীসহ নানা গোষ্ঠির নানা দিবস সরকারি তালিকায় স্থান পেলেও ভোক্তাদের একটি মাত্র দিবস তালিকায় স্থান না পাওয়ায় ভোক্তা হিসাবে আবারও বৈষম্যের শিকার হলো বলে অনেকে মন্তব্য করছেন। ক্যাবসহ অনেক সংগঠন নিজস্ব উদ্যোগে দিবসটি পালনের উদ্যোগ নিয়েছে। যেখানে বিশ্বব্যাপী ভোক্তা সুরক্ষার মূল বিষয়গুলি তুলে ধরে এবং শক্তিশালী ভোক্তা অধিকারের পক্ষে কথা বলে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলিতে, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলি জীবনযাত্রায় নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা তৈরী করে। এবার ২০২৫ সালে, বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, "একটি ন্যায়সঙ্গত টেকসই জীবনযাত্রায় রূপান্তর," টেকসইজীবনযাত্রার জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতির আহ্বান জানায়, যা সকলের জন্য ন্যায্যতা এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় অভিগম্যতা নিশ্চিত করে। 

যদিও স্থায়িত্বশীল জীবনযাত্রার বিষয়টি প্রায়শই বড় অর্থনীতির দ্বারা প্রভাবিত একটি বৈশ্বিক সমস্যা বলে মনে হলেও বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলির অনন্য পরিস্থিতি বিরাজমান রয়েছে যার স্থানীয় সমাধান প্রয়োজন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি ন্যায়সঙ্গত রূপান্তর অর্থ একটি "ন্যায়সঙ্গত রূপান্তর" নিশ্চিত করে যে টেকসই অর্থনৈতিক কষ্ট, বৈষম্য বা সামাজিক বর্জন খচরে তালিকায় আসে না। 

বাংলাদেশি ভোক্তাদের জন্য, এর অর্থ হল পরিবেশ-বান্ধব পছন্দগুলি শুধু ধনীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত নয় বরং সকলের জন্য একটি সহজলভ্যতার সুযোগ তৈরী এবং সাশ্রয়ী মূল্যের বিকল্প হওয়া উচিত।

ইতিমধ্যে আমাদের সকলের কাছে পরিস্কার হয়েছে, টেকসই জীবনযাপনের দিকে বাংলাদেশের জন্য বড় প্রতিবন্ধক ও হুমকি হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, ক্রমবর্ধমান সমুদ্রপৃষ্ঠ উচ্চতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন জনিত প্রভাব ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং খাদ্য নিরাপত্তা । 

তবে সবুজ জীবনযাত্রার দিকে এগিয়ে যেতে হলে অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ হতে হবে। বাংলাদেশে অনেক গুলো পণ্য আমদানি হয়। যা আর্ন্তজাতিক বাজারের মূল্যের ওপর নির্ভর করে। তবে আমদানিকৃত পণ্যের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করে স্থানীয়ভাবে তৈরি, পরিবেশ-বান্ধব বিকল্পগুলিতে রূপান্তর অবশ্যই অর্থনৈতিকভাবে কার্যকর হতে হবে।

টেকসই জীবনধারায় ভোক্তাদের যে সমস্ত মুখোমুখি চ্যালেঞ্জ
অতিরিক্ত খরচের বোঝা এবং বাজার ব্যবস্থায় সকলশ্রেণী পেশার মানুষের সম-অভিগম্যতার সুযোগ, জৈব খাদ্য, বায়োডেগ্রেডেবল প্যাকেজিং এবং নবায়নযোগ্য সৌর শক্তি সমাধানগুলির মতো টেকসই পণ্যগুলি প্রায়শই প্রচলিত বিকল্পগুলির চেয়ে বেশি দামে কিনতে হয়। অনেক ভোক্তা তাদের দীর্ঘমেয়াদী সুবিধা সত্ত্বেও সামর্থের অভাবে এই বিকল্পগুলি ক্রয় করতে পারে না। একইভাবে, টেকসই চাষের কৌশলগুলি খাদ্য নিরাপত্তা বাড়িয়ে তুলতে পারে। সাধারন মানুষের মাঝে এ বিষয়ে তবে প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। ক্রয়ক্ষমতার দিকে নজর না দেওয়া হলে টেকসই বিকল্পগুলি বেশিরভাগ সাধারন মানুষের নাগালের মধ্যে আসবে না। 

ভুল তথ্য এবং পরিবেশবান্ধব
অনেক ভোক্তা সত্যিকারের টেকসই পণ্য এবং সত্যিকারের পরিবেশবান্ধব সুবিধা ছাড়াই "সবুজ" হিসাবে বিপণনকারীদের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। পরিবেশ বান্ধব নয় এমন সব ব্যবসাগুলিকে যখন মিথ্যাভাবে পরিবেশগত দায়বদ্ধতা দাবি করে তখন ভোক্তাদের পক্ষে সত্যিকারের পরিবেশ বান্ধব পণ্যগুলো পছন্দগুলি করা আরও কঠিন হয়ে যায়। টেকসই দাবিগুলি বিশ্বাসযোগ্য কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য স্পষ্ট লেবেলিং, জনসচেতনতা প্রচার ও শক্তিশালী আইনগত বিধিবিধান প্রয়োজন।

অবকাঠামো ও নীতিগত ফাঁকফোকর
পুনর্ব্যবহারযোগ্য সুবিধার অভাব, অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা এবং পরিবেশগত নীতিগুলির দুর্বল প্রয়োগের কারনে টেকসই ব্যবহারের রূপান্তরকে বাধা দিচ্ছে। যদিও প্লাস্টিক নিষিদ্ধকরণ এবং সংরক্ষণের প্রচেষ্টা গতি অর্জন করেছে, বর্জ্য নিষ্পত্তি এবং টেকসই পণ্যের প্রাপ্যতায় চ্যালেঞ্জগুলি এখনও বিদ্যামান। উন্নত অবকাঠামো, যেমন উন্নত পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্রোগ্রাম এবং ব্যবসায়ের জন্য পরিবেশ-বান্ধব প্যাকেজিং গ্রহণের জন্য প্রণোদনা, এই ব্যবধানটি পূরণ করতে সহায়তা করতে পারে।

ভোক্তাদের জন্য ন্যায্য রূপান্তরকে সমর্থন করতে পারে
ভোক্তা, ব্যবসা এবং নীতিনির্ধারকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা টেকসই উন্নয়নের দিকে এমনভাবে স্থানান্তরকে ত্বরান্বিত করতে পারে যা সকল ভোক্তাদের উপকারে আসতে পারে।

ভোক্তা অধিকার ও সচেতনতা জোরদার করা
আমাদের দেশের ভোক্তারা এখনও স্বাধীনভাবে পণ্য পছন্দ করা ও ক্রয় করতে পারে না। তারা বিক্রয় প্রতিনিধি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার প্রচারণা, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে বিজ্ঞাপনের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ পণ্য লেবেলিংয়ে স্বচ্ছতার পক্ষে এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য দাবির জন্য ব্যবসায়ীকে জবাবদিহি করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যার কারণে একটি পরিপূর্ণ লেবেলিং আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাজার ও কমিউনিটি গ্রুপ ভিত্তিক, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং বিভিন্ন পেশাজীবি ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের আচার অনুষ্ঠানগুলোতে ভোক্তা শিক্ষার সম্প্রসারণ করে সাধারন ভোক্তাদেরকে এ বিষয়ে আরও বেশি অবহিত করা, নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী পণ্য ও সেবা ক্রয় করতে পারে কিনা সে বিষয়ে আরও ক্ষমতায়িত করতে হবে।

টেকসই পণ্যগুলিকে আরও সাশ্রয়ী মূল্যের করা
টেকসই ও পরিবশে বান্ধব পণ্যের দাম কমাতে সরকারি ও বেসরকারি খাতকে একযোগে কাজ করতে হবে। সম্ভাব্য ব্যবস্থাগুলির মধ্যে রয়েছে:
•    প্রচলিত বিকল্পগুলির সাথে আরও প্রতিযোগিতামূলক করার জন্য পরিবেশ-বান্ধব পণ্যগুলিকে ভর্তুকি দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
•    টেকসই অনুশীলন গ্রহণকারী ব্যবসায়ের জন্য কর প্রণোদনা, সবুজ পণ্যগুলির বিস্তৃত গ্রহণকে উত্সাহিত করা।
•    টেকসই পণ্যের স্থানীয় উৎপাদনে বিনিয়োগ, ব্যয়বহুল আমদানির উপর নির্ভরতা হ্রাস করা।
এই কৌশলগুলি বাস্তবায়নের মাধ্যমে, টেকসই বিকল্পগুলি পণ্যগুলোর সাধারণ মানুষের কাছে আরও সহজলভ্য হয়ে উঠতে পারে।

