
আজ খতমে তারাবিতে পবিত্র কোরআনের ১৪তম পারা তেলাওয়াত করা হবে। সুরা হিজর ও সুরা নাহলের এই অংশে আল্লাহর কুদরত ও একত্ববাদ, বান্দার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ, পশুপাখির জীবনাচরণে মানুষের শিক্ষা, কন্যাসন্তান আল্লাহর নেয়ামত, মানুষ সৃষ্টির ইতিকথা, জান্নাত-জাহান্নাম, বিশ্বাসের দৃঢ়তা, কিয়ামত দিবসে কাফেরদের আফসোস, শয়তানের ধোঁকা, আল্লাহর নেয়ামত ভুলে যাওয়া, ইবরাহিম (আ.)-এর সন্তান লাভ, লুত (আ.) ও তার জনপদের কাহিনি এবং কাফেরদের প্রশ্নের খণ্ডনসহ নানা বিষয় আলোচিত হয়েছে।
পাহাড় থেকে এলো উট
মক্কায় অবতীর্ণ সুরা হিজরের আয়াত সংখ্যা ৯৯। কোরআনুল কারিমের ১৫তম সুরা এটি। এ সুরায় হিজরবাসীদের আলোচনা থাকায় এর নামকরণ করা হয় সুরা হিজর। ‘হিজর’ হেজাজ ও সিরিয়ার মধ্যস্থলে অবস্থিত একটি উপত্যকার নাম। এখানে সামুদ জাতির বসতি ছিল। তারা ছিল শক্তিশালী। তারা আবাসনের জন্য পাহাড় কেটে বাসগৃহ নির্মাণ করেছিল। সালেহ (আ.) ছিলেন সামুদ জাতির নবি। তিনি জাতিকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দিয়েছিলেন। তারা শোনেনি। তারা নবির সঙ্গে অনেক বাকবিতণ্ডা করল। আল্লাহ নিদর্শনস্বরূপ তাদের মাঝে পাহাড় থেকে একটি উট পাঠান। উটের সঙ্গে ভালো আচরণের আদেশ দেওয়া হয়েছিল। তারা অবাধ্য হয় এবং উটটি হত্যা করে। ফলে আল্লাহ কঠিন ভূমিকম্প তাদের ধ্বংস করে দেন।
পাপীদের আবাসস্থল জাহান্নাম
মুত্তাকিরা জান্নাতে প্রবেশ করবে। জান্নাতিরা শান্তি ও নিরাপদে থাকবে। তাদের অন্তরে কোনো হিংসা থাকবে না। তারা ক্লান্ত হবে না। জান্নাতিরা কখনো আর সেখান থেকে বহিষ্কৃত হবে না। অপরদিকে যারা আল্লাহর একত্ববাদের সঙ্গে অংশীদারত্ব নির্ধারণ করেছে, আল্লাহ ও নবি-রাসুলদের অবাধ্যতা করেছে, ইসলাম ভিন্ন অন্য জীবনব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, ইসলামি বিশ্বাসমতে, তাদের ঠিকানা হবে জাহান্নাম। তাদের আজাবের জন্য রয়েছে সাতটি জাহান্নাম। জাহান্নামে প্রবেশের সাত দরজা। তারা নিজেদের পাপ অনুসারে জাহান্নামের পৃথক পৃথক দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে। আল্লাহ বলেন, ‘অবশ্যই জাহান্নাম তাদের সবারই প্রতিশ্রুত স্থান। তার সাতটি দরজা আছে, প্রত্যেক দরজার জন্য পৃথক পৃথক শ্রেণি আছে।’ (সুরা হিজর, আয়াত : ৪৩-৪৪)
মৌমাছির নামে যে সুরার নাম
মক্কায় অবতীর্ণ সুরা নাহলে আছে ১২৮টি আয়াত। কোরআনের ১৬তম সুরা এটি। নাহল অর্থ মৌমাছি। এ সুরায় মৌমাছির জীবনচক্র ও মধুর আলোচনা থাকায় এর নাম রাখা হয়েছে নাহল।
চতুষ্পদ জন্তু সৃষ্টির কারণ
সুরা নাহলের ৫-৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহতায়ালা চতুষ্পদ জন্তু সৃষ্টির কারণ উল্লেখ করেছেন। চতুষ্পদ জন্তুগুলোর মধ্যে মানুষের জন্য রয়েছে, উষ্ণতার উপকরণ ও বিবিধ উপকার। এতে রয়েছে মানুষের খাবার। সকালের চারণভূমিতে তাদের ছুটে চলা আর সন্ধ্যায় ফিরে আসার মধ্যে রয়েছে অবাক করা সৌন্দর্য। এরা মানুষের বোঝা বহন করে দেশ-দেশান্তরে নিয়ে যায়, যেখানে মানুষ কষ্ট ছাড়া পৌঁছতে পারে না। ঘোড়া, খচ্চর ও গাধায় মানুষ আরোহণ করে। এতে আছে শোভা।
অহংকারীকে আল্লাহ ঘৃণা করেন
অহংকার পতনের মূল। অহংকার মানুষের জীবন ধ্বংস করে দেয়। অহংকারী থেকে সবাই যোজন যোজন দূরে চলে যাবে। পৃথিবীতে প্রথম পাপ চালু হয় অহংকারের বশীভূত হয়ে। আল্লাহতায়ালা যখন আদম (আ.)-কে সেজদার জন্য ইবলিশকে আদেশ করেছিলেন, তখন সে অহংকার দেখিয়ে বলেছিল, ‘সে মাটির তৈরি আর আমি আগুনের। আমি তাকে সেজদা করব না।’ অহংকারের ফলে ইবলিশ বিতাড়িত হলো। পৃথিবীর ইতিহাসে যারাই অহংকার করেছে, কেউ টিকতে পারেনি। শেষ পরিণতি শুভ হয়নি। নবি-রাসুল ও সাহাবিরা অহংকার ও দাম্ভিকতা এড়িয়ে চলতেন। অহংকারী আল্লাহর ভালোবাসা পায় না। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ অহংকারীদের ভালোবাসেন না।’ (সুরা নাহল, আয়াত : ২৩)
