
৫ আগস্টের পর দেশের অনেক প্রতিষ্ঠান সংস্কারের লক্ষ্যে নতুন সরকার সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্র সংস্কারের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে যে প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নেন সেগুলো হলো সংবিধান সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন, স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন, শ্রম সংস্কার কমিশন, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন, খুন ও গুমসংক্রান্ত সংস্কার কমিশন। দুঃখের বিষয়, উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কারের প্রয়োজন পড়ে বিগত ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসন আমলের প্রেক্ষিতে। কিন্তু রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু শিক্ষা খাত সংস্কারের জন্য কোনো কমিশন গঠন করা হয়নি। অথচ স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক নানান কারণে শিক্ষায় সমস্যা ও সংকট বহু গুণে বেড়েছে। নানান কারণে বির্তকিত হয়েছে শিক্ষা খাত বিভিন্ন সময়ে। শিক্ষার বিভিন্ন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে জনগণ বাতিল করেছে, সংস্কার করার জন্য রাজপথে নামলেও কোনো ফল আসেনি। দিনের পর দিন শিক্ষায় সংকট, সমস্যা ঘনীভূত হয়েছে, দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে সমস্যাই বেড়েছে সম্ভাবনা তৈরি হয়নি। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হলে জনগণ বিশেষ করে শিক্ষক সমাজ ভেবেছিল শিক্ষাব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় সংস্কার হবে কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, প্রায় ডজনখানেক প্রতিষ্ঠান, সংস্থাকে সংস্কারের আওতায় আনলেও শিক্ষায় কোনো সংস্কারের উদ্যোগ সরকার গ্রহণ করেনি। অথচ পাহাড়সমান সমস্যা নিয়ে টিকে আছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। এ সমস্যা শিক্ষকরা যতটুকু বোধ করেন অন্যরা ততটুকু হয়তো বোঝেন না। ২০২০ সালের শুরুর দিকে বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হলে সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো একযোগে বন্ধ হয়ে যায়। টানা ৬৭ সপ্তাহ বন্ধ থাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যা বিশ্বে রেকর্ড। বন্ধের এই ধারাবাহিকতার মধ্যেই শুরু হয় অনলাইন ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট নামের পানি পড়া অটোপাস, পুরোনো কারিকুলাম বাতিল করে, নতুন কারিকুলাম চালু, রাজনৈতিক অস্থিরতা ইত্যাদি নানান সংকটে ভেঙে পড়ে শিক্ষাব্যবস্থা।
২০২০ সালের করোনা মহামারির পরে শিক্ষক-শিক্ষার্থী আর কেউই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ক্লাসে ফিরতে পারেনি। পুরোনো সৃজনশীল কারিকুলাম বুঝে ওঠার আগেই একমুখী নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের তোড়জোড়- সব মিলিয়ে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় চরম অস্থির অবস্থা পার করছে। বিভিন্ন সময় নানান দাবিদাওয়া নিয়ে শিক্ষকদের রাজপথে অবস্থান, নন-এমপিও শিক্ষকদের আন্দোলন, বিভিন্ন ইস্যুতে শিক্ষকদের ক্লাস বর্জন, প্রাথমিক শিক্ষকদের দশম গ্রেডপ্রাপ্তির আমলাতান্ত্রিক সমস্যা, বেসরকারি শিক্ষকদের বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, বেতনবৈষম্য নিয়ে শিক্ষকদের শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ, ইএফটি জটিলতায় গত পাঁচ মাসের বেতন-বোনাসবঞ্চিত শিক্ষকদের অমানবিক জীবনযাপন, এনটিআরসির নিয়োগবাণিজ্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বহুমাত্রিক সমস্যা, শিক্ষকতার নিম্নমান ইত্যাদির কারণে দারুণভাবে বিঘ্নিত হয়েছে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ। চলতি বছরের পাঁচ মাস পেরিয়ে গেছে তবুও সব বই শিক্ষার্থীদের হাতে এসে পৌঁছায়নি, রয়েছে চলমান নানান জটিলতা। সবমিলিয়ে চরম এক বিশৃঙ্খলায় জর্জরিত শিক্ষা খাত। ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে শিক্ষায় সব অনিয়ম দূর করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে শিক্ষা আইন বাস্তবায়নের কথা বলা থাকলেও সেটার বাস্তবায়ন বিগত দিনগুলোয় রাজনৈতিক কারণেই সম্ভব হয়নি। বিপ্লবের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকার ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কিত বিষয়ে সংস্কার কমিশন গঠন করে সংস্কারের উদ্যোগ নিলে শিক্ষক সমাজ আশায় বুক বাঁধে এই ভেবে যে, স্বতন্ত্র একটি কমিশন গঠন করে সরকার শিক্ষায় চলমান সব সমস্যার সমাধান করবে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে আশাও ক্রমান্বয়ে ক্ষীণ হয়ে আসে। নতুন সরকার সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংস্কার উদ্যোগ শুরু করলেও শিক্ষা খাত এখনো রয়ে গেল উপেক্ষিত। অথচ বিগত ৫০ বছরের অধিক সময় কল্যাণমুখী, গণমুখী পদক্ষেপ দৃশমান হয়নি। শিক্ষায় যথার্থ পরিকল্পনা আর বিনিয়োগের মাধ্যমে পৃথিবীর অনেক দেশই অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করতে পেরেছে, আমরা করেছি উল্টোটা। একটি উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা একটি জাতিকে উন্নত, ধনী, ঐশ্বর্যবান সর্বোপরি স্বাস্থ্যবান করে তোলে। এজন্য প্রয়োজন দূরদর্শী পরিকল্পনা, রাষ্ট্রের আর্থিক স্বক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, বাস্তবায়নের আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসা। নতুন বাংলাদেশের পুনর্নির্মাণ সফল করতে সংস্কার অপরিহার্য, প্রয়োজনীয় বটে তবে সেটা শিক্ষাকে অবজ্ঞা, উপেক্ষা করে নয় বরং সঙ্গে নিয়ে। নতুন সরকার সেদিকে নজর দেবে, প্রত্যাশিত পরিবর্তনের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষাকে আরও একধাপ এগিয়ে নেবে, এমনটাই প্রত্যাশা সবার।
প্রোগ্রাম অফিসার, দেশভিত্তিক উৎকর্ষ কার্যক্রম, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ঢাকা।
সাবেক অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, এসইডিপি প্রোগ্রাম, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ঢাকা।
[email protected]