স্থানীয় উদ্যোগে টেকসই উদ্যোগকে উৎসাহিত করা
পরিবর্তনের জন্য যে কোন স্থানীয় উদ্যোগের টেকসই কার্যকর পরিবর্তন চালানো সম্ভাব। সমবায়ী ভিত্তিক স্থানীয় কৃষি ও সবজি বাগান, শেয়ারে চলা সাশ্রয়ী গণপরিবহন পরিষেবা এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য ইলেক্ট্রনিক উপকরণ ও  ড্রাইভের মতো প্রোগ্রামগুলি স্থায়িত্বকে আরও ব্যবহারিক এবং সাশ্রয়ী মূল্যে করতে করতে পারে। পরিবেশসম্মত ও টেকসই জীবনযাত্রাকে উৎসাহিত করে এমন ছোট ব্যবসায়গুলিকে অগ্রাধিকার দিয়ে উৎসাহিত করতে হবে। যেখানে স্থানীয়ভাবে তৈরী বায়োডেগ্রেডেবল পণ্য যা পরিবেশগত প্রভাব হ্রাস করার সময় স্থানীয় অর্থনীতিকেও শক্তিশালী করতে পারে।

সরকারি বিধিবিধান ও কর্পোরেট জবাবদিহিতা জোরদার করা
সরকারকে অবশ্যই কঠোর পরিবেশগত বিধিবিধান প্রয়োগ অব্যাহত রাখতে হবে, যেমন:
•    বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং প্লাস্টিক হ্রাসের জন্য ব্যবসাগুলিকে জবাবদিহি করা।
•    সংস্থাগুলির জন্য টেকসই প্রতিবেদন বাধ্যতামূলক করা, তাদের পরিবেশগত প্রভাবের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।
•    সৌর ও বায়ু বিদ্যুৎকে গৃহস্থালি ও ব্যবসার জন্য আরও সহজলভ্য করার জন্য পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির প্রণোদনা প্রসারিত করা।
•    সরকার-সমর্থিত প্রোগ্রামগুলিও টেকসই পাবলিক ট্রান বিকাশের দিকে কাজ করা উচিত

ন্যায়সঙ্গত রূপান্তরে ব্যবসায়ীদের ভূমিকা
ব্যবসাগুলি সবুজ অনুশীলন গ্রহণ করে, সাশ্রয়ী মূল্যের পরিবেশ-বান্ধব বিকল্প সরবরাহ করে এবং কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) উদ্যোগে জড়িত হয়ে স্থায়িত্ব প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্জ্য সংগ্রহ অভিযান, পরিবেশগত শিক্ষা প্রচার এবং বৃক্ষরোপণ প্রচেষ্টার মতো টেকসই প্রোগ্রামগুলি চালানোর জন্য বড় বড় করপোরেট গ্রুপ, ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এবং বেসরকারী উন্নয়ন সংগঠন(এনজিও)গুলির সাথে অংশীদারিত্ব বাড়ানো যেতে পারে। তাদের ব্যবসায়িক প্রচলিত পদ্ধতিতে স্থায়িত্ব জোরদার করে সবুজ অর্থনীতির দিকে রূপান্তরে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে।

সম্মিলিত কর্মের শক্তি
যেহেতু পুরো বিশ্ব এখন একটি ন্যায়সঙ্গত রূপান্তরের পথে অগ্রসর হচ্ছে, ব্যবসা বানিজ্যসহ প্রত্যেক অংশীজন-ভোক্তা, ব্যবসায়ী, নীতিনির্ধারক এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দকে অবশ্যই তাদের ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসতে হবে। টেকসই জীবনযাত্রার দিকে যাত্রা অবশ্যই যাদের আয় ও সম্পদ কম তাদেরকে এপ্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হতে বাধা প্রদান করা হলে পুরো সমাজ কোন ভা্বেই এগিয়ে যেতে পারবে না। কারণ কাউকে পিছিয়ে রেখে সমাজ কোনভাবেই এগিয়ে যেতে পারবে না। তাই সমাধানগুলি অবশ্যই অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।

বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস ২০২৫ আমাদেরকে বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে, স্থীয়ত্বশীল জীবনধারায় একজন নাগরিক, একজন ভোক্তা হিসাবে সত্যিকারের পরিবেশগত দায়বদ্ধতার বিষয়টি। যাতে সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধি, পেশাজীবি যে যে আয়ের হোক না কেন, কেউ যেন স্থায়ীত্বশীল জীবনযাত্রার রূপান্তরে যেন পিছিয়ে না পড়ে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে ন্যায়সঙ্গত রূপান্তরে টেকসই জীবনযাত্রা এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জনে একসাথে চলে পুরো বিশ্বের জন্য অনুকরনীয় মডেল হয়ে উঠতে বাংলাদেশ যেন নেতৃত্ব দিতে পারে, সে প্রত্যাশা সকলের।

লেখক: ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)
[email protected]

আমেরিকার ডিসকাউন্টেট রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ

প্রকাশ: ০৪ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:১৯ পিএম
আমেরিকার ডিসকাউন্টেট রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ
রিয়াজুল হক

বিভিন্ন দেশের পণ্যের ওপর আমেরিকা ট্যারিফ বাড়িয়ে দিয়েছে। যে সিস্টেমে ট্যারিফ বাড়িয়েছে সেটাও দুর্দান্ত রকমের অদ্ভুত একটা ব্যাপার। 

যেমন- কম্বোডিয়া ৯৭ শতাংশ ট্যারিফ চার্জ করতো আমেরিকার নির্ধারিত পণ্যের ওপর, এখন আমেরিকা ৪৯ শতাংশ ট্যারিফ চার্জ নির্ধারণ করেছে। ভিয়েতনাম ৮৮ শতাংশ ট্যারিফ চার্জ করতো আমেরিকার নির্ধারিত পণ্যের ওপর, এখন আমেরিকা ভিয়েতনামের ওপর ৪৪ শতাংশ ট্যারিফ চার্জ নির্ধারণ করেছে। আর নাম দেওয়া হয়েছে ডিসকাউন্ট রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ।

তবে এই পদ্ধতিতে আমাদের পোশাক শিল্পের ওপর একটা প্রভাব আসতে পারে। আমাদের পোশাক খাতের ওপর এতদিন ট্যারিফ ছিল ১৫ শতাংশ, কিন্তু নতুন ট্যারিফের হার ৩৭ শতাংশ নির্ধারিত হয়েছে। অন্যদিকে পোশাক খাতে আমাদের প্রতিযোগী দেশ, যেমন চীনের ওপর ৩৪ শতাংশ, ভারতের ওপর ২৬ শতাংশ, তুরস্কের ওপর ১০ শতাংশ ট্যারিফ চার্জ হবে। আমেরিকার আমদানিকারকরা কম ট্যারিফ দেওয়ার সুযোগে হয়তো আমাদের প্রতিযোগী দেশের দিকেও ঝুঁকতে পারে। আমেরিকা আমাদের জন্য অনেক বড় মার্কেট। অথচ কম ট্যারিফের কারণে পোশাক খাতে আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো আমাদের থেকে কম্পিটিটিভ অ্যাডভান্টেজ পাবে।

২০২৩ সালে বাংলাদেশ আমেরিকায় ৭.২৯ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানি করে এবং প্রায় ২.২১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্যে আমেরিকা থেকে আমদানি করে। আমেরিকায় আমাদের রপ্তানির পরিমাণ আমদানি থেকে প্রায় সাড়ে তিনগুণ বেশি। অর্থাৎ সেখানে আমাদের ট্রেড সারপ্লাস।

এখন আমাদের উচিত, কীভাবে আমাদের রপ্তানি পোশাক শিল্পের ওপর ট্যারিফ কমানো যায়, সেই বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করা। প্রয়োজনে আমরা আমেরিকার কিছু আমদানি করা পণ্যের ওপরও ট্যারিফ কমিয়ে দিতে পারি। যেহেতু আমেরিকা ডিসকাউন্টেট রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ ফলো করছে। 

কেউ কেউ বলতে পারেন, আমেরিকা আমদানি নিরুৎসাহিত করতে চাইছে। তারা নিজেরাই সবকিছু উৎপাদন করবে। এটা কি আদৌ সম্ভব? যেমন ধরুন, আমাদের মোংলা ইপিজেডের মধ্যে যেসব পোশাক কারখানা রয়েছে, সেখানে একজন ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা বেতনে সারা মাস চাকরি করেন‌। আমেরিকায় কাউকে পাবেন, যিনি ৫০ ডলার বেতনে সারা মাস চাকরি করবে? সুতরাং বিষয়টি বাস্তবসম্মত নয়।