কন্যাসন্তান আল্লাহর নেয়ামত
কন্যাসন্তান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে বান্দার জন্য নেয়ামত। মা-বাবার জন্য সেরা উপহার। কন্যাসন্তান মা-বাবার চক্ষু শীতলকারী। তাদের হৃদয়ে থাকে মা-বাবার জন্য অফুরন্ত শুভকামনা ও মায়ার ভাণ্ডার। কন্যাসন্তানকে অশুভ মনে করা গুনাহ। অবহেলা করা পাপ। তাদের সঠিক লালন-পালনে আল্লাহ খুশি হয়। ব্যক্তির জন্য জান্নাত মেলে। জাহান্নাম থেকে মুক্তি মেলে। অথচ জাহেলি যুগে প্রায় মানুষই কন্যাসন্তান হওয়াকে অপমান মনে করত। এখনো অনেকে কন্যাসন্তান হওয়ার সংবাদ পেলে মন খারাপ করেন। আল্লাহ বলেন, ‘আর যখন তাদের কাউকে কন্যাসন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হয়; তখন তার চেহারা কালো হয়ে যায়। আর সে থাকে দুঃখ ভারাক্রান্ত।’ (সুরা নাহল, আয়াত: ৫৮)
মৌমাছির বিস্ময়কর জীবনচক্র
আল্লাহতায়ালার বিস্ময়কর ও অপূর্ব সৃষ্টি মৌমাছি। মৌমাছি সাধারণ মাছির মতোই। আকৃতিতে ছোট। কিন্তু আল্লাহর হুকুমে সে বিস্ময়কর সব কর্ম সাধন করে। মৌমাছির সুশৃঙ্খল সংঘবদ্ধ জীবন, দক্ষ নেতৃত্ব, একনিষ্ঠ আনুগত্য, বিচক্ষণতা, কর্মদক্ষতা, উদ্যমী মনোভাব, চাক বানানো, আপসে বিভিন্ন দায়িত্ব বণ্টন, দূরে অবস্থিত বৃক্ষলতা, গাছপালা, বনবনানি ও ফসলি খেত থেকে ফোঁটা ফোঁটা করে মধু সংগ্রহসহ কত কিছুই করে। মৌমাছির দিকে তাকালে বিস্ময় না হয়ে পারা যায় না। তার কর্মযজ্ঞে আছে মুগ্ধ হওয়ার মতোই ব্যাপার। আল্লাহর কুদরত যে কত বিস্ময়কর, মৌমাছি তার একটি উদাহরণ।
এই সুরার ৬৮ ও ৬৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তোমার প্রতিপালক মৌমাছির অন্তরে ইঙ্গিতে এ নির্দেশ দিয়েছেন, ঘর তৈরি করো পাহাড়ে, বৃক্ষে এবং মানুষ যে ঘর নির্মাণ করে তাতে। এরপর প্রত্যেক ফল থেকে কিছু কিছু আহার করো আর তোমার প্রতিপালক তোমার জন্য যে পথ সহজ করে দিয়েছেন, সে পথ অনুসরণ করো। এর উদর থেকে নির্গত হয় বিবিধ বর্ণের পানীয়। যাতে মানুষের জন্য রয়েছে আরোগ্য। অবশ্যই এতে রয়েছে নিদর্শন চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য।’
মধু অসংখ্য রোগের ওষুধ এবং খাদ্যও। এটি বেহেশতের পানীয় বিশেষ। নবিজি (সা.) মধু পছন্দ করতেন। কারও অসুখ হলে মধু খাওয়ার পরামর্শ দিতেন। নবি (সা.) মধু খেতে খুব ভালোবাসতেন। (শামায়েলে তিরমিজি, হাদিস: ১২১) আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষ মৌমাছির জীবন আরও কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছে। মৌমাছির জীবনচক্রের বিস্ময়কর আরও বহু দিক উন্মোচিত হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মৌমাছি খুবই পরিশ্রমী পতঙ্গ। এক পাউন্ড মধু বানাতে ৫৫০ মৌমাছিকে প্রায় ২০ লাখ ফুলে ভ্রমণ করতে হয়! আবার এক পাউন্ড মধু সংগ্রহ করতে একটি কর্মী মৌমাছিকে প্রায় ১৪.৫ লাখ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে হয়! যা দিয়ে পৃথিবীকে তিনবার প্রদক্ষিণ করা সম্ভব। (টারমিনিক্স)
এ ছাড়া আজকের তারাবিতে আলোচনা হয়েছে অংশে খুঁটিহীন আকাশ নির্মাণ, আসমানে হরেকরকম গ্রহ-নক্ষত্র, আসমানের সুরক্ষা, জমিন, জমিনের পেটে পাহাড় আর সব ধরনের বৃক্ষ, লতাগুল্ম, বন, দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ, মানুষের জীবিকার উপকরণ, অবারিত বাতাস, উড়ে বেড়ানো মেঘমালা, পানি পানে সৃষ্টির তৃষ্ণা মেটানো, তাঁর নিয়ন্ত্রণে জীবন-মৃত্যুসহ নানা বিষয়।
লেখক : আলেম ও সাংবাদিক