এটা ঠিক, ট্যারিফ বাড়িয়ে আমেরিকার সরকারের আয় বাড়বে। বাড়তি ট্যারিফ দিতে যেয়ে সেখানকার আমদানিকারকদের খরচ বাড়বে। আর সেই বাড়তি খরচের জন্য আমদানি করা পণ্যের মূল্য বেড়ে যাবে। আলটিমেট প্রভাবটা পড়বে কাদের ওপর? ঠিক ধরেছেন, আমেরিকার জনগণের ওপর। তাদের বেশি মূল্যে আগের পণ্য কিনতে হবে।

লেখক: যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।

ইতিহাসের আড়ালে ৫৪ বছর একাত্তর সালের ডহরপাড়া গণহত্যা

প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২৫, ০৯:৫৭ পিএম
ইতিহাসের আড়ালে ৫৪ বছর একাত্তর সালের ডহরপাড়া গণহত্যা

একাত্তর সালে বাংলাদেশের নিরীহ সাধারণ মানুষের ওপর পাকিস্তানি বাহিনী ও স্বাধীনতাবিরোধীরা বীভৎস গণহত্যা চালিয়েছিল। এই বর্বর গণহত্যা থেকে রক্ষা পায়নি এ দেশের শিশু ও নারীরা। বরিশালের উজিরপুর উপজেলার গুঠিয়া ইউনিয়নের সবুজে বেষ্টিত মেঠোপথের ডহরপাড়া গ্রামের সাধারণ মানুষও রক্ষা পায়নি সেই গণহত্যা থেকে। রক্তাক্ত সেই ভয়াল দিনের কথা বলতে গেলে এখনো গ্রামের লোক শিউরে ওঠে, কান্নায় কথা আটকে যায় স্বজনদের। একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবর, মুক্তিযুদ্ধ কোষ এবং গণহত্যা-বধ্যভূমি ও গণকবর জরিপ গ্রন্থেও ডহরপাড়া গণহত্যার ওপর অত্যন্ত সংক্ষেপে আলোকপাত করা আছে।

ডহরপাড়া গ্রামের গণহত্যার দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার ১৯৭১ সালের ২০ মে। অনুসন্ধান, গবেষণা ও শহিদ পরিবারের সদস্য এবং স্থানীয়দের ভাষ্য অনুসারে সেদিন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ১৭ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি সৈন্যরা। বর্তমানে গ্রামটির যোগাযোগব্যবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আজ থেকে ৫৪ বছর আগে ডহরপাড়া গ্রামের যোগাযোগব্যবস্থা ছিল খুবই অনুন্নত ও ভরগ্রাম। ভৌগলিক অবস্থানের কারণে এত ভিতরে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রবেশ করার সুযোগ ছিল না। গ্রামের শহিদ পরিবার ও এলাকাবাসীর ধারণা, মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে কিছুদিন আগে মারা গিয়েছিলেন পার্শ্ববর্তী মাধবপাশা এলাকার তৎকালীন স্বাধীনতাবিরোধী নেতা সিরাজ মাওলানা। ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবে বরিশাল ত্রিশ গোডাউন ক্যাম্প থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী লঞ্চে করে ভোরে এসে ভেড়ে গুঠিয়ার কালিজিরা নদীর পাড়ে। অপরিচিত এলাকা হওয়ার কারণে পথ ভুলে গুঠিয়ার এপাড়ে উঠে এসে বটতলা থেকে গণহত্যা শুরু করে ডহরপাড়া গ্রামে প্রবেশ করে পাকিস্তানি সৈন্যরা। এ সময় গ্রামের লোকজন ভয়ে ছোটাছুটি শুরু করে। গ্রামের মুসলমানদের মধ্যে তাৎক্ষণিক ধারণা হয়েছিল যে, মুসলমান ভাই ভাই। এ কারণে অনেকেই টুপি, পাঞ্জাবি পরে কোরআন শরিফ পড়ছিল ঘরে বসে। তবুও শেষ রক্ষা হয়নি অনেকের।

বটতলায় পাকিস্তানিদের হাতে প্রথম শহিদ হন ডহরপাড়ার গ্রামের জুম্মাত আলী ফকিরের ছেলে মালেক ফকির (২৭)। আব্দুল মালেক হাওলাদারের বাড়িতে হত্যা করে দুজনকে। গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধা সাত্তার মোল্লার সামনেই হত্যা করে মেহের উদ্দিন হাওলাদারের ছেলে বয়োজ্যেষ্ঠ আজিমউদ্দিন হাওলাদারকে (৮০)। এই বীভৎস্য গণহত্যা দেখে সাত্তার মোল্লার মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার আগ্রহ তৈরি হয় এবং পরদিনই তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য দেশ ছাড়েন। এভাবেই গণহত্যা চালিয়ে হত্যা করে ডহরপাড়া গ্রামের তালুকদার বাড়ির গোলাম কাদেরের ছেলে কাশেম তালুকদার (৫৫), মেনাজ উদ্দিন হাওলাদারে ছেলে তুজুম্বর (৪৫), হাওলাদারবাড়ির সোবাহান হাওলাদারের ছেলে হাশেম হাওলাদার (৩২), আব্দুল আজিজ হাওলাদারের ছেলে নূর মোহাম্মদ হাওলাদার (৪৫), তোরাব হাওলাদারের ছেলে ওহাব হাওলাদার (৬৫), সাদেত আলী হাওলাদের ছেলে আশরাফ আলী (২৫), আজাহার আলী হাওলাদারের  ছেলে লতিফ আলী হাওলার (২৪), হাতেম আলী হাওলাদারের ছেলে আব্দুল মান্নান হাওলাদার মনা (২০), হাসেম আলী হাওলাদারের ছেলে নুরুল ইসলাম হাওলাদার (২৬), নিজামউদ্দিন হাওলাদারের ছেলে কদম আলী হাওলাদার (৪৬), আফসার উদ্দিন হাওলাদারের ছেলে মোশারফ হোসেন হাওলাদার (৬০), ঝালকাঠি পরমহল নবগ্রামের ময়িজ উদ্দিন হাওলাদারের ছেলে মোবারক হোসেন হাওলাদার (৬০), সিকদারবাড়ির কদম আলী সিকদারের ছেলে ইসমাইল সিকদার (৩৬) ও লস্করবাড়ির হামেদ লস্করের ছেলে মুজাহার লস্কর (৪৫) এবং ডহরপাড়া গ্রামের সবার কাছে মেহেন্দী গঞ্জের হুজুর নামে পরিচিত এক ব্যক্তিসহ মোট ১৭ জনকে হত্যা করে পাকিস্তানিরা। স্থানীয়দের কাছে তিনি মেহেন্দি গঞ্জের হুজুর নামেই পরিচিত ছিলেন যার মূল বাড়ি ছিল হিজলা উপজেলায় এবং তিনিও স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করতেন। শহিদ আশরাফ আলী সেনাবাহিনীতে চাকরি করতেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি এলাকায় এসে দেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে এলাকার মানুষকে সংগঠিত করে গ্রামের সামাদিয়া দারুল উলুম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ দিতেন। শহিদ কদম আলী হাওলাদারও পেশায় শিক্ষকতা করতেন। 

ওইদিনের গণহত্যায় আহত হন হাওলাদার বাড়ির নিজাম উদ্দিন হাওলাদারের ছেলে কাশেম আলী হাওলাদার (৩০), ইয়াছিন আলী হাওলাদারের ছেলে আজাহার আলী হাওলাদার (৫০) ও মৃত সাদেক আলী মুন্সির ছেলে আব্দুল ওহাব আলী হাওলাদার (২২), তালুকদার বাড়ির লেহাজ উদ্দিন হাওলাদারের ছেলে আব্দুল হাই হাওলাদার (৩০)। আহতদের মধ্যে ওহাব আলী হাওলাদার ছিলেন পেশায় শিক্ষক।

 

এই গণহত্যার সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ওইদিন পাকিস্তানি বাহিনীদের হাতে শহিদ হয়েছেন স্থানীয় শিক্ষক, চাকরিজীবী, মসজিদের ইমাম, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ। ডহরপাড়া গ্রাম ও শহিদদের পরিবারের অনেক সদস্য স্থানীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। 

তবে ডহরপাড়ার এই গণহত্যা নিয়ে স্বাধীনতার এত বছরেও উল্লেখযোগ্য কোনো গবেষণা কিংবা তথ্যচিত্র নির্মিত হয়নি। এত বছরে শহিদ পরিবারের সদস্যরা শহিদের মর্যাদা পাননি। শহিদদের স্মৃতিরক্ষার্থে কোনো শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়নি। বেশির ভাগ শহিদের স্থানীয়ভাবে কাফনের কাপড় সংগ্রহ করে কিংবা বাড়ির মহিলাদের পরনের সাদা কাপড় দিয়ে দ্রুত দাফন করা হয়েছিল। গণহত্যায় শহিদদের জানাজার নামাজ পড়িয়েছিলেন আবুল বাশার হুজুর ও ইস্কান্দার মৌলভী এবং চেরাগ আলী মুন্সি। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যরাই নিজেদের মতো করে জানাজা ও দাফন-কাফন করেছিলেন। 

লেখক: রাইসা রহমান উর্মি, এমএড (প্রশিক্ষণার্থী), সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকা ও ইমাম মেহেদী, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক, পিএস টু ভিসি, লালন বিজ্ঞান ও কলা বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস ২০২৫: ‘একটি টেকসই জীবনধারায় ন্যায়সঙ্গত রূপান্তর’

প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২৫, ০১:০১ পিএম
আপডেট: ১৫ মার্চ ২০২৫, ০১:০২ পিএম
বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস ২০২৫: ‘একটি টেকসই জীবনধারায় ন্যায়সঙ্গত রূপান্তর’
এস এম নাজের হোসাইন

অন্যান্য বছরের মত এবারও আগামি ১৫ মার্চ বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস ২০২০ বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বব্যাপী উদযাপিত হতে হচ্ছে। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে ‘ভোক্তাবাদ’ আন্দোলন জোরদার হয়। ১৯৬২ সালের ১৫ মার্চ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি কর্তৃক মার্কিন কংগ্রেসে ক্রেতা-ভোক্তা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার ঐতিহাসিক দিনটির স্মরণে প্রতি বছরের ১৫ মার্চ বিশ্ব জুড়ে দিবসটি বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ক্রেতা-ভোক্তা আন্দোলনে বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ভোক্তা সংগঠনগুলো নানামুখী কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্বে ভোক্তা আন্দোলনের মূল প্রবক্তা মার্কিন সিনেটর ও মাল্টিন্যাশনাল মনিটর পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা রাল্ফ নাদের। ক্রেতা-ভোক্তাদের আর্ন্তজাতিক সংগঠন কনজুমারস ইন্টারন্যাশনাল বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ভোক্তা আন্দোলনে নেতৃত্বদান ও এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ভোক্তা অধিকার সুরক্ষায় এসব সংগঠনগুলো প্রয়োজনীয় কর্মসূচি চালিয়ে আসছে। কিন্তু ক্রেতা-ভোক্তাদের অধিকার কতটুকু সংরক্ষিত হচ্ছে সেটা আজও এক বড় ধরনের প্রশ্ন। একই সাথে ভোক্তা বা ক্রেতা হিসেবে অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে আমরা কতটুকু সচেতন ও কার্যকর করতে পেরেছি বা করেছি এ প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচক নয়। 

১৫ মার্চ বিশ্ব ক্রেতা-ভোক্তা অধিকার দিবসটি ১৯৮৩ সালের থেকে যথাযোগ্য মর্যাদায় বিশ্বের দেশে দেশে পালিত হয়ে আসছে। সারা বিশ্বের ভোক্তা সংগঠনগুলোর ফেডারেশন Consumer International (CI) ভোক্তা অধিকার প্রচারণার একমাত্র সম্মিলিত কণ্ঠস্বর বা দাবি আদায়ের বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক। সারা বিশ্বের ১১৫টি দেশের ২২০টিরও বেশি সংগঠন এর সদস্য। বাংলাদেশের একমাত্র ও শীর্ষস্থানীয় ভোক্তা সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কনজুমার ইন্টারন্যাশনাল এর পূর্ণাঙ্গ সদস্য। বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য হলোঃ টেকসই ভোক্তা (A Just Transition to Sustainable Lifestyles)!। বাংলাদেশে বিষয়টি মুজিবর্ষের সাথে সামঞ্জস্য রেখে নির্ধারন করা হয়েছে “একটি টেকসই জীবনধারায় ন্যায়সঙ্গত রূপান্তর”। বিষয়টি আমাদের সকলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ন। কারন ভোক্তা অধিকার কী রাস্ট্র, সমাজ, ব্যবসায়ী, উৎপাদক, প্রশাসন-আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ সবাই ভোক্তা হলেও ভোক্তার করনীয় ও দায়িত্ব সর্ম্পকে ধারনার অভাব রয়েছে। 

“ভোক্তা” শব্দের সাথে আমরা সকলেই পরিচিত। ভোক্তার ইংরেজী শব্দ কনজুমার যার অর্থ ভোগকারী। অর্থাৎ কেউ কোন পণ্য, খাদ্য, পানীয় দ্রব্য বা সেবা প্রদানকারীর সেবা গ্রহণ করে অর্থাৎ যারা ভোগ করে তাদেরকে ভোক্তা বলে। দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ ২০০৯ এর আওতায় ভোক্তা হলেন “তিনিই যিনি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ব্যতীত, সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করে বা সম্পূর্ণ বাকিতে পণ্য বা সেবা ক্রয় করেন, অথবা কিস্তিতে পণ্য বা সেবা ক্রয় করেন”। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ কোনো না কোনোভাবে একজন ভোক্তা। আবার অনেকে বলে থাকেন “মানুষের জীবন ও জীবিকার সাথে যে সমস্ত অধিকার ও সুযোগ-সুবিধাগুলি রাস্ট্র ও জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত” এগুলিই ভোক্তা অধিকারের আওতায়। জাতিসংঘ স্বীকৃত ভোক্তা অধিকারগুলির মধ্যে “অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের মৌলিক চাহিদা পুরনের অধিকার”, “নিরাপদ পণ্য ও সেবা পাওয়ার অধিকার”, “পণ্যের উপাদান, ব্যবহারবিধি, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ইত্যাদির তথ্য জানার অধিকার”, “যাচাই বাছাই করে ন্যায্য মূল্যে সঠিক পণ্য ও সেবা পাবার অধিকার”, “কোন পণ্য বা সেবা ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্থ হলে ক্ষতিপুরণ পাওযার অধিকার”, “অভিযোগ করার ও প্রতিনিধিত্বের অধিকার”, “ক্রেতা-ভোক্তা হিসাবে অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষা লাভের অধিকার”, “স্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ ও বসবাস করার অধিকার” অন্যতম। তবে অধিকারের পাশাপাশি কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কেও বলা হলেও এ বিষয়গুলি সম্পর্কে আমাদের উদাসীনতা একেবারেই কম নয়। বিষয়গুলো হলো; “পণ্য বা সেবার মান ও গুনাগুন সম্পর্কে সচেতন ও জিজ্ঞাসু হোন”, “দরদাম করে সঠিক পণ্যটি বাছাই করুন”, “আপনার আচরনে অন্য ক্রেতা যেন ক্ষতিগ্রস্থ না হন সে ব্যাপারে সচেতন থাকুন”, “পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সচেতন ও সক্রিয় হোন”, “ক্রেতা-ভোক্তা হিসাবে অধিকার সংরক্ষনে সেচ্ছার ও সংগঠিত হোন”।

বিশ্বের সর্বাপেক্ষা অর্থনৈতিক গোষ্ঠি ভোক্তাদের স্বার্থ চিন্তা করে প্রতি বছর ১৫ মার্চ বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস পালন করা হয়ে আসছে। যদিও বাংলাদেশে সরকারিভাবে এই দিবসটি পালনের কোন কর্মসূচি নাই। ব্যবসায়ীসহ নানা গোষ্ঠির নানা দিবস সরকারি তালিকায় স্থান পেলেও ভোক্তাদের একটি মাত্র দিবস তালিকায় স্থান না পাওয়ায় ভোক্তা হিসাবে আবারও বৈষম্যের শিকার হলো বলে অনেকে মন্তব্য করছেন। ক্যাবসহ অনেক সংগঠন নিজস্ব উদ্যোগে দিবসটি পালনের উদ্যোগ নিয়েছে। যেখানে বিশ্বব্যাপী ভোক্তা সুরক্ষার মূল বিষয়গুলি তুলে ধরে এবং শক্তিশালী ভোক্তা অধিকারের পক্ষে কথা বলে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলিতে, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তন এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলি জীবনযাত্রায় নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা তৈরী করে। এবার ২০২৫ সালে, বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, "একটি ন্যায়সঙ্গত টেকসই জীবনযাত্রায় রূপান্তর," টেকসইজীবনযাত্রার জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতির আহ্বান জানায়, যা সকলের জন্য ন্যায্যতা এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় অভিগম্যতা নিশ্চিত করে। 

যদিও স্থায়িত্বশীল জীবনযাত্রার বিষয়টি প্রায়শই বড় অর্থনীতির দ্বারা প্রভাবিত একটি বৈশ্বিক সমস্যা বলে মনে হলেও বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলির অনন্য পরিস্থিতি বিরাজমান রয়েছে যার স্থানীয় সমাধান প্রয়োজন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি ন্যায়সঙ্গত রূপান্তর অর্থ একটি "ন্যায়সঙ্গত রূপান্তর" নিশ্চিত করে যে টেকসই অর্থনৈতিক কষ্ট, বৈষম্য বা সামাজিক বর্জন খচরে তালিকায় আসে না। 

বাংলাদেশি ভোক্তাদের জন্য, এর অর্থ হল পরিবেশ-বান্ধব পছন্দগুলি শুধু ধনীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত নয় বরং সকলের জন্য একটি সহজলভ্যতার সুযোগ তৈরী এবং সাশ্রয়ী মূল্যের বিকল্প হওয়া উচিত।

ইতিমধ্যে আমাদের সকলের কাছে পরিস্কার হয়েছে, টেকসই জীবনযাপনের দিকে বাংলাদেশের জন্য বড় প্রতিবন্ধক ও হুমকি হলো, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, ক্রমবর্ধমান সমুদ্রপৃষ্ঠ উচ্চতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন জনিত প্রভাব ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং খাদ্য নিরাপত্তা । 

তবে সবুজ জীবনযাত্রার দিকে এগিয়ে যেতে হলে অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ হতে হবে। বাংলাদেশে অনেক গুলো পণ্য আমদানি হয়। যা আর্ন্তজাতিক বাজারের মূল্যের ওপর নির্ভর করে। তবে আমদানিকৃত পণ্যের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করে স্থানীয়ভাবে তৈরি, পরিবেশ-বান্ধব বিকল্পগুলিতে রূপান্তর অবশ্যই অর্থনৈতিকভাবে কার্যকর হতে হবে।

টেকসই জীবনধারায় ভোক্তাদের যে সমস্ত মুখোমুখি চ্যালেঞ্জ
অতিরিক্ত খরচের বোঝা এবং বাজার ব্যবস্থায় সকলশ্রেণী পেশার মানুষের সম-অভিগম্যতার সুযোগ, জৈব খাদ্য, বায়োডেগ্রেডেবল প্যাকেজিং এবং নবায়নযোগ্য সৌর শক্তি সমাধানগুলির মতো টেকসই পণ্যগুলি প্রায়শই প্রচলিত বিকল্পগুলির চেয়ে বেশি দামে কিনতে হয়। অনেক ভোক্তা তাদের দীর্ঘমেয়াদী সুবিধা সত্ত্বেও সামর্থের অভাবে এই বিকল্পগুলি ক্রয় করতে পারে না। একইভাবে, টেকসই চাষের কৌশলগুলি খাদ্য নিরাপত্তা বাড়িয়ে তুলতে পারে। সাধারন মানুষের মাঝে এ বিষয়ে তবে প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। ক্রয়ক্ষমতার দিকে নজর না দেওয়া হলে টেকসই বিকল্পগুলি বেশিরভাগ সাধারন মানুষের নাগালের মধ্যে আসবে না। 

ভুল তথ্য এবং পরিবেশবান্ধব
অনেক ভোক্তা সত্যিকারের টেকসই পণ্য এবং সত্যিকারের পরিবেশবান্ধব সুবিধা ছাড়াই "সবুজ" হিসাবে বিপণনকারীদের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। পরিবেশ বান্ধব নয় এমন সব ব্যবসাগুলিকে যখন মিথ্যাভাবে পরিবেশগত দায়বদ্ধতা দাবি করে তখন ভোক্তাদের পক্ষে সত্যিকারের পরিবেশ বান্ধব পণ্যগুলো পছন্দগুলি করা আরও কঠিন হয়ে যায়। টেকসই দাবিগুলি বিশ্বাসযোগ্য কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য স্পষ্ট লেবেলিং, জনসচেতনতা প্রচার ও শক্তিশালী আইনগত বিধিবিধান প্রয়োজন।

অবকাঠামো ও নীতিগত ফাঁকফোকর
পুনর্ব্যবহারযোগ্য সুবিধার অভাব, অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা এবং পরিবেশগত নীতিগুলির দুর্বল প্রয়োগের কারনে টেকসই ব্যবহারের রূপান্তরকে বাধা দিচ্ছে। যদিও প্লাস্টিক নিষিদ্ধকরণ এবং সংরক্ষণের প্রচেষ্টা গতি অর্জন করেছে, বর্জ্য নিষ্পত্তি এবং টেকসই পণ্যের প্রাপ্যতায় চ্যালেঞ্জগুলি এখনও বিদ্যামান। উন্নত অবকাঠামো, যেমন উন্নত পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্রোগ্রাম এবং ব্যবসায়ের জন্য পরিবেশ-বান্ধব প্যাকেজিং গ্রহণের জন্য প্রণোদনা, এই ব্যবধানটি পূরণ করতে সহায়তা করতে পারে।

ভোক্তাদের জন্য ন্যায্য রূপান্তরকে সমর্থন করতে পারে
ভোক্তা, ব্যবসা এবং নীতিনির্ধারকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা টেকসই উন্নয়নের দিকে এমনভাবে স্থানান্তরকে ত্বরান্বিত করতে পারে যা সকল ভোক্তাদের উপকারে আসতে পারে।

ভোক্তা অধিকার ও সচেতনতা জোরদার করা
আমাদের দেশের ভোক্তারা এখনও স্বাধীনভাবে পণ্য পছন্দ করা ও ক্রয় করতে পারে না। তারা বিক্রয় প্রতিনিধি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার প্রচারণা, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে বিজ্ঞাপনের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ পণ্য লেবেলিংয়ে স্বচ্ছতার পক্ষে এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য দাবির জন্য ব্যবসায়ীকে জবাবদিহি করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যার কারণে একটি পরিপূর্ণ লেবেলিং আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাজার ও কমিউনিটি গ্রুপ ভিত্তিক, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং বিভিন্ন পেশাজীবি ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের আচার অনুষ্ঠানগুলোতে ভোক্তা শিক্ষার সম্প্রসারণ করে সাধারন ভোক্তাদেরকে এ বিষয়ে আরও বেশি অবহিত করা, নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী পণ্য ও সেবা ক্রয় করতে পারে কিনা সে বিষয়ে আরও ক্ষমতায়িত করতে হবে।

টেকসই পণ্যগুলিকে আরও সাশ্রয়ী মূল্যের করা
টেকসই ও পরিবশে বান্ধব পণ্যের দাম কমাতে সরকারি ও বেসরকারি খাতকে একযোগে কাজ করতে হবে। সম্ভাব্য ব্যবস্থাগুলির মধ্যে রয়েছে:
•    প্রচলিত বিকল্পগুলির সাথে আরও প্রতিযোগিতামূলক করার জন্য পরিবেশ-বান্ধব পণ্যগুলিকে ভর্তুকি দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
•    টেকসই অনুশীলন গ্রহণকারী ব্যবসায়ের জন্য কর প্রণোদনা, সবুজ পণ্যগুলির বিস্তৃত গ্রহণকে উত্সাহিত করা।
•    টেকসই পণ্যের স্থানীয় উৎপাদনে বিনিয়োগ, ব্যয়বহুল আমদানির উপর নির্ভরতা হ্রাস করা।
এই কৌশলগুলি বাস্তবায়নের মাধ্যমে, টেকসই বিকল্পগুলি পণ্যগুলোর সাধারণ মানুষের কাছে আরও সহজলভ্য হয়ে উঠতে পারে।

স্থানীয় উদ্যোগে টেকসই উদ্যোগকে উৎসাহিত করা
পরিবর্তনের জন্য যে কোন স্থানীয় উদ্যোগের টেকসই কার্যকর পরিবর্তন চালানো সম্ভাব। সমবায়ী ভিত্তিক স্থানীয় কৃষি ও সবজি বাগান, শেয়ারে চলা সাশ্রয়ী গণপরিবহন পরিষেবা এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য ইলেক্ট্রনিক উপকরণ ও  ড্রাইভের মতো প্রোগ্রামগুলি স্থায়িত্বকে আরও ব্যবহারিক এবং সাশ্রয়ী মূল্যে করতে করতে পারে। পরিবেশসম্মত ও টেকসই জীবনযাত্রাকে উৎসাহিত করে এমন ছোট ব্যবসায়গুলিকে অগ্রাধিকার দিয়ে উৎসাহিত করতে হবে। যেখানে স্থানীয়ভাবে তৈরী বায়োডেগ্রেডেবল পণ্য যা পরিবেশগত প্রভাব হ্রাস করার সময় স্থানীয় অর্থনীতিকেও শক্তিশালী করতে পারে।

সরকারি বিধিবিধান ও কর্পোরেট জবাবদিহিতা জোরদার করা
সরকারকে অবশ্যই কঠোর পরিবেশগত বিধিবিধান প্রয়োগ অব্যাহত রাখতে হবে, যেমন:
•    বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং প্লাস্টিক হ্রাসের জন্য ব্যবসাগুলিকে জবাবদিহি করা।
•    সংস্থাগুলির জন্য টেকসই প্রতিবেদন বাধ্যতামূলক করা, তাদের পরিবেশগত প্রভাবের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।
•    সৌর ও বায়ু বিদ্যুৎকে গৃহস্থালি ও ব্যবসার জন্য আরও সহজলভ্য করার জন্য পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির প্রণোদনা প্রসারিত করা।
•    সরকার-সমর্থিত প্রোগ্রামগুলিও টেকসই পাবলিক ট্রান বিকাশের দিকে কাজ করা উচিত

ন্যায়সঙ্গত রূপান্তরে ব্যবসায়ীদের ভূমিকা
ব্যবসাগুলি সবুজ অনুশীলন গ্রহণ করে, সাশ্রয়ী মূল্যের পরিবেশ-বান্ধব বিকল্প সরবরাহ করে এবং কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) উদ্যোগে জড়িত হয়ে স্থায়িত্ব প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্জ্য সংগ্রহ অভিযান, পরিবেশগত শিক্ষা প্রচার এবং বৃক্ষরোপণ প্রচেষ্টার মতো টেকসই প্রোগ্রামগুলি চালানোর জন্য বড় বড় করপোরেট গ্রুপ, ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এবং বেসরকারী উন্নয়ন সংগঠন(এনজিও)গুলির সাথে অংশীদারিত্ব বাড়ানো যেতে পারে। তাদের ব্যবসায়িক প্রচলিত পদ্ধতিতে স্থায়িত্ব জোরদার করে সবুজ অর্থনীতির দিকে রূপান্তরে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে।

সম্মিলিত কর্মের শক্তি
যেহেতু পুরো বিশ্ব এখন একটি ন্যায়সঙ্গত রূপান্তরের পথে অগ্রসর হচ্ছে, ব্যবসা বানিজ্যসহ প্রত্যেক অংশীজন-ভোক্তা, ব্যবসায়ী, নীতিনির্ধারক এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দকে অবশ্যই তাদের ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসতে হবে। টেকসই জীবনযাত্রার দিকে যাত্রা অবশ্যই যাদের আয় ও সম্পদ কম তাদেরকে এপ্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত হতে বাধা প্রদান করা হলে পুরো সমাজ কোন ভা্বেই এগিয়ে যেতে পারবে না। কারণ কাউকে পিছিয়ে রেখে সমাজ কোনভাবেই এগিয়ে যেতে পারবে না। তাই সমাধানগুলি অবশ্যই অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।

বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস ২০২৫ আমাদেরকে বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে, স্থীয়ত্বশীল জীবনধারায় একজন নাগরিক, একজন ভোক্তা হিসাবে সত্যিকারের পরিবেশগত দায়বদ্ধতার বিষয়টি। যাতে সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধি, পেশাজীবি যে যে আয়ের হোক না কেন, কেউ যেন স্থায়ীত্বশীল জীবনযাত্রার রূপান্তরে যেন পিছিয়ে না পড়ে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে ন্যায়সঙ্গত রূপান্তরে টেকসই জীবনযাত্রা এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জনে একসাথে চলে পুরো বিশ্বের জন্য অনুকরনীয় মডেল হয়ে উঠতে বাংলাদেশ যেন নেতৃত্ব দিতে পারে, সে প্রত্যাশা সকলের।

লেখক: ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)
[email protected]

নারীর অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন ও সম্ভাবনা

প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২৫, ০৯:০৪ এএম
নারীর অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন ও সম্ভাবনা
ডা. রুবাইয়াৎ ফেরদৌস

বেগম রোকেয়া বলেছেন- ‘যে জাতি নারীকে অবজ্ঞা করে সে জাতি কখনো উন্নতি করতে পারে না।’ বিশ্বখ্যাত মানবাধিকার কর্মী মালালা ইউসুফজাই বলেছেন, ‘আমরা সবাই সফল হতে পারব না, যদি আমাদের অর্ধেককে পিছিয়ে রাখা হয়।’

এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়- ‘অধিকার, সমতা ও ক্ষমতায়ন- নারী ও কন্যার উন্নয়ন।’ এ দিনটি শুধু উদযাপনের জন্য নয়, বরং নারীদের জীবনমান উন্নত করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ারও সময়।

নারী দিবসের ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট:
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের সূচনা ১৯০৮ সালে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে পনেরো হাজার নারী শ্রমিক তাদের কর্মস্থলে ন্যায্য মজুরি, কর্মঘণ্টা কমানো এবং ভোটাধিকারের দাবিতে বিক্ষোভ করেন। এরপর ১৯০৯ সালে আমেরিকার সোশ্যালিস্ট পার্টি ২৮ ফেব্রুয়ারি ‘জাতীয় নারী দিবস’ পালন করে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি আসে ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে, যেখানে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেতা ক্লারা জেটকিন নারী দিবস পালনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯১১ সালে প্রথমবার অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়। ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ (ইউএনও) এই দিনটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয় এবং ১৯৭৭ সালে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে নারী অধিকার ও সমতার লক্ষ্যে এই দিনটি পালনের আহ্বান জানানো হয়।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসের তাৎপর্য বহুমাত্রিক। এটি শুধু নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের দিন নয়, বরং নারীদের অধিকার রক্ষা, সমান সুযোগ তৈরি, লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং নারীদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন।
এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়ে ফিরে আসি। এবারের প্রতিপাদ্য হলো- ‘অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন- সব নারী ও কন্যার উন্নয়ন।’ এনিয়ে যদি বলতে হয় তাহলে পুরো সমাজের কাছে ছোট ছোট কয়েকটা অর্থপূর্ণ প্রশ্ন আমি ছুড়ে দিতে চাই। আমাদের গুরুজনরা, মনীষী-মহীয়সীরা সত্যিই অনেক সুন্দর কথা ও সুযোগ তৈরি করে দিয়ে গেছেন যদিও-

# তবুও আমরা এখনো কেন লড়াই করেই যাচ্ছি?
# এখনো শত শত মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে যৌতুকের জন্য নির্যাতিত। কেন?
# এখনো কেন তাদের পাতে মাছের লেজটাই নিয়ম করে জোটে?
# এখনো কেন পাবলিক প্লেসে হেনস্থার শিকার হতে হয়?
# এখনো মার্জিতভাবে চললেও নোংরা দৃষ্টির ছোবলে সর্বদা কুঁচকে থাকতে হয়। কেন?
# নারী প্রতিষ্ঠিত হলেও শুনতে হয়- ‘ও নিশ্চয়ই কুপথে রোজগার করে’। কেন?
# এখনো নারী কেন আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভোগে?
# এখনো নারী সমাজের বেশির ভাগই বিষণ্ণতার রোগী। কেন?
# এখনো নারী ‘কোনটা তোমার আসল বাড়ি’- এই প্রশ্নে ঘুরপাক খায়?
# এখনো নারী মানেই রান্নাঘর। কেন?
# এখনো নারী ‘কে আমার আপন’ খুঁজতে খুঁজতে হয়রান?
# এখনো কেন পরিবারের কোনো সিদ্ধান্তের বৈঠকে ঠাঁয় হয় না? সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে কণ্ঠ দিতে পারে না? অধিকার তার নেই। কেন?
# এখনো নারী টক্সিক ম্যারাইটাল লাইফেও আতঙ্কগ্রস্ত, আবার ডিভোর্সের পরেও আতঙ্কগ্রস্ত? বিয়ের পর আতঙ্ক, স্বামী যদি ডিভোর্স দিয়ে দেয়! আবার ডিভোর্সের পরেও আতঙ্ক, সমাজ যদি আমাকেই দোষারোপ করে যে, আমিই খারাপ তাই সংসার টেকাতে পারিনি?
# সব ক্ষেত্রেই এখনো কেন নারীর দোষ?
# শিক্ষা ও ক্যারিয়ারের পদে পদে বাধা। কেন?
# কেন বেতনবৈষম্য?
# কেন চাকরির সুযোগের অভাব?
# পারিবারিক ও সামাজিক গোঁড়ামি- কেন?
# মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। কেন?

এ প্রশ্নগুলোর বাইরেও হাজার হাজার প্রশ্ন নিয়ে আজও আমাদের নারীসমাজ যুদ্ধ করছে। এই যুদ্ধের অবসান এখন সময়ের দাবি। অথচ দ্য ফ্যাক্ট ইজ, নারী কোনো একক পরিচয়ে সীমাবদ্ধ নয়, তিনি একাধারে মা, মেয়ে, স্ত্রী, বোন, কর্মী, নেতা, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, ইঞ্জিনিয়ার, খেলোয়াড়, স্বপ্নদ্রষ্টা ও সমাজ পরিবর্তনের অগ্রদূত। শিক্ষা, বিজ্ঞান, চিকিৎসা, রাজনীতি, ব্যবসা, ক্রীড়া সব ক্ষেত্রে নারীরা সফলতার গল্প লিখছেন। বেগম রোকেয়া থেকে মালালা ইউসুফজাই, মেরি কুরি থেকে কাল্পনা চাওলা। তারা প্রমাণ করেছেন যে, নারী এগিয়ে গেলে সমাজও এগিয়ে যায়।

বিশ্বখ্যাত লেখিকা মায়া এঞ্জেলু বলেছেন- ‘প্রতিবার একজন নারী যখন নিজের জন্য দাঁড়ান, তখন তিনি সব নারীর জন্যও দাঁড়ান। কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’ কবি সুফিয়া কামাল তার ‘আমি নারী’ কবিতায় বলেছেন-
‘আমি সেই নারী-
যে জগতের আলো আঁধারে আপন শক্তিতে জ্বলে,
আমি সেই নারী-
যে প্রেম, সাহস, শক্তি, ভালোবাসায় অনড় ও অমলিন।’

নারী সমাজের ব্যাপারে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের প্রতিষ্ঠাতা হযরত খান বাহাদুর আহসানুল্লাহ (র.), যিনি ছিলেন একজন সুবিবেচক এবং বিচক্ষণ মানুষ। তার দৃষ্টি এবং চিন্তাশক্তি খুবই প্রখর ও সুনিপুণ ছিল সেই আমলেও। তিনি বলেছেন, ‘মুসলিম মহিলাগণ কখনো জ্ঞানে ও পাণ্ডিত্যে পুরুষ দিগের পশ্চাতে ছিলেন না। এমনকি বহুবিধ শাস্ত্রে তাঁহারা অধিকতর পারদর্শী ও অগ্রণী ছিলেন। কি অস্ত্রবিদ্যায়, কি রাজনীতি, কি রাজ্য শাসন সর্বত্রই তাঁহাদের প্রতিভা প্রকাশ লাভ করিয়াছিল।’ (রচনাবলি; তৃতীয় খণ্ড; পৃষ্ঠা ৯৫-৯৯)।

দুঃখের বিষয় এখনো অনেক নারী নির্যাতন, বৈষম্য ও নিরাপত্তাহীনতার শিকার। আজকের এই দিবসে আমরা সবাই মিলে প্রতিজ্ঞা করি- নারীর কণ্ঠকে গুরুত্ব দেব, নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করব, নারী স্বাধীনতা ও মর্যাদাকে সম্মান করব। সব নারীকে বলতে চাই- আসুন আমরা কোনো বাধার দেয়ালে থেমে না যাই, বরং সেই দেয়াল ভেঙে নতুন পথ তৈরি করি। কারণ নারী হলো শক্তি, নারী হলো সাহস, নারী হলো আগামী দিনের স্বপ্নদ্রষ্টা। নারী যখন নিজের শক্তি বুঝতে পারে, তখন সে পুরো বিশ্ব বদলে দিতে পারে। ওইদিন খুব তাড়াতাড়িই আসবে, যেদিন সমতা, ক্ষমতা আর অধিকারের জন্য লড়াই করতে হবে না। ওই নতুন পথে আলোকিত হয়ে নারী-পুরুষ সবাই হাঁটব। দেশ ও জাতিকে উন্নত করব। পরিশেষে, কবি জীবনানন্দ দাসের সঙ্গে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই-
‘আমার ভিতরে রক্তের স্রোত আছে,
আমার চোখে অগ্নিশিখা
আমি থামবো না
আমি হারবো না।’

লেখক: মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ‍ও সহকারী অধ্যাপক
সাইকিয়াট্রি বিভাগ, ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল

মহাবিশ্বে গ্রহাণুর বিচরণ ও পৃথিবীর উপর এর ক্ষতিকর প্রভাব

প্রকাশ: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮:২৭ এএম
মহাবিশ্বে গ্রহাণুর বিচরণ ও পৃথিবীর উপর এর ক্ষতিকর প্রভাব
মো. জাহিদুল ইসলাম

যেসব গ্রহ-উপগ্রহ দিয়ে সৌরজগৎ সৃষ্টি হয়েছে সেসব গ্রহ-উপগ্রহের অবশিষ্ট টুকরোগুলোই হচ্ছে গ্রহাণু। যা সূর্যকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান। এদের মধ্যে মাঝেমধ্যে কয়েকটা ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবীর কক্ষপথে ঢুকে পৃথিবীর সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটায়। গ্রহানু হলো সৌরজগতের অংশ, ছোট গ্রহ, পাথুরে বস্তু যা সাধারনত মঙ্গল গ্রহ ও বৃহস্পতি গ্রহের মধ্যে অবস্থান। আনুমান করা হয় প্রায় ১৩ লক্ষ গ্রহানু রয়েছে।

মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহের মধ্যের এই অঞ্চলকে  গ্রহানু বলয় বলে। এই বলয়ের মধ্যে গ্রহের তুলনায় অনেক ছোট পাথরখণ্ড এবং ধাতু রয়েছে। এই পাথরখণ্ডগুলিকে গ্রহাণুপুঞ্জ বা ছোট গ্রহ বলা হয়। এগুলি পৃথিবী থেকে খালি চোখে দেখা যায় না, কিন্তু অনেকগুলিকে দূরবীন বা ছোট দূরবীক্ষণ যন্ত্রের (টেলিস্কোপ) মাধ্যমে দেখা যেতে পারে।

সৌরজগতে সম্ভবত কয়েক লক্ষ গ্রহাণু রয়েছে। ৯৬,০০০ এরও বেশি গ্রহাণুকে সংখ্যা দিয়ে পরিচিতি দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে প্রায় ১২,০০০ এর নাম রয়েছে। কিন্তু যদিও অনেক গ্রহাণু আছে, গ্রহাণুপুঞ্জ বলয়ের বেশিরভাগ স্থানই ফাঁকা।  সৌরজগতের প্রথম ১০ কোটি বছরে গ্রহাণুপুঞ্জ বলয় তার ভরের ৯৯.৯৯% হারিয়ে ফেলেছে। প্রতিনিয়ত অসংখ্য গ্রহাণু পৃথিবীতে আঘাত করছে। মহাকাশ থেকে রোজ শত শত টন ধুলোবালি নিক্ষিপ্ত হয় পৃথিবীর দিকে।

কোন কোন সময় বছরে প্রায় একবার একটা  ছোট আকৃতির (উদাহরণ স্বরূপ গাড়ির আকারের) গ্রহাণু আমাদের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করতে পারলেও মেসোস্ফিয়ার স্তরে এসে পুড়ে যায়। কখনো পৃথিবীর পৃষ্ঠে পৌঁছাতে পারে না। এদিকে আশার কথা হচ্ছে যে অধিকাংশ গ্রহাণু আকারে খুব ছোট হয়। পৃথিবীর জন্যে পর্যাপ্ত ক্ষতিকর গ্রহাণুর সংখ্যা অবশ্য কম। তাই পৃথিবীতে আঘাত হানার সম্ভাবনাও কম।

তবে পৃথিবীতে গ্রহাণুর আঘাত হানা একেবারেই অসম্ভব নয়। কিছু কিছু গ্রহাণু দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে এক কিলোমিটারেরও কম। অনানুষ্ঠানিকভাবে ৫০ মিটার পর্যন্ত গ্রহাণুর পরিধির   সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর চেয়ে ছোট যে কোন কিছু উল্কা নামে পরিচিত। দূরবীক্ষণ যন্ত্রের অগ্রগতির ফলে এবং বিশেষ করে পৃথিবীর কাছাকাছি ঘুরে বেড়ানো বস্তুগুলির ক্ষেত্রে, ৫০ মিটারের চেয়ে ছোট কিছু বস্তু  মাঝে মাঝে পৃথিবীর কাছ দিয়ে যেতে দেখা যায়। তবে ডাইনোসর বিলুপ্তির জন্যে দায়ী ১০-১২ কিলোমিটার পরিধির একটি গ্রহাণু পৃথিবীতে আঘাত হানলে সেটা হবে ভিন্ন এক বিষয়। এমন গ্রহাণুর সংখ্যা খুব কম এবং তা কয়েক মিলিয়ন বছরে একবার পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসতে পারে।

এদিকে গ্রহাণু থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্য বায়ুমণ্ডল রয়েছে। এর পাশাপাশি পৃথিবীর চারপাশে সমস্ত মহাকাশের শিলাগুলোর ওপর নজর রাখার জন্য নাসাসহ আরও অনেক স্যাটেলাইট রয়েছে। তবে গ্রহাণুর বিশেষ পর্যবেক্ষণ এবং গতিবিধি লক্ষ্য পর্যবেক্ষণ ব্যতীত পৃথিবীর দিকে আগত গ্রহাণু শনাক্ত করা খুব কঠিন। এ ছাড়া, বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে ডার্ট নামে নাসা একটি যান মহাকাশে পাঠায়। যা মূলত পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসা কোনো গ্রহাণুকে তার গতিপথ থেকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেবার জন্য তৈরি করা হয়েছে।

গ্রহাণু সাধারণত অনিয়মিত আকারের হয়। তবে কিছু কিছু  প্রায় গোলাকার গ্রহাণুর দেখা যায়। গ্রহাণুর কোন বায়ুমণ্ডল নেই। গঠনগত দিক থেকে গ্রাহানু ৩ শ্রেণীর হয়ে থাকে। যেমনঃ-  প্রথমটি হচ্ছে C- Type: (Chondrite)। এদের সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এই C- Type: (Chondrite) গ্রহাণু সাধারণত কাদা ও সিলিকেট শিলা দ্বারা তৈরি । এরা মূলত সৌরজগতের অন্যতম আদি বস্তু। দ্বিতীয়টি হচ্ছে  S- Type। এই  S- Type ধরনের গ্রহাণু সিলিকেট ও নিকেল-আয়রন দিয়ে গঠিত। তৃতীয় এবং সর্বশেষ  M- Type ধাতব গ্রহাণু ও নিকেল-আয়রন দিয়ে গঠিত।

বিভিন্ন আকারের গ্রহানু রয়েছে, ছোট যেমন মাত্র ১০ মিটার ব্যাসার্ধের আবার বড় আকারেরও গ্রহানু আছে যেমন ভেস্তা যার ব্যাসার্ধ প্রায় ৫৩০ কিমি। গ্রহানু সৌরজগতের সমসাময়িক, বয়স প্রায় ৪৬০ কোটি বছর। তবে গ্রহানু পৃথিবীর জন্য বিপজ্জনক হতে পারে যদি পৃথিবীতে আঘাত হানে ঠিক যেমন ছয় কোটি ষাট লক্ষ বছর আগে ১০ থেকে ১৫ কিমি ব্যাসার্ধের একটি গ্রহানু পৃথিবীকে আঘাত হেনেছিল। যার ফলাফল হিসেবে আস্তে আস্তে ডাইনোসর বিলুপ্ত হয়েছিল। বিজ্ঞানীদের মতে গ্রহাণুর সঙ্গে পৃথিবীর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলে সেটি হবে পারমাণবিক বোমার চেয়েও শক্তিশালী। কোনো একটি শহরে গ্রহাণু এসে পড়লে ধ্বংসযজ্ঞ শুধু ওই শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। পুরো গ্রহেই তার মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। আর যদি একটা জায়গায় প্রভাব পড়তো তাহলে তো ছয় কোটি ষাট লক্ষ বছর আগে পৃথিবীর যে স্থানে গ্রহাণু আঘাত হেনেছিল শুধু সেই স্থানের ডাইনোসরগুলো মারা যেত। ডাইনোসরগুলো পুরো পৃথিবী থেকে  বিলুপ্ত হতো না। অন্য জায়গার ডাইনোসরগুলো বেঁচে থাকতো।

এদিকে পৃথিবীর সাথে গ্রহাণুর সংঘর্ষের ফলে যদি কোথাও বড় ধরনের আগুন লেগে যায়, কিম্বা একটা বিশাল গর্ত তৈরি হয় এবং সেখান থেকে যদি সব ধ্বংসাবশেষ বায়ুমণ্ডলে চলে যায়, তাহলে সারা গ্রহেই ধুলোবালি ছড়িয়ে পড়তে পারে। এরকম হলে পৃথিবীর প্রাণীরা হয়তো বেঁচে থাকতে পারবে না। এরকম ধূলিঝড় বা ডাস্ট স্টর্ম মঙ্গল গ্রহে দেখতে পাওয়া যায়। এর ফলে সেখানে সূর্যের আলো দেখা যায় না।

নাসার পাঠানো রোভার এই ধূলিঝড় প্রত্যক্ষ করেছে। এরকম ধূলিঝড় বা ডাস্ট স্টর্ম মঙ্গল গ্রহে দেখতে পাওয়া যায়। এর ফলে সেখানে সূর্যের আলো দেখা যায় না। নাসার পাঠানো রোভার এই ধূলিঝড় প্রত্যক্ষ করেছে। গ্রহানুর অবস্থানের উপর ভিত্তি করে গ্রহানুকে তিনটি ভাগে বিভিক্ত করা হয়। এদের মধ্যে  প্রধান গ্রহানু বলয় (Main Asteroid Belt) বলয়টি রয়েছে মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহের মধ্যে। আনুমান করা হয় ১১ লক্ষ থেকে ১৯ লক্ষ গ্রহানু ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এই বলয়ে। আরেকটি ট্রোজান (Trojans) এটি একটি বিশেষ এলাকা, প্রতি গ্রহের কক্ষপথের দুইটি অংশে সেই গ্রহের মহাকর্ষ বল ও সূর্যের মহাকর্ষ বল সমান, ঠিক এই কারনে ওই অংশে মোটামুটি স্থিতিশীল অবস্থায় থাকে, সেই অংশ ল্যাগ্রেঞ্জ পয়েন্ট নামে পরিচিত।

সর্বশেষটি হলো পৃথিবীর নিকটবর্তী গ্রহাণু (Near-Earth Asteroids) যা পৃথিবীর খুব কাছ দিয়ে অতিক্রম করে। নাসা এই ধরনের গ্রহানুর উপর নজরদারি করে থাকে। সম্প্রতি একটি গ্রহাণুর গতিবিধির নিয়ে বিজ্ঞানীরা খুবই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। মহাকাশ বিজ্ঞানীদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে ‘২০২৪ ওয়াইআর-৪’ নামের একটি গ্রহাণু। এটি ২০৩২ সালে পৃথিবীতে আঘাত হানতে পারে বলে ধারণা করছেন বিজ্ঞানীরা। দিন দিন এ নিয়ে উদ্বেগ ক্রমেই বাড়ছে। শুরুতে ২০৩২ সালে গ্রহাণুটি পৃথিবীতে আঘাত হানতে পারে বলে ১ শতাংশ আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন মহাকাশ বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি নাসার বিজ্ঞানীরা গ্রহাণুটির পৃথিবীর সঙ্গে সংঘর্ষের সম্ভাবনা বাড়িয়ে ১ শতাংশ থেকে ২ শতাংশে উন্নীত করেন।

গ্রহাণুটির যাত্রাপথ সম্পর্কে নতুন তথ্য পাওয়ার পর এমনটিই জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি এ তথ্য নিশ্চিত করেছে ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা (ইএসএ)। বিজ্ঞানীরা গ্রহাণুটির গতি এবং আকারের আরও নির্ভুলভাবে পরিমাপের জন্য জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের মাধ্যমে গ্রহাণুটি পর্যবেক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পৃথিবীকে নিরাপদ রাখতে কোনো সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন হয় কিনা এই বিষয়টির পাশাপাশি গ্রহাণুটির ছোট ছোট ঝুঁকির দিকটিও ভালোভাবে খতিয়ে দেখতেই টেলিস্কোপটি ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন বিজ্ঞানীরা।

গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো ‘২০২৪ ওয়াইআর-৪’ গ্রহাণু শনাক্ত করা হয়। এর পর থেকে এটি পৃথিবীর কাছাকাছি আছড়ে পড়তে পারে এমন গ্রহাণুদের ঝুঁকি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে এই গ্রহাণুর ব্যাস ৪০ থেকে ৯০ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। এটি ২০১৩ সালে রাশিয়ায় আঘাত হানা গ্রহাণুর আকারের মতো হতে পারে। যেই গ্রহাণুটি বায়ুমণ্ডলে বিস্ফোরিত হয়ে চেলিয়াবিনস্ক শহরে হাজার হাজার জানালার কাচ ভেঙে ফেলেছিল এবং এ ঘটনায় কয়েক শ মানুষ সামান্য আঘাত পেয়েছিল। একটি বরফাচ্ছন্ন হ্রদে আছড়ে পড়ে এই গ্রহাণু। আছড়ে পড়ার পর এর মাত্র ১ মিটার অবশিষ্ট ছিল। তবে যদি ৯০ মিটার আকারের গ্রহাণু আঘাত হানে তাহলে তার প্রভাব অনেক বেশি হতে পারে।

১৯০৮ সালের সাইবেরিয়ার তুঙ্গুস্কা ঘটনাটির মতো প্রভাব ফেলতে পারে। এটি লাখ লাখ গাছকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল এবং প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, কয়েকজন মানুষ মারাও যান। যদি এমন আঘাত কোনো বড় শহরের ওপর হয় তবে তার ফলাফল মহাবিপর্যয়ের মতো হতে পারে।

লেখক: নেটওয়ার্ক টেকনিশিয়ান (আইসিটি সেল), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
[email protected]